ভগবান্ সূত্রকার বাদরায়ণের বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রের প্রথম সুত্র ‘অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১) সাধনচতুষ্টয়ের আনন্তর্য্যই সূত্রস্থ 'অথ' শব্দের অর্থ। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য উক্ত সূত্রের ভাষ্যে বলছেন,'নিত্যানিত্যবস্তুবিবেক, ইহামুত্রফলভোগবিরাগ, শমদমাদি সাধনের উৎকর্ষ প্রাপ্তি এবং মোক্ষলাভের ইচ্ছা, ইহাদের অব্যবহিত পরেই ব্রহ্মজিজ্ঞাসা উপদিষ্ট হচ্ছে। সেই সকল বর্ত্তমান থাকলে ধর্ম্মজিজ্ঞাসার পূর্বেও এবং পরেও ব্রহ্মজিজ্ঞাসা করতে এবং তাঁকে জানতে পারা যায়, কিন্তু বিপর্যয় হলে অর্থাৎ সাধন চতুষ্টয় না থাকলে তা পারা যায় না। সেইহতু 'অথ' শব্দের দ্বারা যথোক্ত সাধনচতুষ্টয়ের উৎকর্ষপ্রাপ্তির আনন্তর্য্যই উপদিষ্ট হচ্ছেঠ।
ভাষ্যকার যে চারটি সাধনের কথা বলছেন তার প্রথমটি হচ্ছে নিত্যানিত্যবস্তু-বিবেক। তারপর, পর পর আসছে, ইহামুত্রফলভোগবিরাগ, শমাদিষট্ সম্পত্তি ও মুমুক্ষুত্ব। এইগুলি নিঃসংশয়ে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের উপায়।
১. নিত্যানিত্যবস্তু-বিবেকঃ- একমাত্র ব্রহ্মই নিত্য ও সত্য এবং জগৎপ্রপঞ্চ অনিত্য ও মিথ্যা এই ধারণায় দৃঢ় প্রত্যয় হওয়াকেই নিত্য-অনিত্য-বস্তু-বিবেক বলে।
২. ইহামুত্রফলভোগবিরাগঃ- নিজের দেহ থেকে আরম্ভ করে ব্রহ্মার দেহ-পর্যন্ত সমস্ত অনিত্য ভোগের সামগ্রীর দোষ-দর্শন ও সেসবের দোষের কথা শোনার ফলে ভোগ্যবস্তুতে যে অনীহা জাগে ও সে সমস্ত ত্যাগ করার ইচ্ছা জন্মায় তাকেই বৈরাগ্য বলা হয়।
৩. সাধনসম্পত্তিঃ- ‘সাধনসম্পত্তি’ বলতে বোঝায় শম্, দম্, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান ও শ্রদ্ধা। প্রতি মুহূর্তে বিষয়সমূহে দোষ দেখতে পাওয়ার ফলে বিষয়ে যে বৈরাগ্য আসে তা থেকে মনের নিজ লক্ষ্যস্থল ব্রহ্মে নিশ্চল স্থিতি লাভ হয়, একে শম বলা হয়। উভয় প্রকারের ইন্দ্রিয়গুলিকে (অর্থাৎ কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়কে) সমস্ত বিষয় থেকে বিমুখ করে তাদের নিজের নিজের জায়গায় নিশ্চল ভাবে ধরে রাখাকেই দম বলে। চিত্তবৃত্তিকে বাহ্যবিষয় অবলম্বন না করতে দেওয়াই শ্রেষ্ঠ উপরতি। কোন রকম চিন্তাভাবনা বা বিলাপ না করে সব রকমের দুঃখকেই গ্রহণ করে নেওয়া এবং বিনা প্রতিকারে তাদের সহ্য করে যাওয়াকে বলে তিতিক্ষা। শাস্ত্র ও গুরুবাক্যের সত্যতায় দৃঢ় বিশ্বাস রাখা ও অন্তরে সেই বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করাকে জ্ঞানীরা শ্রদ্ধা বলেন। এই শ্রদ্ধার সাহায্যে আত্মবস্তু লাভ হয়। সব সময়, সবরকম ভাবে বুদ্ধিকে শুদ্ধব্রহ্মে লগ্ন করে রাখাকে সমাধান বলে। কিন্তু বেদান্ততত্ত্ব আলোচনা করে চিত্তের যে প্রসন্নতা হয়, তা সমাধান নয়।
৪. মুমুক্ষুত্বঃ- অহঙ্কার থেকে আরম্ভ করে স্থূল দেহ পর্যন্ত যেসব বন্ধন সেগুলো অজ্ঞান কল্পিত। নিজের স্বরূপজ্ঞানের দ্বারা সেইসব বন্ধন থেকে মুক্তি লাভের ইচ্ছাই মুমুক্ষুতা।
No comments:
Post a Comment