মায়াময় ব্রহ্ম (সগুণ ব্রহ্ম) বা পরমেশ্বর জগতের নিমিত্তকারণ, আর নির্গুণ ব্রহ্ম জগতের উপাদান কারণ। সগুণ ও নির্গুণ ভিন্ন তত্ত্ব নয়; সুতরাং এক ব্রহ্মই জগতের নিমিত্তও বটেন, উপাদানও বটেন। একই ব্রহ্মের এই উভয়বিধ কারণতাই (অভিন্ন নিমিত্তোপাদনতা) অদ্বৈতবেদান্তের সিদ্ধান্ত। এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, নির্বিশেষ ব্রহ্ম উপাদান হবেন কিরূপে? উপাদানকারণ কার্যে অনুগত হয়ে থাকে, ফলে বিকারী বা পরিণামী কারণেরই উপাদানকারণতা সম্ভব হয়। অবিকারী নির্বিশেষ ব্রহ্ম উপাদানকারণ হতে পারেন না।
এর
উত্তরে বক্তব্য এই যে, অদ্বৈত
বেদান্তের মতে উপাদান কারণ দুই প্রকার —১. পরিণামী উপাদান
ও ২. অপরিণামী উপাদান।
অপরিণামী ব্রহ্ম পরিণামী উপাদান হতে পারেন না সত্য, কিন্তু
ব্রহ্মবিবর্ত জগতের ব্রহ্ম অধিষ্ঠান বা আশ্রয় বিধায়
ব্রহ্মকে অপরিণামী উপাদানকারণ বলায় কোন বাধা নেই। এই অপরিণামী উপাদানকারণই
বিবর্ত্তকারণ বলে অদ্বৈতবেদান্তে পরিচিত। এইরূপ পরিণামী ও অপরিণামী এই
উভয়বিধ উপাদান কারণের লক্ষণ কি?
আচার্য
মধুসূদন সরস্বতী অদ্বৈতসিদ্ধিতে বলেছেন— "আত্মনি কার্য্যজনিহেতুত্বস্য উপাদানলক্ষণত্বাৎ, তস্য চ পরিণাম্য পরিণাম্যুভয়সাধারণত্বাৎ।"
অর্থাৎ আত্মা বা নিজকে আশ্রয়
করে যে সকল কার্য
উৎপন্ন হয়ে থাকে, সে সকল কার্যের
যা হেতু, তাই উপাদান কারণ। দণ্ড ঘটের উপাদানকারণ নয়, নিমিত্তকারণ, মাটি উপাদানকারণ। কেননা, ঘট মাটিকে আশ্রয়
করে উৎপন্ন হয়, দণ্ডকে আশ্রয় করে উৎপন্ন হয় না; দণ্ড আত্মাশ্রিত (দণ্ডাশ্রিত) কার্যের কারণ নয়, মৃত্তিকা-আশ্রিত কার্যের কারণ, সুতরাং দণ্ডকে উপাদানকারণ বলা যায় না। মাটি আত্মাশ্রিত (মৃত্তিকাশ্রিত) কার্যেরই কারণ সুতরাং মাটি উপাদানকারণ। এইরূপ আত্মা বা ব্রহ্মকে আশ্রয়
করে যে জড় জগতের
উৎপত্তি হয়ে থাকে, তাতে অধিষ্ঠান ব্রহ্ম আত্মাশ্রিত কার্যেরই হেতু হয়ে থাকেন সুতরাং ঐ অধিষ্ঠান ব্রহ্মকে
উপাদান কারণ বলতে কোন আপত্তি নেই। তাছাড়া, অনির্বচনীয় অবিদ্যাকে আশ্রয় করে (অবিদ্যা-পরিণামবশতঃ) যে অনির্বচনীয় জড়
প্রপঞ্চের উৎপত্তি হয়ে থাকে, তাতে অবিদ্যা যে উপাদান হবে,
এটা অবশ্য স্বীকার্য। অবিদ্যাকে আশ্রয় করে যে সকল অবিদ্যা-পরিণাম জড় কার্যের উৎপত্তি হয়ে থাকে, অবিদ্যার আশ্রয় ব্রহ্মই ঐ সকল জড়
কার্যেরও আশ্রয় হন, সুতরাং অবিদ্যাকে পরিণামী উপাদান ও ব্রহ্মকে অপরিণামী
উপাদান বলে স্বীকার করায় সঙ্গত।.....
তথ্যসূত্রঃ-
১.
পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য শ্রীমধুসূদন সরস্বতী বিরচিত "অদ্বৈতসিদ্ধি"।
২.
"বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ আশুতোষ শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতি।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
জুলাই
২৪, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।