সদানন্দযোগীন্দ্র সরস্বতী বেদান্তসারে নিত্যকর্ম্মের অপূর্ব সংজ্ঞা দিয়াছেন-"নিত্যানি—অকরণে প্রত্যবায়সাধনানি সন্ধ্যা বন্দনাদীনি"-(বেদান্তসার-৯) অর্থাৎ যা না করিলে প্রত্যবায় হয় তাই নিত্যকর্ম্ম, যেমন সন্ধ্যা-বন্দনা প্রভৃতি।
ভগবান
শঙ্করাচার্য কৃষ্ণযজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয়োপনিষদের ভাষ্য-ভূমিকাতে বলিতেছেন—"নিত্যকর্ম্মসমূহ
না করিলে প্রত্যবায় হয়—এইরূপ শ্রুতি আছে, এবং প্রত্যবায় শব্দ যেহেতু অনিষ্ঠার্থবোধক।
আর নিত্যকর্ম্মসমূহের অকরণহেতু ভবিষ্যৎ দুঃখরূপ যে প্রত্যবায় হয় উহার পরিহারের জন্য
নিত্যকর্ম্মসমূহের অনুষ্ঠান করিতে হয়।"
মীমাংসকরা
কর্ম্মকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করিয়াছেন- অর্থকর্ম্ম ও গুণকর্ম্ম। এই অর্থকর্ম্ম আবার
তিন প্রকার- নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্য। যে কর্ম্ম নিত্য করা প্রয়োজন অর্থাৎ, যে-কর্ম্ম
অবশ্য করণীয় এবং না করিলে প্রত্যবায় (পাপ) ঘটে, তা হলো নিত্যকর্ম; যেমন সন্ধ্যাবন্দনাদি
প্রার্থনা করা নিত্যকর্ম। যাবজ্জীবন কেহই সমগ্র অঙ্গের সাথে কর্ম্মানুষ্ঠান করিতে পারেন
না। সমর্থ থেকে কর্ম্মানুষ্ঠানের অঙ্গহানি করা চলিবে না। তবে অসমর্থ ব্যক্তির পক্ষে
প্রধান কর্ম অনুষ্ঠিত হইলেও কর্ম সম্পন্ন হইবে। তাই মীমাংসাসূত্রে মহর্ষি জৈমিনি বলিতেছেন-
‘অপি
বাপ্যেকদেশে স্যাৎ প্রধানে হ্যর্থনির্বৃত্তির্গুণমাত্রমিতরত্তদর্থত্বাৎ।’-(মীমাংসাসূত্র-৬/৩/২)
অর্থাৎ
কর্ম্মের একদেশ, অর্থাৎ প্রধান অংশ অনুষ্ঠিত হলেই নিত্যকর্ম্ম সিদ্ধ হয়। তাতেই প্রত্যবায়-পরিহার
হয়ে থাকে। অন্যান্য অঙ্গগুলি গুণমাত্র। যেহেতু সেগুলি স্বর্গাদি ফলের নিমিত্ত অনুষ্ঠিত
হয়ে থাকে।
এখন
প্রশ্ন নিত্যাদি কর্ম্মের কি প্রয়োজন? উত্তর হইল চিত্তশুদ্ধি, যথা—"এতেষাং নিত্যাদীনাং
বুদ্ধিশুদ্ধিঃ পরং প্রয়োজনম্"-(বেদান্তসার-১৩) অর্থাৎ এই সকল নিত্যাদি কর্মের
প্রধান প্রয়োজন বুদ্ধিকে শুদ্ধ করা।
আচার্য
শঙ্কর ভগবদ্গীতার (৩/৪) ভাষ্যে বিষয়টা আরও স্পষ্ট করিতেছেন—কর্ম্মনিষ্ঠা চিত্তশুদ্ধি
দ্বারা জ্ঞাননিষ্ঠা বা পুরুষার্থের সাধক হয়। কর্মনিষ্ঠা জ্ঞাননিষ্ঠার হেতু বলিয়া পরতন্ত্রভাবে
পুরুষার্থের কারণ হয়, স্বতন্ত্রভাবে নহে। এই অর্থ দেখাইবার জন্য ভগবান বলিতেছেন- সত্ত্বশুদ্ধি
ও জ্ঞানোৎপত্তিদ্বারা জ্ঞাননিষ্ঠার হেতু যজ্ঞাদি কর্ম্মসকলের অনারম্ভ অর্থাৎ প্রারম্ভ
না করিয়া পুরুষ ইহজন্মে বা জন্মান্তরে নৈষ্কর্ম্যভাব অর্থাৎ কর্ম্মশুন্যতা ও নিষ্ক্রিয়
আত্ম-স্বরূপে অবস্থিতি প্রাপ্ত হয় না। আবার কেবলমাত্র সন্ন্যাস অর্থাৎ জ্ঞানশূন্য কর্ম্মত্যাগ
হইতে সিদ্ধি অর্থাৎ নৈষ্কর্ম্যলক্ষণা জ্ঞানযোগনিষ্ঠা সম্যক্ রূপে অধিগত হয় না। শ্রুতিতেও
বলা হইতেছে-“এই আত্মাকে ব্রাহ্মণেরা বেদাধ্যয়ন এবং যজ্ঞের দ্বারা জানিতে ইচ্ছা করেন।”-(বৃহদারণ্যক
উপনিষদ-৪।৪।২২)
মহাভারতেও অন্যত্র বলা হইতেছে-“পুরুষের পাপের ক্ষয় হইলে জ্ঞান অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধি দ্বারা জ্ঞানাভ্যাস যোগ্যতা উৎপত্তি হয়।”-(শান্তিপর্ব-২০৪।৮)........
No comments:
Post a Comment