Saturday, 12 March 2022

বেদের নাসদীয় সূক্তে মুখ্য প্রাণের অনাদিত্ব প্রতিপাদ্য নহেঃ-



আজকের আলোচনায় মুখ্যপ্রাণোৎপত্তি বিচার্য বিষয়। "ব্রহ্ম হইতে মুখ্যপ্রাণ উৎপন্ন হয়" এই মুণ্ডক শ্রুতির সহিত ঋগ্বেদ্ সংহিতার নাসদীয় সূক্তে "সৃষ্টির পূর্বে মুখ্যপ্রাণের অস্তিত্ব প্রতিভাত হয়" এই শ্রুতির বিরোধ মনে হয়। আর শ্রুতিদ্বয়ের বিরোধবশতঃ সংশয় হয়—মুখ্যপ্রাণ কি অনাদি অথবা উৎপন্ন হয়?

ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রের প্রাণশ্রৈষ্ঠ্যাধিকরণের ভাষ্যে এই সংশয়ের নিরাকরণ করিতেছেন—

মুখ্যপ্রাণ অন্যান্য প্রাণ (–ইন্দ্রিয়) সকলের ন্যায় ব্রহ্মের কার্য্য, ইহা ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণ অতিদেশ করিতেছেন। আর অবিশেষভাবে (মুখ্য ও অমুখ্য) সকল প্রাণেরই সেই ব্রহ্মবিকারতা (—তাহারা ব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন, ইহা ২/৪/১ অধিকরণে) বর্ণিত হইয়াছে। যেহেতু-

'এতস্মাজ্জায়তে প্রাণো মনঃ সর্বেন্দ্রিয়াণি চ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ- ২/১/৩)

"ইঁহা (–ব্রহ্ম) হইতে মুখ্য প্রাণ মন ও ইন্দ্রিয়সকল উৎপন্ন হয়", এই প্রকারে ইন্দ্রিয়ের সহিত মন হইতে ভিন্নভাবে মুখ্যপ্রাণের উৎপত্তি শ্রুত হইতেছে। আর যেহেতু-

'স প্রাণমসৃজত'-(প্রশ্ন উপনিষৎ-৬/৪)

"তিনি প্রাণকে সৃষ্টি করিলেন" ইত্যাদি শ্রুতিসকলও আছে।

আচ্ছা তাহলে কোন প্রয়োজনে অতিদেশ হইতেছে? অধিক আশঙ্কাকে নিরাকরণ করিবার জন্য। নাসদীয় নামক ব্রহ্মপ্রধান সূক্তে এইপ্রকার মন্ত্রবর্ণ আছে–

'ন মৃত্যুরাসীদমৃতং ন তর্হি ন রাত্র্যা অহ্ন আসীত্প্রকেতঃ৷ আনীদবাতং স্বধয়া তদেকং তস্মাদ্ধান্যন্নপরঃ কিংচনাস'।।-(ঋগ্বেদ্ সংহিতা-১০/১২৯/২)

"তখন (–মহাপ্রলয়কালে) মৃত্যু (–বিনাশশীল কার্য্য বস্তু) ছিল না, অমৃত ছিল না, রাত্রি ও দিনের প্রকেত (–চিহ্ন, অর্থাৎ চন্দ্র ও সূর্য) ছিল না, স্বধার (–স্বকর্ত্তৃক ধৃতা মায়ার) সহিত অবাত (–প্রাণবায়ুবর্জিত, অবিক্রিয়) সেই এক ব্রহ্ম আনীৎ (–বর্ত্তমান) ছিলেন, তাঁহা হইতে শ্রেষ্ঠ কিছুই ছিল না", ইত্যাদি।

"আনীৎ" এই প্রকারে মুখ্যপ্রাণের কর্ম্ম গৃহীত হওয়ায় এই শ্রুতিবাক্য জগতের উৎপত্তির পূর্ব্বে প্রাণের অস্তিত্ব বর্তমান আছে অর্থাৎ প্রাণ অজ (–জন্মরহিত) এই প্রকার বুদ্ধি কাহারও কাহারও উৎপন্ন হয়। ভগবান সূত্রকার তাদৃশ বুদ্ধিকে অতিদেশের দ্বারা অপনোদন করিতেছেন। যথা—

আনীৎ শব্দটিও উৎপত্তির পূর্বে মুখ্যপ্রানের অস্তিত্ব সূচনা করিতেছে না; যেহেতু অবাত (–প্রাণবায়ুরহিত), এইপ্রকার বিশেষণ আছে। আর

'অপ্রাণো হ্যমনাঃ শুভ্রঃ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২/১/২)

"সেই অক্ষর পুরুষ প্রাণরহিত মনোবিহীন এবং শুদ্ধ", এইপ্রকারে মূলপ্রকৃতির (–জগতের মূলকারণ ব্রহ্মের) প্রাণাদি সমস্ত বিশেষরাহিত্য প্রদর্শিত হওয়ায় মহাপ্রলয়ে মুখ্যপ্রাণের সত্তা সিদ্ধ হয় না। সেইহেতু নাসদীয় সূক্তের এই "আনীৎ" শব্দটি মহাপ্রলয়ে ব্রহ্মরূপ কারণের অস্তিত্ব প্রদর্শনের জন্য, ইহা অবগত হইতে হইবে।

 

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...