ব্রহ্ম শব্দের অগোচর, বাক্য মনের অতীত। বাক্যদ্বারা তাঁকে প্রকাশ করা যায় না। বাষ্কলিকর্তৃক পৃষ্ট হয়ে গুরু বার্ধ্ব মৌনদ্বারাই এই ব্রহ্মতত্ত্ব ব্যাখ্যান করেছিলেন। বাষ্কলি গুরু বার্ধ্বকে বললেন —'হে ভগবান্! আমাকে ব্রহ্মবিষয়ে উপদেশ করুন।' বার্ধ্ব নিরুত্তর রইলেন। শিষ্য দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার একই প্রশ্ন করলে গুরু বার্ধ্ব বললেন—'আমি তো উপদেশ দিচ্ছি, তুমিই বুঝতে পারছ না। আত্মা উপশান্তস্বরূপ।' বার্ধ্ব মৌন অবলম্বন করেই সেই কথা বললেন।
যোগবাশিষ্ঠে
দেখা যায় শ্রীরামচন্দ্র যতিরাজ বশিষ্ঠদেবকে বলেছিলেন —'যদি মৌনাবলম্বন করেই তত্ত্ব বুঝাবার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, তবে আপনি আমাকে এত উপদেশ দিলেন
কেন? প্রথম হতেই আপনি মৌন ধারণ করলেই হত?' প্রত্যুত্তরে শ্রীবশিষ্ঠ বলেছিলেন—'তাহলে লোকে ভাবত যে আমি মূর্খ,
কিছু জানি না। তাই নানা কথা বলে এখন চুপ করেছি। এখন তুমিও মৌনাবলম্বনের রহস্য বুঝবে।' আসল তত্ত্বটি মুখে বলা যায় না। তবে আচার্যগণ ব্রহ্ম, আত্মা, ঋত, সত্য ইত্যাদি নানা শব্দ কল্পনা করেছেন। তাই শ্রুতি নানা কল্পিত উপায়ে সেই তত্ত্ব বর্ণন করেছেন। 'ঋতমাত্মা পরং ব্রহ্ম সত্যমিত্যাদিকা বুধৈঃ। কল্পিতা ব্যবহারার্থং সংজ্ঞাস্তস্য মহাত্মনঃ।'-(যোগবাশিষ্ঠ)
নাম,
জাতি, গুণ, ক্রিয়া প্রভৃতির কোন একটি থাকলে তবেই সেই বস্তুটিকে শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা যায়। ব্রহ্ম নাম-জাতি-আদি-রহিত। অতএব শব্দের অগোচর। কিছু বলতে গেলেই দ্বৈত এসে পড়ে। তাই গুরু পরম কৃপায় অধ্যারোপ অপবাদ ন্যায়ে শিষ্যকে উপদেশ দেন। অধ্যারোপ হল ভ্রম, রজ্জুতে
সর্পভ্রম। আচার্য সদানন্দ যোগী তৎকৃত বেদান্তসারে বলেছেন—
"অসর্পভূতায়াং রজ্জৌ
সর্প আরোপবৎ বস্তুনি অবস্তু-আরোপঃ—অধ্যারোপঃ। অপবাদঃ নাম—রজ্জুবিবর্তস্য সর্পস্য রজ্জুমাত্রত্ববৎ বস্তু-বিবর্তস্য অবস্তুনঃ অজ্ঞানাদেঃ প্রপঞ্চস্য বস্তুমাত্রত্বম্।"-(বেদান্ত-সারঃ)
সর্প
(সাপ) নয় এমন যে রজ্জু (দড়ি),
তাতে যেমন সর্পের আরোপ হয়, সেরকম বস্তুতে অবস্তুর আরোপকে অধ্যারোপ বলে। সার কথা হল, সত্য কোন বস্তুতে অসত্য অন্য কোন বস্তুর জ্ঞান করাকে অধ্যারোপ বলে। রজ্জুর বিবর্ত সর্প যেমন রজ্জুমাত্র, সেরূপ বস্তুর বিবর্ত যে অজ্ঞানাদি সকল
জড়পদার্থ, তাও বস্তু মাত্রই, এরূপ নিশ্চয় বুদ্ধির নাম অপবাদ।
অসঙ্গ
উদাসীন পরমাত্ম-বস্তুর বিবর্তভূত অজ্ঞান থেকে আরম্ভ করে সমূহ জড় জগৎ পর্যন্ত সকল কিছুই স্বরূপতঃ আধার চৈতন্যমাত্রই; দৃশ্য অদৃশ্য জগতের আধারভূত চৈতন্যই বস্তু, বাকি সব অবস্তু, মিথ্যা—এরূপ বোধ করাকেই অপবাদ বলে।
তথ্যসূত্রঃ-
১.
যোগবাশিষ্ঠসারঃ, স্বামী ধীরেশানন্দ অনুবাদ ও ব্যাখ্যাকৃত।
২.
আচার্য সদানন্দ-যোগীন্দ্র সরস্বতী বিরচিত বেদান্ত-সারঃ।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
ডিসেম্বর
২২, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment