ভগবদ্গীতা (১৬/৮) অনুসারে অনেকেই দাবি করেন, আসুরিক প্রবৃত্তির লোকেরাই নাকি জগৎকে মিথ্যা বলে। তাই সেই ভেদবাদীদের দৃষ্টিতে 'ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা' এই অদ্বৈতমত আসুরিক। এই বিষয়ে আজকের আলোচনা।
প্রথমত
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার এই শ্লোকের মূল তাৎপর্য কি দেখা নেয়া যাক।
অসত্যমপ্রতিষ্ঠং
তে জগদাহুরনীশ্বরম্ ৷
অপরস্পরসম্ভূতং
কিমন্যত্কামহৈতুকম্ ৷৷১৬.৮৷৷
ভগবান
ভাষ্যকার শঙ্করাচার্যের ভাষ্যানুবাদ-
আসুরস্বভাববিশিষ্ট
ব্যক্তিগণ বলে, যেরূপ আমরা মিথ্যা-পরিপূর্ণ সেইরূপ এই সমস্ত জগৎই অসত্য (বেদাদি প্রমাণশূন্য)
এবং অপ্রতিষ্ঠ অর্থাৎ জগতে কোন ধর্মাধর্মের প্রতিষ্ঠা নেই। যেহেতু (বেদকর্তা) ধর্মাধর্মের
অনুপাতী এই জগতের শাসিতা ঈশ্বর বলে কিছু বিদ্যমান নেই। অতএব তারা বলে এই জগৎ অনীশ্বর।
তারা আর কি বলে? কামবশতঃ স্ত্রী-পুরুষের সংযোগেই এই জগৎ উৎপন্ন; ইহার উৎপত্তির অদৃষ্ট
ধর্মাধর্মাদি অন্য কারণ নাই। এই হলো লোকায়তিক দৃষ্টি। ৮
অর্থাৎ
এখানে স্পষ্ট যে, অনীশ্বরবাদী লোকায়ত (চার্বাকাদি) দর্শনকেই এখানে আসুরিক মত বলা হয়েছে।
যারা এইরকম লোক-গাথা অবলম্বন করে অর্থ এবং কামকেই পুরুষার্থ মনে করে পারলৌকিক বিষয়
অস্বীকার করে। অপরদিকে অদ্বৈতবেদান্ত শাশ্বত সনাতন ব্রহ্মবাদী দর্শন, অনীশ্বরবাদী নয়।
এবার
আসি বিবেকচূড়ামণির ২০ নং শ্লোকের 'ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা' বিষয়ে। এই 'মিথ্যা' শব্দের
অর্থ-বন্ধ্যাপুত্রের ন্যায় অলীকত্ব নয়, পরন্তু অনির্বচনীয়ত্ব। বাস্তব সত্তারহিত যার
প্রতীতি হয়, যার স্বরূপকে 'ইহা এই প্রকার' এইরূপে শৃঙ্গগ্রাহিতয়া নির্ব্বচন করা যায়
না এবং বাক্যের দ্বারা বর্ণনা করা যায় না, তাহাকে বলে 'অনির্বচনীয়' বা 'মিথ্যা'। এই
মিথ্যা শব্দ এই অর্থে এই দর্শনে পারিভাষিক। যোগবাশিষ্ঠসারে শ্রীবশিষ্ঠ তাই বলছেন-"হে
রাম! (সংসারকারণ) এই মায়া স্বনাশে আনন্দ দান করে। উহার স্বভাব দেখা বা বুঝা যায় না;
কারণ (বিচারদৃষ্টিতে) দেখিলে উহাকে পাওয়াই যায় না, উহার নাশ হয় (উহা তাই অনির্বচনীয়)।"-(যোগবাশিষ্ঠসারঃ,
জগৎ মিথ্যাত্ব প্রকরণ-৬)
এই
বিবেকচূড়ামণির অন্যান্য শ্লোকে আবার জগৎকে ব্রহ্ম হতে অভিন্ন বলা হয়েছে। যথা-
"সকল
অবস্থায় এই জগৎ ব্রহ্ম প্রতীতির প্রবাহ মাত্র, অতএব সর্বপ্রকারে এই জগৎ ব্রহ্ম মাত্র।"-(বিবেকচূড়ামণি-৫২১)
"এই
বিস্তৃত জগতের সবকিছুই অবশ্য ব্রহ্মমাত্র"-(বিবেকচূড়ামণি-৩৯৪)
সুতরাং
জগতের স্বতন্ত্র নিরপেক্ষ সত্তা নেই। ইহার অধিষ্ঠান আত্মার সত্যতার জন্য ইহা সত্যরূপে
প্রতীত হয়। বিবেকচূড়ামণিতে (২৩২,২৩৩) এই বিষয়ে বলা হচ্ছে-
"এই
জগৎ যদি স্বরূপতঃ সত্য হত অর্থাৎ ইহার নিত্য বর্তমান স্বতন্ত্র সত্ত্বা থাকত, তাহলে
সত্যস্বরূপ জগতের কখনো নাশ হতো না। বস্তু স্বরূপের জ্ঞাতা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ 'আমি সে
সকল বস্তুতে নেই' আর 'সে সকল বস্তু আমাতে নেই' এইরূপ বলে জগৎ মিথ্যাত্বের সমর্থন করেছেন।"
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার
নবম অধ্যায়ে শ্রীভগবান তাই বলছেন-
ময়া
ততমিদং সর্বং জগদব্যক্তমূর্তিনা৷
মত্স্থানি
সর্বভূতানি ন চাহং তেষ্ববস্থিতঃ৷৷
ন
চ মত্স্থানি ভূতানি পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্৷
ভূতভৃন্ন
চ ভূতস্থো মমাত্মা ভূতভাবনঃ৷৷৪,৫
অর্থাৎ
আমি ইন্দ্রিয়ের অগোচর ও অব্যক্তমূর্তি; আমার দ্বারা এই সমগ্র বিশ্ব পরিব্যাপ্ত । ব্রহ্মাদি
স্থাবর পর্যন্ত সমস্ত ভূত আমাতে অবস্থিত; কিন্তু আমি আকাশবৎ অপরিচ্ছিন্ন অসংসর্গী বলিয়া
তৎসমুদয়ে আধেয়ভাবে অবস্থিত নহি । ৪
আমার
ঈশ্বরীয় যোগ দর্শন কর । বস্তুতঃ ব্রহ্মাদিস্তম্ভপর্যন্ত ভূতগণ সর্বসঙ্গবর্জিত আমাতে
পারমার্থিকভাবে অবস্থিত নহে; অসংসর্গীত্ব নিবন্ধন আমার আত্মা ভূতগণে অবস্থিত না হইয়াও
তাহাদের ধারক ও জনক । ৫
এখন
আবার প্রশ্ন জগৎ যদি চিদাত্মা হতে ভিন্ন নয় তবে উহা ভিন্নরূপে প্রতিভাত হয় কেন? এই
শঙ্কার উত্তরে বলছেন-
"আত্মবিষয়ক
অজ্ঞানবশতই জগৎ প্রতিভাত হইয়া থাকে, অধিষ্ঠানভূত আত্মার জ্ঞান হইলে আর আত্মা হইতে
পৃথকরূপে কোন জগৎ দৃষ্টিগোচর হয় না। যেমন রজ্জুস্বরূপের অজ্ঞানবশতই ভ্রান্তিসর্প দেখা
যায়, রজ্জুর জ্ঞান হইলে আর ঐ সর্পপ্রতীতি হয় না।" -(অষ্টাবক্র গীতা, শিষ্যোক্তমাত্মানুভবোল্লাসঃ,
৭)
অর্থাৎ
রজ্জুতে যেমন পরমার্থতঃ সর্প কোন কালেই থাকে না তদ্রূপ ব্রহ্মরূপ অধিষ্ঠানে পরমার্থতঃ
এই জগৎ কোন কালেই নেই। ব্রহ্মসূত্রের ২।১।১৪ এর ভাষ্যে ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য তা স্পষ্ট
করেছেন-
"পারমার্থিক
দৃষ্টিতে শুদ্ধ চৈতন্যে ঈশ্বরত্ব ও জীবত্ব প্রভৃতি দ্বৈতবুদ্ধি উপপন্ন হয় না, সেই বিষয়ে
শ্রুতি প্রমাণ-
'যত্র
নান্যত্পশ্যতি নান্যচ্ছৃণোতি নান্যদ্বিজানাতি স ভূমা' -(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৭/২৪/১)।
অর্থাৎ
'যেখানে অপর কিছু দর্শন করে না, অপর কিছু শ্রবণ করে না, অপর কিছু জানিতে পারে না, তাহাই
ভূমা।'
'যত্র
ত্বস্য সর্বমাত্মৈবাভূত্তত্কেন কং পশ্যেৎ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৫/১৫)।
অর্থাৎ
'কিন্তু সমস্তই যখন ইহার আত্মাই হইয়া গেল, তখন কাহার দ্বারা কাহাকে দর্শন করিবে?'
ইত্যাদি
শ্রুতিবাক্যের দ্বারাও তাহাই বর্ণিত হইতেছে। এই প্রকারে সকল উপনিষদই পরমার্থ অবস্থাতে
সকলপ্রকার ব্যবহারের অভাবের কথা বলিতেছেন। সেইরূপেই ঈশ্বর ভগবদ্গীতাতে বলিতেছেন-
'ন
কর্তৃত্বং ন কর্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভুঃ৷ ন কর্মফলসংযোগং স্বভাবস্তু প্রবর্ততে' 'নাদত্তে
কস্যচিত্পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভুঃ৷ অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ'।-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-
৫।১৪,১৫)
অর্থাৎ
'কারণ প্রভু আত্মা মনুষ্যের কর্তৃত্ব, কর্ম ও কর্মফলপ্রাপ্তি সৃষ্টি করেন না; কিন্তু
স্বভাব অর্থাৎ নিজ বা পরমাত্মার যে সদসদাত্মিকা ভাব অর্থাৎ অবিদ্যালক্ষণা মায়াশক্তি
কর্তৃত্বাদিরূপে প্রবর্তিত হয়। অর্থাৎ অবিদ্যাপ্রভাবে কর্তৃত্ব ও কারয়িতৃত্বাদি আত্মাতে
আরোপিত হয় । পরমার্থতঃ বিভু আত্মা কাহারও পাপ বা পূজা জপহোমাদিরূপ পুণ্যও গ্রহণ করেন
না । পূর্বোক্ত অবিদ্যা দ্বারা ‘আমি কর্তৃত্ব ও কারয়িতৃত্বাদিরহিত’ - এই বিবেকজ্ঞান
আত্মজ্ঞান দ্বারা আবৃত বলিয়া প্রাণিগণ মোহগ্রস্থ হয়, অর্থাৎ মোহবশে ‘আমি করি ও করাই’,
‘আমি ভোগ করি ও করাই’ - ইত্যাদি ভ্রম করিয়া থাকে।'
এইপ্রকারে
পারমার্থিক অবস্থাতে শাসক (ঈশ্বর) ও শাসিত (জীব) ইত্যাদি ব্যবহারের অভাব প্রদর্শিত
হইতেছে।"-(ব্রহ্মসূত্র-২।১।১৪, শাঙ্করভাষ্য)
তাছাড়া
আত্মবোধে আচার্য বলছেন-‘রাগ ও দ্বেষাদিযুক্ত এই সংসার স্বপ্নতুল্য, যেমন স্বপ্নসময়ে
দৃশ্যমান বস্তু সত্য বলিয়া বোধ হয়, জাগ্রতকালে মিথ্যা বলিয়া জানা যায়, সেইরূপ যতকাল
অজ্ঞান থাকে, ততকাল জগৎ সত্য বলিয়া প্রতীত হয়, কিন্তু তত্ত্বজ্ঞান উৎপন্ন হইলে জগতের
মিথ্যাত্বই জ্ঞাত হওয়া যায়। যতকাল সকলের অধিষ্ঠানরূপ অদ্বিতীয় ব্রহ্মের জ্ঞান না হয়,
তাবৎকাল শুক্তিকাতে (ঝিনুকে) রৌপ্যের ন্যায় জগৎ সত্য বলিয়া প্রতীত হয়।‘ -(শঙ্করাচার্য,
আত্মবোধ-৬,৭)
সবশেষে
গৌড়পাদাচার্য্যৈর মাণ্ডুক্যকারিকা দিয়ে আলোচনার সারতত্ত্ব প্রস্ফুটিত করব।
অনিশ্চিতা
য়থা রজ্জুরন্ধকারে বিকল্পিতা ।
সর্পধারাদিভির্ভাবৈস্তদ্বদাত্মা
বিকল্পিতঃ ॥- (মাণ্ডুক্যকারিকা-২।১৭)
অর্থাৎ
অজ্ঞাত রজ্জু যেমন সর্পরূপে প্রতীতির হেতু, অজ্ঞাত নির্বিশেষ ব্রহ্মই তদ্রূপ জগৎরূপে
প্রতীতির হেতু।
অতএব অদ্বৈতবেদান্ত আসুরিক মত নয়, বরংচ শ্রুতি, স্মৃতি ও ন্যায় সিদ্ধ বেদান্ত দর্শন।
No comments:
Post a Comment