বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রের বায়ুক্রিয়াধিকরণের প্রতিপাদ্য বিষয় মুখ্য প্রাণের স্বরূপ নির্ণয়। মুখ্য প্রাণ কি বায়ু মাত্র? অথবা ইন্দ্রিয়গণের ক্রিয়া? অথবা অন্য কিছু? ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণ বলিতেছেন-
ন
বায়ুক্রিয়ে পৃথগুপদেশাত্৷৷- (ব্রহ্মসূত্র-২/৪/৯)
আচার্য
শঙ্কর সূত্রভাষ্যে সিদ্ধান্ত করিতেছেন—"মুখ্য প্রাণ বায়ু নহে এবং ইন্দ্রিয় সকলের
ব্যাপারও নহে। কেন নহে? যেহেতু পৃথগ্ভাবে উপদিষ্ট হইয়াছে। বায়ু হইতে মুখ্যপ্রাণের
পৃথগ্ভাবে উপদেশ আছে। যথা-
প্রাণ
এব ব্রহ্মণশ্চতুর্থঃ পাদঃ স বাযুনা জ্যোতিষা ভাতি চ তপতি চ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৩/১৮/৪)
'মুখ্যপ্রাণই
ব্রহ্মের চতুর্থ পাদ, তাহা বায়ুরূপ জ্যোতির দ্বারা প্রকাশিত হয় ও কার্য্যক্ষম হয়।'
মুখ্যপ্রাণ বায়ু হইলে নিশ্চয়ই বায়ু হইতে পৃথগ্ভাবে উপদিষ্ট হইত না। এইপ্রকারে ইন্দ্রিয়
সকলের বৃত্তি হইতেও মুখ্যপ্রাণের পৃথগ্ভাবে উপদেশ আছে। যথা- "এই পুরুষ হইতে প্রাণ
জাত হয় এবং মন সর্বেন্দ্রিয়..."-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২/১/৩) সুতরাং বৃত্তি ও বৃত্তি
মানের অভিন্নতাবশতঃ মুখ্যপ্রাণ ইন্দ্রিয়সকলের সাধারণ বৃত্তি হইয়াই ইন্দ্রিয়সকল হইতে
নিশ্চয়ই পৃথগ্ভাবে উপদিষ্ট হইত না।..."
তাহলে
মুখ্যপ্রাণ কি? মুখ্য প্রাণ বায়ুরূপ মহাভূতের কার্য্য, বায়ুমাত্র নহে, তদ্ভিন্নও
নহে। আচার্য শঙ্কর ভাষ্যে তাহাই সিদ্ধান্ত করিতেছেন—"এই বায়ুই অধ্যাত্মভাবকে
প্রাপ্ত হইয়া প্রাণ ও অপান প্রভৃতি পাঁচ প্রকার ব্যূহরূপ বিশেষস্বরূপে অবস্থানকরতঃ
মুখ্যপ্রাণ নামে কথিত হয়। তাহা বায়ু হইতে তত্ত্বান্তর (সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু) নহে,
অথবা বায়ুমাত্রও নহে।"
মনের
ন্যায় ইহারও পাঁচটি বৃত্তি আছে বলিয়া শাস্ত্রে উপদেশ করা হইয়াছে। 'পঞ্চবৃত্তির্মনোবদ্ব্যপদিশ্যতে'-(ব্রহ্মসূত্র-২/৪/১২)
আচার্য
শঙ্কর ভাষ্যে বলিতেছেন— "আর এই হেতুবশতঃ মুখ্যপ্রাণের বিশেষ কার্য্য বর্তমান আছে,
যেহেতু শ্রুতিসকলে ইহা পঞ্চবৃত্তিযুক্তরূপে (—ক্রিয়াভেদে পাঁচ প্রকার অবস্থাযুক্তরূপে)
বর্ণিত হইতেছে, যথা—"প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান ও সমান", ইত্যাদি। আর এই বৃত্তি
ভেদ কার্য্যভেদকে অপেক্ষা করে। সেই কার্য্য প্রদর্শন করিতেছেন—সম্মুখভাগে যাহার বৃত্তি
এবং উচ্ছ্বাস (–প্রশ্বাস এবং দেহধারণ) প্রভৃতি যাহার কর্ম্ম, তাহা প্রাণ। অধোভাগে যাহার
বৃত্তি এবং নিঃশ্বাসাদি (—শ্বাসগ্রহণ ও অধোবায়ুত্যাগ) যাহার কর্ম্ম, তাহা অপান। সেই
দুইটীর (—প্রাণ ও অপানের) সন্ধি স্থলে (—নাভিতে) বর্ত্তমান যাহা অগ্নিমন্থনাদি বলসাধ্য
কর্ম্মের হেতু, তাহা ব্যান। ঊর্ধ্ব দিকে যাহার বৃত্তি এবং উৎক্রমণ গত্যাগতি ও উদগার
প্রভৃতির যাহা হেতু, তাহা উদান। অন্নরসকে যাহা সকল অঙ্গে সমানভাবে লইয়া যায়, তাহা
সমান।
এই
প্রকারে মুখ্যপ্রাণ মনের ন্যায় পঞ্চবৃত্তিযুক্ত, অর্থাৎ মনের যেমন পাঁচপ্রকার বৃত্তি,
মুখ্যপ্রাণেরও এইপ্রকার।
No comments:
Post a Comment