শ্রীরামানুজাচার্য ব্রহ্মসূত্রের ‘শ্রীভাষ্যে’ অদ্বৈতবেদান্তোক্ত অবিদ্যার বিরুদ্ধে সাতটি আপত্তি (দোষ) উত্থাপিত করেছেন। এই সাতটি আপত্তি ‘সপ্তধা অনুপপত্তি’ নামে দার্শনিক পণ্ডিত সমাজে পরিচিত। তবে রামানুজ পরবর্তী অদ্বৈতবাদী আচার্যরা ঐসব আপত্তির খণ্ডনও দিয়েছেন। রামানুজাচার্যের প্রথম অনুপপত্তিটি হলো আশ্রয়ানুপপত্তি।
(১) "আশ্রয়ানুপপত্তির খণ্ডন"—
ক.
ব্রহ্মাশ্রয়ানুপপত্তি-
পূর্বপক্ষ— রামানুজাচার্যের
মতে অদ্বৈতবেদান্তী জ্ঞানরূপ ব্রহ্মকে যে অজ্ঞানের আশ্রয়
বলে সিদ্ধান্ত করেছেন তা সঙ্গত হয়
নি। কেননা, জ্ঞান ও অজ্ঞান আলোক
ও অন্ধকারের মত পরস্পর বিরোধী
পদার্থ। অর্থাৎ অন্ধকারের নাশক আলোক যেমন অন্ধকারের আশ্রয় হয় না, ঠিক তেমনি অজ্ঞানের নাশক বিশুদ্ধ জ্ঞানও সেরূপ অজ্ঞানের আশ্রয় হতে পারে না।
উত্তরপক্ষ— আচার্য
রামানুজোক্ত এই অনুপপত্তি বিশ্লেষণ
করলে সুধী পাঠক দেখতে পাবেন যে, তিনি অজ্ঞানকে জ্ঞানের অভাব বলে বুঝেছেন। ঘট ও ঘটাভাব
যেমন একজায়গায় থাকে না, জ্ঞান এবং জ্ঞানাভাবও সেরূপ একত্র থাকতে পারে না। রামানুজ স্বামী অজ্ঞান, অবিদ্যা প্রভৃতি শব্দে 'ন'এর বা
অকারের প্রয়োগ দেখেই এরূপ অনুপপত্তির জালে জড়িয়ে পড়েছেন এবং অজ্ঞানকে জ্ঞানের প্রাগভাব বলেই ব্যাখ্যা করেছেন। জ্ঞানের প্রাগভাবের অতিরিক্ত অনাদি ভাবরূপ অজ্ঞান যা প্রত্যক্ষ, অনুমান
প্রভৃতির সাহায্যে অদ্বৈতবেদান্তী নিঃসংশয়ে প্রমাণ করেছেন, তা রামানুজ স্বামীর
অন্তর স্পর্শ করে নি। এই সত্ত্বরজস্তমো-গুণময়ী
ভাবরূপ অবিদ্যাকে জগজ্জননী ব্রহ্মশক্তিরূপে অদ্বৈতবাদী গ্রহণ করেছেন। জগৎপ্রসবিনী এই মহাশক্তিকে অভাবরূপ
বলা যায় কি? অভাব বিশ্বের পরিণামী উপাদান হতে পারে কি?
পূর্বপক্ষ—ব্রহ্মশক্তি
অবিদ্যা বা অজ্ঞান যে
অভাবরূপ নয়, তা বুঝা গেল।
এখন কথা এই, অদ্বৈতবাদীর সিদ্ধান্ত অনুসারে 'অবিদ্যা বিদ্যাবিরোধী ভাবরূপ বস্তু', এটা স্বীকার করলেই বা বিদ্যাকে বিদ্যাবিরোধী
অবিদ্যার আশ্রয় ও বিষয় বলে
গ্রহণ করা যাবে কিরূপে? জ্ঞানাভাবের কথা ছেড়ে দিলেও জ্ঞানস্বরূপ পরব্রহ্মের সহিত অজ্ঞানের বিরোধ থাকায়, জ্ঞানময় ব্রহ্মকে কোনমতেই অজ্ঞানের আশ্রয় বলা চলে না—"জ্ঞানস্বরূপস্য ব্রহ্মণো বিরোধাদেব নাজ্ঞানাশ্রয়ত্বম্।"-(শ্রীভাষ্য)
উত্তরপক্ষ— রামানুজাচার্যের
এইরূপ আপত্তির উত্তরে মধুসূদন সরস্বতী অদ্বৈতসিদ্ধিতে বলেছেন—
"ননু কথং চৈতন্যমজ্ঞানাশ্রয়ঃ; তস্য প্রকাশস্বরূপত্বাৎ, তয়োশ্চ তমঃ প্রকাশবদ্ বিরুদ্ধস্বভাবত্বাদিতি চেন্ন, অজ্ঞানবিরোধি জ্ঞানং হি ন চৈতন্যমাত্রম্,
কিন্তু বৃত্তিপ্রতিবিম্বিতম্; তচ্চ নাবিদ্যাশ্রয়ঃ, যচ্চাবিদ্যাশ্রয়ঃ, তচ্চ নাজ্ঞানবিরোধি।"-(অদ্বৈতসিদ্ধিঃ)
অর্থাৎ
জ্ঞান এবং অজ্ঞান আলোক ও অন্ধকারের মত
পরস্পর বিরুদ্ধ হলেও, অজ্ঞানবিরোধী জ্ঞান চৈতন্যমাত্রই নয়, কিন্তু অন্তঃকরণ-বৃত্তিতে প্রতিফলিত চৈতন্য। ঐ বৃত্তিপ্রতিবিম্বিত চৈতন্যই অজ্ঞানের
বিরোধী হয়ে থাকে। বৃত্তিপ্রতিফলিত ঐ চৈতন্য অজ্ঞানের
আশ্রয় নয়। শুদ্ধ পরব্রহ্ম চৈতন্যই অজ্ঞানের আশ্রয়। এই আশ্রয় শুদ্ধ
চৈতন্য অজ্ঞানের বিরোধী নয়।
পূর্বপক্ষ— জ্ঞান
যদি অজ্ঞানের বিরোধী হয়, তবে জ্ঞানের জ্ঞানত্বই অজ্ঞানের বিরোধিতার হেতু হবে। শুদ্ধ ব্রহ্মজ্ঞানেও জ্ঞানত্ব আছে, বৃত্তিপ্রতিবিম্বিত জ্ঞানেও জ্ঞানত্ব আছে। এই অবস্থায় বৃত্তিপ্রতিফলিত
জ্ঞান অজ্ঞানের বিরোধী হবে, শুদ্ধ ব্রহ্মবিজ্ঞান অজ্ঞানের বিরোধী হবে না, আশ্রয় হবে, এরূপ অদ্বৈতবাদীর সিদ্ধান্ত কিরূপে নির্বিবাদে গ্রহণ করা যায়। "জ্ঞানস্বরূপংব্রহ্মেতি জ্ঞানমবিদ্যায়া বাধকং, ন স্বরূপভূতং জ্ঞানমিতি
চেন্ন, উভয়োরপি ব্রহ্মস্বরূপপ্রকাশত্বে সত্যন্যতরস্য অবিদ্যাবিরোধিত্বম্ অন্যতরস্য নেতি বিশেষানবগমাৎ। জ্ঞানমজ্ঞানবিরোধি চেৎ স্বয়মেব বিরোধি ভবতীতি নাস্যা ব্রহ্মাশ্রয়ত্ব সম্ভবঃ।"-(শ্রীভাষ্য)
উত্তরপক্ষ— এই
অনুপত্তি বিরুদ্ধে অদ্বৈতবাদী বলেন, জ্ঞানের অজ্ঞানবিরোধিতায় জ্ঞানত্বই হেতু নয়, জ্ঞানের বৃত্তিসম্পর্কই হেতু বলে জানবে। অন্তঃকরণবৃত্তিতে প্রতিফলনের ফলে জ্ঞানে এক বিশেষ শক্তির
সঞ্চারিত হয় এবং ঐ শক্তির সঞ্চারবশতঃই
জ্ঞানে অজ্ঞানবিরোধিতা স্ফূর্তিলাভ করে। এমন কি চরম অদ্বয়
ব্রহ্মজ্ঞানের ক্ষেত্রেও 'ব্রহ্ম জ্ঞানস্বরূপ", এই বৃত্তিবোধই ব্রহ্মতিরস্করণী
অবিদ্যার বিলয়ের কারণ হয়ে থাকে। অবিদ্যার আশ্রয় এবং ভাসক শুদ্ধচৈতন্য যখন বৃত্তি প্রতিবিম্বিত হয়, তখন তাই অজ্ঞানের বিলুপ্তি ঘটায়। জ্ঞানের অজ্ঞান-নাশকতা-শক্তির সঞ্চার বৃত্তিতে প্রতিবিম্বনের ফলেই আত্মপ্রকাশ লাভ করে। এজন্যই অদ্বৈতসিদ্ধান্তে জ্ঞানকে (জ্ঞানত্বকে) অজ্ঞানের নাশক না বলে, জ্ঞানের
বৃত্তি সম্পর্ককেই অজ্ঞানের নাশক বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বৃত্তিজ্ঞানই অজ্ঞানের নিবৃত্তি ঘটায় —"বৃত্তিজ্ঞানেনৈবাজ্ঞাননিবৃত্তিঃ।"
শতভূষণী দ্রষ্টব্য।
পূর্বপক্ষ—যদি
মূল ব্রহ্ম চৈতন্যের সহিত অজ্ঞানের বিরোধিতা নাই থাকে তবে ব্রহ্মচৈতন্য প্রকাশস্বরূপ কিনা, এরূপ আশঙ্কা স্বাভাবিক নয় কি?
উত্তরপক্ষ—প্রতিবাদীর
এরূপ প্রশ্নের উত্তরে মধুসূদন সরস্বতী অদ্বৈতসিদ্ধিতে বলেছেন—'সূর্যরশ্মি তৃণ তূলা প্রভৃতিকে প্রকাশিত করে। ঐ সূর্যরশ্মি যখন
সূর্যকান্তমণিতে প্রতিফলিত হয়ে তৃণ তূলা প্রভৃতির উপর পতিত হয়, তখন মণিতে প্রতিফলিত সৌরকিরণ তৃণ, তূলা প্রভৃতিকে দগ্ধ করে। অনুরূপভাবে অজ্ঞানের ভাসক শুদ্ধচৈতন্য যখন অন্তঃকরণবৃত্তিতে প্রতিফলিত হয়, তখন সেই প্রতিফলিত চৈতন্যই অজ্ঞানকে বিনাশ করে।'-(অদ্বৈতসিদ্ধিঃ)
পূর্বপক্ষ—স্বয়ংপ্রকাশ
ব্রহ্ম অজ্ঞানের আশ্রয় হবেন কিরূপে?
উত্তরপক্ষ—এই
প্রশ্নের উত্তরে আনন্দবোধ ভট্টারকাচার্য ন্যায়মকরন্দে বলেছেন—"নহি বয়ং প্রকাশাভাবমবিদ্যামাচক্ষ্মহে
যেন সা প্রকাশাত্মনি ব্রহ্মণি
ন ভবেদিতি; উক্তং হি ন ভাবো
নাপ্যভাবঃ কিন্তু অনির্বাচৈবাবিদ্যা"-(ন্যায়মকরন্দ)
অবিদ্যা
যদি প্রকাশের অভাব হত, তবেই প্রকাশস্বরূপ ব্রহ্মে প্রকাশাভাব অবিদ্যা থাকতে পারত না, অবিদ্যার ব্রহ্মাশ্রয়ত্ব উপপাদন অসঙ্গত হত। অবিদ্যা আমাদের মতে অভাবরূপ নয়, এটা ভাবাভাব-বিলক্ষণ ও অনির্বচনীয়। এই
অনির্বাচ্য অবিদ্যার সাথে ব্রহ্মের স্বতঃ কোন বিরোধ নেই, সুতরাং ব্রহ্মের অবিদ্যার আশ্রয় হতে বাধা কি?
সুতরাং
জ্ঞানস্বরূপ শুদ্ধব্রহ্মের সহিত ব্রহ্মশক্তি অবিদ্যার স্বতঃ কোনও বিরোধ নেই। এই অনাদি মায়াশক্তির
সহায়তায় নির্গুণ সগুণ হন, সৃষ্টি-সংহার লীলার অভিনয় করেন। শুদ্ধ পরব্রহ্মেরও অজ্ঞান বা মায়াশক্তিযোগ অবশ্য
স্বীকার্য। এরূপ মূলাজ্ঞানের ও জ্ঞানময় ব্রহ্মের
কোন বিরোধ নেই। বিরোধ তখনই ঘটে, যখন জ্ঞান ও অজ্ঞান অন্তঃকরণবৃত্তিতে
প্রতিফলিত হয়ে দেখা দেয়।
পূর্বপক্ষ—কি
প্রকারে ইহা অবগত হওয়া যায় যে, পরব্রহ্ম বিচিত্র শক্তিযুক্ত?
উত্তরপক্ষ— ভগবান্
সূত্রকার বলেছেন—'সর্বোপেতা চ তদ্দর্শনাৎ৷' ভগবান্
শঙ্করাচার্য শারীরকমীমাংসা ভাষ্যে বলেছেন— শ্রেষ্ঠ দেবতা (ব্রহ্ম) সর্ব্বশক্তিযুক্ত, এটা অঙ্গীকার করতে হবে। কোন হেতবলে? তা বলছেন—'তদ্দর্শনাৎ' অর্থাৎ যেহেতু তিনি—
'সর্বকর্মা সর্বকামঃ
সর্বরসঃ সর্বমিদমভ্যাত্তোবাক্যনাদরঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৩/১৪/২)
অর্থাৎ তিনি সর্বকর্মা (এই বিশ্ব তাঁর
কর্ম), সর্ববিধ বিশুদ্ধ কামনাবান, সকল প্রকার সুখকর গন্ধযুক্ত, সর্বপ্রকার উত্তম রসযুক্ত, এই সমগ্র জগৎব্যাপিয়া
বর্তমান, বাগিন্দ্রিয় বিবর্জ্জিত এবং নিষ্কাম্।
'সত্যকামঃ সত্যসংকল্পঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৮/৭/১)
অর্থাৎ তিনি সত্যকামও সত্যসঙ্কল্প।
'যঃ সর্বজ্ঞঃ
সর্ববিৎ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১/১/৯)
যিনি সর্বজ্ঞ ও সর্ববিৎ।
'এতস্য
বা অক্ষরস্য প্রশাসনে গার্গি সূর্যাচন্দ্রমসৌ বিধৃতৌ তিষ্ঠতঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩/৮/৯)
'হে গার্গি, এই অক্ষরের (নাশরহিত
পরমেশ্বরের) প্রকৃষ্ট শাসনে সূর্য ও চন্দ্রমা বিধৃত
হয়ে অবস্থান করছে।'
ইত্যাদি
এইজাতীয় শ্রুতি পরদেবতার সকলপ্রকার শক্তির সহিত সম্বন্ধ সেইপ্রকারেই প্রদর্শন করছে। তাছাড়া বহুশ্রুতিবচনই ঘোষণা করে যে, ব্রহ্ম শক্তিমান্। যেমন—
‘মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনং
চ মহেশ্বরম্।-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৪.১০) 'প্রকৃতিকে
মায়া এবং পরমেশ্বরকে মায়াধীশ বলে জানবে।'
যাঁতে
সকলপ্রকার বিশেষ প্রতিষিদ্ধ হয়েছে, সেই ব্রহ্মেরও সকলপ্রকার শক্তির সহিত সম্বন্ধ সম্ভব, ইত্যাদি এটাও অবিদ্যার দ্বারা কল্পিত যে রূপের বিভিন্নতা,
তার উল্লেখের দ্বারা বলা হয়েছে। আর দেখ শাস্ত্রও
'অপাণিপাদো জবনো গ্রহীতা পশ্যত্যচক্ষুঃ স শ্রৃণোত্যকর্ণঃ' -(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৩।১৯) অর্থাৎ 'হস্তপদ না থাকলেও তিনি
দ্রুত গমন করেন, চক্ষুবিহীন হলেও দর্শন করেন, কর্ণবিহীন হলেও শ্রবণ করেন।' এইপ্রকারে করণবিহীন অর্থাৎ দেহেন্দ্রিয়াদিরহিত ব্রহ্মের সকলপ্রকার শক্তির সহিত সম্বন্ধ প্রদর্শন করছেন।
খ.
জীবাশ্রয়ানুপপত্তিঃ-
পূর্বপক্ষ-
জীব অবিদ্যারই সৃষ্টি, অবিদ্যাসৃষ্ট জীব অবিদ্যার আশ্রয় হবে কিরূপে? এতে তো পরস্পরাশ্রয় দোষ
অপরিহার্য হয়।
উত্তরপক্ষ-
উক্ত আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, জীব ও অবিদ্যা উভয়েই
অদ্বৈতমতে অনাদি। অনাদি বস্তুকে উৎপন্ন বলা ব্যবহার মাত্র, তা যথার্থ উৎপত্তি
নয়। দর্পণ ও প্রতিবিম্বের কি
জন্যজনকভাব আছে? তাছাড়া বীজ ও অঙ্কুরের ন্যায়
জীব ও অবিদ্যার অনাদি
পরস্পরাশ্রয়তা দোষাবহ নয়। বীজ হতে বৃক্ষ হয় এবং বৃক্ষ হতে বীজ হয়, আর সেই বীজ
বৃক্ষের আশ্রয় হয় এবং বৃক্ষও বীজের আশ্রয় হয়, এতে কি অন্যোন্যাশ্রয় দোষ
হয়? অনাদি বস্তুতে এ দোষ হয়
না। তাছাড়া জীবের ব্রহ্মবিষয়ে অনাদি অজ্ঞান দেখতে পাওয়া যায়, সুতরাং জীব অজ্ঞানের আশ্রয়। বাচস্পতি মিশ্র বলেন—"নচ অবিদ্যোপাধিভেদাধীনোজীবভেদঃ, জীবভেদাধীনশ্চ অবিদ্যোপাধিভেদ ইতি পরস্পরাশ্রয়াদুভয়াসিদ্ধিরিতি
সাম্প্রতম্। অনাদিত্বাদ্ বীজাঙ্কুরবদুভয় সিদ্ধেঃ।"-(ভামতী-১।৪।৩)
সুতরাং
রামানুজাচার্যের আশ্রয়ানুপপত্তির মূলে যে কোন বলিষ্ঠ
প্রমাণ নেই, উপরের আলোচনা হতে সুধীপাঠক তা সহজেই বুঝতে
পারবেন।
(২) তিরোধানানুপপত্তির খণ্ডনঃ-
পূর্বপক্ষঃ- প্রকাশের তিরোধান অর্থে প্রকাশের অনুৎপত্তি অথবা প্রকাশের নাশকে বুঝায়। প্রকাশস্বরূপ ব্রহ্ম যখন উৎপন্ন বস্তু নয়, তখন প্রকাশ-তিরোধান বললে প্রকাশের নাশকেই বুঝাবে। স্বপ্রকাশ পরব্রহ্মের বিনাশ অবশ্য কোনমতেই কল্পনা করা চলে না। অতএব প্রকাশের তিরোধানও সম্ভবপর হয় না।
অবিদ্যা ব্রহ্মকে আবৃত (তিরোহিত) করে কিরূপে? স্বপ্রকাশ পরব্রহ্মের তিরোধান সম্ভবই বা হয় কিরূপে?শ্রীভাষ্যে বলা হইয়াছে-‘নিত্যমুক্ত-স্বপ্রকাশজ্ঞানস্বরূপস্যাবিদ্যোপাধি তিরোধানাসম্ভবাৎ। তিরোধানং নাম বস্তুস্বরূপে বিদ্যমানে তৎপ্রকাশনিবৃত্তিঃ। প্রকাশ এব বস্তুস্বরূপম্ ইত্যঙ্গীকারে তিরোধানাভাবঃ স্বরূপনাশো বা স্যাৎ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২২) অর্থাৎ নিত্যমুক্ত ও নিত্যপ্রকাশময় জ্ঞানস্বভাব ব্রহ্মের অবিদ্যা-জনিত আবরণের অপগম সম্ভব হয় না। কেননা, তিরোধান অর্থ- বস্তুর স্বরূপ বিদ্যমান সত্ত্বেও তাহার প্রকাশ বা প্রতীতিযোগ্যতা নিবৃত্তি, (উচ্ছেদ নয়); অতএব, ‘প্রকাশই ব্রহ্মের স্বরূপ’ একথা স্বীকার করলে হয় আবরণের অভাব, না হয়, ব্রহ্মেরই স্বরূপোচ্ছেদ হয়ে যেতে পারে।
সিদ্ধান্তঃ-
তিরোধান শব্দের স্বেচ্ছানুরূপ দ্বিবিধ অর্থ কল্পনা করে
অদ্বৈত সিদ্ধান্তে অনুপপত্তি প্রদর্শন ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। প্রকাশের তিরোধান শব্দের প্রকৃত অর্থ, প্রকাশের বিনাশ নয়, প্রকাশের স্ফুর্তি
না হওয়া। গাঢ় মেঘের আবরণে
সূর্য তিরোহিত হলে, প্রকাশময় সূর্য
বিনষ্ট হয়েছে, কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি
এরূপ মনে করেন কি?
মেঘের আবরণবশতঃ সূর্য প্রকাশ পাচ্ছে না, বায়ুবেগে মেঘ
অন্তর্হিত হলেই সূর্য দৃষ্টিগোচর
হবে। এক্ষেত্রেও অবিদ্যার আবরণে আবৃত ব্রহ্ম জীবের
দৃষ্টিতে প্রতিভাত হচ্ছে না, প্রকাশ পাচ্ছে
না, এরূপ মনে করাই
স্বাভাবিক। ব্রহ্মের এই তিরস্করনী অবিদ্যা
বিদ্যার উদয়ে অন্তর্হিত হলে, জ্ঞানময় ব্রহ্ম
পূর্ণসচ্চিদানন্দরূপেই বিরাজ করবেন। জীব এবং শিবের
মধ্যে অজ্ঞানের যবনিকা যে বিভেদের সৃষ্টি
করেছে, ঐ যবনিকা সরে
গেলে, জীব নিজের শিবভাব
প্রত্যক্ষ করে ধন্য হবেন।
শঙ্কাঃ-
প্রকাশই যার স্বরূপ, তার
সেই স্বরূপ কোন কারণেই আবৃত
হতে পারে না, আবৃত
হলে তার স্বরূপই নষ্ট
হয়ে যায়। সুতরাং স্বপ্রকাশের আবরণ কিরূপে সম্ভবপর
হয়?
উত্তরঃ-
প্রতিবাদীর এই প্রশ্নের উত্তরে
অদ্বৈতবেদান্তী বলেন, প্রকাশস্বরূপ ব্রহ্মের যথার্থ আবরণ হয় না,
এটা সত্য কথা। তবে,
স্বয়ংজ্যোতিঃ ব্রহ্মের কল্পিত আবরণ অসম্ভব নয়।
এই কল্পিত অজ্ঞানাবরণবশতঃ 'ব্রহ্ম ন প্রকাশতে', এরূপ
ব্যবহারও সম্ভবপর। সূর্য মেঘের আবরণে আবৃত হলে, আকাশে
সূর্য নেই, সূর্য দেখা
যাচ্ছে না, প্রকাশিত হচ্ছে
না, এরূপ ব্যবহার পণ্ডিত
মূর্খ সকলেই করেন। তমঃস্বভাবা অবিদ্যার আবরণে আবৃত পরিপূর্ণ স্বয়ংজ্যোতিঃ
সম্পর্কেও 'ব্রহ্ম ন ভাতি ন
প্রকাশতে', এইপ্রকার ব্যবহার অজ্ঞানান্ধ জীব করবে, তাতে
আর আশ্চর্য কি? এই ব্যবহার
অবিদ্যার কার্য। স্বয়ংপ্রকাশ ব্রহ্মে 'ন প্রকাশতে', এরূপ
ব্যবহারের যোগ্যতা সম্পাদনই ব্রহ্মের আবরণ, পরব্রহ্মের তিরোধান প্রভৃতিরূপে অদ্বৈতবেদান্তে ব্যাখ্যাত হয়েছে। "নাস্তি ন প্রকাশত ইতি
ব্যবহার এবাভিজ্ঞাদিসাধারণঃ, অস্তি প্রকাশতে ইতি ব্যবহারাভাবো বা
আবরণকৃত্যম্। আবরণমহিমৈব পরিপূর্ণং ব্রহ্ম নাস্তি ন প্রকাশত ইতি
ব্যবহারঃ, অস্তি প্রকাশত ইতি ব্যবহার প্রতিবন্ধশ্চ।"-(অদ্বৈতসিদ্ধি দ্রষ্টব্য)
শঙ্কাঃ-
কিপ্রকারে স্বরূপের নাশ ব্যাতিরেকেই একব্রহ্মে
অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি হবে?
উত্তরঃ-
ব্রহ্মসূত্রের (২।১।২৭) সূত্রভাষ্যে ভগবান্ শঙ্করাচার্য বলেছেন—"অবিদ্যার দ্বারা কল্পিত রূপের বিভিন্নতা অঙ্গীকার করা হয়।"
তাছাড়া
'আত্মনিচৈবং বিচিত্রাশ্চ হি৷'-(২.১.২৮)
সূত্রের ভাষ্যে ভগবান্ ভাষ্যকার স্পষ্ট করেছেন—আর দেখ এই
বিষয়ে বিবাদ করা উচিত নয়
যে, কিপ্রকারে স্বরূপের নাশ ব্যাতিরেকেই একব্রহ্মে
অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি হবে? যেহেতু—
''ন
তত্র রথা ন রথযোগা
ন পন্থানো ভবন্ত্যথ রথান্রথযোগান্পথঃ সৃজতে'
-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৩/১০)
অর্থাৎ
'সেখানে (স্বপ্নে) রথসকল থাকে না, অশ্বসকল
থাকে না এবং পথসকল
থাকে না অথচ তিনি
রথসকল অশ্বসকল ও পথসকলকে সৃষ্টি
করেন।'
ইত্যাদি শ্রুতিবাক্যের দ্বারা স্বপ্নদর্শী এক আত্মাতেও স্বরূপের নাশ ব্যাতিরেকেই অনেকপ্রকার আকারবিশিষ্ট সৃষ্টি পঠিত হচ্ছে। আর লোকমধ্যেও দেবতা প্রভৃতিতে এবং মায়াবী প্রভৃতিতে স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই হস্তী ও অশ্ব প্রভৃতি বিচিত্র সৃষ্টিসকল পরিদৃষ্ট হচ্ছে। এই প্রকার এক ব্রহ্মেও স্বরূপের নাশ ব্যতিরেকেই অনেকপ্রকার আকার বিশিষ্ট সৃষ্টি হবে।
(৩) স্বরূপানুপপত্তির খণ্ডনঃ-
পূর্বপক্ষঃ-
স্বরূপানুপপত্তি অর্থাৎ অবিদ্যাকে যখন একটা কিছু
বলতে হবে, তখন এটা
হয় সৎস্বরূপ, কিংবা অসৎস্বরূপ। কিন্তু অদ্বৈতমতে এটাকে সৎস্বরূপও বলা হয় না
বা অসৎস্বরূপও বলা হয় না।
বস্তুতঃ যতক্ষণ এটাকে যথার্থ অনর্থকারক ভ্রম এবং ব্রহ্মভিন্ন
না বলা যায়, ততক্ষণ
এটার মায়িকত্বই সিদ্ধ হয় না। মায়াই
তো যত অনর্থের মূল।
অতএব অদ্বৈতমতে অবিদ্যা যে সদসদ্ভিন্নস্বরূপ তাই
উৎপন্ন হয় না। এজন্য
অদ্বৈতমতে অবিদ্যার স্বরূপই অসিদ্ধ। আচার্য রামানুজ তাঁর শ্রীভাষ্যে বলেছেন—"স্বপ্রকাশ চিদ্রূপ পরব্রহ্মের আবরক যে অবিদ্যা-দোষের কথা বলা হয়েছে
সেখানে প্রশ্ন এই, উক্ত অবিদ্যা-দোষ সত্য, না
মিথ্যা? অবিদ্যা সত্য হলে অদ্বৈতবাদ
দ্বৈতবাদে পরিণত হয়, মিথ্যা হলে,
ঐ মিথ্যার মূল হিসেবেও অপর
দোষের কল্পনা আবশ্যক হয়। ফলে 'অনবস্থাদোষ'
অনিবার্যরূপেই দেখা দেয়।
উত্তরপক্ষঃ-
এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবাদী বলেন—'অবিদ্যার স্বরূপই সিদ্ধ হয় না'—এটা
যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ সৎ
এবং অসৎ ভিন্ন যে
কিছু নেই —এটা বলা
যায় না। যা মিথ্যা,
তা সৎও নয় এবং
অসৎও নয়। তাকে সদসদ্ভিন্নই
বলা হয়; কারণ যা
সৎ তার বিনাশ হতে
পারে না এবং যা
অসৎ তার জ্ঞানও হয়
না। যেমন সদ্ ব্রহ্মের
বিনাশ নেই এবং অসৎ
বন্ধ্যাপুত্রের কখনও জ্ঞান হয়
না। 'বন্ধ্যাপুত্র' এই শব্দজন্য যে
জ্ঞান তাও জ্ঞান নয়।
তা বিকল্প নামক বৃত্তিবিশেষ। কিন্তু
রজ্জুতে যে সর্পের জ্ঞান
হয়, সেই জ্ঞানের বিষয়
যে সর্প, সেই সর্প দেখাও
যায় এবং নাইও বটে।
রজ্জুতে সর্প সৎ হলে
তার অন্যথাজ্ঞান হত না এবং
অসৎ হলে দেখাও যেত
না। অতএব অবিদ্যা 'একটা
কিছু' বলে যে তা
হয় সৎ, না হয়
অসৎ হবে এরূপ বলা
যায় না। তারপর যা
মায়িক হবে, তা যে
যথার্থ অনর্থকর হবে বলা হয়েছে,
তাও অসঙ্গত। কারণ, মায়ার অনর্থকারিতা যথার্থ বলবার আবশ্যকতা নেই। মায়াজন্য যে
অনর্থ, তা মায়ারই মত
যথার্থ, মায়ার নাশে তার নাশ
হয়। যথার্থ অনর্থ নেই তথাপি তাকে
যথার্থ মনে করা হয়
—এটাই অদ্বৈতমতে মায়া।
তাছাড়া জগজ্জননী অবিদ্যা পরব্রহ্মেরই শক্তি। পরিদৃশ্যমান বিশ্বপ্রপঞ্চ এই অবিদ্যাশক্তিরই পরিণাম। শক্তি বিশ্বের উপাদান কারণ। সত্ত্বরজস্তমোগুণময়ী অবিদ্যা বা মায়াশক্তি মহৎ, অহঙ্কার প্রভৃতিরূপে পরিণত হয়ে, সমষ্টি-ব্যষ্টিরূপে বিচিত্র বিশ্ব রচনা করে। তন্মধ্যে মহতত্ত্ব বা বুদ্ধিতত্ত্বই মায়াশক্তির প্রথম পরিণাম। বুদ্ধি স্বভাবতঃ স্বচ্ছ, শুদ্ধচৈতন্যের ওটা দর্পণস্বরূপ। স্বচ্ছ ব্যষ্টিবুদ্ধিতে চৈতন্যের যে প্রতিবিম্ব পড়ে, তাই জীব আখ্যা লাভ করে। সমষ্টিবুদ্ধিতে চৈতন্যের প্রতিবিম্বের নাম ঈশ্বর। চিৎস্বরূপ শুদ্ধ বিম্বচৈতন্য নিরাশ্রয় নির্বিষয় হলেও, তার প্রতিবিম্ব জীব বা ঈশ্বর নিরাশ্রয় নির্বিষয় নয়। জীব ও ঈশ্বর বিম্বশুদ্ধচৈতন্যে অধিষ্ঠিত থেকে বিবিধ বিচিত্র বিষয় দর্শন করে, নিজেকেও প্রত্যক্ষ করে। নিরূপাধি শুদ্ধ চৈতন্য তা করে না। অনন্ত বিষয়জালের অন্তরালে অবস্থান করে শুদ্ধ শুদ্ধই থাকে। বিষয়ের উপাধি কালিমা তাঁকে স্পর্শ করে না। ভাবরূপ অবিদ্যা-শক্তির এই পরিণামে অবিদ্যার কোনরূপ স্বাতন্ত্র্য নেই। শুদ্ধ ব্রহ্মকে আশ্রয় করেই অবিদ্যা পরিণাম প্রাপ্ত হয়ে থাকে। পরিণামই অবিদ্যার স্বভাব। অবিদ্যার এই স্বাভাবিক পরিণামে তার অধিষ্ঠান বা আশ্রয় শুদ্ধ চৈতন্য ব্যতীত অপর কোনও প্রেরকের অপেক্ষাও নেই, প্রয়োজনও নেই। সুতরাং শ্রীরামানুজোক্ত মিথ্যা অবিদ্যা-দোষের মূলে অপরাপর দোষের কল্পনা এবং তন্নিবন্ধন অনবস্থার আপত্তির কোনই ভিত্তি দেখা যায় না।
(৪) অনির্বচনীয়ত্বানুপপত্তি খণ্ডনঃ-
পূর্বপক্ষ— আচার্য
রামানুজ শ্রীভাষ্যে বলেছেন, প্রতীতি বা উপলব্ধিই হল
দার্শনিক পদার্থ কল্পনার ভিত্তি। পদার্থের মধ্যে কতগুলো সৎ (সত্য) রূপে, কতগুলো অসৎ (অসত্য) রূপে প্রতীতির গোচর হয়ে থাকে। ভাব ও অভাব, সৎ
ও অসৎ এই দুইপ্রকার পদার্থের
পরিচয় পাওয়া যায়। 'সর্বাচ প্রতীতিঃ সদসদাকারা।'(শ্রীভাষ্য) পদার্থ হয় সত্য হবে, নতুবা অসত্য হবে। সৎও নয়, অসৎও নয়, সদসৎও নয়, এরূপ অনির্বাচ্য পদার্থ কিরূপে কল্পনা করা যায়? মাধ্বতার্কিক ব্যাসরাজও রামানুজোক্ত যুক্তি অনুসরণ করে অনির্বাচ্যবাদ খণ্ডনের প্রয়াস করেছেন। এই অনির্বাচ্য বস্তুর
দার্শনিক চিন্তাজগতে কোন স্থান আছে কিনা? অবিদ্যাকে অনির্বাচ্য বলে অদ্বৈতবেদান্তী যে সিদ্ধান্ত করেছেন,
ঐ সিদ্ধান্ত কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
উত্তরপক্ষ— রামানুজাচার্যের
মতে "সদ্ভিন্নমসৎ, অসদ্ভিন্নং সৎ", অর্থাৎ যা সৎ নয়,
সদ্ভিন্ন তাই অসৎ, এবং যা অসৎ নয়,
অর্থাৎ অসদ্ভিন্ন তাই সৎ বা সত্য।
রামানুজ স্বামী সত্য ও অসত্যের এরূপ
পরস্পর বিরহ ব্যাপক অর্থ প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু অদ্বৈতবাদীর মতে সৎশব্দে পরমার্থ সৎ পরব্রহ্মকে বুঝায়,
অসৎশব্দে অলীক আকাশকুসুম প্রভৃতিকে বুঝায়। অদ্বৈতসিদ্ধান্তে সৎ ও অসৎশব্দ
গোত্ব এবং গোত্বাভাবের মত পরস্পর বিরহব্যাপক
নয়। এরা গোত্ব ও অশ্বত্বের ন্যায়
পরস্পর বিরহব্যাপ্য। 'সত্ত্বাসত্ত্বয়োর্ন পরস্পরবিরহরূপত্বম্, কিন্তু পরস্পরবিরহব্যাপ্যতামাত্রম্।'
(অদ্বৈতসিদ্ধিঃ) অর্থাৎ সৎ ও অসৎ
গোত্ব এবং অশ্বত্বের ন্যায় একত্র থাকে না, তবে গজত্বে গোত্ব ও অশ্বত্ব এই
উভয়েরই অভাব থাকে। পরিদৃশ্যমান এই বিশ্বপ্রপঞ্চ পরব্রহ্মের
ন্যায় সত্যও নয়, আকাশকুসুমের ন্যায় অলীকও নয়। এজন্য বিশ্বপ্রপঞ্চে সৎ এবং অসৎ,
এই উভয়েরই অভাব পাওয়া যায়। এরূপ প্রপঞ্চকেই অদ্বৈতবেদান্তের পরিভাষায় অনির্বাচ্য বলা হয়েছে। এই প্রপঞ্চ এবং
এর মূল অবিদ্যা সত্যব্রহ্মও নয়, অসৎ আকাশকুসুমও নয়। ফলে, প্রপঞ্চ সদসৎও নয়, সদসদ্ভিন্নও নয়। চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত, এটাই অনির্বাচ্যত্বের পরিচয়। এরূপ পরিচয়মূলেই অদ্বৈতসিদ্ধিতে মধুসূদন সরস্বতী ব্যাসরাজের আপত্তির বিরুদ্ধে অনির্বাচ্যত্বের নিম্নোক্ত লক্ষণ নির্বচন করেছেন—"সদ্বিলক্ষণত্বে সতি অসদ্বিলক্ষণত্বে সতি সদসদ্বিলক্ষণত্বম্"। (অদ্বৈতসিদ্ধি) অর্থাৎ
সতের বিলক্ষণ ও অসতের বিলক্ষণ
হয়ে, যা সদসতেরও বিলক্ষণ
হয়, তাই অনির্বাচ্য বলে জানবে। সুতরাং রামানুজ ও শঙ্করের মতে
সৎ ও অসতের অর্থের
(বাচ্যতার) ভেদ স্বীকার করায়, অনির্বাচ্যত্বের বিরুদ্ধে রামানুজাচার্যের অনুপপত্তি ভগবান্ শঙ্করের মতকে স্পর্শ করেনি।
পূর্বপক্ষঃ-
অনির্বাচ্য অবিদ্যায় প্রমাণ কি? এটা তো অদ্বৈতবাদীদের নিছক
কল্পনা মাত্র।
উত্তরপক্ষঃ-
এরূপ প্রশ্নোত্তরে অদ্বৈতবাদী বলেন, প্রত্যক্ষ, অনুমান প্রভৃতিই অনির্বাচ্য অবিদ্যায় প্রমাণ হয়ে থাকে। শুক্তিরজত, রজ্জুসর্প প্রভৃতি স্থলে শুক্তি প্রভৃতি আধারে মিথ্যা রজতের যে প্রত্যক্ষ হয়ে
থাকে, এরূপ প্রত্যক্ষই অনির্বাচ্য অবিদ্যায় প্রমাণ বলে গণ্য হবে। শুক্তির জ্ঞানোদয়ে রজত যখন তিরোহিত হয়, তখন 'মিথৈব রজতমভাৎ' এতকাল পর্যন্ত আমার দৃষ্টিতে মিথ্যা রজতেরই ভাতি হয়েছিল, এরূপ যে প্রত্যক্ষ জ্ঞানোদয়
হয়, সেখানে মিথ্যা শব্দে অনির্বচনীয় রজতকেই বুঝায়।
তাছাড়া
এই অনির্বচনীয় অবিদ্যায়—"নাসদাসীন্নোসদাসীৎ",
"তম আসীত্তমসা গূঢ়মগ্রেঽপ্রকেতম্", ইত্যাদি নাসদীয়সুক্তও প্রমাণ। তাছাড়া এটা নিছক কল্পনা নয়, এটা শ্রুতি সিদ্ধান্ত। অথর্ববেদীয় সর্বসারোপনিষৎ এ বর্ণিত আছে—
"অনাদিরন্তবতী প্রমাণাপ্রমাণসাধারণা
ন সতী নাসতী ন সদসতী স্বয়মধিকা
বিকাররহিতা নিরূপ্যমাণা সতীতরলক্ষণশূন্যা সা মায়েত্যুচ্যতে।"-(সর্বসারোপনিষৎ-১৩)
"শুরু নেই
কিন্তু শেষ আছে, প্রমাণ আছে আবার প্রমাণ নেই, আছে বলা যায় না আবার নেইও
বলা যায় না। সৎ ও অসৎ
একসঙ্গে বলা যায় না, (ব্রহ্ম) স্বয়ং বিকারশূন্য হওয়ায় বিকারের হেতুরূপে নিরূপ্যমান (জ্ঞাত) হলে নেই এবং বিকারের হেতুরূপে নিরূপিত না হলে আছে-এইরূপ লক্ষণশূন্য যা (ভাব) তাই-ই মায়া বলে
কথিত হয়।"
নিম্নে
প্রদর্শিত অনুমানও মিথ্যারজত প্রভৃতি যে অনির্বাচ্য তা
প্রমাণিত করে।
"বিমতং (পক্ষ)
সত্ত্বরহিতত্বে সতি অসত্ত্বরহিতত্বে সতি সত্ত্বাসত্ত্বরহিতম্ (সাধ্য), বাধ্যত্বাদ্দোষপ্রযুক্তভানাদ্বা
(হেতু), যন্নৈবং তন্নৈবং (ব্যতিরেক ব্যাপ্তি), যথা ব্রহ্ম (দৃষ্টান্ত)।" অদ্বৈতসিদ্ধিঃ দ্রষ্টব্য।
বিবাদগোচর মিথ্যা শুক্তিরজত প্রভৃতি সৎও নয়, অসৎও নয়, সদসৎও নয়। সুতরাং শুক্তিরজত প্রভৃতি অনির্বাচ্য। যেহেতু ওটা অধিষ্ঠান শুক্তি প্রভৃতির জ্ঞানোদয়ে বাধিত হয় এবং দোষবশতঃই মিথ্যারজত প্রভৃতির ভাতি হয়ে থাকে। যা অনির্বাচ্য নয় তা কদাচ বাধিত হয় না, সেই বস্তুর ভাতি বা প্রকাশের মূলে কোনরূপ দোষও বিরাজ করে না, যেমন শুদ্ধ নির্বিশেষ পরব্রহ্ম। মিথ্যা শুক্তিরজত যেমন অনির্বাচ্য, তথাকথিত সত্য রজত এবং ওদের মূল অবিদ্যাও অদ্বৈতবাদীর সিদ্ধান্তে অনির্বাচ্য। সুতরাং আলোচ্য অনুমানে সপক্ষ দৃষ্টান্ত সম্ভবপর নয় বলে ব্যতিরেকী দৃষ্টান্তের উপন্যাস করা হয়েছে বুঝতে হবে। এরূপ অনুমানই অনির্বাচ্যত্বে প্রমাণ বলে জানবে—'তস্মাদনুমানমত্রপ্রমাণম্'। অদ্বৈতসিদ্ধিঃ দ্রষ্টব্য।
(৫) প্রমাণানুপপত্তির খণ্ডনঃ-
পূর্বপক্ষ— এতাদৃশ
অবিদ্যার কোন প্রমাণ নেই। অর্থাৎ এটার কি প্রত্যক্ষ, কি
অনুমান এবং কি শব্দ—কোন প্রমাণই নেই। অতএব অবিদ্যা স্বীকারে প্রমাণেরও অনুপপত্তি হয়।
উত্তরপক্ষ— অবিদ্যার
প্রমাণ নেই যে বলা হয়েছে
এটা অসঙ্গত। কারণ, 'আমি অজ্ঞ' এটাই এটার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। 'দেবাত্মশক্তিং স্বগুণৈঃ নিগূঢ়াম্'-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-১.৩) — এইরূপ
প্রভৃতি শ্রুতি এটার শাব্দ প্রমাণ।
পূর্বপক্ষ— অদ্বৈতবাদীর
উল্লিখিত প্রত্যক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বলেন যে, আলোচিত প্রত্যক্ষের দ্বারা জ্ঞানের অভাবই প্রকাশ পায়, অদ্বৈতসম্মত ভাবরূপ অজ্ঞান প্রমাণিত হয় না। অ-জ্ঞান কথাটির
মধ্যে যে 'অ' শব্দটি আছে,
তা নিঃসন্দেহে জ্ঞানের অভাবই ব্যক্ত করে, ভাবরূপ অজ্ঞান প্রতিপাদন করে না। ভাবরূপ অজ্ঞানসাধনে উক্ত প্রত্যক্ষ প্রমাণই নয়, ওটা প্রমাণাভাস।
উত্তরপক্ষ— প্রতিবাদীর
এরূপ মন্তব্যের বিরুদ্ধে অদ্বৈতবাদী বলেন, প্রদর্শিত প্রত্যক্ষের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে হলে অজ্ঞানকে ভাবরূপ বলেই গ্রহণ করতে হবে। 'আমি অজ্ঞ' প্রভৃতি প্রত্যক্ষে জ্ঞানের অভাবই প্রকাশ পায়, এরূপ সিদ্ধান্ত সমর্থন করা চলে না। 'আমি অজ্ঞ' এই প্রকার প্রত্যক্ষের
ক্ষেত্রে স্বীয় অজ্ঞতা জ্ঞাতা সাক্ষাৎসম্বন্ধেই উপলব্ধি করে থাকেন। অভাব সাক্ষাৎসম্বন্ধে জ্ঞাতার জ্ঞানের গোচর হয় না; পরোক্ষভাবেই ভাসে। অভাবের সহিত চক্ষুরিন্দ্রিয় প্রভৃতির মুখ্যতঃ কোনরূপ যোগ ঘটে না। ভূতল প্রভৃতি যে সকল আধারে
অভাবের প্রত্যক্ষ হয়ে থাকে, সেই ঘটশূন্য ভূতল প্রভৃতির সহিতই চক্ষুর সংযোগ ঘটে এবং ঘটশূন্য ভূতল প্রভৃতির প্রত্যক্ষই ঘটাভাবের প্রত্যক্ষ। 'অনুপলব্ধি' নামক স্বতন্ত্র একটি প্রমাণের সাহায্যে অভাবের জ্ঞানোদয় হয়। অনুপলব্ধি পরোক্ষ প্রমাণ। ঐ পরোক্ষ প্রমাণমূলে
উৎপন্ন অভাবের বোধও সুতরাং পরোক্ষ। ঐরূপ পরোক্ষ জ্ঞানাভাবের দ্বারা অজ্ঞানের প্রত্যক্ষ উপপাদন কিরূপে সম্ভবপর?
তাছাড়া
অজ্ঞানের প্রতিযোগী জ্ঞান উপস্থিত থাকলে, সেখানে জ্ঞানের অভাব থাকতে পারে না। ভূতলে ঘট থাকলে, ঘটের
অভাব সেখানে থাকে কি? অভাবের সহিত তার প্রতিযোগীর জ্ঞান তো সুস্পষ্ট। "আমি অজ্ঞ"
এটাও অবশ্য এক শ্রেণির জ্ঞান।
এরূপ জ্ঞান বর্তমান থাকলে, সেখানে জ্ঞানের অভাবের বোধ প্রতিবাদী কিভাবে উপপাদন করতে পারেন?
পূর্বপক্ষ— 'অহম্
অজ্ঞঃ' প্রভৃতি এসকল প্রত্যক্ষ যে ভাবরূপ অজ্ঞানেরই
প্রত্যক্ষ তা অদ্বৈতবাদী বুঝলেন
কিরূপে?
উত্তরপক্ষ— অজ্ঞানের
যবনিকায় জ্ঞান যখন ঢাকা পড়ে, তখন সত্য-শিব-সুন্দর জীব তার নিজের স্বরূপ ভুলে গিয়ে, নিজেকে অহম্ অভিমানী মনে করে সংসারের সাগর দোলায় দোল খেতে থাকে। অজ্ঞ জীবের এরূপ পরিচয়ই 'অহম্ অজ্ঞঃ' এই প্রত্যক্ষের মূলে
বিরাজ করছে। এটা ভাবরূপ অজ্ঞানেরই প্রত্যক্ষ। ভাবরূপ অজ্ঞানই যবনিকা; ভাবরূপ অজ্ঞানবশেই জীবের শিবরূপ ঢাকা পড়ে। অজ্ঞান জ্ঞানের অভাবরূপ হলে তা দ্বারা জীবের
শিবভাব ঢাকা পড়ত না। কেননা, অভাবের কোন কিছু ঢেকে রাখবার ক্ষমতা নেই।
প্রশ্ন
— ভাবরূপ অবিদ্যায় অনুমান কি?
উত্তর
— প্রকাশাত্ম যতি তদীয় 'পঞ্চপাদিকাবিবরণে' নিম্নে উদ্ধৃত অনুমানের প্রয়োগ করেছেন—
বিবাদাধ্যাসিতং
প্রমাণ জ্ঞানম্ (পক্ষ), স্বপ্রাগভাবব্যতিরিক্ত-স্ববিষয়াবরণ-স্বনিবর্ত্য-স্বদেশগতবস্ত্বন্তর পূর্বকম্ (সাধ্য)।
অপ্রকাশিতার্থ
প্রকাশকত্বাৎ (হেতু)।
অন্ধকারে
প্রথমোৎপন্নপ্রদীপশিখাবৎ
(দৃষ্টান্ত)।
জ্ঞানোদয়ের
ফলে যেখানে অপ্রকাশিত ঘট প্রমুখ বস্তু
জ্ঞাতার জ্ঞানে ভাসে, সেসকল ক্ষেত্রেই প্রমাণমূলে উৎপন্ন জ্ঞান অজ্ঞাত ঘট প্রভৃতি বস্তুসম্পর্কে
জ্ঞাতার যে অজ্ঞান ছিল,
সেই অজ্ঞানকে নিঃশেষে নিবৃত্ত করেই আত্মপ্রকাশ লাভ করে। দৃষ্টান্ত হিসেবে অন্ধকারাচ্ছন্ন বস্তুর প্রকাশক প্রদীপ শিখার উল্লেখ করা যেতে পারে। এই দৃষ্টান্তটি অজ্ঞান
যে ভাবরূপ বস্তু, জ্ঞানোৎপত্তির পূর্বতনীন অভাব নয়, তাই স্পষ্টতঃ বুঝিয়ে দেয়। কারণ, অভাব কোন বস্তুর আবরক হয় না। জ্ঞান যে সকল বস্তু
প্রকাশ করে, অজ্ঞান তাই ঢেকে রাখে। ঢেকে রাখার এই ক্ষমতা ভাববস্তুরই
কেবল আছে। সুতরাং বস্তুর আবরক জ্ঞাননাশ্য অজ্ঞান ভাবরূপই বটে।
পূর্বপক্ষ— আচার্য
রামানুজ স্বামী তাঁর শ্রীভাষ্যে বলেছেন, আলোচিত অনুমান প্রকৃত অনুমান নয়, ওটা অনুমানাভাস বা দুষ্ট অনুমান।
তিনি বলেন, অপ্রকাশিত অর্থের (বস্তুর) প্রকাশক (অপ্রকাশিতার্থ প্রকাশকত্বাৎ) এরূপ হেতুমূলে অদ্বৈতবাদী যে ভাবরূপ অবিদ্যার
সাধন করেছেন, সেখানে জিজ্ঞাস্য এই যে, অবিদ্যা
তাঁর মতে উক্ত অনুমানবলে সিদ্ধ হয়েছে বলে ভাবরূপ অজ্ঞানও যে প্রমাণ-জ্ঞান
(প্রমাণ-মূলে উৎপন্ন জ্ঞান) তাতে সন্দেহ কি? এরূপ অজ্ঞান অপ্রকাশিত প্রপঞ্চের প্রকাশকবিধায় অর্থাৎ ওতে অনুমানের হেতু বিদ্যমান থাকায় ঐ অজ্ঞানের আবরক
দ্বিতীয় একটি ভাবরূপ অজ্ঞান সাধন করতেও কোনরূপ বাধা দেখা যায় না। অজ্ঞানের আবরক আরেকটি অজ্ঞান অদ্বৈতবাদী অবশ্যই স্বীকার করবেন না। ফলে, উল্লিখিত অনুমানের হেতু মে অদ্বৈতবাদীর অভিপ্রেত
সাধ্য সাধন করে না, এই রহস্যই অদ্বৈতবাদীকে
মেনে নিতে হবে এবং সহজ কথায় অপ্রকাশিতার্থের প্রকাশকত্বরূপ হেতু 'অনৈকান্তিক' হেত্বাভাসই হয়ে দাঁড়ায়।
উত্তরপক্ষ— এরূপ
আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবাদী বলেন, ভাবরূপ অবিদ্যা দৃশ্যমান বিশ্বপ্রপঞ্চের উপাদান কারণ সন্দেহ নেই। নিখিল বিশ্বের তা উপাদান হলেও,
বিশ্বপ্রপঞ্চের তা প্রকাশক নয়।
ঘটের উপাদান মাটি ঘটের প্রকাশক হয় কি? স্বপ্রকাশ জ্ঞানই একমাত্র প্রকাশক — এটা রামানুজাচার্য মুক্তকণ্ঠেই তাঁর শ্রীভাষ্যে ঘোষণা করেছেন। অবিদ্যা ব্রহ্মের তিরস্করণী, স্বয়ংজ্যোতিঃ ব্রহ্মই অবিদ্যার ভাসক (প্রকাশক)। অবিদ্যা জড়
ও সাক্ষি-ভাস্য। এরূপ জড় অবিদ্যার বিশ্বপ্রপঞ্চকে প্রকাশ করবার ক্ষমতা কোথায়? ফলে দেখা যাচ্ছে যে, অবিদ্যায় অপ্রকাশিত অর্থের প্রকাশকত্বরূপ হেতু অজ্ঞানের আবরক অজ্ঞানান্তরে (সাধ্যে) বর্তমান না থাকায়, ঐরূপ
হেতু যে সাধ্যের ব্যভিচারী
হওয়ায় হেত্বাভাস হবে তাতে সন্দেহ কি?
অজ্ঞানের
আবরক এই অজ্ঞানান্তরের সহিত
ব্রহ্মের তো কোন সংস্পর্শ
নেই, পরব্রহ্মের ওটা আবরক নয়, ওটা অজ্ঞানেরই আবরক। সাক্ষীর সহিত সংস্পর্শ না থাকায় এরূপ
অজ্ঞানান্তর সাক্ষি-ভাস্যও হবে না। অজ্ঞান জড় বস্তু। জয় অজ্ঞানের নিজেকে বা অপরকে প্রকাশ
করবার ক্ষমতা নেই। এরূপ ক্ষেত্রে অজ্ঞানের আবরক অজ্ঞানান্তরকে প্রকাশ করবে কে? প্রকাশক না থাকায় ঐ
অজ্ঞানান্তর অপ্রকাশিতই থেকে যাবে। এরূপ অপ্রকাশিত অজ্ঞান কল্পনার সার্থকতাই বা কোথায়? জ্ঞানরূপ
ব্রহ্মকে আবৃত না করলে, সেই
অজ্ঞানকে অদ্বৈতবেদান্তের সিদ্ধান্তে অজ্ঞানই বলা চলবে না। রামানুজ স্বামীর এরূপ অজ্ঞান কল্পনা অদ্বৈতবাদীর দৃষ্টিতে নিষ্ফল প্রয়াস বলে গণ্য হবে।.
(৬) নিবর্তকানুপপত্তির খণ্ডনঃ-
পূর্বপক্ষ— অনাদি ভাবরূপ অবিদ্যার নিবর্তক কোনও হেতু দেখা যায় না। নির্গুণ ব্রহ্মজ্ঞানে এই অবিদ্যার নিবৃত্তি হতে পারে না। কারণ, নির্গুণব্রহ্মের জ্ঞানই অসম্ভব। জ্ঞান যারই হয় তাই সগুণ। রামানুজাচার্য বলেন শ্রুতি-স্মৃতি-পুরাণ প্রভৃতি কোন শাস্ত্রই ব্রহ্মকে নির্বিশেষ বলে না। "বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তমাদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ"-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৩/৮) ইত্যাদি এই সকল শ্রুতি স্পষ্টতঃ পরব্রহ্মকে অনন্তকল্যাণগুণময় সবিশেষ তত্ত্ব বলেই বিবৃত করেছেন। 'সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২/১/১), এই শ্রুতিপ্রতিপাদিত ব্রহ্ম যে অনেক ধর্মবিশিষ্ট হবেন, এবং এটা দ্বারা অদ্বৈতবেদান্তের অভিপ্রেত নির্বিশেষ ব্রহ্মের সিদ্ধি হবে না, তাতে সন্দেহ কি?
উত্তরপক্ষ— নির্গুণের
জ্ঞানই হয় না —ইত্যাদি যা বলেছেন তা
অসঙ্গত। কারণ গুণের যে জ্ঞান তা
তো নির্গুণেরই জ্ঞান। যেহেতু গুণ নির্গুণই হয়। আর যাবতীয় সগুণ
বস্তুর জ্ঞানেই নির্গুণের জ্ঞান প্রকারান্তরে পূর্বেই হয়ে থাকে। গুণযুক্ত বললে গুণশূন্য কিছুর একটা জ্ঞানই হয়। প্রথমে নির্গুণের জ্ঞান না হলে, গুণযুক্তের
জ্ঞানই হয় না। ব্রহ্মের গুণযোগ বা সবিশেষভাব অবিদ্যাকল্পিত।
অবিদ্যাই ব্রহ্মকে সগুণ করে বলে নির্গুণব্রহ্মের জ্ঞানে অবিদ্যার নিবৃত্তি হয়। অবিদ্যার খোলস বিদ্যার উদয়ে খসে পড়লে, ব্রহ্মের অবিদ্যাকল্পিত গুণযোগও খসে পড়বে। তখন চরম ও পরম নির্বিশেষ
তত্ত্বই বিরাজ করবে।
তাছাড়া
শ্রুতি ও স্মৃতি সমুদ্র
মন্থন করলে ব্রহ্মের সবিশেষ ও নির্বিশেষ এই
দ্বিবিধ রূপেরই পরিচয় পাওয়া যায়। সবিশেষ ব্রহ্মবাদ বা ভক্তিবাদ নির্বিশেষে
পৌঁছাবার সোপানস্বরূপ। কোনরূপ বিশেষ ধর্ম বা গুণের দ্বারা
ব্রহ্মের পরিচয় দেওয়া চলে না। যিনি সেরূপ ভাবে ব্রহ্মের পরিচয় দিতে যান, তিনি যে বস্তুতঃ ব্রহ্মজ্ঞ
নন, এটাই "অবিজ্ঞাতং বিজ্ঞানতাং বিজ্ঞাতমবিজানতাম্'-(কেন উপনিষৎ-২/৩) এরূপ
শ্রুতিবাক্য দ্বারা স্পষ্টতঃ বুঝা যায়।
ব্রহ্ম
নির্বিশেষ বলেই তো শ্রুতি কেবল
"নেতি নেতি"--(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-২।৫।৬) দ্বারা অর্থাৎ "ইহা ব্রহ্ম নহে", "উহা ব্রহ্ম নহে", এইরূপে নিষেধমুখে নির্বিশেষ ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝাতে চেষ্টা করছেন ; ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝাবার জন্য নিষেধসূচক 'ন'-এর অসংখ্য
প্রয়োগ করেছেন। 'অস্থূলমনণ্বহ্রস্বমদীর্ঘম্'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ ৩।৮।৮) 'ইনি স্থুল নন, অণু নন, হ্রস্ব নন, দীর্ঘ নন', এইসকল শ্রুতি নির্বিশেষ ব্রহ্মের জ্ঞাপক। পুনশ্চ 'অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ম্'-(কঠ উপনিষদ্-১।৩।১৫)
অর্থাৎ 'শব্দরহিত, স্পর্শরহিত, রূপবিহীন, ক্ষয়রহিত' ইত্যাদি এই বাক্যসকলে যাঁ
হতে সমস্ত বিশেষ নিরাকৃত হয়েছে, সেই ব্রহ্মই উপদিষ্ট হচ্ছেন।
'সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম' এইসকল শ্রুতিতেও সেই নেতি নেতি পথেই ব্রহ্মের লক্ষণ নিরূপণের চেষ্টা করা হয়েছে। ব্রহ্মের সদ্ভাব, চিদ্ভাব ও আনন্দভাব ব্যাখ্যা করায় আপাতদৃষ্টিতে ব্রহ্মকে সগুণ, সবিশেষ বলে মনে হলেও ব্রহ্ম সেরূপ নন। সৎ, চিৎ, আনন্দ এই পদত্রয় বস্তুতঃ 'নেতি'রই প্রতিরূপ, অভাবের সূচক মাত্র। সৎ শব্দের অর্থ মিথ্যা নয়, চিৎ শব্দের অর্থ জড় নয়, আনন্দ শব্দের অর্থ দুঃখরূপ নয়। পরব্রহ্মকে সৎ বললে বুঝায় যে, জগৎ যেমন ভঙ্গুর ও মিথ্যা, সেইরূপ মিথ্যা নয়। চিদ্ বললে বুঝায়, জড়বস্তু যেমন অপ্রকাশ এবং তমঃস্বভাব, ব্রহ্মবস্তু সেরূপ নয়, ব্রহ্ম স্বয়ংজ্যোতিঃ এবং স্বপ্রকাশ; আনন্দ বললে বুঝায় যে, ব্রহ্ম সুখস্বরূপ, দুঃখস্বরূপ নয়। এইরূপে সৎ, চিৎ, আনন্দ এই তিনটি পদ অভাব পরিচয়েই ব্রহ্মের স্বরূপ প্রতিপাদন করে; এবং ব্রহ্ম যে অন্য সকল জাগতিক পদার্থ হতে বিলক্ষণ তা বুঝিয়ে দেয়।.....
(৭) নিবৃত্তানুপপত্তির
খণ্ডনঃ-
অদ্বৈতবেদান্তোক্ত
অবিদ্যার বিরুদ্ধে রামানুজাচার্যের সর্বশেষ আপত্তিটি হলো নিবৃত্তানুপপত্তি।
পূর্বপক্ষঃ-
নিবৃত্তি অর্থ নাশ। অদ্বৈতবাদীর
মতে নির্বিশেষ জ্ঞানের দ্বারা অর্থাৎ, 'অহম্ ব্রহ্মাস্মি’—এই
ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা মায়া বা অবিদ্যা
নিবৃত্ত বা দূর হয়।
কিন্তু রামানুজাচার্য আপত্তি করে বলেন যে,
অবিদ্যার নিবৃত্তি সম্ভব নয়। কারণ, অদ্বৈতমতে
অবিদ্যা অনাদি ভাবরূপ। অনাদি ভাবরূপ বস্তুর আত্যন্তিক বিনাশ অসম্ভব।
উত্তরপক্ষঃ-
এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবাদী বলেন—অবিদ্যার নিবৃত্তানুপপত্তি
হল একটি অন্যায় আশঙ্কা।
কারণ অধিষ্ঠানজ্ঞানে যে ভ্রমনিবৃত্তি হয়,
তা রজ্জুসর্পাদিস্থলে প্রত্যক্ষই হয়। অবিদ্যা ভাবরূপ
ও অনাদি বলে যে তার
নাশ অসম্ভব—একথাও বলা যায় না।
কারণ, অনাদি প্রাগভাবের নাশ আছে এবং
ভাববিরোধী অনাদি অত্যন্তাভাবেরও বিনাশ নেই। অতএব ভাববস্তু
অনাদি বলেই যে অবিদ্যার
নিবৃত্তি হয় না—তাও
বলা যায় না।
তাছাড়া
ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা যে অবিদ্যা নিবৃত্তি
হয়, এর শ্রুতিপ্রমাণ রয়েছে।
যথা—
"তস্যাভিধ্যানাদ্যোজনাত্তত্ত্ব-ভাবাৎ ভূয়শ্চান্তে বিশ্বমায়ানিবৃত্তিঃ॥"
-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-১/১০)
অর্থাৎ
সেই পরমাত্মার অভিধ্যানে অর্থাৎ চিন্তার ফলে, (অভিধ্যান কি প্রকারে?) জীবাত্মাকে
পরমাত্মাতে সংযোজিত করায়, 'আমিই ব্রহ্ম' এইরূপ
তত্ত্ববোধ উপস্থিত হলে, পুনঃ পুনঃ
এইসকল কর্ম অনুষ্ঠিত হলে,
অন্তে প্রারব্ধকর্ম্ম শেষ হলে পর
যেসময় আত্মজ্ঞান সমুদিত হয়, ঠিক সেই
সময়ই বিশ্বমায়ার নিবৃত্তি হয়, অর্থাৎ সুখ-দুঃখমোহাত্মক সমস্ত সংসাররূপ মায়ার নিবৃত্তি হয়।
সুতরাং, অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে রামানুজাচার্যের আপত্তিগুলি যুক্তিযুক্ত নয়, এটা প্রমাণিত।.....
তথ্যসূত্রঃ-
১.ভগবান্ শঙ্করাচার্যের শারীরকমীমাংসা ভাষ্য ও বাচস্পতি মিশ্রের ভামতী।
২.মধুসূদন সরস্বতীর অদ্বৈতসিদ্ধিঃ।
৩.উদ্বোধন প্রকাশিত বেদ গ্রন্থমালা (অপ্রধান উপনিষদ সমূহ)
৪.বেদান্তদর্শন অদ্বৈতবাদ,তৃতীয় খণ্ড,শ্রীআশুতোষ শাস্ত্রী,কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি।
৫.রাজেন্দ্রনাথ ঘোষের "আচার্য শঙ্কর ও রামানুজ" শীর্ষক গ্রন্থ।
ইতি
শ্রীশুভ চৌধুরী।
No comments:
Post a Comment