ইতোমধ্যে আলোচনা করিয়াছি জাগতিক বৈষম্য বা ক্রূরতার জন্য ঈশ্বরের প্রতি দোষারোপ করা অনুচিত,কারণ যে প্রাণিগণ সৃষ্ট হয়, তাহাদের ধর্ম্ম ও অধর্ম্মকে অপেক্ষা করিয়া বিষম সৃষ্টি হইয়া থাকে। এখন পুনরায় সূত্রকার শ্রীমৎমহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ আপত্তি উপস্থাপন পূর্ব্বক সিদ্ধান্ত করিতেছেন এইভাবে-
ন কর্মাবিভাগাদিতি চেৎ, ন, অনাদিত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৫)।।
শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- পরমহংসপরিব্রাজক ভগবৎপূজ্যপাদ্ শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য শারীরকমীমাংসা ভাষ্যে বলিতেছেন-
-এইপ্রকার শ্রুতিবলে সৃষ্টির পূর্ব্বে ব্রহ্ম ও জগতের অবিভাগ নিশ্চিত হয় বলিয়া প্রথম সৃষ্টির পূর্ব্বে কর্ম্ম থাকে না, যাহাকে অপেক্ষা করিয়া পরবর্তী বিষমসৃষ্টি হইবে। সৃষ্টির পরবর্তীকালেই শরীরাদিরূপ বিভাগকে অপেক্ষা করিয়া কর্ম্ম অনুষ্ঠিত হয় এবং কর্ম্মকে অপেক্ষা করিয়া হয় শরীরাদিরূপ বিভাগ, এইপ্রকার ইতরেতরাশ্রয়দোষ হইয়া পড়ে। সেইহেতু বিভাগের পরবর্ত্তিকালে কর্ম্মকে অপেক্ষা করিয়া ঈশ্বর যদি প্রবৃত্ত হন, তাহা হউন; কিন্তু শরীরাদিরূপে বিভাগের পূর্ব্বে সৃষ্টির বিচিত্রতার হেতুভূত কর্ম্মের অভাববশতঃ প্রথম সৃষ্টিতুল্য উচ্চাবচ দেবতির্য্যগাদি ভেদবিহীন হইয়া পড়িতেছে, এইপ্রকার যদি আপত্তি করা হয় তদুত্তরে সিদ্ধান্ত হইল-
ইহা দোষ নহে, যেহেতু জগৎ সংসার অনাদি। এই দোষ হইতে পাড়িত যদি সংসার সাদি হইত। কিন্তু অনাদি সংসারে বীজ ও অঙ্কুরের ন্যায় হেতু ও হেতুমদ্ভাবে অর্থাৎ কারণ ও কার্য্যভাবে কর্ম্মের ও সৃষ্টিবৈষম্যের যে প্রবৃত্তি, তাহার বিরোধ হয় না।
আচ্ছা, কি প্রকারে অবগত হওয়া যায় যে, এই জগৎ সংসার অনাদি? এই হেতু ভগবান্ সূত্রকার পূনরায় বলিতেছেন-
‘উপপদ্যতে চাপ্যুপলভ্যতে চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৬)।।
শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- আচার্য্য শঙ্কর ভগবতের ভাষ্য হইল-জগৎ সংসারের অনাদিত্ব যুক্তিসঙ্গত। যেহেতু সংসার সাদি হইলে অকস্মাৎ অর্থাৎ বিনাকারণে তাহার উৎপত্তি হওয়ায় (তৎপরর্বর্তী সৃষ্টিও বিনা কারণে সম্ভব হইতে পারে বলিয়া পূর্ব্বসৃষ্টিতে) মুক্তপুরুষগণের (সংসারের হেতুভূত অবিদ্যাদি না থাকিলেও) পুনরায় সংসারে উদ্ভূতি অর্থাৎ জন্ম হইয়া পড়িবে। (তাহাতে বেদের জ্ঞানকাণ্ড মোক্ষশাস্ত্র ব্যর্থ হইয়া পড়ে)।
আবার অকৃতাভ্যাগমও (অর্থাৎ যে ব্যক্তি যে কর্ম্মের অনুষ্ঠান করে নাই, তৎকর্তৃক সেই কর্ম্মের ফলভোগও) হইয়া পড়িবে, যেহেতু সুখ ও দুঃখ প্রভৃতির যে বৈষম্য, তাহার কোন হেতু নাই।(তাহাতে শুভকর্ম্মের বিধায়ক এবং অশুভকর্ম্মের নিবর্ত্তক যে বিধিনিষেধ শাস্ত্র অর্থাৎ বেদের কর্ম্মকাণ্ড ব্যর্থ হইয়া পড়ে।)
আর ঈশ্বর যে বৈষম্যের হেতু নহেন তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। কেবল অর্থাৎ অন্য সহায়বিহীন মূলা অবিদ্যাও বৈষম্যের কারণ নহে, যেহেতু তাহা একরূপ। কিন্তু রাগাদি ক্লেশবাসনার দ্বারা আক্ষিপ্ত অর্থাৎ প্রবর্ত্তিত কর্ম্মকে অপেক্ষা করিয়াই অবিদ্যা হয় বৈষম্যকারী। কিন্তু কর্ম্ম ব্যতিরেকে শরীর সম্ভব নহে এবং শরীর ব্যতিরেকে কর্ম্ম সম্ভব নহে, এই প্রকারে ইতরেতরাশ্রয় দোষ হইয়া পড়ে। অনাদি হইলেই কিন্তু বীজাঙ্কুরের ন্যায় কার্য্যকারণ ভাব উপপন্ন হওয়ায় কোন দোষ হয় না।(অগ্রে বীজ উৎপন্ন হয়, পরে তাহা হইতে অঙ্কুর উৎপন্ন হয়, অথবা অগ্রে অঙ্কুর উৎপন্ন হয়, পরে তাহা হইতে বীজ উৎপন্ন হয়; ইহা নিরূপণ করা যায় না বলিয়া এই বীজাঙ্কুর প্রবাহকে অনাদিরূপে অঙ্গীকার করা হয়।)
আর শ্রুতি এবং স্মৃতি উভয়েই এই জগৎ সংসারের অনাদিত্ব উপলব্ধ হয়। শ্রুতি এইপ্রকার আছে-'অনেন জীবেনাত্মনা'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ ৬।৩।২) অর্থাৎ "এই জীবাত্মারূপে", এইরূপ সৃষ্টির নব কল্পারম্ভের প্রারম্ভে শরীরসম্বন্ধী আত্মাকে প্রাণধারণের নিমিত্তক জীবশব্দের দ্বারা অভিহিত করিয়া সংসার যে অনাদি, ইহা শ্রুতি প্রদর্শন করিতেছেন। কিন্তু সংসার সাদি হইলে পূর্ব্বে প্রাণধারণ না করিয়া প্রাণধারণরূপ নিমিত্তবশতঃ যে জীবশব্দের প্রয়োগ হয়, তাহার দ্বারা সৃষ্টির প্রারম্ভে পরমাত্মা কি প্রকারে অভিহিত হইবেন? আর প্রাণকে ধারণ করিবেন, এই হেতু পরমাত্মা জীব শব্দে অভিহিত হইবেন, ইহা বলা যায় না, যেহেতু অনাগত সম্বন্ধ অপেক্ষা অতীত সম্বন্ধ বলবান, কারণ তাহা সম্পাদিত হইয়া গিয়াছে। আর শাস্ত্রেও জগৎ যে সৃষ্টির পূর্ব-কল্পেও বর্তমান ছিলো তা এ-জাতীয় শ্রুতিতেই আছে-
স্মৃতিতেও সংসারের অনাদিত্ব উপলব্ধ হইতেছে- 'ন রূপমস্যেহ তথোপলভ্যতে নান্তো ন চাদির্ন চ সংপ্রতিষ্ঠা'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৫।৩)
'ইহলোকে এই সংসাররূপ অশ্বত্থের উক্তপ্রকার রূপ উপলব্ধ হয় না, কারণ স্বপ্ন-মরীচিকার ন্যায় ইহা দৃষ্ট-নষ্ট-স্বরূপ । এই সংসারের আরম্ভ নাই, কারণ ইহা অনাদি।'
No comments:
Post a Comment