Tuesday, 31 March 2020

অবিদ্যাবস্থাতে জীব ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন হওয়ায় অহিতকরণাদি দোষ জীবেরই, ব্রহ্মের নহেঃ-


জীবের 'তত্ত্বমসি' ইত্যাদি বাক্যের দ্বারা ব্রহ্মত্ব কথিত হইয়াছে বলিয়া ব্রহ্ম জগৎস্রষ্টা হইলে জীবেরই স্রষ্টৃত্ব হইয়া পড়ে। এইহেতু ব্রহ্মে অহিত যে জরামরণ প্রভৃতি বহুবিধ অনিষ্টকরারূপ দোষ, তাহার প্রাপ্তি হইয়া পড়িবে। অর্থাৎ জীব ব্রহ্মে অভেদ উক্তি করিলে জীবের হিতকার্যাদির অকরণ এবং এই জাতীয় অন্যান্য দোষগুলি ব্রহ্মেও আরোপিত হইবার আশঙ্কা আছে। এইরূপ পূর্বপক্ষ প্রাপ্ত হইলে ভগবান্ সূত্রকার সিদ্ধান্ত করিতেছেন

'অধিকং তু ভেদনির্দ্দেশাৎ৷৷'-(ব্রহ্মসূত্র ..২২)

শারীরকভাষ্যে আচার্য্য শঙ্কর ভগবৎপাদ্ বলিতেছেন—'তু' শব্দটি পূর্ব্বপক্ষকে নিরাকরণ করিতেছে। যিনি সর্বজ্ঞ, সর্ব্বশক্তিমান নিত্যশুদ্ধবুদ্ধমুক্তস্বভাব ব্রহ্ম, তিনি জীব হইতে অধিক অর্থাৎ ভিন্ন, তাঁহাকেই আমরা জগতের স্রষ্টা বলিতেছি। তাঁহাতে নিজের মঙ্গল না করা প্রভৃতি দোষসকল প্রসক্ত হয় না। যেহেতু তাঁহার করণীয় হিত কিছুই নাই এবং পরিহরণীয় অহিতও কিছুই নাই, কারণ তিনি নিত্য মুক্তস্বভাব। আর তাঁহার জ্ঞানের প্রতিবন্ধ অথবা শক্তির প্রতিবন্ধ কোথাও হয় না, যেহেতু তিনি সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিসম্পন্ন। জীব কিন্তু এই প্রকার সর্ব্বজ্ঞত্বাদি গুণযুক্ত নহে, স্বীয় মঙ্গল না করা প্রভৃতি দোষসকল অবশ্যই তাহাতে হইয়া পড়ে। কিন্তু জীবকে আমরা জগতের স্রষ্টা বলি না। ইহা কোন হেতুবলে বলা যায়?

যেহেতু সংসার দশাতে অবিদ্যাবস্থাতে জীব ব্রহ্মের মধ্যে ভেদের নির্দ্দেশ আছে।

'আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্রোতব্যো মন্তব্যো নিদিধ্যাসিতব্যঃ '-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ ২।৪।৫)

অর্থাৎ হে মৈত্রেয়ি, আত্মাই দ্রষ্টব্য শ্রোতব্য নিশ্চিতরূপে ধ্যেয়।

'সোন্বেষ্টব্যঃ বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ'- (ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৮।৭।১)

অর্থাৎ তিনি অন্বেষণের যোগ্য (শাস্ত্র আচার্য্যের দ্বারা জ্ঞাতব্য) এবং স্বসংবেদ্যরূপে জানিবার যোগ্য।

'সতা সোম্য তদা সংপন্নো ভবতি' - (ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।৮।১)

অর্থাৎ হে প্রিয়দর্শন, তখন জীব সতের অর্থাৎ ব্রহ্মের সহিত একীভূত হয়।

'শারীর আত্মা প্রাজ্ঞেনাত্মনান্বারূঢঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ ৪।৩।৩৫)

অর্থাৎ জীবাত্মা প্রাজ্ঞ আত্মার অধিষ্ঠিত হইয়া,......ইত্যাদি এইজাতীয় যে জীব ব্রহ্মের মধ্যে কর্ত্তা কর্ম্ম প্রভৃতিরূপে বিভিন্নতার নির্দ্দেশ তাহা জীব হইতে ভিন্নরূপে ব্রহ্মকে প্রদর্শন করিতেছে।

কিন্তু শঙ্কা হইল 'তত্ত্বমসি' (ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।৮।৭) 'তুমিই তিনি', ইত্যাদি এইজাতীয় অভিন্নতার নির্দ্দেশও শ্রুতিতে প্রদর্শিত হইয়াছে। সুতরাং জীব ব্রহ্মের মধ্যে বিরুদ্ধ যে ভিন্নতা অভিন্নতা, তাহা কি প্রকারে সম্ভব হইবেতদুত্তরে বলিব, ইহা দোষ নহে, যেহেতু মহাকাশ ঘটাকাশ অবলম্বী যুক্তি দ্বারা এই উভয়ের সম্ভাবনা সেই সেই স্থলে প্রতিপাদিত হইয়াছে। (এই বিষয়ে ব্রহ্মসূত্রের ২।১।১৪ এর ভাষ্যে ভগবান্ শঙ্করাচার্য্য বলিতেছেনঘট কমণ্ডলু প্রভৃতির অন্তর্গত আকাশসকল যেমন হয় মহাকাশ হইতে অভিন্ন, আর দৃষ্ট নষ্ট স্বরূপ হওয়ায় এবং স্বরূপতঃ অনুপাখ্য অর্থাৎ বস্তুসত্তারহিত, সৎ বা অসৎরূপে নির্ব্বাচনের অযোগ্য হওয়ায় মৃগতৃষ্ণিকার জল প্রভৃতি যেমন ঊষরভূমি অর্থাৎ মরুভূমি প্রভৃতি হইতে অভিন্ন, এইরূপে এই ভোগ্য ভোক্তা প্রভৃতি সমন্বিত প্রপঞ্চসমূহের ব্রহ্মরূপ অধিষ্ঠান ব্যতিরেকে তাহাদের সত্তা নাই।)

আর দেখ, যখন 'তত্ত্বমসি' ইত্যাদি এইজাতীয় অভেদনির্দ্দেশের দ্বারা জীব ব্রহ্মের অভিন্নতা বিজ্ঞাপিত হয়, তখন জীবের সংসারিত্ব ব্রহ্মের স্রষ্টৃত্ব অপগত হয়, কারণ মিথ্যা অজ্ঞানের দ্বারা বিস্তারিত সমস্ত ভেদব্যবহার সম্যগ্ জ্ঞানের দ্বারা বাধিত হইয়া পড়ে। সেই অবস্থাতে সৃষ্টিই বা কোথায় এবং অহিতকরণ প্রভৃতি দোষসকলই বা কোথায়? অবিদ্যাকর্ত্তৃক প্রত্যুপস্থাপিত নাম রূপের দ্বারা কৃত যে দেহেন্দ্রিয়সংঘাতরূপ উপাধি, তদ্বিষয়ক অবিবেককৃত ভ্রান্তিই অহিতকরণাদিরূপ সংসার, তাহা কিন্তু আত্মাতে জন্ম, মরণ, ছেদন ভেদন প্রভৃতি অভিমানের ন্যায় পরমার্থতঃ নাই। ইহা বহুবার বলা হইয়াছে। ভেদব্যবহার বাধিত না হইলে 'তিনি অন্বেষণের যোগ্য (শাস্ত্র আচার্য্যের দ্বারা জ্ঞাতব্য) এবং স্বসংবেদ্যরূপে জানিবার যোগ্য।' ইত্যাদি এইজাতীয় ভেদনির্দ্দেশের দ্বারা ব্রহ্মের যে জীব হইতে ভিন্নতা অবগত হওয়া যায়, তাহা ব্রহ্মে হিতাকরণাদি দোষের সম্ভাবনাকে নিরাকরণ করে। অতএব অবিদ্যাবস্থাতে ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন যে জীব, স্বীয় অহিতকরণাদিদোষ তাহারই, অসঙ্গ ব্রহ্মের নহে।.......

তথ্যসূত্রঃ- বেদান্তদর্শন, ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের শারীরক-মীমাংসা ভাষ্য।

শ্রীশুভ চৌধুরী

মার্চ ৩০, ২০২০ খৃষ্টাব্দ।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...