Thursday, 31 March 2022

ওঙ্কারের স্বরূপ ব্রহ্ম, এই সমস্তই ওঙ্কারের স্বরূপঃ-

 


কৃষ্ণযজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয়োপনিষদের শীক্ষাবল্লীর অষ্টম অনুবাকে বর্ণিত আছে—"ওমিতি ব্রহ্ম। ওমিতীদং সর্বম্।"-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-১/৮/১)

শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্যে বলিতেছেন—'ওমিতি' অংশের 'ইতি' শব্দ স্বরূপবোধক; ওঙ্কারের স্বরূপ অর্থাৎ এই শব্দস্বরূপকে ব্রহ্ম এইরূপ মনে ধারণ করিবে অর্থাৎ উপাসনা করিবে; কেননা ওঙ্কারের স্বরূপ, এই সমুদয় শব্দস্বরূপই ওঙ্কারের দ্বারা ব্যাপ্ত, আর 'যেহেতু অশ্বত্থ পত্র যেরূপ শিরাজালে ব্যাপ্ত'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-২/২৩/৩) এই রূপ অন্যশ্রুতিও আছে। আর যেহেতু অভিধেয় (শব্দার্থ) ঐ শব্দের অধীন হয় এইজন্য 'এই সমস্তই ওঙ্কার' এইরূপ বলা হইতেছে।

মুণ্ডক শ্রুতিতে সৃষ্টিক্রমঃ-



অথর্ববেদীয় মুণ্ডকোপনিষদের প্রথম মুণ্ডকের প্রথম খণ্ডে বর্ণিত আছে—

তপসা চীয়তে ব্রহ্ম ততোঽন্নমভিজায়তে ।

অন্নাৎ প্রাণো মনঃ সত্যং লোকাঃ কর্মসু চামৃতম্ ॥ -(মুণ্ডক উপনিষৎ- ১/১/ ৮)

আচার্য শঙ্কর এই শ্রুতির ভাষ্যে বলিতেছেন–"সৃষ্টির উৎপত্তি ক্রম জানেন বলিয়া প্রাণীদের উৎপত্তির কারণ অবিনাশী ব্রহ্ম তপসা অর্থাৎ ওই জ্ঞানের (সঙ্কল্পের) দ্বারা (সৃষ্ট্যুন্মুখ) হন অর্থাৎ অঙ্কুরসদৃশ এই জগৎ উৎপন্ন করিতে ইচ্ছা করিয়া বীজসদৃশ নিজে স্ফীত হন যেভাবে পুত্র সমুৎপাদনার্থ পিতা আনন্দে উল্লসিত হন।

সর্বজ্ঞতানিবন্ধন সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহারশক্তির এইরূপ জ্ঞানবশতঃ স্ফীত হওয়ার ফলে তন্নিমিত্ত অর্থাৎ ব্রহ্মের নিমিত্ত অন্ন— অদন অর্থাৎ ভোগ করা যায় বলিয়া অন্ন (ভোগ্য) অর্থাৎ অব্যক্ত যাহা সকল সংসারী জীবের সাধারণ কারণ (কেননা যেহেতু অব্যক্ত হইতে সকল প্রাণীর ভোগ্যশরীর সৃষ্ট হয়), সেই অব্যক্ত অভিব্যক্তেচ্ছু অবস্থারূপে উৎপন্ন হয়। তদনন্তর অভিব্যক্তেচ্ছু অবস্থা বিশিষ্ট ভোগ্য অব্যক্ত হইতে প্রাণ অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভ যিনি কার্যব্রহ্মের (জগতের) জ্ঞানশক্তি ও ক্রিয়াশক্তিবিশিষ্ট, জগৎজীবের সমষ্টিস্বরূপ, প্রেয়ঃ কামনা ও কামনা জনিত কর্মফলের সমষ্টিরূপ বীজের অঙ্কুরসদৃশ, স্থূলজগতের, সূক্ষ্মস্বরূপ তিনি 'উৎপন্ন হন'।

আমার সেই প্রাণ (হিরণ্যগর্ভ) হইতে মন অর্থাৎ সঙ্কল্প, বিকল্প, সংশয় ও নিশ্চয়াদি স্বভাববিশিষ্ট মনসংজ্ঞক (সমষ্টি অন্তঃকরণ) উৎপন্ন হয়। তাহার পর আবার সঙ্কল্পাদ্যাত্মক (সমষ্টি) মন হইতে সত্য অর্থাৎ সত্যসংজ্ঞক আকাশাদি সূক্ষ্ম ভূতপঞ্চক সৃষ্ট হয়। এবং সত্যনামক সেই ভূতপঞ্চক হইতে ব্রহ্মাণ্ড ও তারপর ভূর্লোক প্রভৃতি সপ্তলোক উৎপন্ন হয়। আর সেই সকল লোকেতে (শরীরে) মনুষ্যাদি প্রাণিবর্গের বর্ণ ও আশ্রম অনুযায়ী নানাবিধ কর্ম এবং নিমিত্তস্বরূপ ঐ কর্মসকলেতে অমৃত অর্থাৎ ঐ কর্ম জনিত ফল উৎপন্ন হয়। শতকোটি কল্প অতিক্রম হইলেও যাবৎকাল পর্যন্ত (জ্ঞানোদয়ে)কর্মসমূহ বিনষ্ট না হয় তাবৎকাল পর্যন্ত (কর্মের সহিত) তৎফলও অক্ষুণ্ণ থাকিতেছে বলিয়া কর্মফলকে অমৃত বলা হইতেছে।

Sunday, 20 March 2022

মুখ্য প্রাণের স্বরূপ নির্ণয়ঃ-

 


বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রের বায়ুক্রিয়াধিকরণের প্রতিপাদ্য বিষয় মুখ্য প্রাণের স্বরূপ নির্ণয়। মুখ্য প্রাণ কি বায়ু মাত্র? অথবা ইন্দ্রিয়গণের ক্রিয়া? অথবা অন্য কিছু? ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণ বলিতেছেন-

ন বায়ুক্রিয়ে পৃথগুপদেশাত্৷৷- (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/৯)

আচার্য শঙ্কর সূত্রভাষ্যে সিদ্ধান্ত করিতেছেন—"মুখ্য প্রাণ বায়ু নহে এবং ইন্দ্রিয় সকলের ব্যাপারও নহে। কেন নহে? যেহেতু পৃথগ্ভাবে উপদিষ্ট হইয়াছে। বায়ু হইতে মুখ্যপ্রাণের পৃথগ্ভাবে উপদেশ আছে। যথা-

প্রাণ এব ব্রহ্মণশ্চতুর্থঃ পাদঃ স বাযুনা জ্যোতিষা ভাতি চ তপতি চ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৩/১৮/৪)

'মুখ্যপ্রাণই ব্রহ্মের চতুর্থ পাদ, তাহা বায়ুরূপ জ্যোতির দ্বারা প্রকাশিত হয় ও কার্য্যক্ষম হয়।' মুখ্যপ্রাণ বায়ু হইলে নিশ্চয়ই বায়ু হইতে পৃথগ্ভাবে উপদিষ্ট হইত না। এইপ্রকারে ইন্দ্রিয় সকলের বৃত্তি হইতেও মুখ্যপ্রাণের পৃথগ্ভাবে উপদেশ আছে। যথা- "এই পুরুষ হইতে প্রাণ জাত হয় এবং মন সর্বেন্দ্রিয়..."-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২/১/৩) সুতরাং বৃত্তি ও বৃত্তি মানের অভিন্নতাবশতঃ মুখ্যপ্রাণ ইন্দ্রিয়সকলের সাধারণ বৃত্তি হইয়াই ইন্দ্রিয়সকল হইতে নিশ্চয়ই পৃথগ্ভাবে উপদিষ্ট হইত না।..."

তাহলে মুখ্যপ্রাণ কি? মুখ্য প্রাণ বায়ুরূপ মহাভূতের কার্য্য, বায়ুমাত্র নহে, তদ্ভিন্নও নহে। আচার্য শঙ্কর ভাষ্যে তাহাই সিদ্ধান্ত করিতেছেন—"এই বায়ুই অধ্যাত্মভাবকে প্রাপ্ত হইয়া প্রাণ ও অপান প্রভৃতি পাঁচ প্রকার ব্যূহরূপ বিশেষস্বরূপে অবস্থানকরতঃ মুখ্যপ্রাণ নামে কথিত হয়। তাহা বায়ু হইতে তত্ত্বান্তর (সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু) নহে, অথবা বায়ুমাত্রও নহে।"

মনের ন্যায় ইহারও পাঁচটি বৃত্তি আছে বলিয়া শাস্ত্রে উপদেশ করা হইয়াছে। 'পঞ্চবৃত্তির্মনোবদ্ব্যপদিশ্যতে'-(ব্রহ্মসূত্র-২/৪/১২)

আচার্য শঙ্কর ভাষ্যে বলিতেছেন— "আর এই হেতুবশতঃ মুখ্যপ্রাণের বিশেষ কার্য্য বর্তমান আছে, যেহেতু শ্রুতিসকলে ইহা পঞ্চবৃত্তিযুক্তরূপে (—ক্রিয়াভেদে পাঁচ প্রকার অবস্থাযুক্তরূপে) বর্ণিত হইতেছে, যথা—"প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান ও সমান", ইত্যাদি। আর এই বৃত্তি ভেদ‌ কার্য্যভেদকে অপেক্ষা করে। সেই কার্য্য প্রদর্শন করিতেছেন—সম্মুখভাগে যাহার বৃত্তি এবং উচ্ছ্বাস (–প্রশ্বাস এবং দেহধারণ) প্রভৃতি যাহার কর্ম্ম, তাহা প্রাণ। অধোভাগে যাহার বৃত্তি এবং নিঃশ্বাসাদি (—শ্বাসগ্রহণ ও অধোবায়ুত্যাগ) যাহার কর্ম্ম, তাহা অপান। সেই দুইটীর (—প্রাণ ও অপানের) সন্ধি স্থলে (—নাভিতে) বর্ত্তমান যাহা অগ্নিমন্থনাদি বলসাধ্য কর্ম্মের হেতু, তাহা ব্যান। ঊর্ধ্ব দিকে যাহার বৃত্তি এবং উৎক্রমণ গত্যাগতি ও উদগার প্রভৃতির যাহা হেতু, তাহা উদান। অন্নরসকে যাহা সকল অঙ্গে সমানভাবে লইয়া যায়, তাহা সমান।

এই প্রকারে মুখ্যপ্রাণ মনের ন্যায় পঞ্চবৃত্তিযুক্ত, অর্থাৎ মনের যেমন পাঁচপ্রকার বৃত্তি, মুখ্যপ্রাণেরও এইপ্রকার।

 

Thursday, 17 March 2022

হিরণ্যগর্ভ কি?

 


কঠশ্রুতির (১/৩/১০) শাঙ্করভাষ্যে উল্লেখ রহিয়াছে-"অব্যক্ত হইতে প্রথম উৎপন্ন হিরণ্যগর্ভতত্ত্ব যাহা জ্ঞানশক্তি ও ক্রিয়াশক্তিস্বরূপ, সেই মহান আত্মা (–সমষ্টিবুদ্ধি হিরণ্যগর্ভ) ঐ বুদ্ধি-উৎপাদক ভূতসূক্ষ্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।"

ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞের সংযোগই যে ভূতকারণ সেই বিষয়ে শ্রীভগবান বলিতেছেন- "সর্বকার্য (উৎপত্তিশীল বস্তু) হইতে মহত্ত্বহেতু এবং আত্মবিকারস্বরূপ সর্বকার্যের ভরণকারী 'মহৎ' নামে প্রসিদ্ধ ব্রহ্ম, আমার স্বভূতা মদীয়া মায়া ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতি— যিনি স্বীয় বিকারজাত সর্বভূতের যোনি অর্থাৎ উৎপত্তির কারণ। সেই মহদ্ব্রহ্মরূপ যোনিতে আমি (ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ প্রকৃতিদ্বয় দ্বারা শক্তিমান ঈশ্বর) গর্ভাধান (হিরণ্যগর্ভ জন্মের বীজ অর্থাৎ সর্বভূত জন্মকারণের বীজ নিক্ষেপ) করি অর্থাৎ অবিদ্যা, কাম ও কর্ম-রূপ উপাধি অনুবিধায়ী ক্ষেত্রজ্ঞকে ক্ষেত্রের সহিত সংযোজন করি। সেই গর্ভাধান হইতে হিরণ্যগর্ভের উৎপত্তিদ্বারা সর্বভূতের উৎপত্তি হইয়া থাকে।"-(শাঙ্করভাষ্য, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-১৪/৩)

সৃষ্টির আরম্ভে প্রকৃতির এই প্রথম পরিণামকে মহত্তত্ত্বও বলা হয়। আধুনিক সাংখ্যকারগণ উহাকেই বুদ্ধিতত্ত্ব বলেন। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে প্রকৃতি থেকে চিত্তের উৎপত্তিপূর্বক তাহার লক্ষণ বর্ণিত আছে-"সেই পরমপুরুষ দৈববশত (জীবের অদৃষ্টবশত) ক্ষুভিতধর্মিণী স্বীয়া প্রকৃতিতে বীর্য (চিদরূপা শক্তি) আধান করেন। তখন সেই প্রকৃতি হিরণ্ময় অর্থাৎ প্রকাশবহুল মহৎতত্ত্বকে সৃষ্টি করেন।"-(শ্রীধর স্বামী টীকা, শ্রীমদ্ভাগবতম্-৩/২৬/১৯)

 

Wednesday, 16 March 2022

অব্যক্ত কি?

 


প্রথমে শ্রুতিতে কি বলছে এ বিষয়ে দেখে নেয়া যাক। কৃষ্ণযজুর্বেদীয় কঠশ্রুতিতে বর্ণিত আছে- "মহতঃ পরম্ অব্যক্তম্"-(কঠ উপনিষৎ-১/৩/১১) শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্যে বলেছেন- "মহৎ (হিরণ্যগর্ভ) হইতেও শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ সূক্ষ্মতর ও প্রত্যগাত্মভূত এবং ব্যাকৃত সকলের অপেক্ষাও মহত্তর এই অব্যক্ত, যাহা সম্পূর্ণ জগতের বীজভূত অর্থাৎ উপাদান কারণ স্বরূপ, অব্যাকৃত নাম ও রূপের সত্তাস্বরূপ, সমস্ত কার্য ও কারণশক্তির সমষ্টি, অব্যক্ত অব্যাকৃত আকাশাদি নামে প্রলয়কালে কথনীয় এবং বটবীজকণিকায় নিহিত বটবৃক্ষের শক্তির ন্যায় পরমাত্মাতে ওতপ্রোতভাবে সম্যক আশ্রিত।"

স্মৃতিতে শ্রীভগবান্ সাংখ্যের চতুর্বিংশতি তত্ত্বের বর্ণনায় বলছেন-"বুদ্ধিরব্যক্তমেব চ"-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-১৩/৫) শঙ্করাচার্য ভাষ্যে বলছেন-"অধ্যবসায় লক্ষণা বুদ্ধিরও কারণ অব্যক্ত অর্থাৎ যা ব্যক্ত নয় তাই অব্যক্ত বা অব্যাকৃত অর্থাৎ ঈশ্বর-শক্তি, যিনি শ্রীভগবানকর্তৃক 'আমার দুরতিক্রমণীয়া মায়া'-(ভগবদ্গীতা-৭/১৪) বলে উক্ত হয়েছেন।"

ব্রহ্মসূত্রের 'তদধীনত্বাদর্থবৎ৷৷১.৪.৩৷৷' এইসূত্রে তাহা স্পষ্ট। শঙ্করাচার্য উক্ত সূত্রের ভাষ্যে বলছেন-

"অবিদ্যারূপা যে প্রসিদ্ধা বীজশক্তি, তাহা 'অব্যক্ত' এই শব্দের দ্বারা নির্দ্দেশের যোগ্য, তাহা পরমেশ্বরকে আশ্রয়করতঃ অবস্থান করে, মায়াময়ী এবং মহাসুপ্তিস্বরূপা, যাহাতে স্বরূপজ্ঞানরহিত সংসারী জীবগণ শয়ন করে অর্থাৎ আবদ্ধ হইয়া জন্মমৃত্যু অনুভব করে। সেই এই অব্যক্ত কোন কোন স্থলে 'আকাশ' এই শব্দের দ্বারা নির্দিষ্ট হইয়াছে, যেহেতু এইপ্রকার শ্রুতি আছে-

'এতস্মিন্নু খল্বক্ষরে গার্গ্যাকাশ ওতশ্চ প্রোতশ্চ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩/৮/১১)

অর্থাৎ 'হে গার্গি, এই অক্ষরে (ক্ষয়রহিত ব্রহ্মে) 'আকাশ' ওতপ্রোতভাবে অবস্থিত আছে।'...."

 

Saturday, 12 March 2022

বেদের নাসদীয় সূক্তে মুখ্য প্রাণের অনাদিত্ব প্রতিপাদ্য নহেঃ-



আজকের আলোচনায় মুখ্যপ্রাণোৎপত্তি বিচার্য বিষয়। "ব্রহ্ম হইতে মুখ্যপ্রাণ উৎপন্ন হয়" এই মুণ্ডক শ্রুতির সহিত ঋগ্বেদ্ সংহিতার নাসদীয় সূক্তে "সৃষ্টির পূর্বে মুখ্যপ্রাণের অস্তিত্ব প্রতিভাত হয়" এই শ্রুতির বিরোধ মনে হয়। আর শ্রুতিদ্বয়ের বিরোধবশতঃ সংশয় হয়—মুখ্যপ্রাণ কি অনাদি অথবা উৎপন্ন হয়?

ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রের প্রাণশ্রৈষ্ঠ্যাধিকরণের ভাষ্যে এই সংশয়ের নিরাকরণ করিতেছেন—

মুখ্যপ্রাণ অন্যান্য প্রাণ (–ইন্দ্রিয়) সকলের ন্যায় ব্রহ্মের কার্য্য, ইহা ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণ অতিদেশ করিতেছেন। আর অবিশেষভাবে (মুখ্য ও অমুখ্য) সকল প্রাণেরই সেই ব্রহ্মবিকারতা (—তাহারা ব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন, ইহা ২/৪/১ অধিকরণে) বর্ণিত হইয়াছে। যেহেতু-

'এতস্মাজ্জায়তে প্রাণো মনঃ সর্বেন্দ্রিয়াণি চ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ- ২/১/৩)

"ইঁহা (–ব্রহ্ম) হইতে মুখ্য প্রাণ মন ও ইন্দ্রিয়সকল উৎপন্ন হয়", এই প্রকারে ইন্দ্রিয়ের সহিত মন হইতে ভিন্নভাবে মুখ্যপ্রাণের উৎপত্তি শ্রুত হইতেছে। আর যেহেতু-

'স প্রাণমসৃজত'-(প্রশ্ন উপনিষৎ-৬/৪)

"তিনি প্রাণকে সৃষ্টি করিলেন" ইত্যাদি শ্রুতিসকলও আছে।

আচ্ছা তাহলে কোন প্রয়োজনে অতিদেশ হইতেছে? অধিক আশঙ্কাকে নিরাকরণ করিবার জন্য। নাসদীয় নামক ব্রহ্মপ্রধান সূক্তে এইপ্রকার মন্ত্রবর্ণ আছে–

'ন মৃত্যুরাসীদমৃতং ন তর্হি ন রাত্র্যা অহ্ন আসীত্প্রকেতঃ৷ আনীদবাতং স্বধয়া তদেকং তস্মাদ্ধান্যন্নপরঃ কিংচনাস'।।-(ঋগ্বেদ্ সংহিতা-১০/১২৯/২)

"তখন (–মহাপ্রলয়কালে) মৃত্যু (–বিনাশশীল কার্য্য বস্তু) ছিল না, অমৃত ছিল না, রাত্রি ও দিনের প্রকেত (–চিহ্ন, অর্থাৎ চন্দ্র ও সূর্য) ছিল না, স্বধার (–স্বকর্ত্তৃক ধৃতা মায়ার) সহিত অবাত (–প্রাণবায়ুবর্জিত, অবিক্রিয়) সেই এক ব্রহ্ম আনীৎ (–বর্ত্তমান) ছিলেন, তাঁহা হইতে শ্রেষ্ঠ কিছুই ছিল না", ইত্যাদি।

"আনীৎ" এই প্রকারে মুখ্যপ্রাণের কর্ম্ম গৃহীত হওয়ায় এই শ্রুতিবাক্য জগতের উৎপত্তির পূর্ব্বে প্রাণের অস্তিত্ব বর্তমান আছে অর্থাৎ প্রাণ অজ (–জন্মরহিত) এই প্রকার বুদ্ধি কাহারও কাহারও উৎপন্ন হয়। ভগবান সূত্রকার তাদৃশ বুদ্ধিকে অতিদেশের দ্বারা অপনোদন করিতেছেন। যথা—

আনীৎ শব্দটিও উৎপত্তির পূর্বে মুখ্যপ্রানের অস্তিত্ব সূচনা করিতেছে না; যেহেতু অবাত (–প্রাণবায়ুরহিত), এইপ্রকার বিশেষণ আছে। আর

'অপ্রাণো হ্যমনাঃ শুভ্রঃ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২/১/২)

"সেই অক্ষর পুরুষ প্রাণরহিত মনোবিহীন এবং শুদ্ধ", এইপ্রকারে মূলপ্রকৃতির (–জগতের মূলকারণ ব্রহ্মের) প্রাণাদি সমস্ত বিশেষরাহিত্য প্রদর্শিত হওয়ায় মহাপ্রলয়ে মুখ্যপ্রাণের সত্তা সিদ্ধ হয় না। সেইহেতু নাসদীয় সূক্তের এই "আনীৎ" শব্দটি মহাপ্রলয়ে ব্রহ্মরূপ কারণের অস্তিত্ব প্রদর্শনের জন্য, ইহা অবগত হইতে হইবে।

 

Thursday, 10 March 2022

"তোটকাষ্টকম্"

 


"বিদিতাখিলশাস্ত্রসুধাজলধে মহিতোপনিষদ্ কথিতার্থনিধে।

হৃদয়ে কলয়ে বিমলম্ চরণম্ ভব শঙ্কর দেশিক মে শরণম।।"

"হে সমস্ত শাস্ত্রের অমৃততত্ত্বের জ্ঞাতা, হে উপনিষদোক্ত আত্মবিজ্ঞানের দাতা। আমার হৃদয়ে আপনার পবিত্র চরণের ধ্যান করছি, হে গুরু শঙ্কর আপনি আমায় শরণ প্রদান করুন।।" (১)

"করুণাবরুণালয় পালয় মাম্ ভবসাগরদুঃখবিদুনহৃদম।

রচয়াখিলদর্শনতত্ত্ববিদম্ ভব শঙ্কর দেশিক মে শরণম্।।"

"হে করুণার সাগর, আমাকে ভবসাগরের ভীষণ দুঃখ থেকে উদ্ধার করুন। আমাকে সমস্ত দর্শনের সারতত্ত্বের জ্ঞান প্রদান করুন, হে গুরু শঙ্কর আপনি আমায় শরণ প্রদান করুন।।" (২)

"ভবতা জনতা সুহিতা ভবিতা নিজবোধবিচারণ চারুমতে।

কলয়েশ্বরজীববিবেকবিদম্ ভব শঙ্কর দেশিক মে শরণম্।।"

"আপনি আত্মস্বরূপ বিচারে অতি দক্ষ, আপনার প্রভাবে অসংখ্য জীব সুখী হয়েছে। আপনি আমাকে ঈশ্বর এবং জীব এই উভয় তত্ত্বের বোধ করান, হে গুরু শঙ্কর আপনি আমায় শরণ প্রদান করুন।।" (৩)

"ভব এব ভবানিতি মে নিতরাম্ সমজায়ত চেতসি কৌতুকিতা।

মম বারয় মোহমহাজলধিম্ ভব শঙ্কর দেশিক মে শরণম্।।"

"আপনি স্বয়ং শিব, এটা উপলব্ধি করতে পেরে আমার চিত্তে পরমানন্দের স্পন্দন হয়। আমাকে এই বিরাট মোহসমুদ্র হতে উদ্ধার করুন, হে গুরু শঙ্কর আপনি আমায় শরণ প্রদান করুন।।" (৪)

"সুকৃতেধিকৃতে বহুধা ভবতো ভবিতা সমদর্শনলালসতা।

অতিদীনমিমম্ পরিপালয় মাম্ ভব শঙ্কর দেশিক মে শরণম্।।"

"আমি বহুজন্মের পূণ্যের ফলে আপনার কৃপালাভ করার সুযোগ পেয়েছি। এই কিঙ্করকে এখন আপনি রক্ষা করুন, হে গুরু শঙ্কর আপনি আমায় শরণ প্রদান করুন।।" (৫)

"জগতীমবিতুম্ কলিতাকৃতয়ো বিচরন্তি মহামহসশ্ছলতঃ।

অহিমাংশুরিবাত্র বিভাসি গুরো ভব শঙ্কর দেশিক মে শরণম্।।"

"হে গুরু, এই জগতের মঙ্গলের জন্য অনেক মহাপুরুষগণ বিভিন্ন রূপ ধারণ করে সর্বত্র বিচরণ করেন। তাঁদের মধ্যে আপনিই সূর্যের মতো তেজস্বী এবং জাজ্বল্যমান, হে গুরু শঙ্কর আপনি আমায় শরণ প্রদান করুন।।" (৬)

"গুরুপুঙ্গব পুঙ্গবকেতন তে সমতাময়তাম্ নহি কোপি সুধীঃ।

শরণাগতবৎসল তত্ত্বনিধে ভব শঙ্কর দেশিক মে শরণম্।।"

"হে শ্রেষ্ঠ গুরু, হে প্রভো আপনার ধ্বজে বৃষ শোভায়মান, কেউই আপনার সমকক্ষ নয়। হে শরণাগতদের আশ্রয়প্রদানকারী, হে তত্ত্বজ্ঞানের রত্ন, হে গুরু শঙ্কর আপনি আমায় শরণ প্রদান করুন।।" (৭)

"বিদিতা ন ময়া বিশদৈককলা ন চ কিণ্চন কাঞ্চনমস্তি গুরো।

দ্রুতমেব বিধেহি কৃপাম্ সহজাম্ ভব শঙ্কর দেশিক মে শরণম্।।"

"আমি শাস্ত্রের তত্ত্ব জানিনা, আমার কোনো ধনসম্পদও নেই গুরু। দ্রুত আমার প্রতি আপনার কৃপা বিধান করুন যা আপনার পক্ষে অতি সহজ, হে গুরু শঙ্কর আপনি আমায় শরণ প্রদান করুন।।" (৮)

ইতি শ্রীমত্তোটকাচার্য বিরচিতং তোটকাষ্টকম্ বা শ্রীশঙ্করদেশিকাষ্টকং সম্পূর্ণম্ ||

ইতি শ্রীমদ্ তোটকাচার্য বিরচিত তোটকাষ্টক বা শ্রীশঙ্করদেশিকাষ্টক স্তোত্র সমাপ্ত।

 

Sunday, 6 March 2022

অদ্বৈতবেদান্ত আসুরিক মত, এই দাবির খণ্ডনঃ-


ভগবদ্গীতা (১৬/৮) অনুসারে অনেকেই দাবি করেন, আসুরিক প্রবৃত্তির লোকেরাই নাকি জগৎকে মিথ্যা বলে। তাই সেই ভেদবাদীদের দৃষ্টিতে 'ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা' এই অদ্বৈতমত আসুরিক। এই বিষয়ে আজকের আলোচনা।

প্রথমত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই শ্লোকের মূল তাৎপর্য কি দেখা নেয়া যাক।

অসত্যমপ্রতিষ্ঠং তে জগদাহুরনীশ্বরম্ ৷

অপরস্পরসম্ভূতং কিমন্যত্কামহৈতুকম্ ৷৷১৬.৮৷৷

ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্যের ভাষ্যানুবাদ-

আসুরস্বভাববিশিষ্ট ব্যক্তিগণ বলে, যেরূপ আমরা মিথ্যা-পরিপূর্ণ সেইরূপ এই সমস্ত জগৎই অসত্য (বেদাদি প্রমাণশূন্য) এবং অপ্রতিষ্ঠ অর্থাৎ জগতে কোন ধর্মাধর্মের প্রতিষ্ঠা নেই। যেহেতু (বেদকর্তা) ধর্মাধর্মের অনুপাতী এই জগতের শাসিতা ঈশ্বর বলে কিছু বিদ্যমান নেই। অতএব তারা বলে এই জগৎ অনীশ্বর। তারা আর কি বলে? কামবশতঃ স্ত্রী-পুরুষের সংযোগেই এই জগৎ উৎপন্ন; ইহার উৎপত্তির অদৃষ্ট ধর্মাধর্মাদি অন্য কারণ নাই। এই হলো লোকায়তিক দৃষ্টি। ৮

অর্থাৎ এখানে স্পষ্ট যে, অনীশ্বরবাদী লোকায়ত (চার্বাকাদি) দর্শনকেই এখানে আসুরিক মত বলা হয়েছে। যারা এইরকম লোক-গাথা অবলম্বন করে অর্থ এবং কামকেই পুরুষার্থ মনে করে পারলৌকিক বিষয় অস্বীকার করে। অপরদিকে অদ্বৈতবেদান্ত শাশ্বত সনাতন ব্রহ্মবাদী দর্শন, অনীশ্বরবাদী নয়।

এবার আসি বিবেকচূড়ামণির ২০ নং শ্লোকের 'ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা' বিষয়ে। এই 'মিথ্যা' শব্দের অর্থ-বন্ধ্যাপুত্রের ন্যায় অলীকত্ব নয়, পরন্তু অনির্বচনীয়ত্ব। বাস্তব সত্তারহিত যার প্রতীতি হয়, যার স্বরূপকে 'ইহা এই প্রকার' এইরূপে শৃঙ্গগ্রাহিতয়া নির্ব্বচন করা যায় না এবং বাক্যের দ্বারা বর্ণনা করা যায় না, তাহাকে বলে 'অনির্বচনীয়' বা 'মিথ্যা'। এই মিথ্যা শব্দ এই অর্থে এই দর্শনে পারিভাষিক। যোগবাশিষ্ঠসারে শ্রীবশিষ্ঠ তাই বলছেন-"হে রাম! (সংসারকারণ) এই মায়া স্বনাশে আনন্দ দান করে। উহার স্বভাব দেখা বা বুঝা যায় না; কারণ (বিচারদৃষ্টিতে) দেখিলে উহাকে পাওয়াই যায় না, উহার নাশ হয় (উহা তাই অনির্বচনীয়)।"-(যোগবাশিষ্ঠসারঃ, জগৎ মিথ্যাত্ব প্রকরণ-৬)

এই বিবেকচূড়ামণির অন্যান্য শ্লোকে আবার জগৎকে ব্রহ্ম হতে অভিন্ন বলা হয়েছে। যথা-

"সকল অবস্থায় এই জগৎ ব্রহ্ম প্রতীতির প্রবাহ মাত্র, অতএব সর্বপ্রকারে এই জগৎ ব্রহ্ম মাত্র।"-(বিবেকচূড়ামণি-৫২১)

"এই বিস্তৃত জগতের সবকিছুই অবশ্য ব্রহ্মমাত্র"-(বিবেকচূড়ামণি-৩৯৪)

সুতরাং জগতের স্বতন্ত্র নিরপেক্ষ সত্তা নেই। ইহার অধিষ্ঠান আত্মার সত্যতার জন্য ইহা সত্যরূপে প্রতীত হয়। বিবেকচূড়ামণিতে (২৩২,২৩৩) এই বিষয়ে বলা হচ্ছে-

"এই জগৎ যদি স্বরূপতঃ সত্য হত অর্থাৎ ইহার নিত্য বর্তমান স্বতন্ত্র সত্ত্বা থাকত, তাহলে সত্যস্বরূপ জগতের কখনো নাশ হতো না। বস্তু স্বরূপের জ্ঞাতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ 'আমি সে সকল বস্তুতে নেই' আর 'সে সকল বস্তু আমাতে নেই' এইরূপ বলে জগৎ মিথ্যাত্বের সমর্থন করেছেন।"

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার নবম অধ্যায়ে শ্রীভগবান তাই বলছেন-

ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্তমূর্তিনা৷

মত্স্থানি সর্বভূতানি ন চাহং তেষ্ববস্থিতঃ৷৷

ন চ মত্স্থানি ভূতানি পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্৷

ভূতভৃন্ন চ ভূতস্থো মমাত্মা ভূতভাবনঃ৷৷৪,৫

অর্থাৎ আমি ইন্দ্রিয়ের অগোচর ও অব্যক্তমূর্তি; আমার দ্বারা এই সমগ্র বিশ্ব পরিব্যাপ্ত । ব্রহ্মাদি স্থাবর পর্যন্ত সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত; কিন্তু আমি আকাশবৎ অপরিচ্ছিন্ন অসংসর্গী বলিয়া তৎসমুদয়ে আধেয়ভাবে অবস্থিত নহি । ৪

আমার ঈশ্বরীয় যোগ দর্শন কর । বস্তুতঃ ব্রহ্মাদিস্তম্ভপর্যন্ত ভূতগণ সর্বসঙ্গবর্জিত আমাতে পারমার্থিকভাবে অবস্থিত নহে; অসংসর্গীত্ব নিবন্ধন আমার আত্মা ভূতগণে অবস্থিত না হইয়াও তাহাদের ধারক ও জনক । ৫

এখন আবার প্রশ্ন জগৎ যদি চিদাত্মা হতে ভিন্ন নয় তবে উহা ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয় কেন? এই শঙ্কার উত্তরে বলছেন-

"আত্মবিষয়ক অজ্ঞানবশতই জগৎ প্রতিভাত হইয়া থাকে, অধিষ্ঠানভূত আত্মার জ্ঞান হইলে আর আত্মা হইতে পৃথকরূপে কোন জগৎ দৃষ্টিগোচর হয় না। যেমন রজ্জুস্বরূপের অজ্ঞানবশতই ভ্রান্তিসর্প দেখা যায়, রজ্জুর জ্ঞান হইলে আর ঐ সর্পপ্রতীতি হয় না।" -(অষ্টাবক্র গীতা, শিষ্যোক্তমাত্মানুভবোল্লাসঃ, ৭)

অর্থাৎ রজ্জুতে যেমন পরমার্থতঃ সর্প কোন কালেই থাকে না তদ্রূপ ব্রহ্মরূপ অধিষ্ঠানে পরমার্থতঃ এই জগৎ কোন কালেই নেই। ব্রহ্মসূত্রের ২।১।১৪ এর ভাষ্যে ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য তা স্পষ্ট করেছেন-

"পারমার্থিক দৃষ্টিতে শুদ্ধ চৈতন্যে ঈশ্বরত্ব ও জীবত্ব প্রভৃতি দ্বৈতবুদ্ধি উপপন্ন হয় না, সেই বিষয়ে শ্রুতি প্রমাণ-

'যত্র নান্যত্পশ্যতি নান্যচ্ছৃণোতি নান্যদ্বিজানাতি স ভূমা' -(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৭/২৪/১)।

অর্থাৎ 'যেখানে অপর কিছু দর্শন করে না, অপর কিছু শ্রবণ করে না, অপর কিছু জানিতে পারে না, তাহাই ভূমা।'

'যত্র ত্বস্য সর্বমাত্মৈবাভূত্তত্কেন কং পশ্যেৎ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৫/১৫)।

অর্থাৎ 'কিন্তু সমস্তই যখন ইহার আত্মাই হইয়া গেল, তখন কাহার দ্বারা কাহাকে দর্শন করিবে?'

ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যের দ্বারাও তাহাই বর্ণিত হইতেছে। এই প্রকারে সকল উপনিষদই পরমার্থ অবস্থাতে সকলপ্রকার ব্যবহারের অভাবের কথা বলিতেছেন। সেইরূপেই ঈশ্বর ভগবদ্গীতাতে বলিতেছেন-

'ন কর্তৃত্বং ন কর্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ৷ ন কর্মফলসংযোগং স্বভাবস্তু প্রবর্ততে' 'নাদত্তে কস্যচিত্পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুঃ৷ অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ'।-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা- ৫।১৪,১৫)

অর্থাৎ 'কারণ প্রভু আত্মা মনুষ্যের কর্তৃত্ব, কর্ম ও কর্মফলপ্রাপ্তি সৃষ্টি করেন না; কিন্তু স্বভাব অর্থাৎ নিজ বা পরমাত্মার যে সদসদাত্মিকা ভাব অর্থাৎ অবিদ্যালক্ষণা মায়াশক্তি কর্তৃত্বাদিরূপে প্রবর্তিত হয়। অর্থাৎ অবিদ্যাপ্রভাবে কর্তৃত্ব ও কারয়িতৃত্বাদি আত্মাতে আরোপিত হয় । পরমার্থতঃ বিভু আত্মা কাহারও পাপ বা পূজা জপহোমাদিরূপ পুণ্যও গ্রহণ করেন না । পূর্বোক্ত অবিদ্যা দ্বারা ‘আমি কর্তৃত্ব ও কারয়িতৃত্বাদিরহিত’ - এই বিবেকজ্ঞান আত্মজ্ঞান দ্বারা আবৃত বলিয়া প্রাণিগণ মোহগ্রস্থ হয়, অর্থাৎ মোহবশে ‘আমি করি ও করাই’, ‘আমি ভোগ করি ও করাই’ - ইত্যাদি ভ্রম করিয়া থাকে।'

এইপ্রকারে পারমার্থিক অবস্থাতে শাসক (ঈশ্বর) ও শাসিত (জীব) ইত্যাদি ব্যবহারের অভাব প্রদর্শিত হইতেছে।"-(ব্রহ্মসূত্র-২।১।১৪, শাঙ্করভাষ্য)

তাছাড়া আত্মবোধে আচার্য বলছেন-‘রাগ ও দ্বেষাদিযুক্ত এই সংসার স্বপ্নতুল্য, যেমন স্বপ্নসময়ে দৃশ্যমান বস্তু সত্য বলিয়া বোধ হয়, জাগ্রতকালে মিথ্যা বলিয়া জানা যায়, সেইরূপ যতকাল অজ্ঞান থাকে, ততকাল জগৎ সত্য বলিয়া প্রতীত হয়, কিন্তু তত্ত্বজ্ঞান উৎপন্ন হইলে জগতের মিথ্যাত্বই জ্ঞাত হওয়া যায়। যতকাল সকলের অধিষ্ঠানরূপ অদ্বিতীয় ব্রহ্মের জ্ঞান না হয়, তাবৎকাল শুক্তিকাতে (ঝিনুকে) রৌপ্যের ন্যায় জগৎ সত্য বলিয়া প্রতীত হয়।‘ -(শঙ্করাচার্য, আত্মবোধ-৬,৭)

সবশেষে গৌড়পাদাচার্য্যৈর মাণ্ডুক্যকারিকা দিয়ে আলোচনার সারতত্ত্ব প্রস্ফুটিত করব।

অনিশ্চিতা য়থা রজ্জুরন্ধকারে বিকল্পিতা ।

সর্পধারাদিভির্ভাবৈস্তদ্বদাত্মা বিকল্পিতঃ ॥- (মাণ্ডুক্যকারিকা-২।১৭)

অর্থাৎ অজ্ঞাত রজ্জু যেমন সর্পরূপে প্রতীতির হেতু, অজ্ঞাত নির্বিশেষ ব্রহ্মই তদ্রূপ জগৎরূপে প্রতীতির হেতু।

অতএব অদ্বৈতবেদান্ত আসুরিক মত নয়, বরংচ শ্রুতি, স্মৃতি ও ন্যায় সিদ্ধ বেদান্ত দর্শন।

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (২/২৪) শ্লোক প্রক্ষিপ্ত, এই আপত্তির খণ্ডনঃ-


ইদানিং কিছু নির্দিষ্ট অর্বাচীন সম্প্রদায় দাবি করছে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সাংখ্যযোগের ২৪ নং শ্লোক নাকি প্রক্ষিপ্ত। সেই অতিজ্ঞানীদের মতে এই শ্লোকের প্রক্ষিপ্ততার কারণ হল পুনরুক্তি দোষ। এই বিষয়ে আজকের আলোচনার সূত্রপাত করছি। ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য বহু পূর্বেই এই আপত্তির খণ্ডন করেছেন গীতার এই শ্লোকের ভাষ্যে। যথা-

ভাষ্যানুবাদ- (পূর্বপক্ষ) এই সকল শ্লোকের প্রতি পুনরুক্তি দোষারোপ করা কি উচিত নয়? যেহেতু "ন জায়তে ম্রিয়তে বা" ইত্যাদি একটি শ্লোকের দ্বারা আত্মার নিত্যত্ব এবং অবিক্রিয়ত্ব পূর্বেই বলা হয়েছে। সেখানে আত্মবিষয়ক যা কিছু বলা হয়েছে তা এই শ্লোকার্থ হতে অতিরিক্ত নয়, কেবল কিছু শব্দের পুনরুক্তি এবং কিঞ্চিৎ অর্থের পুনরুক্তি।

(উত্তরপক্ষ) আত্মবস্তুর দুর্বোধত্বহেতু (সহজে বোধগম্য নহে, এই হেতু), শ্রীভগবান বাসুদেব পুনঃ পুনঃ ঐ প্রসঙ্গ উত্থাপিত করে বিভিন্ন শব্দ দ্বারা সেই একই বস্তু নিরুপণ করছেন এই চিন্তা করে যে সেই সূক্ষ্মতত্ত্ব সংসারীদের বুদ্ধিগোচর হয়ে সংসার নিবৃত্তির হেতু হবে।......

বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রে এই বিষয়ের আরও স্পষ্ট মীমাংসা আছে। যথা-

"শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন, এ সকল অনুষ্ঠান একবার করলে যদি আত্মদর্শন না হয়—তবে পুনঃ পুনঃ করতে হবে। যতদিন না আত্মদর্শন হয় ততদিন পর্যন্ত করতে হবে। শাস্ত্র সেই অভিপ্রায়েই বার বার এবং শ্রবণাদি বহুবিধ উপায় উপদেশ করেছেন।"

-(সূত্রার্থ সংক্ষেপ, ব্রহ্মসূত্র ৪/১/১)

 

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...