Tuesday, 31 May 2022

শঙ্করাচার্যের মত মায়াবাদ ও প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধশাস্ত্র, বিরুদ্ধবাদীদের এই দাবির খণ্ডনঃ-

 


পূর্বপক্ষঃ- পদ্মপুরাণে উত্তরখণ্ডে ৯৩ অধ্যায়ে রুদ্র স্বয়ং দেবীকে বলিতেছেন-রুদ্র উবাচ--শৃণু দেবী প্রবক্ষ্যামি তামসানি যথাক্রমম্।.......নিরীশ্বরেণ বাদেন কৃতং শাস্ত্রং মহত্তরম।।

এইস্থলে দেখা যায়,বলা হইতেছে-

(১) জ্ঞানিগণের পাতিত্যকারক যে সকল তামসশাস্ত্র, তাহারা শৈব, পাশুপত, বৈশেষিক, ন্যায়, সাংখ্য, চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈনশাস্ত্র।

(২) মায়াবাদটি অসৎশাস্ত্র ও প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধশাস্ত্র।

(৩) ইহা ব্রাহ্মণরূপী রুদ্রকর্তৃক কলিতে কথিত।

(৪) ইহাতে শ্রুতিবাক্যের অন্যথা করা হইয়াছে, কর্মের ত্যাগ উপদিষ্ট হইয়াছে, জীব ও ঈশ্বরের ঐক্য উক্ত হইয়াছে, ব্রহ্মকে নির্গুণ বলা হইয়াছে ইত্যাদি।

উত্তরপক্ষঃ- ভগবান শঙ্করের মত মায়াবাদ নহে-কিন্তু ব্রহ্মবাদ বা ঔপনিষদবাদ। এস্থলে ব্রাহ্মণরূপী রুদ্র মায়াবাদপ্রচারকর্তা বলিয়া নির্দেশ থাকায় বৈষ্ণবগণ আচার্য শঙ্কর ও তাঁহার মতবাদ বলিয়া বুঝিয়া থাকেন। কিন্তু শঙ্করসম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিগণ বলেন- ইহাতে আচার্য শঙ্করের ব্রহ্মবাদ লক্ষ্য করা হয় নাই।কারণ, শঙ্করের মতবাদটি মায়াবাদই নহে; উহা ব্রহ্মবাদ। যেহেতু শঙ্কর নিজ বেদান্তসূত্রভাষ্যে (২/২/৯) সূত্রের ভাষ্যে নিজেই বলিয়াছেন- 'জ্ঞানশক্তিও সাংখ্য অনুমান করিলে প্রতিবাদকার্য হইতে তিনি নিবৃত্ত হইলেন,আর তখন এক চেতনই অনেকস্বরুপ জগৎ প্রপঞ্চের উপাদান হইল এইরুপে ব্রহ্মবাদই স্বীকার করা হইল।' বস্তুতঃ শঙ্করমতকে মায়াবাদ বলা হয়, তাহা বিপক্ষগণের কথা। বৈষ্ণবগণ প্রবল হইয়া শঙ্কর সম্প্রদায়কে যাহা বলিয়া নিন্দা করিতেন, শঙ্করসম্প্রদায়ের অজ্ঞব্যক্তিগণ তাহা নিন্দার সূচক না বুঝিয়া নিজেকেই তাই বলিয়া নির্দেশ করিতে লাগিল। পরে প্রসিদ্ধি অনুরোধে বিজ্ঞেও তাহাই বলিতে লাগিলেন।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শঙ্করমতকে মায়াবাদ বলাই যায় না। কারণ, যে মতে যাহাকে সর্বমূলতত্ত্ব বলিয়া নির্দেশ করা হয়, তাহারই নামে সেই মতবাদের নামকরণ করা হয়। যেমন- শিব শক্তি বিষ্ণু প্রভৃতি যে যে মতে মূলতত্ত্ব বলা হয়, সেই সেই মতের নাম শৈব শাক্ত বৈষ্ণব প্রভৃতি। শঙ্করমতে জগৎ মিথ্যা (আবার এ মিথ্যা মানে অলীক বা অসৎ মনে করবেন না।) অর্থ্যাৎ মায়া, সত্য একমাত্র ব্রহ্ম। তাহাই সকলের মূলতত্ত্ব। এই ব্রহ্মে এই জগৎ কল্পিত বলিয়া জগৎ মিথ্যা বলা হয়। সুতরাং মায়া মূলতত্ত্ব নহে, প্রত্যুত ব্রহ্মই মূলতত্ত্ব। এজন্য শঙ্করমতকে ব্রহ্মবাদই বলা সঙ্গত।অন্যত্র বহু স্থলে মীমাংসক ও ন্যায়াচার্যগণ এবং স্বমতের আচার্যগণ ইহাকে ঔপনিষদবাদ নামে আখ্যাত করিয়াছে। এজন্য কুসুমাঞ্জলি, শাস্ত্রদীপিকা এবং মধুসূদনী প্রভৃতি গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।

বিরুদ্ধবাদিগণের ইহাকে মায়াবাদ বলিবার কারণ এই যে, ইহার সঙ্গে বৌদ্ধমতের কিঞ্চিৎ সাদৃশ্য আছে।সে সাদৃশ্য এই যে, বৌদ্ধগণ জগৎকে অসতে অর্থ্যাৎ শূন্যে, মায়া বা অবিদ্যাকল্পিত বলিয়া থাকেন, সুতরাং বৌদ্ধমতেও জগৎ নাই। শঙ্করমতে জগৎ সতে অর্থাৎ ব্রহ্মে মায়াকল্পিত বলিয়া পরমার্থতঃই নাই।এখন জগতের না থাকা অংশে বা কল্পিতত্ব অংশে ঐক্যই একটু সাদৃশ্য বলিতে হইবে। বৈষ্ণবাদি বিপক্ষগণ এই সাদৃশ্য অংশকে লক্ষ্য করিয়া নিজমতে নিষ্ঠার বৃদ্ধি উদ্দেশ্যে পরমতের নিন্দা করিয়া ইহাকে মায়াবাদ বলিয়াছেন। বস্তুতঃ বৌদ্ধমতে জগৎকল্পনার অধিষ্ঠান অর্থ্যাৎ মূলতত্ত্ব অসৎ বা শূন্য এবং শঙ্করমতে সেই অধিষ্ঠান বা মূলতত্ত্ব সৎ ব্রহ্ম,আর তাহাতে এই দুই মতের যে অত্যন্ত বিরোধ তাহা কেহই অস্বীকার করিতে পারেন না। অতএব মায়াবাদ শঙ্করের বাদ নহে। শঙ্কর যদি জগতের মূলতত্ত্ব বা অধিষ্ঠানকে মায়া বা শূন্য বলিতেন তাহা হইলে তাঁহার মতবাদ মায়াবাদ হইত। যেহেতু মূলত্ত্বানুসারেই মতবাদের নামকরণ হয়-ইহাই রীতি। মায়া উভয় মতেই নিমিত্তকারণ বটে, কিন্তু তাই বলিয়া তাহা যে অধিষ্ঠানরুপ উপাদান কারণ, তাহা শঙ্কর বলেন নাই। বৌদ্ধমতে উপাদানরুপ এই অধিষ্ঠান স্বীকার করা হয় না, তাঁহাদের মতে নিরধিষ্ঠান ভ্রম স্বীকার করা হয়। অতএব পদ্মপুরাণের এই নিন্দা প্রকৃতপক্ষে শঙ্করমতের নিন্দা নহে, পরন্তু অন্য কোন মতবাদের নিন্দা। পরবর্তী বিপক্ষগণ শঙ্করমতে এইরুপ মায়াবাদত্ব আরোপ করিয়া নিন্দা করিয়া থাকেন মাত্র।

তাহাদের যুক্তি অনুসারে তাহারাই বিপদে পড়ে চৈতন্যস্বরুপ আত্মার জ্ঞানরুপে পরিণাম স্বীকার করায়, রামানুজ জৈনমতের প্রভাবে প্রভাবিত হইয়াছেন বলিয়া মনে করার সঙ্গত কারণ আছে। সর্বদর্শনসংগ্রহে মাধবাচার্য মধ্বের মুখে ভেদাভেদবাদী রামানুজকে জৈন পদাঙ্কনুসারী বলিতে কুন্ঠিত হন নাই। রামানুজ যে পাঞ্চরাত্রমতাবলম্বী,সেই পাঞ্চরাত্র মত সম্বন্ধে বরাহ পুরাণে ৬৬ অধ্যায়ে আছে--

অলভা বেদমন্ত্রাণাং পাঞ্চরাত্রোদিতেন হি....শুদ্রাদীনান্ত ন শ্রোতপদবী মুপাযাস্যতি।।১২ তাহার পর অপরাপর পুরাণ মধ্যে আছে- পাঞ্চরাত্রং ভাগবতং তন্ত্রং-----এবং বিধানি চান্যানি মোহনার্থানি তানি তু।।।

কুর্ম ১১ অধ্যায়, সুতসংহিতা ৪র্থ মুক্তিখণ্ড এইরুপ পুরাণজাতীয় অপরাপর বহু গ্রন্থেই ভাগবত ও রামানুজমতের বহু নিন্দা আছে। যাহা হউক ইহা হইতে জানা যায়--

(১) বেদমন্ত্র লভ্য না হইলে পাঞ্চরাত্র আচারে ভগবান লাভ।

(২) পাঞ্চরাত্রমত ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের জন্য,শূদ্রের জন্য নহে।

(৩) পাঞ্চরাত্র ভাগবত ও বৈখানসতন্ত্র বেদভ্রষ্টের জন্য বিষ্ণু উপদেশ করিয়াছেন।

(৪) পাঞ্চরাত্রাদির বেদমূলকত্ব নাই ।

(৫) পাঞ্চরাত্রাদি শাস্ত্র মোহনার্থ রচিত।

(৬) ভাগবত ও সাত্ত্বত শাস্ত্র অভিন্ন।

(৭) ইহা কুণ্ড ও গোলকগণের জন্য অভিপ্রেত।কুণ্ড অর্থ--পতিসত্ত্বে জারজ পুত্র এবং গোলক অর্থ--পতি মরণান্তে জারজ পুত্র।।

এদিকে অদ্বৈতমতে জগৎকে বলা হয় মিথ্যা অর্থ্যাৎ অনির্বচনীয়। কেবলমাত্র জগতের ব্যবহারিক সত্যতাই এই মতে স্বীকৃত হইয়া থাকে। দ্বৈতবাদীও এই ব্যবহারিক সত্তার বাহিরে যাইতে পারেন না। আর, ব্যবহারিক সত্তাতো প্রাতিভাসিক সত্তারই সামগ্রিক উন্নতর সংস্করণমাত্র। এই অবস্থায় বিজ্ঞানে বিজ্ঞেয় বিষয়ের প্রাতিভাসিক সত্তা দ্বৈতবাদীকেও নত মস্তকে স্বীকার করিতে হইবে। এই প্রাতিভাসিক সত্তার ক্ষেত্রে তাহা হইলে দ্বৈতবাদী, অদ্বৈতবাদী, বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ প্রভৃতি সকলেই একমত। বিজ্ঞেয় বিষয়ের প্রাতিভাসিক সত্তার অতিরিক্ত পারমার্থিক সত্তার প্রশ্নে দ্বৈতবাদের সহিত অদ্বৈত ও বৌদ্ধমতের মতদ্বৈধ আছে সন্দেহ নাই। কিন্তু অন্ততঃ একটি ক্ষেত্রে (প্রাতিভাসিক সত্তার ব্যাখায়) তো সকল মতেরই অনুমোদন রহিয়াছে দেখা গেল। অতএব বিজ্ঞানের আধারে জগৎ কল্পিত,এই সিদ্ধান্তের জন্য অদ্বৈতবেদান্তবাদ ও বিজ্ঞানবাদ যদি অভিন্ন হয়, তবে বিজ্ঞান জ্ঞেয় বিষয়ের প্রাতিভাসিক সত্তা আছে,এইরুপ সিদ্ধান্ত স্বীকার করার জন্য দ্বৈতবাদীকেও বিজ্ঞানবাদী বলিতে আপত্তি কী? দ্বৈতবাদীর অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রকাশত্মযতি তদীয় 'বিবরণে' যে প্রত্যুত্তর দিয়াছেন, ইহাই তাঁহার (প্রকাশত্মযতির) নিগূঢ় রহস্য বলিয়া মনে হয়। প্রকাশত্মযতির বক্তব্যের সহিত আমরা আরও একটু যোগ করিয়া বলিতে পারি- বহির্জগতের বস্তুসত্তা অস্বীকার করার জন্য যদি বিজ্ঞানবাদ ও অদ্বৈতবাদ এক হইয়া যায়,তবে পরিদৃশ্যমান বিশ্বের বাস্তব সত্তা স্বীকার করার জন্য চার্বাক দর্শন ও দ্বৈতদর্শন এক বা অভিন্ন হইয়া যায় না কেন? দ্বৈতবাদীরা কি নিজেদের চার্বাকপন্থী বলিতে রাজি হইবেন?

আর শঙ্করকে, চার্বাকমতপ্রবর্তক বৃহস্পতি অথবা বৌদ্ধমতপ্রবর্তক বুদ্ধের ন্যায় দৈত্যবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিগণকে মোহিত করিবার জন্য রুদ্রাবতার বলিতে পারা যায় না। কারণ, তাঁহার প্রচারিত মত ব্যাসদেবেরই পুরাণমধ্যে বিস্তৃতভাবে বর্ণিত। পুরাণাদিমধ্যে বৌদ্ধ বা চার্বাকমত থাকিলেও তাহাতে অশ্রদ্ধা উৎপাদনের জন্য সেই পুরাণমধ্যেই বলা হইয়াছে। কিন্তু শঙ্করমতের সম্বন্ধে সে চেষ্টা করা হয় নাই। যে পুরাণে শঙ্করমত উক্ত তাহাতে তাহার নিন্দা নাই। যে পুরাণে অন্যমত বর্ণিত, তাহাতেই নিন্দা আছে। অতএব এইরুপ যে মতনিন্দা তাহা মতবিশেষে শ্রদ্ধা উৎপাদনের জন্য, তাহা কোন মতের নিন্দার জন্য নহে।

(ঋণঃ- স্বামীচিদঘনানন্দ পুরী ও মহামহোপাধ্যায় আশুতোষ শাস্ত্রী, কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ স্কলার, এম-এ পিএইচডি, বিদ্যাবাচস্পতি।)

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...