‘জ্ঞানযোগ’
কর্ম্মযোগ যাহার উপায়, এমন যে
জ্ঞাননিষ্ঠালক্ষণ কর্ম্ম-সন্ন্যাস সহিত জ্ঞানযোগের কথা, যাহা পূর্ব দুই অধ্যায়ে বলা
হইয়াছে, প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তিলক্ষণ বেদার্থ যে আদর্শে পরিসমাপ্ত, পরবর্তী সমস্ত গীতাতে
এই কর্ম্মসন্ন্যাস যোগই ভগবান্ কর্তৃক বিবক্ষিত হইয়াছে, সেইজন্য বেদার্থের পরিসমাপ্তি
বা আদর্শকে চিন্তা করে বংশ কথনের দ্বারা শ্রীভগবান্ সেই জ্ঞানযোগের স্তুতি করিতেছেন-
শ্রীভগবানুবাচ।
ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম্
।
বিবস্বান্ মনবে প্রাহ মনুরিক্ষ্বাকবেহব্রবীৎ || ১ ||
শ্রীভগবান্ বলিলেন-
জগৎ-পরিপালক ক্ষত্রিয়দের বলাধানের জন্য আমি উক্ত
দুই অধ্যায়ের এই যোগ প্রথমে সৃষ্টির আদিকালে বিবস্বান আদিত্যকে বলিয়াছিলাম; কেননা ঐ
যোগবলে যুক্ত হইয়া ক্ষত্রিয়রা ব্রাহ্মণদিগের রক্ষণে সমর্থ হইবে। তথা ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়গণ
পরিপালিত হইলে জগত্ অনায়াসে পরিপালিত হইবে, কারণ তাহারা উভয়ে জগৎ পরিপালনের নিমিত্ত
যথেষ্ট সমর্থ। এই যোগের ফল অবিনাশী, তাই ইহা অব্যয়; কেননা এই সম্যক্ জ্ঞাননিষ্ঠালক্ষণ
যোগের মোক্ষরূপ ফল কখনো ব্যয় বা নষ্ট হয় না। ঐ বিবস্বান সূর্য এই যোগ স্বপুত্র মনুকে
বলিয়াছিলেন আর মনু স্বপুত্র আদি রাজা ইক্ষ্বাকুকে বলিয়াছিলেন।
এবং পরম্পরাপ্রাপ্তমিমং
রাজর্ষয়ো বিদুঃ ।
স কালেনেহ মহতা যোগো নষ্টঃ পরন্তপ || ২ ||
এইরূপ ক্ষত্রিয় পরম্পরাপ্রাপ্ত হইয়া এই যোগ রাজর্ষিগণ
অবগত হইয়াছিলেন। ইহারা রাজা ও ঋষি উভয়ই ছিলেন বলিয়া রাজর্ষি। হে পরন্তপ! এক্ষণে দীর্ঘ
কালপ্রভাবে সে যোগ নষ্ট অর্থাৎ সম্প্রদায়ক্রমে বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছে।আপনার বিপক্ষকে
‘পর’ বলিয়া, সেই বিপক্ষদের যিনি স্বীয় শৌর্যতেজকিরণ দ্বারা ভানুর ন্যায় তাপিত করেন
তিনিই পরন্তপ অর্থাৎ শত্রুতাপন।
স এবায়ং ময়া তেহদ্য যোগঃ
প্রোক্তঃ পুরাতনঃ ।
ভক্তোহসি মে সখা চেতি রহস্যং হ্যেতদুত্তমম্ || ৩ ||
দুর্বল অজিতেন্দ্রিয় অধিকারীদের প্রাপ্ত হইয়া এই
যোগ নষ্ট হইয়াছে উপলব্ধি করিয়া এবং সাধারণ লোকদেরও পুরুষার্থহীন দেখিয়া- তুমি আমার
ভক্ত ও সখা, সেইজন্য সেই পুরাতন যোগ অদ্য আমি তোমাকে বলিলাম, এ যোগজ্ঞান অতি উত্তম
রহস্য।
ভগবান যাহা বলিবেন তাহা মিথ্যা এইপ্রকার বুদ্ধি কাহারও না হউক, এই কারণে ঐ প্রকার বৃথা বুদ্ধির পরিহারার্থ অর্জ্জুন আশঙ্কার ছলে বলিতেছেন-
অর্জ্জুন উবাচ।
অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম
বিবস্বতঃ ।
কথমেতদ্বিজানীয়াং ত্বমাদৌ প্রোক্তবানিতি || ৪ ||
অর্জ্জুন কহিলেন- পরবর্তীকালে বসুদেবগৃহে আপনার
জন্ম, আর পূর্ববর্তীকালে সৃষ্টির প্রারম্ভে বিবস্বান আদিত্যের জন্ম অর্থাৎ উৎপত্তি,
অবিরুদ্ধ অর্থহেতু তাহা কি করিয়া জানিব যে, তুমি সৃষ্টির আদিতে এই যোগ বলিয়াছিলে, সেই
তুমিই ইদানীং আমাকেও এই যোগ বলিতেছ?
মূর্খদের বাসুদেব বিষয়ে যে অনীশ্বর এবং অসর্বজ্ঞ আশঙ্কা-যাহা অর্জ্জুনের প্রশ্ন-তাহা পরিহার করিবার জন্য শ্রীভগবান বলিতেছেন-
শ্রীভগবানুবাচ।
বহুনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জ্জুন।
তান্যহং বেদ সর্ব্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ || ৫ ||
হে অর্জ্জুন!
আমার এবং তোমার বহু জন্মসকল ব্যতীত অর্থাৎ অতিক্রান্ত হইয়াছে, সেইসকল আমি জানি কিন্তু
তুমি জান না, কারণ ধর্ম্ম-অধর্ম্ম অর্থাৎ পাপপূণ্যাদি মিথ্যা সংস্কারজন্য তোমার শুদ্ধ
জ্ঞানশক্তি প্রতিবদ্ধ বা আবরিত। পরন্তু হে পরন্তপ! আমি নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্ত স্বভাবহেতু
অনাবরণ জ্ঞানশক্তি এই জন্য আমি জানি।
তুমি নিত্যেশ্বর, তোমার ধর্ম্মাধর্ম্ম না থাকিলে কি কারণে তবে জন্ম হইয়া থাকে? অর্জ্জুনের এইপ্রকার আশঙ্কার উত্তরে বলিতেছেন-
অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি
সন্।
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া || ৬ ||
আমি অজ অর্থাৎ জন্মরহিত হইয়াও; অব্যয়াত্মা অর্থাৎ
যাঁহার জ্ঞানশক্তির ক্ষয় নাই এইরূপ অক্ষীণ জ্ঞানশক্তি স্বভাব হইয়াও; ব্রহ্মাদি থেকে
তৃণ পর্য্যন্ত সর্ব্বভূতের ঈশ্বর হইয়াও; আমার যে স্বপ্রকৃতি, অর্থাৎ ত্রিগুণাত্মিকা
বৈষ্ণবী মায়া, সমস্ত জগৎ যাহার বশে বর্তমান, যদ্দ্বারা মোহিত হইয়া লোকে নিজের আত্মা
বাসুদেবকে জানিতে পারে না, সেই নিজ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠিত হইয়া অর্থাৎ তাঁহাকে বশীভূত
করিয়া আমি সম্ভাবিত হই অর্থাৎ আত্মমায়ার দ্বারা যেন লোকবৎ দেহধারণ করিয়া জন্মগ্রহণ
করি; কিন্তু পরমার্থতঃ নহে।
শ্রীভগবানের সেই দিব্য-জন্ম কখন এবং কিজন্য? তাহাই বলিতেছন-
যদা যদা
হি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভিবতি ভারত।
অভ্যুত্থানধর্ম্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ || ৭ ||
পরিত্রাণায় সাধূনাম্ বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে || ৮ ||
হে ভারত! বর্ণাশ্রমাদিলক্ষণ প্রাণীদের
অভ্যুদয়-নিঃশ্রেয়স সাধন ধর্ম্মের যখন যখনই গ্লানি অর্থাৎ হানি হয় এবং অধর্ম্মের অভ্যুত্থান হয় তখনই মায়ার দ্বারা নিজেকে সৃজন করি। সৎমার্গে
স্থিত সাধুদের পরিত্রাণ অর্থাৎ পরিরক্ষণের জন্য ও দুষ্কৃত পাপকারীদের বিনাশের জন্য
এবং ধর্ম্মের সম্যক্ স্থাপনের জন্য প্রতিযুগে আমি সম্ভাবিত হই।
জন্ম কর্ম্ম চ মে দিব্যমেবং
যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।
ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জ্জুন || ৯ ||
আমার মায়ারূপ জন্ম এবং সাধু পরিত্রাণাদি কর্ম্ম
দিব্য অর্থাৎ অপ্রাকৃত ঐশ্বরিক কর্ম্ম। যিনি এইরূপ যথোক্ত তত্ত্বের সহিত জানেন, হে
অর্জ্জুন! তিনি এই দেহত্যাগ করিয়া আর পুনর্জ্জন্মরূপ উৎপত্তি প্রাপ্ত হন না, আমার নিকটই
আগমন করেন অর্থাৎ তিনি মুক্তিলাভ করেন।
এই মোক্ষমার্গ ইদানীং প্রবৃত্ত হয় নি। তাহলে কি ব্যাপার? পূর্বেও-
বীতরাগভয়ক্রোধা
মন্ময়া মামুপাশ্রিতাঃ।
বহবো জ্ঞানতপসা পূতা মদ্ভাবমাগতাঃ || ১০ ||
যাহাদের রাগ, ভয় এবং ক্রোধ বিগত হইয়াছে, তাহারা বীতরাগভয়ক্রোধ,
মন্ময়া অর্থাৎ ব্রহ্মবিদ্-যাঁহারা স্বীয় আত্মাকে ঈশ্বর হইতে অভেদদর্শী, আমি যে পরমেশ্বর
বাসুদেব আমাকে আশ্রয়কারী, কেবল জ্ঞাননিষ্ঠ বহু সাধক জ্ঞানতপস্যা দ্বারা-জ্ঞান অর্থাৎ
পরমাত্ম-বিষয়ক তপস্যার দ্বারা পূত বা পরাশুদ্ধি লাভ করিয়া মদ্ভাব অর্থাৎ ঈশ্বরভাবরূপ
যে মোক্ষ তাতে আগমন করিয়াছেন অর্থাৎ সম্যকরূপে প্রাপ্ত হইয়াছেন।
তবে ত তোমারও রাগ-দ্বেষ আছে, যে কারণ তুমি কোন কোন ব্যক্তিকেই আত্মভাব প্রদান করিতেছ? সকলকে তাহা কর না, এইপ্রকার ঈশ্বরে পক্ষপাত আছে বলিয়া যদি কাহারও শঙ্কা হয়, তবে তাহা নিরাকরণ করিবার জন্য বলা যাইতেছে যে-
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে
তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্মানুবর্ত্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্ব্বশঃ || ১১ ||
যে, যে প্রকারে, যে প্রয়োজনে, যে ফলের অর্থী হইয়া
আমাকে উপাসনা করে, তাহাকে আমি সেই ফলদানের দ্বারা অনুগৃহীত করি। কারণ তাহারা মোক্ষের
প্রতি অনর্থী অর্থাৎ মোক্ষ চায় না। কারণ একই ব্যাক্তির পক্ষে মোক্ষ এবং ফল কামনা একই
সাথে সম্ভব নহে। এই জন্য যে ফলার্থী তাহাকে ফল প্রদানের দ্বারা, আবার যাহারা শাস্ত্রোক্ত
কর্মকারী কিন্তু অফলার্থী মুমুক্ষু তাহাদের চিত্তশুদ্ধির জন্য জ্ঞানাভ্যাসযোগ প্রদানের
দ্বারা, যাঁহারা জ্ঞানী সন্ন্যাসী মুমুক্ষু তাহাদিগকে মোক্ষ প্রদানের দ্বারা এবং আর্ত
ভক্তদের আর্তি হরণের দ্বারা অর্থাৎ এইরূপ যাহারা যে ভাবে আমার ভজনা করে তাহাদের সেই
ভাবে আমি তুষ্ট করি। পুনশ্চ রাগদ্বেষ বা মোহনিমিত্ত আমি কাউকে তুষ্ট করি না। হে পার্থ!
যে কোনও ভাবে বর্তমান মনুষ্য সর্বাবস্থায় সর্ব্বভাব সমন্বিত আমার অর্থাৎ ঈশ্বরের মার্গ
সর্ব্বপ্রকারে অনুসরণ করিতেছে।
তুমি ঈশ্বর, তোমার রাগ বা দ্বেষ নাই, এই কারণ সকল প্রাণীরই উপর অনুগ্রহেচ্ছা তোমার তুল্য এবং তুমিই সকলের সকল প্রকার ফলদানে সমর্থ, এইপ্রকার হইলেও তুমি থাকিতে কেন সকল ব্যক্তি মুমুক্ষু হইয়া বাসুদেবই সকল জগৎ, এইপ্রকার যথার্থ জ্ঞানের দ্বারা তোমাকে প্রাপ্ত হয় না, তাহার কারণ শ্রবণ কর-
কাঙ্ক্ষতঃ কর্ম্মণাং সিদ্ধিং
যজন্ত ইহ দেবতাঃ।
ক্ষিপ্রং হি মানুষে লোকে সিদ্ধির্ভবতি কর্ম্মজা ||১২ ||
কর্ম্ম সকলের সিদ্ধি অর্থাৎ ফলনিষ্পত্তি
প্রার্থনাকারীরা অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষাকারীরা এই লোকে ইন্দ্র, অগ্নি প্রভৃতি দেবতাদের যজনা
করে। শ্রুতি বলিতেছেন-‘পক্ষান্তরে যে কেহ আমি ভিন্ন এবং আমার উপাস্য ইনি ভিন্ন-এই মনে
করিয়া আপনা হইতে পৃথগভূত দেবতাকে উপাসনা করেন, তিনি অবিদ্যাবান্; দেবগণের নিকট যেন
তিনি পশুরই সদৃশ।’ - (বৃহদারণ্যক উপনিষদ-১।৪।১০) সেই ভিন্ন দেবতাযাজী ফলাকাঙ্ক্ষীদের
অন্যলোক অপেক্ষা এই মনুষ্যলোকেই ক্ষিপ্র অর্থাৎ অতিশীঘ্র সিদ্ধি লাভ হয়, কারণ মনুষ্যলোকে
শাস্ত্রাধিকার আছে। মনুষ্যলোকে বর্ণাশ্রমাদি কর্মাধিকার এইটিই বিশেষত্ব। সেই বর্ণাশ্রমাদির
অধিকারীদের কর্ম্মসকলের কর্ম্মজাত ফলসিদ্ধি শীঘ্রই হইয়া থাকে।
চাতুর্ব্বর্ণ্যং
ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্ত্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্ত্তারমব্যয়ম্ || ১৩
||
আমি যে ঈশ্বর-আমাকর্তৃক গুণ ও
কর্ম্মের বিভাগ অনুযায়ী চারিটি বর্ণ সৃষ্ট অর্থাৎ উৎপাদিত হইয়াছে। প্রমাণস্বরূপ এই
শ্রুতিবাক্য-‘সেই বিরাটপুরুষের মুখ ব্রাহ্মণরূপে, বাহু রাজন্যরূপে, উরু বৈশ্যরূপে এবং
পদদ্বয় শুদ্ররূপে কল্পিত হইয়াছিল, অর্থাৎ যেন তাঁহারা কল্পিত বিরাটের ঐসকল স্থান হইতে
জাত হইয়াছিলেন।’-(ঋগ্বেদ সংহিতা ১০।৯০।১২)
এখানে গুণ অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিন গুণ ও
কর্ম্মের বিভাগ, যেমন- সত্ত্বপ্রধান ব্রাহ্মণ, তাহাদিগের কর্ম্ম শম, দম, তপাদি; সত্ত্বগুণ
যাহাদিগের গৌণ রজঃপ্রধান ক্ষত্রিয়, তাহাদিগের কর্ম্ম শৌর্য্য তেজাদি; তমোগুণ গৌণ রজঃপ্রধান
বৈশ্য, তাহাদিগের কর্ম্ম কৃষিবাণিজ্যাদি; রজোগৌণ তমঃপ্রধান শূদ্র, তাহাদিগের কর্ম্ম
শুশ্রুষা। মায়া সংব্যবহার হেতু সেই
চাতুর্বর্ণ্য সৃষ্ট্যাদি কর্মের কর্তা হইলেও আমাকে পরমার্থতঃ অকর্তা বলিয়া জানিবে।
সেইজন্য আমাকে অব্যয় অসংসারী বলেই জানিও।
ন মাং
কর্ম্মাণি লিম্পন্তি ন মে কর্ম্মফলে স্পৃহা।
ইতি মাং ষোহভিজানাতি কর্ম্মভির্ণ স বধ্যতে || ১৪
||
আমাকে যেসকল কর্ম্মের কর্তা মনে করিতেছ, পরমার্থতঃ
আমি তাহাদের কর্তা নই, যেহেতু-দেহাদির উৎপত্তির হেতু সেই সকল কর্ম্ম আমাকে লিপ্ত করিতে
পারে না, কারণ আমাতে অহঙ্কারের অভাব আছে এবং কর্ম্মফলে অর্থাৎ সেই কর্ম্ম সকলের ফলেও
আমার স্পৃহা বা তৃষ্ণা নেই। যে সব সংসারীদের-‘আমি কর্তা’ এইরূপ অভিমান এবং কর্ম্ম ও
তৎফলে স্পৃহা আছে তাহাদের কর্ম্মসকল লিপ্ত করে-একথা ঠিক, কিন্তু অভিমান ও স্পৃহার অভাবহেতু
আমাকে কর্ম্মসকল লিপ্ত করে না। এইভাবে অন্য যে কেউ আমাকে আত্মারূপে জানে অর্থাৎ আমি
কর্তা নই এবং আমার কর্মফলে স্পৃহা নেই এই প্রকারে যে আমাকে জানে সে কর্ম্মের দ্বারা
বন্ধন প্রাপ্ত হয় না।
এবং জ্ঞাত্বা
কৃতং কর্ম্ম পূর্ব্বৈরপি মুমুক্ষুভিঃ।
কুরু কর্ম্মৈব তস্মাত্ত্বং পূর্ব্বৈঃ পূর্ব্বতরং কৃতম্
|| ১৫ ||
‘আমি কর্তা নই, আমার কর্ম্মফলেও স্পৃহা নাই’-পূর্বপূর্ব
মুমুক্ষগণ কর্তৃক এইভাবে জেনে কর্ম্ম কৃত হইয়াছিল। তুমিও সেইজন্য কর্ম্ম কর, তুমি তুষ্ণী
অর্থাৎ চুপচাপ হইয়া বসিয়া থাকিও না অথবা তোমার সন্ন্যাসগ্রহণও কর্তব্য নহে। যদি তুমি
অনাত্মজ্ঞ হও তাহইলে তুমি আত্মশুদ্ধির নিমিত্ত কর্ম্ম কর, আর যদি তুমি তত্ত্ববিৎ হও
তাহইলে লোকশিক্ষার নিমিত্ত কর্ম্ম কর। পূর্বপূর্ব জনকাদি কর্তৃক যেমনভাবে কর্ম কৃত
হইয়াছিল সেইভাবে কর্ম্ম কর-অধুনাতন অশাস্ত্রীয় স্বাভাবিক প্রাকৃত কর্ম্ম তুমি সম্পাদন
করো না।
কিং কর্ম্ম
কিমকর্ম্মেতি কবয়োহপ্যত্র মোহিতাঃ।
তত্তে কর্ম্ম প্রবক্ষ্যামি যজ্জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেহশুভাৎ
|| ১৬ ||
‘প্রাচীনগণ কর্তৃক অনুষ্ঠিত কর্ম্মের মত কর্ম্ম
কর’-এই বিশেষণের তাৎপর্য কি? –বলছি,
কারণ কর্ম্মেতে মহাবৈষম্য আছে। কি কর্ম্ম এবং কি অকর্ম্ম এই কর্ম্মবিজ্ঞান বিষয়ে
কবি বা মেধাবীরাও মোহ প্রাপ্ত হইয়াছেন। অতএব তোমাকে আমি কর্ম্ম এবং অকর্ম্মবিজ্ঞান
বলিব যাহা জানিয়া সংসাররূপ অশুভ হইতে তুমি মুক্তিলাভ করিবে।
কর্ম্মণো হ্যপি বোদ্ধব্যং বোদ্ধব্যঞ্চ বিকর্ম্মণঃ।
অকর্ম্মণশ্চ বোদ্ধব্যং গহনা কর্ম্মণো গতিঃ || ১৭ ||
শাস্ত্রবিহিত কর্ম্ম কি, তাহা বুঝিতে হইবে, বিকর্ম্ম
অর্থাৎ শাস্ত্র-প্রতিষিদ্ধ কর্ম্ম কি, তাহা বুঝিতে হইবে, এবং তূষ্ণীভাব অকর্ম্ম কি,
তাহা বুঝিতে হইবে। এই তিনটি বিষয়ে অধ্যাহার কর্ত্তব্য। যেহেতু কর্ম্ম, বিকর্ম্ম ও অকর্ম্মের
গতি অর্থাৎ যথার্থ তত্ত্ব অতি গহন অর্থাৎ বিষম দুর্জ্ঞেয়।
কর্ম্মণ্যকর্ম্ম
যঃ পশ্যেদকর্ম্মণি চ কর্ম্ম যঃ।
স বুদ্ধিমান্ মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃৎস্নকর্ম্মকৃৎ
|| ১৮ ||
কর্ম্ম অর্থাৎ যাহা করা যায় তথা যাহা ব্যাপারমাত্র;
সেই কর্ম্মেতে আত্মার নিষ্ক্রিয়ত্বহেতু কর্ম্মের অভাব যিনি দেখেন এবং অকর্ম্মে অর্থাৎ
কর্ম্মাভাবেও তথা জড়তার মধ্যেও প্রবৃত্তি-নিবৃত্তির কর্তৃতন্ত্রত্বহেতু যাঁহারা কর্ম্ম
দেখেন তথা ব্রহ্মবস্তু প্রাপ্ত হওয়ার পূর্ব্বে সব ক্রিয়া-কারক আদি ব্যবহার তা কিছু
করাই হউক বা না করাই হউক সবই কর্তৃতন্ত্র অর্থাৎ অবিদ্যাভূমিতে অহংবুদ্ধিপূর্বক যে
কর্ম্ম হইয়া থাকে,তা সে চুপ করে বসে থাকা হইলেও, তাহাতে তিনি কর্ম্ম দেখেন মনুষ্য সকলের
মধ্যে তিনিই বুদ্ধিমান, তিনিই যোগী এবং সমস্ত কর্ম্মকারী। তিনি প্রবৃত্তির কর্তা নহেন
এবং নিবৃত্তিরও কর্তা নহেন - ইহা যিনি জানেন তিনিই বুদ্ধিমান। আমি কর্ম্ম করি, এইরূপ
জ্ঞান ভ্রান্তি। আত্মাতে শরীরেন্দ্রিয়-ব্যাপারে উপরম আরোপ করিয়া আমি (আত্মা) নিষ্কর্মা,
সুখী - এই জ্ঞানও মিথ্যা। বর্তমান শ্লোকে এই উভয় প্রকার ভ্রান্তি দূর করা হইয়াছে। মৃগতৃষ্ণায়
জলের ন্যায় ও শুক্তিকায় রজতের ন্যায় নিষ্ক্রিয় আত্মাতে কর্তৃত্ব ও ভোক্তৃত্ব দর্শন
ভ্রান্ত জীবের স্বভাব। নৌকারূঢ় ব্যাক্তি নৌকা চলিতে থাকিলে তটস্থ গতিহীন বৃক্ষসমূহে
প্রতিকূল গতি এবং দুরবর্তী গতিশীল বস্তুকে গতিহীন দেখেন। এইরূপ বিপরীত দর্শন মায়িক
সংসারের ধর্ম।
যস্য সর্ব্বে সমারম্ভাঃ
কামসঙ্কল্পবর্জ্জিতাঃ।
জ্ঞানাগ্নিদগ্ধকর্ম্মাণং তমাহুঃ পণ্ডিতং বুধাঃ || ১৯ ||
যথোক্ত তত্ত্বদর্শীর সম্যকরূপে আরম্ভ সমস্ত কর্ম্মসকল
কাম এবং তাহার কারণ সঙ্কল্প উভয়-বর্জ্জিত অর্থাৎ নিষ্প্রয়োজন চেষ্টামাত্ররূপে
অনুষ্ঠান করা হয়। ঈদৃশ ব্যক্তির সমারম্ভসকল অনর্থক চেষ্টা মাত্র; প্রবৃত্তিমার্গে
কেবল লোকশিক্ষার্থ, এবং নিবৃত্তিমার্গে কেবল জীবনযাত্রানির্ব্বাহার্থ। সেই জ্ঞানাগ্নি
দ্বারা দগ্ধ কর্ম্মাকে অর্থাৎ কর্মাদিতে অকর্মাদি দর্শন হইল জ্ঞান, তাহা অগ্নিস্বরূপ,
যাঁহার সেই জ্ঞানাগ্নি দ্বারা শুভাশুভলক্ষণ কর্ম্মসকল দগ্ধ হইয়াছে তাঁহাদেরই ব্রহ্মবিদেরা
পরমার্থতঃ পণ্ডিত বলিয়া থাকেন।
ত্যক্ত্বা কর্মফলাসঙ্গং
নিত্যতৃপ্তো নিরাশ্রয়ঃ ৷
কর্মণ্যভিপ্রবৃত্তোহপি নৈব কিঞ্চিত্করোতি সঃ ৷৷২০৷৷
জ্ঞানরূপ অগ্নিদ্বারা কর্ম্মবীজ দগ্ধ হওয়ায় বিদ্বানের
ক্রিয়মান যে কর্ম্ম তা পরমার্থত অকর্ম্মই; কেননা তাহার নিষ্ক্রিয়-আত্ম-দর্শনসম্পন্নত্ব
হইয়াছে। কারণ কর্ম্মেতে অভিমান এবং ফলাসক্তি পরিত্যাগ করিয়া যথোক্ত জ্ঞানের দ্বারা
নিত্যতৃপ্ত অর্থাৎ বিষয়ে নিরাকাঙ্ক্ষা হইয়া নিরাশ্রয় অর্থাৎ যে ফলকে আশ্রয় করে মানুষ
পুরুষার্থ সিদ্ধির ইচ্ছা করিয়া থাকে, এইরূপ দৃষ্ট ও অদৃষ্টফল এবং তাহাদের সাধনরূপ আশ্রয়
যিনি রহিত; তিনি জনকাদির ন্যায় পূর্ববৎ কর্মে অভিপ্রবৃত্ত হইয়াও আত্মার নিষ্ক্রিয়ত্বদর্শনসম্পন্নতাহেতু
কিছুই করেন না।
নিরাশীর্যতচিত্তাত্মা ত্যক্তসর্বপরিগ্রহঃ
৷
শারীরং কেবলং কর্ম কুর্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্ ৷৷ ২১৷৷
যিনি নিরাশী অর্থাৎ যাঁহা হইতে সমস্ত আশিষ বা আশা
নির্গত হইয়া গিয়াছে, যিনি যতচিত্তাত্মা অর্থাৎ চিত্ত তথা অন্তঃকরণ এবং স্থূলসূক্ষ্মদেহ
যাহা বাহ্য বা স্থূল পঞ্চভূতাত্মক কার্য (দেহ) ও করণের (ইন্দ্রিয়ের) সংঘাতমাত্র, এই
উভয়কে যিনি সংযত করিয়াছেন, যিনি ত্যক্ত-সর্ব্বপরিগ্রহ অর্থাৎ সর্বপরিগ্রহ ত্যাগ করিয়াছেন;
তিনি শরীরস্থিতি মাত্র প্রয়োজন কেবল অর্থাৎ তাহাতেও অভিমানবর্জ্জিত কর্ম্ম করিলেও কোন
অনিষ্টরূপ পাপ প্রাপ্ত হন না। এইরূপে শরীরযাত্রামাত্রচেষ্ট
যতি অর্থাৎ জ্ঞাননিষ্ঠ সন্ন্যাসীই মুক্তি লাভ করিয়া থাকেন।
যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্টো দ্বন্দ্বাতীতো
বিমত্সরঃ ৷
সমঃ সিদ্ধাবসিদ্ধৌ চ কৃত্বাপি ন নিবধ্যতে ৷৷ ২২৷৷
‘অযাচিত, অসংকল্পিত,
যদৃচ্ছায় উপপন্ন’ ইত্যাদি বৌধায়ন ধর্ম্মসূত্র (২১।৮।১২) বাক্যের
দ্বারা সমস্ত পরিগ্রহ ত্যক্ত যতি অর্থাৎ সন্ন্যাসীর শরীরস্থিতিহেতু অন্নাদির প্রয়োজন
এবং সেই অন্নের প্রাপ্তি বিষয়ে যতি কিরূপ আচরণ করিবেন, সেই সম্বন্ধে ভগবান বলিতেছেন-
‘অপ্রার্থিতভাবে উপস্থিত হয় এমন যে যদৃচ্ছালাভ এবং তাহার দ্বারা যিনি সন্তুষ্ট, যিনি
দ্বন্দ্বাতীত অর্থাৎ যিনি শীতোষ্ণাদি দ্বন্দ্বের দ্বারা আহত হইলেও অবিষন্ন চিত্ত, যাঁহার
মাৎসর্য বিগত হইয়াছে অর্থাৎ যাঁহার নির্বৈরবুদ্ধি এবং যদৃচ্ছায় যাহা লাভ হয় তাহার সিদ্ধি
এবং অসিদ্ধিতে সমতুল্য বুদ্ধি যাঁহার; সাধারণ লোকের দ্বারা তাঁহার উপর কর্তৃত্ব অধ্যারোপিত
হইলেও তিনি শরীরস্থিতিমাত্র প্রয়োজনে ভিক্ষাটনাদি কর্ম্ম করিয়াও নিবদ্ধ হন না, কারণ
যে কর্ম্মসকল বন্ধনের হেতু, তাহারা তাহাদের হেতুর (অবিদ্যার) সহিত জ্ঞানাগ্নির দ্বারা
দগ্ধ হইয়া গিয়াছে।’
গতসঙ্গস্য মুক্তস্য জ্ঞানাবস্থিতচেতসঃ
৷
যজ্ঞায়াচরতঃ কর্ম সমগ্রং প্রবিলীয়তে ৷৷ ২৩ ৷৷
গতসঙ্গের অর্থাৎ যাঁহার সমস্ত আসক্তি নিবৃত্ত হইয়াছে,
মুক্তের অর্থাৎ যাঁহার ধর্মাধর্মাদি বন্ধন নিবৃত্ত হইয়াছে, জ্ঞানাবস্থিত চিত্তের অর্থাৎ
শুদ্ধজ্ঞানেতেই যাঁহার চিত্ত অবস্থান করিতেছে, তিনিই জ্ঞানাবস্থিতচেতা, তাঁহার অর্থাৎ
এইরূপ যজ্ঞ সম্পাদনের নিমিত্ত কর্ম্ম আচরণকারীর সঞ্চিত ও উন্মুখ ফলের সহিত বর্ত্তমান
সমগ্র কর্ম্ম প্রবিলয় বা বিনাশ প্রাপ্ত হয়।
ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্মহবির্ব্রহ্মাগ্নৌ
ব্রহ্মণা হুতম্ ৷
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্মসমাধিনা ।। ২৪ ।।
জ্ঞানীর ক্রিয়মাণ কর্ম্ম আর অন্য কর্ম্ম সৃষ্টি
না করিয়া ফলের সহিত বিলয় প্রাপ্ত হয় কেন? যেহেতু-অর্পণ অর্থাৎ যজ্ঞে আহুতিদানের যন্ত্র
স্রুকস্রুবাদি সকলও ব্রহ্মই অর্থাৎ যে করণের দ্বারা ব্রহ্মবিৎ অগ্নিতে হবিঃ অর্পণ করেন
তা ব্রহ্মরূপেই দেখেন অর্থাৎ আত্ম বিনা ঐ বস্তুর কোন সত্তাই নাই, ইহাই বোঝেন; ঠিক যেমন
শুক্তিকায় রজত দৃষ্ট হইলেও বাস্তবিকপক্ষে লোকে রজতের অভাবই দেখিয়া থাকে। হবিঃ ব্রহ্ম
অর্থাৎ হবির্বুদ্ধিদ্বারা গৃহ্যমান যাহা অর্থাৎ হোমের ঘৃত তাহাও তাঁহার নিকট ব্রহ্মই।
যেখানে হবন করা হয়, সেই অগ্নিও ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কর্তা, ব্রহ্মরূপ কর্তার দ্বারাই হবন
করা হয়-এইরূপ অর্থ। তাঁহার দ্বারা যাহা হুত হয় অর্থাৎ যে হবণক্রিয়া সম্পাদন হয়, সেই
হবনক্রিয়াও ব্রহ্ম। ব্রহ্মবিৎ কর্তৃক গন্তব্য যে ফল তাহাও ব্রহ্মই। ব্রহ্মরূপ কর্ম্মে
যাঁহাদের সমাধি হইয়াছে সেই ব্রহ্মকর্ম্ম-সমাধিসম্পন্নগণ কর্তৃক ব্রহ্মই গন্তব্য।
দৈবমেবাপরে যজ্ঞং যোগিনঃ
পর্যুপাসতে ৷
ব্রহ্মাগ্নাবপরে যজ্ঞং যজ্ঞেনৈবোপজুহ্বতি ৷৷ ২৫ ৷।
যে যজ্ঞের দ্বারা দেবতাদিগকে পূজা করা যায় তাহাই
দৈবযজ্ঞ, অপর কোন কোন যোগীগণ অর্থাৎ কর্ম্মীগণ সেই যজ্ঞ অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। ব্রহ্মাগ্নৌ
অর্থাৎ ‘ব্রহ্ম সত্য-জ্ঞান-অনন্তস্বরূপ’-(তৈত্তিরীয় উপনিষদ্-২।১), ‘বিজ্ঞান এবং আনন্দস্বরূপ
ব্রহ্ম’-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-৩।৯।২৮), ‘যিনি সাক্ষাৎ অপরোক্ষহেতু ব্রহ্ম, যিনি সর্বান্তর
আত্মা’-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ্-৩।৪।১) ইত্যাদি বেদবচনোক্ত ক্ষুধাপিপাসাদি সর্ব্ব সংসারধর্ম্মবর্জ্জিত,
‘নেতি নেতি’ বিচারের দ্বারা যাঁহাকে সমস্ত বিশেষ পদার্থ হইতে নিরস্তরূপে অর্থাৎ নির্ব্বিশেষরূপে
জানা যায়-এইরূপ তত্ত্বকে ব্রহ্মশব্দের দ্বারা বলা হয়। ব্রহ্ম এবং তাহাই অগ্নি, হোমাধিকরণত্বরূপে
বলিবার ইচ্ছাহেতু তিনিই (সেই ব্রহ্মই) ব্রহ্মাগ্নি, সেই ব্রহ্মাগ্নিতে অপরে অর্থাৎ
অন্যান্য ব্রহ্মবিদেরা যজ্ঞকে অর্থাৎ জীবাত্মাকে আহুতি দেন। আত্মা যজ্ঞশব্দবাচ্য, কারণ
আত্মার বহুনামের মধ্যে যজ্ঞ শব্দেরও উল্লেখ দেখা যায়। যজ্ঞশব্দবাচ্য আত্মা পরমার্থতঃ
পরব্রহ্মই হওয়ায় সেই জীবাত্মার যে বুদ্ধ্যাদি উপাধিসংযুক্ত জীবত্ব তাহাই আহুতিরূপ।
যজ্ঞের দ্বারা অর্থাৎ জীবত্মার দ্বারা অর্থাৎ উক্তলক্ষণ জীবোপাধির দ্বারা অপরে হোম
করেন। ব্রহ্মাত্মৈকত্ব-দর্শননিষ্ঠ সন্ন্যাসীরা এইরূপ হোম করেন অর্থাৎ সোপাধিক জীবাত্মাকে
নিরুপাধিক পরব্রহ্মস্বরূপে দর্শন করেন।
শ্রোত্রাদীনীন্দ্রিয়াণ্যন্যে
সংযমাগ্নিষু জুহ্বতি ৷
শব্দাদীন্বিষয়ানন্য ইন্দ্রিয়াগ্নিষু জুহ্বতি ৷৷ ২৬ ৷৷
অন্য যোগীরা শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়সকল সংযমরূপ অগ্নিসকলে
হবন করেন অর্থাৎ ইন্দ্রিয় সংযম করিয়া থাকেন। অন্যে শব্দাদি বিষয়সকল ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিসকলে
হবন করেন অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তত্ত্বজ্ঞানের অবিরুদ্ধ বিষয়ের গ্রহণকেই এখানে হোমরূপে
কল্পনা করা হইয়াছে।
সর্বাণীন্দ্রিয়কর্মাণি প্রাণকর্মাণি
চাপরে ৷
আত্মসংযমযোগাগ্নৌ জুহ্বতি জ্ঞানদীপিতে ৷৷ ২৭ ৷৷
অপরে সর্ব ইন্দ্রিয়কর্ম্মসকল এবং প্রাণকর্ম্মসকল
অর্থাৎ প্রাণ যে আধ্যাত্মিক বায়ু তাহার যে আকুঞ্চন প্রসারণ প্রভৃতি কর্ম্মসকল আত্মসংযমরূপ
যোগাগ্নিতে হোম করিয়া থাকেন। জ্ঞান-প্রদীপিত অর্থাৎ ঘৃতাদি স্নেহ পদার্থের দ্বারা যেমন
অগ্নি প্রজ্বলিত হইয়া উঠে, সেইরূপ বিবেকবিজ্ঞানের দ্বারা উজ্বলভাব প্রাপ্ত যে সংযমাগ্নি
তাহাতে ইন্দ্রিয় ও প্রাণ কর্ম্মসকলকে বিলীন করিয়া দেন।
দ্রব্যযজ্ঞাস্তপোযজ্ঞা যোগযজ্ঞাস্তথাপরে
৷
স্বাধ্যায়জ্ঞানযজ্ঞাশ্চ যতয়ঃ সংশিতব্রতাঃ ৷৷ ২৮ ৷৷
আবার কোন কোন যোগী তীর্থাদিতে যজ্ঞবুদ্ধিপূর্ব্বক
অন্নবস্ত্রাদি দ্রব্যের বিনিয়োগকারী দ্রব্যযজ্ঞনিষ্ঠ; আবার কোন কোন তপস্বীরা তপোযজ্ঞ
পরায়ণ, কেহ কেহ বা প্রাণায়াম-প্রত্যাহারাদিলক্ষণ অষ্টাঙ্গযোগ পরায়ণ এবং কোন কোন সম্যকরূপে
স্থিত তীক্ষ্ণীকৃত ব্রতী ও যত্নশীলেরা যথাবিধি ঋগাদিমন্ত্রাভ্যাস দ্বারা স্বাধ্যায়যজ্ঞ
পরায়ণ ও শাস্ত্রার্থ পরিজ্ঞানরূপ জ্ঞানযজ্ঞ পরায়ণ।
অপানে জুহ্বতি প্রাণ প্রাণেপানং
তথাপরে ৷
প্রাণাপানগতী রুদ্ধ্বা প্রাণায়ামপরায়ণাঃ ৷৷ ২৯ ৷৷
অন্যান্য যোগী অপানবায়ুতে প্রাণবায়ু আহুতি দেন
অর্থাৎ পূরক প্রাণায়াম করিয়া থাকেন এবং অপরে প্রাণবায়ুতে অপানবায়ু আহুতি দিয়া অর্থাৎ
রেচকনামক প্রাণায়াম করিয়া থাকেন। মুখ এবং নাসিকার দ্বারা বায়ুর নির্গমনকে প্রাণের গতি
বলে, তাহার বিপরীতভাবে অধোগমন অপানের গতি। সেই প্রাণ ও অপানবায়ুর গতি নিরোধপূর্বক প্রাণায়াম
পরায়ণেরা কুম্ভক নামক প্রাণায়াম করিয়া থাকেন।
অপরে নিয়তাহারাঃ প্রাণান্প্রাণেষু
জুহ্বতি৷
সর্বেপ্যেতে যজ্ঞবিদো যজ্ঞক্ষপিতকল্মষাঃ ৷৷ ৩০ ৷৷
অপর কোন কোন যোগী পরিমিত আহারপূর্ব্বক প্রাণবায়ুসমূহে
অন্যান্য প্রাণবায়ু আহুতি দেন অর্থাৎ যে যে প্রাণবায়ু জয় করেন, সেই সেই প্রাণবায়ুতে
অন্যান্য প্রাণবায়ু হোম করেন। এই সকল যজ্ঞবিদেরা শাস্ত্রোক্ত যজ্ঞ দ্বারা পাপমুক্ত
হন।
যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজো যান্তি
ব্রহ্ম সনাতনম্ ৷
নায়ং লোকোহস্ত্যযজ্ঞস্য কুতোহন্যঃ কুরুসত্তম ৷৷ ৩১ ৷৷
যথোক্ত যজ্ঞ কোরে তাহার অবশিষ্ট দ্বারা যথাকালে
যথাবিধি অমৃতাখ্য অন্ন ভোজন করে এইরূপ যজ্ঞশিষ্ট অমৃতভোজীরা সনাতন অর্থাৎ চিরন্তন ব্রহ্মে
গমন করে। হে কুরুশ্রেষ্ঠ! যথাশাস্ত্রোক্ত একটি যজ্ঞও যিনি অনুষ্ঠান করে না সেই অযজ্ঞের
পক্ষে সর্ব্ব-প্রাণিসাধারণের উপযোগী এই লোকও নেই; তাহার পক্ষে অন্য বিশিষ্ট সাধনের
দ্বারা সাধ্য স্বর্গাদি লোকসকল কি করিয়া থাকিতে পারে?
এবং বহুবিধা যজ্ঞা বিততা
ব্রহ্মণো মুখে ৷
কর্মজান্বিদ্ধি তান্সর্বানেবং জ্ঞাত্বা বিমোক্ষ্যসে ৷৷ ৩২ ৷৷
এইভাবে যথাশাস্ত্রোক্ত বহুপ্রকার যজ্ঞ বেদের মুখে
অর্থাৎ বেদকে দ্বারস্বরূপ করে বিস্তারিত হইয়াছে। যেমন ‘আমি বাক্যতে প্রাণকে হোম করি’
ইত্যাদি নানারূপ যজ্ঞের কথা বেদে আছে। সমস্ত যজ্ঞই কায়িক, বাচিক এবং মানস কর্মোদ্ভব
অর্থাৎ সমস্ত যজ্ঞ অনাত্মবস্তু হইতে জাত কারণ আত্মা নির্বাপার অর্থাৎ নিষ্ক্রিয়। কর্ম্ম
এবং অকর্ম্মতত্ত্ব এইভাবে যথার্থভাবে জেনে তুমি অশুভ হইতে মুক্তিলাভ করিবে। ‘এই সব
আমার কার্য্য নহে, আমি উদাসীন আত্মা, বুদ্ধ্যাদির কর্ম্ম আমার কর্ম্ম নহে’; এইভাবে
জেনে, এই সম্যকদর্শনহেতু সংসারবন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করিবে-এইরূপ অর্থ।
শ্রেয়ান্দ্রব্যময়াদ্যজ্ঞাজ্জ্ঞানযজ্ঞঃ
পরন্তপ ৷
সর্বং কর্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে ৷৷ ৩৩ ।।
হে পরন্তপ! দ্রব্যসাধন-সাধ্য
যজ্ঞ হইতে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ। দ্রব্যময় যজ্ঞই ফলারম্ভক, জ্ঞানযজ্ঞ ফলারম্ভক নহে, এইজন্য
জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেয়ঃতর অর্থাৎ প্রশস্যতর। হে পার্থ! যেহেতু অখিল অর্থাৎ অপ্রতিবদ্ধভাবে
সর্ব্বকর্ম জ্ঞানে অর্থাৎ মোক্ষসাধনে সর্বতঃ পরিপূর্ণ মহাসাগরবৎ যে জ্ঞান তাতে পরিসমাপ্ত
হয় অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত হয়। শ্রুতিতেও এই বিষয়টি প্রতিপাদিত হইয়াছে যে,
‘যেমন পাশাখেলায় কৃত অর্থাৎ চতুরঙ্ক পাশা বিজয় করিলে তাহার নিম্মসংখ্যাগুলিও আপনা হইতে
অধিকৃত হয়, সেইরূপ প্রজারা যাহা কিছু সাধুকর্ম্ম করে, তাহার সকল ফল, ব্রহ্মজ্ঞানীর
প্রাপ্তি হইয়া থাকে। রৈক্ক ঋষি যাহা জানেন সেইভাবে যে কেহ ব্রহ্মকে জানেন, তাহারও সেইরূপ
ফল হইয়া থাকে।’-(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৪।১।৪),
তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন
সেবয়া ৷
উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ ৷৷ ৩৪ ।।
সেই বিশিষ্ট জ্ঞান যে বিধির দ্বারা পাওয়া যায় তাহা
জান। আচার্য্যের নিকট গমন করে প্রকৃষ্টরূপে সর্বাঙ্গ নিম্নকরণের দ্বারা প্রণিপাত অর্থাৎ
দীর্ঘ নমস্কারের দ্বারা ‘বন্ধন কি?’, ‘মোক্ষ কি?’, ‘বিদ্যা কি?’, ‘অবিদ্যাই বা কি?’
ইত্যাদি পরিপ্রশ্ন এবং সেবা অর্থাৎ গুরুশুশ্রূষার দ্বারা সেই ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া
যায়। এইরূপ বিনয়াদির দ্বারা প্রসন্নভূত তত্ত্বদর্শী জ্ঞানী আচার্য্যেরা তোমাকে যথোক্ত-বিশেষণ
অর্থাৎ তত্ত্বদর্শনরূপ জ্ঞান উপদেশ প্রদান করিবেন।
যজ্জ্ঞাত্বা ন পুনর্মোহমেবং
যাস্যসি পাণ্ডব ৷
যেন ভূতান্যশেষেণ দ্রক্ষ্যস্যাত্মন্যথো ময়ি ৷৷ ৩৫ ৷৷
যে জ্ঞান তত্ত্বদর্শীদের দ্বারা উপদিষ্ট হইয়াছে
তাহা অধিগত অর্থাৎ প্রাপ্ত হইয়া পুনরায়, হে পাণ্ডব!
যেমন ইদানীং মোহপ্রাপ্ত হইয়াছ সেইরূপ পুনরায় প্রাপ্ত হইবে না। তথা, যে জ্ঞানের দ্বারা
ভূতসকলকে অশেষরূপে-ব্রহ্মাদি তৃণ পর্য্যন্ত- সাক্ষাৎভাবে আত্মাতে দেখিতে পাইবে, অর্থাৎ
আমি যে প্রত্যাগাত্মা, সেইজন্য আমাতে অর্থাৎ বাসুদেব পরমেশ্বরে এই ভূত সকল অনুভূত হইবে।
অর্থাৎ সেই জ্ঞানের দ্বারা সর্ব্ব উপনিষৎ- প্রসিদ্ধ ক্ষেত্রজ্ঞ বা জীব ও ঈশ্বরের একত্ব
দেখিতে পাইবে-এইরূপ অর্থ।
অপি চেদসি পাপেভ্যঃ সর্বেভ্যঃ
পাপকৃত্তমঃ ৷
সর্বং জ্ঞানপ্লবেনৈব বৃজিনং সন্তরিষ্যসি ৷৷ ৩৬ ৷।
এই জ্ঞানের মাহাত্ম্য শ্রবণ কর-যদি সর্ব্ব পাপকারিগণ
অপেক্ষাও অতিশয় পাপিষ্ট হও, তাহা হইলেও জ্ঞানরূপ ভেলা দ্বারা পাপরূপ সমুদ্রকে পার হইতে
পারিবে। এখানে শুধু নিষিদ্ধ কর্ম্মকে পাপ বলা হইতেছে না, মুমুক্ষুর পক্ষে ধর্ম্মও অর্থাৎ
অহং-মমতাযুক্ত সকাম বৈধ কর্ম্মকেও পাপের অন্তর্ভূক্ত করা হইতেছে।
যথৈধাংসি সমিদ্ধোগ্নির্ভস্মসাত্কুরুতের্জুন
৷
জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাত্কুরুতে তথা ৷৷ ৩৭ ৷৷
সম্যকরূপে দীপ্ত অগ্নি যেমন কাষ্ঠসকলকে ভষ্মসাৎ
করে, হে অর্জ্জুন! সেইরূপ জ্ঞানাগ্নি সর্ব্বকর্ম্মসকল ভষ্মসাৎ করে অর্থাৎ সদসৎ সংস্কার
নির্বীজ করে। পরন্তু জ্ঞানাগ্নি সাক্ষাৎভাবে কর্ম্মসকলকে কাষ্ঠবৎ ভষ্ম করিতে পারে না,
সেইজন্য সম্যক্ দর্শনই কর্ম্মসকলের নির্বীজত্বের কারণ-এইরূপ শ্রীভগবানের কথার অভিপ্রায়।
অতীত অনেক জন্মের সঞ্চিত, ইহজন্মে জ্ঞানোৎপত্তির পূর্বে কৃত এবং জ্ঞান সহ ভাবী সমস্ত
কর্ম জ্ঞান দ্বারা বিনষ্ট হয়। কিন্তু প্রারব্ধ কর্ম নষ্ট না হইয়া উপভোগের দ্বারা ক্ষয়
প্রাপ্ত হয়। যে কর্ম্ম হইতে এই শরীর আরব্ধ তা ফলদানে প্রবৃত্ত হওয়ায় তাহাকে প্রারব্ধ
বলে।
ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ
বিদ্যতে ৷
তত্স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি ৷৷ ৩৮ ৷৷
ইহসংসারে জ্ঞানের সদৃশ পবিত্র পাবন বা শুদ্ধিকর
আর কিছু নাই। যাঁহারা স্বয়ং কর্ম্মযোগ বা সমাধিযোগ অভ্যাসের দ্বারা সংসিদ্ধ অর্থাৎ
সংস্কৃত বা যোগ্যতা প্রাপ্ত মুমুক্ষু দীর্ঘ কাল পরে সেই জ্ঞান আত্মাতেই লাভ করিয়া থাকেন-এইরূপ
অর্থ।
শ্রদ্ধাবাঁল্লভতে জ্ঞানং
তত্পরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ ৷
জ্ঞানং লব্ধ্বা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি ৷৷ ৩৯ ৷৷
শ্রদ্ধাবান্ জ্ঞান লাভ করে। শ্রদ্ধালু হইলেও কেহ
কেহ হয়ত তত্ত্বজ্ঞান সম্বন্ধে মন্দপ্রযত্ন হইতে পারে, সেইজন্য বলিতেছেন জ্ঞানলাভের
উপায়ে তৎপর অর্থাৎ গুরু উপসনাদিতে অভিযুক্ত হইতে হইবে। শ্রদ্ধাবান্ এবং তৎপর হইয়াও
যদি অজিতেন্দ্রিয় হয়, সেইজন্য বলিতেছন সংযতেন্দ্রিয় হইতে হইবে অর্থাৎ বিষয় থেকে নিবর্তিত
হইয়াছে যাঁহার ইন্দ্রিয়সকল তিনি সংযতেন্দ্রিয়। যিনি এইরূপ শ্রদ্ধাবান্, তৎপর ও শ্রদ্ধালু
তিনি অবশ্যই জ্ঞান লাভ করেন। জ্ঞানলাভ করিয়া পরা অর্থাৎ মোক্ষাখ্য শান্তি বা উপরতি
অচিরে অর্থাৎ শীঘ্রই লাভ হইয়া থাকে। সম্যক্ দর্শন হইতে শীঘ্র মোক্ষ হইয়া থাকে-ইহাই
সর্বশাস্ত্রন্যায় প্রসিদ্ধ সুনিশ্চিত অর্থ৷
অজ্ঞশ্চাশ্রদ্দধানশ্চ সংশয়াত্মা
বিনশ্যতি৷
নায়ং লোকোস্তি ন পরো ন সুখং সংশয়াত্মনঃ ৷৷ ৪০ ৷৷
অজ্ঞ অর্থাৎ অনাত্মজ্ঞ, গুরু ও শাস্ত্রবাক্যে শ্রদ্ধাহীন
এবং সংশয়াত্মা অর্থাৎ সন্দেহাকুলচিত্ত ব্যক্তি বিনষ্ট হয়। এই তিনটি মোক্ষবিরোধী ধর্ম্মীর
মধ্যে সংশয়াত্মা অধিক পাপিষ্ঠ; কেননা তাহাদের এই সাধারণলোকও নেই, পরলোকও নেই, সুখও
নেই, কারণ ঐ সকল বিষয়েও সংশয়চিত্তদের সংশয় উপস্থিত হয়। সেইজন্য সংশয় কর্ত্তব্য নহে।
যোগসংন্যস্তকর্মাণং জ্ঞানসংছিন্নসংশয়ম্৷
আত্মবন্তং ন কর্মাণি নিবধ্নন্তি ধনঞ্জয় ৷৷ ৪১ ৷৷
পরমার্থদর্শনলক্ষণ যোগের দ্বারা সমস্ত ধর্ম্মাধর্মাখ্য-কর্ম্ম
পরিত্যক্ত হইয়াছে যে পরমার্থদর্শীর দ্বারা তিনি যোগসংন্যস্তকর্ম্মা। যোগসংন্যস্তকর্ম্মা
ব্যক্তি কিরূপ? জ্ঞান-সংছিন্ন-সংশয় অর্থাৎ আত্মা ও ঈশ্বরের একত্বদর্শনলক্ষণ জ্ঞানের
দ্বারা সংচ্ছিন্ন হইয়াছে সংশয় যাঁহার। যিনি এইরূপ যোগসংন্যস্তকর্ম্মা সেই আত্মবন্ত
অর্থাৎ অপ্রমত্ত ব্যক্তিকে গুণচেষ্টারূপ দৃষ্ট কর্ম্মসকল নিবদ্ধ করিতে পারে না, অর্থাৎ
হে ধনঞ্জয়! ঐ সকল কর্ম্মের অনিষ্ঠাদিরূপ ফল ঐ আত্মবন্তের প্রতি ফলদান করে না।
তস্মাদজ্ঞানসংভূতং হৃত্স্থং
জ্ঞানাসিনাত্মনঃ ৷
ছিত্ত্বৈনং সংশয়ং যোগমাতিষ্ঠোত্তিষ্ঠ ভারত ৷৷ ৪২ ৷৷
সেইজন্য পাপিষ্ঠ অজ্ঞানসম্ভূত অর্থাৎ অবিবেকজাত
হৃদয়স্থ অর্থাৎ বুদ্ধিতে স্থিত সংশয় শোকমোহাদি দোষহর সম্যগ্ দর্শনরূপ জ্ঞানাসি অর্থাৎ
জ্ঞানরূপ খড়্গ দ্বারা নিজের পাপ ছেদন কর। নিজের বিনাশের হেতুভূত এই সংশয় ছেদন করে,
সম্যগ্-দর্শনের উপায়স্বরূপ কর্ম্মযোগ অনুষ্ঠান কর। হে ভারত! এক্ষণে যুদ্ধের নিমিত্ত
উত্থিত হও।
ইতি
শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং
ভীষ্মপর্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু
ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে
শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসম্বাদে
জ্ঞানযোগো
নাম
চতুর্থোঽধ্যায়ঃ।
ॐ নমো ভগবতে বাসুদেবায়।
॥ শ্রীবেদব্যাসায় নমঃ॥ শ্রীশঙ্করভগবত্পাদাচার্যস্বামিনে
নমঃ ॥