Monday, 15 January 2024

চিৎসুখাচার্য—

 


শ্রীহর্ষ আনন্দবোধেন্দ্রের ন্যায় চিৎসুখাচার্য অদ্বৈতবেদান্তের একটি স্তম্ভ বিশেষ। ইনি দক্ষিণভারতে কামকোটি মঠের পীঠাধীশরূপে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন বলে জানা যায়। ইনি নব্যন্যায়ে অতি অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন এবং নৈয়ায়িক প্রভৃতি যাবতীয় প্রতিপক্ষের মত খণ্ডবিখণ্ডিত করে "প্রত্যক্-তত্ত্ব-প্রদীপিকা" বা 'চিৎসুখী' নামক অদ্বৈতবেদান্তের একটি কালজয়ী গ্রন্থ রচনা করেন। ইনার গুরুর নাম জ্ঞানোত্তমাচার্য। তত্ত্ব-প্রদীপিকার নমস্কার শ্লোকে জ্ঞানোত্তমাচার্যকে তাঁর গুরু বলে উল্লেখ করেছেন।

তত্ত্ব-প্রদীপিকা ব্রহ্মসূত্রের ন্যায় চার অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে সমন্বয়, দ্বিতীয়ে অবিরোধ, তৃতীয়ে ব্রহ্মজ্ঞানের সাধন, চতুর্থে ব্রহ্মবিজ্ঞানের ফল বা মুক্তিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। শ্রীহর্ষের খণ্ডনখণ্ডখাদ্যের রচনাশৈলী অনুসরণ করেই তত্ত্ব-প্রদীপিকা লিখিত হয়েছে। গদ্যে তত্ত্ব-বিচার করে শ্লোকে সিদ্ধান্ত নিবদ্ধ করা হয়েছে। তত্ত্ব-প্রদীপিকার উপর চিৎসুখাচার্যের শিষ্য সুখপ্রকাশের শিষ্য প্রত্যগ্রূপ ভগবান্ নয়ন-প্রসাদিনী নামে অতি অপূর্ব টীকা রচনা করেছেন।

তত্ত্ব-প্রদীপিকার দ্বিতীয় অধ্যায়ে চিৎসুখ ন্যায়ের ষোড়শ পদার্থ এবং বৈশেষিকের সপ্তপদার্থ খণ্ডন করবার উদ্দেশ্যে বল্লভাচার্যের ন্যায়-লীলাবতীর এবং উদয়নাচার্য প্রভৃতির লক্ষণ উদ্ধৃত করে খণ্ডন করেছেন। ন্যায়কন্দলী রচয়িতা শ্রীধরাচার্য এবং গঙ্গেশ উপাধ্যায়ও খণ্ডনে বাদ যান নি। শ্রীহর্ষ তৎকৃত খণ্ডন-খণ্ডখাদ্যে উদয়নাচার্য প্রভৃতির বিরুদ্ধে তর্কের শরজাল বিস্তার করে ন্যায়-মত বিধ্বস্ত করলে গঙ্গেশ উপাধ্যায়, বল্লভাচার্য, বর্দ্ধমান উপাধ্যায় প্রভৃতির আক্রমণে ন্যায় বৈশেষিক মতের যে জাগরণ দেখতে পাওয়া যায়, বিশেষতঃ গঙ্গেশ উপাধ্যায় কর্তৃক তত্ত্বচিন্তামণিতে শ্রীহর্ষের মত খণ্ডিত হওয়ায় অদ্বৈত বেদান্ত চিন্তায় যে দূর্বলতা দেখা দেয়, আচার্য চিৎসুখ সেই দৌর্বল্য বিদূরিত করে অদ্বৈত সিদ্ধান্ত সুদৃঢ় ভিত্তিতে স্থাপন করেন। পরপক্ষ খণ্ডন এবং স্বীয় পক্ষ স্থাপন, এই উভয় অংশে চিৎসুখের তত্ত্ব-প্রদীপিকার ন্যায় গ্রন্থ আর দ্বিতীয় নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। এর থেকে ধারণা করা যায় চিৎসুখাচার্য বল্লভাচার্যের পরবর্তী খৃষ্টীয় ১৩শ শতকে আবির্ভূত হন। তবে তিনি বিদ্যারণ্যের পূর্ববর্তী ছিলেন, কারণ বিদ্যারণ্য মুনীশ্বর সর্বদর্শন-সংগ্রহে চিৎসুখের নাম উল্লেখ করেছেন।

তত্ত্ব-প্রদীপিকা ব্যতীত চিৎসুখাচার্য শাঙ্কর ভাষ্যের ভাব-প্রকাশিকা টীকা, মণ্ডনমিশ্রের ব্রহ্মসিদ্ধির উপর অভিপ্রায়-প্রকাশিকা নামে টীকা, সুরেশ্বরাচার্যের নৈষ্কর্মসিদ্ধির উপর ভাবতত্ত্ব-প্রকাশিকা টীকা, খণ্ডন-খণ্ডখাদ্যের টীকা, বিবরণ-তাৎপর্য-দীপিকা টীকা বিষ্ণুপুরাণের টীকা, আনন্দবোধের ন্যায়মকরন্দের এবং প্রমাণমালার টীকা, শঙ্কর-চরিত, অধিকরণমঞ্জরী, ষড়্দর্শনসংগ্রহ-বৃত্তি প্রভৃতি বিবিধ গ্রন্থমালা রচনা করে অদ্বৈতবাদের প্রতিপক্ষ মত নিরাস করতঃ ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ভাষ্য ধারার বিশেষ পুষ্টি সাধন করেন। শুনা যায় যে, মধ্বাচার্য দিগ্বিজয় কালে ইনার সঙ্গে বিচার করেন নি।........

তথ্যসূত্রঃ-

. বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ, আশুতোষ শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি।

. শ্রীযোগেন্দ্রনাথ তর্কসাংখ্যবেদান্ততীর্থ অনুবাদিত "অদ্বৈতসিদ্ধিঃ" গ্রন্থের ভূমিকা।

শ্রীশুভ চৌধুরী

জানুয়ারি ১৪, ২০২৪ খৃষ্টাব্দ।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...