Monday, 31 January 2022

ইন্দ্রিয়সকল অণু পরিমাণঃ-

 


ইন্দ্রিয়সকল ব্যাপী, অথবা অণুপরিমাণ? এই সংশয়ের সমাধান রহিয়াছে বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রের প্রাণাণুত্বাধিকরণে। অধিকরণ প্রতিপাদ্য বিষয় হইল ইন্দ্রিয়সকলের পরিচ্ছিন্ন পরিমাণতা। ভগবান সূত্রকার সিদ্ধান্ত করিতেছেন-

অণবশ্চ।। -(ব্রহ্মসূত্র ২/৪/৭)

ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য ভাষ্যে বলিতেছেন- এক্ষণে সেই ইন্দ্রিয়সকলেরই পরিমাণরূপ অন্য স্বভাবকে ভগবান সূত্রকার সংগ্রহ করিতেছেন। প্রস্তাবিত এই ইন্দ্রিয়সকলকে অণুপরিমাণ বুঝিতে হইবে। সূক্ষ্মতা ও পরিচ্ছিন্নতাই (-মধ্যমপরিমাণতাই) ইহাদের অণুতা, কিন্তু পরমাণুতুল্যতা নহে, যেহেতু তাহা হইলে সমগ্রদেহব্যাপী কার্য্য অসঙ্গত হইয়া পড়িবে। এই ইন্দ্রিয়সকল সূক্ষ্ম, যদি স্থূল হইত, মরণকালে শরীর হইতে নির্গমনকারী ইহারা ম্রিয়মাণ ব্যক্তির পার্শ্বস্থ পুরুষগণকর্ত্তৃক গর্ত্ত হইতে নির্গত সর্পের ন্যায় উপলব্ধ হইত। আর এই ইন্দ্রিয়সকল পরিচ্ছিন্ন; যদি সর্ব্বগত হইত, উৎক্রমণ, পরলোক গমন এবং তথা হইতে আগমন প্রতিপাদিকা শ্রুতির বিরোধ হইয়া পড়িত। (কারণ স্বরূপতঃ বিভু জীবের বুদ্ধ্যাদি উপাধিও বিভু হইলে তাহার উৎক্রান্তি প্রভৃতি সম্ভব হইবে না।).......

 

'ন তস্য প্রতিমা অস্তি' অর্থাৎ তাঁহার কোন উপমা নেইঃ-



শুক্লযজুর্বেদ সংহিতার দ্বাত্রিংশ অধ্যায়ের এই মন্ত্রাংশটুকুর ভাবার্থ নিয়া অনেক আলোচনা সমালোচনা হইয়া থাকে। আচার্য শঙ্কর শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ভাষ্যে ইহার ভাবার্থ স্পষ্ট করিতেছেন-

নৈনমূর্ধ্বং ন তির্যঞ্চং

ন মধ্যে ন পরিজগ্রভৎ ।

ন তস্য প্রতিমা অস্তি

যস্য নাম মহদ্ যশঃ ॥

-(শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ-৪/১৯)

শাঙ্করভাষ্য অনুবাদঃ- কূটস্থ ব্রহ্ম ঊর্দ্ধাদি কোন দিকে কাহারো গ্রহণযোগ্য নহে, অদ্বিতীয়ত্ব নিবন্ধন কাহারো সঙ্গে তুলনার যোগ্যও নহে, এবং তাঁহার যশঃ কাল ও দিগাদি দ্বারা সীমাবদ্ধ নহে; এই অভিপ্রায়ে বলিতেছেন-'নৈনমূর্ধ্বং' ইত্যাদি।

যেহেতু এই আত্মা সর্ব্বপ্রকার পরিচ্ছেদরহিত নিরংশ ও নিরবয়ব, সেইহেতু কেহই তাহাঁকে ঊর্দ্ধ-অধঃ প্রভৃতি দিকে গ্রহণ করিতে সমর্থ হয় না। সেই পরমেশ্বর অখণ্ড আনন্দানুভবস্বরূপ এবং দ্বিতীয়রহিত, এইজন্য তাঁহার প্রতিমা অর্থাৎ উপমা নাই। দিক্ প্রভৃতি দ্বারা অপরিচ্ছিন্ন মহৎযশ কীর্ত্তিই যাহার নাম অর্থাৎ কেবল কীর্ত্তি দ্বারা যাহার উল্লেখ মাত্র হয়, তাহার উপমা নাই।

 

Tuesday, 25 January 2022

শতশ্লোকী অথবা বেদান্তকেশরী

 


শতশ্লোকী অথবা বেদান্তকেশরী

শ্রীঃ॥

অথ শতশ্লোকী॥

দৃষ্টান্তো নৈব দৃষ্টস্ত্রিভুবনজঠরে সদ্গুরোর্জ্ঞানদাতুঃ

স্পর্শশ্চেত্তত্র কল্প্যঃ নয়তি যদহো স্বর্ণতামশ্মসারম্

স্পর্শত্বং তথাপি শ্রিতচরণয়ুগে সদ্গুরুঃ স্বীয়শিষ্যে

স্বীয়ং সাম্যং বিধত্তে ভবতি নিরুপমস্তেন বাঽলৌকিকোঽপি ||||

আনন্দ গিরি টীকা - দৃষ্টান্ত ইতি। জ্ঞানদাতুঃ সদ্গুরোস্ত্রিভুবনজঠরে দৃষ্টান্তো নৈব দৃষ্টঃ। ক্ষুদ্রবিদ্যোপদেষ্টৃণাং গুরূণাং দৃষ্টান্তঃ কথঞ্চিদুপলভ্যতে। পরন্তু " হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যত" ইত্যুক্তত্বাৎ, জ্ঞানদাতুঃ শ্রীগুরোর্দৃষ্টান্তঃ ত্রিভুবনজঠরান্তর্বতিষু দেবাদিষু লৌকিকেষু নানাবিচিত্রবস্তুষু নৈব দৃষ্টঃ। অথ মনাক্সাম্যদর্শনেন স্পর্শপাষাণো দৃষ্টান্তত্বেন কল্প্যঃ কল্পনীয়শ্চেৎ, তথাপি ঘটত ইত্যাহ নয়তীতি। স্পর্শাশ্মা অশ্মসারং লোহং যদ্যপি স্বর্ণতাং নয়তি প্রাপয়তি, তথাপি স্পর্শত্বং প্রাপয়তি, স্বসদৃশং করোতি। সদ্গুরুস্তু শ্রিতচরণযুগে স্বীয়শিষ্যে স্বীয়ং সাম্যং বিধত্তে। তেন কারণেন স্পর্শাদের্দৃষ্টান্তানর্হত্বাদ্ গুরুর্নিরুপমো দৃষ্টান্তশূন্যঃ তথাঽলৌকিকোঽপি প্রপঞ্চাতীতোঽপি ( দৃষ্টঃ। ) আত্মাকারত্বাৎ "জ্ঞানী ত্বাত্মৈব মে মত" মিতি ভগবদ্বাক্যাৎ ||||

ভাবার্থ - ত্রিভুবনমধ্যে জ্ঞানদাতা সদ্গুরুর দৃষ্টান্ত দেখা যায় না। যদি বল, স্পর্শমণিই দৃষ্টান্তরূপে কল্পিত হবে; কারণ, ওটা লৌহকেও স্বর্ণে পরিণত করে থাকে। তাহলে বলব - না, স্পর্শমণি সদ্গুরুর দৃষ্টান্ত হতে পারে না; কারণ, স্পর্শমণি লৌহকে স্পর্শমণিতে পরিণত করতে পারে না, সুবর্ণেই পরিণত করে থাকে; আর চরণযুগলে আশ্রিত স্বীয় শিষ্যকে সদ্গুরু স্বকীয় সাম্যই প্রদান করে থাকেন। অতএব সদ্গুরু উপমারহিত অথবা অলৌকিক ||||

যদ্বচ্ছ্রীখণ্ডবৃক্ষপ্রসৃতপরিমলেনাভিতোঽন্যেঽপি বৃক্ষাঃ

শশ্বৎ সৌগন্ধ্যভাজোঽপ্যতনুতনুভৃতাং তাপমুন্মূলয়ন্তি

আচার্যাল্লব্ধবোধা অপি বিধিবশতঃ সংনিধৌ সংস্থিতানাং

ত্রেধা তাপং পাপং সকরুণহৃদয়াঃ স্বোক্তিভিঃ ক্ষালয়ন্তি ||||

ভাবার্থ - যেমন চন্দনবৃক্ষ হতে প্রসূত সৌগন্ধ দ্বারা চারিপার্শ্ব স্থিত বৃক্ষ সকল নিরন্তর সুগন্ধযুক্ত হয়েও অনেক লোকের তাপ নাম করে থাকে, সেইরূপ ভাগ্যবশতঃ যারা আচার্য্যের নিকট হতে জ্ঞানলাভ করেছেন, করুণহৃদয় সেই শিষ্যগণও স্বকীয় উক্তি দ্বারা সমীপস্থিত জনগণের আধ্যাত্মিকাদি ত্রিবিধ পাপতাপ বিধৌত করে থাকেন ||||

আত্মানাত্মপ্রতীতিঃ প্রথমমভিহিতা সত্যমিথ্যাত্বষোগাদ্

দ্বেধা ব্রহ্মপ্রতীতির্নিগমনিগদিতা স্বানুভূত্যোপপত্ত্যা

আদ্যা দেহানুবন্ধাদ্ভবতি তদপরা সা সর্বাত্মকত্বাৎ

আদৌ ব্রহ্মাঽহমস্মীত্যনুভব উদিতে খল্বিদং ব্রহ্ম পশ্চাৎ ||||

ভাবার্থ - এই শ্লোকে আত্মা এবং অনাত্মার প্রতীতির প্রকার বলছেন। প্রথমতঃ সত্যত্বের এবং মিথ্যাত্বের যােগ দ্বারা আত্মা এবং অনাত্মার প্রতীতির বিষয় বলা

হয়ে থাকে; অর্থাৎ "সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম" ইত্যাদি শ্রুতিবলে যা সত্য তাই আত্মা এবং তদ্বিপরীত যা মিথ্যা তাই অনাত্মা-এইরূপে সত্য এবং মিথ্যারূপ দুইটি কোটিই প্রথমতঃ তত্ত্ববিচারে পাওয়া যায়। বেদে দুইপ্রকার ব্রহ্মপ্রতীতির বিষয় বলা হয়েছে; প্রথম-স্বানুভূতি দ্বারা, দ্বিতীয়-যুক্তি দ্বারা। প্রথম প্রকারের অনু্ভূতি শরীরবচ্ছেদে, এবং দ্বিতীয় প্রকারের অনুভূতি সর্বাত্মকরূপে হয়ে থাকে ( অর্থাৎ ) প্রথমতঃ "অহং ব্রহ্ম" এই প্রকার অনুভব উদিত হলে পশ্চাৎ ( যুক্তি দ্বারা ) "সর্ব্বং খল্বিদং ব্রহ্ম" অর্থাৎ 'এই সকলই ব্রহ্ম' এই প্রকার অনুভব হয়ে থাকে ||||

আত্মা চিদ্বিৎসুখাত্মানুভবপরিচিতঃ সর্বদেহাদিয়ন্তা

সত্যেবং মূঢবুদ্ধির্ভজতি ননু জনোঽনিত্যদেহাত্মবুদ্ধিম্

বাহ্যোঽস্থিস্নায়ুমজ্জাপলরুধিরবসাচর্মমেদোয়ুগন্ত-

র্বিণ্মূত্রশ্লেষ্মপূর্ণং স্বপরবপুরহো সংবিদিত্বাপি ভূয়ঃ ||||

ভাবার্থ - আত্মা চিৎস্বরূপ, বিজ্ঞানস্বরূপ এবং পরমানন্দস্বরূপ এবং সকল দেহাদির নিয়ন্তারূপেই নিরন্তরাভ্যাস দ্বারা জ্ঞাত হন। এইরূপে অনুভবের বিষয় হলেও মূঢ়বুদ্ধি ব্যক্তিগণ স্বকীয় এবং পরকীয় শরীরকে বাহিরে অস্থি, স্নায়ু, মজ্জা, মাংস, রুধির, চৰ্ব্বি, চর্ম্ম মেদযুক্ত এবং অভ্যন্তরে মলমুত্র শ্লেষ্মাপূর্ণরূপে জেনেও পুনরায় অনিত্য দেহাদিকে আত্মারূপে জেনে থাকে। ( মূলে পাঠ আছে "চিদ্বিৎসুখাত্মা" এর অর্থ চিৎস্বরূপ বিজ্ঞানস্বরূপ এবং সুখস্বরূপ। চিৎ এবং বিজ্ঞান অভিন্নাত্মক। অতএব মনে হয়, মূলে পাঠ ছিল "সচ্চিৎসুখাত্মা। এই পাঠে ছন্দপতনও হয় না অথচ ব্রহ্মের সচ্চিদানন্দ স্বরূপতাও লাভ হয়। আমরা আনন্দগিরির ব্যাখ্যানুসারেই অনুবাদ করলাম।)

দেহস্ত্রীপুত্রমিত্রানুচরহয়বৃষাস্তোষহেতুর্মমেত্থং

সর্বে স্বায়ুর্নয়ন্তি প্রথিতমলমমী মাংসমীমাংসয়েহ

এতে জীবন্তি যেন ব্যবহৃতিপটবো যেন সৌভাগ্যভাজ-

স্তং প্রাণাধীশমন্তর্গতমমৃতমমুং নৈব মীমাংসয়ন্তি ||||

ভাবার্থ - সকলেই 'দেহ, স্ত্রী, পুত্র, মিত্র, অনুচর, অশ্ব এবং বৃষ আমার প্রীতিহেতু,' এই রূপেই মাংসপিণ্ডমাত্রের বিচার দ্বারা, ( বংশবিজ্ঞানাদি দ্বারা ) প্রথিত, স্বকীয় পূর্ণ আয়ুঃ ক্ষেপণ করে থাকে। কিন্তু যা দ্বারা সকল লােক বেঁচে থাকে, যদ্দ্বারা

ব্যবহারনিপুণ হয় এবং যদ্দ্বারা সৌভাগ্যবান্ হয়ে থাকে, সেই অন্তর্য্যামী অমৃতস্বরূপ এবং প্রাণেরও অধিপতি আত্মাকে চিন্তা করে না ||||

কশ্চিৎকীটঃ কথঞ্চিৎপটুমতিরভিতঃ কণ্টকানাং কুটীরং

কুর্বংস্তেনৈব সাকং ব্যবহৃতিবিধয়ে চেষ্টতে যাবদায়ুঃ

তদ্বজ্জীবোঽপি নানাচরিতসমুদিতৈঃ কর্মভিঃ স্থূলদেহং

নির্মায়াত্রৈব তিষ্ঠন্ননুদিনমমুনা সাকমভ্যেতি ভূমৌ ||||

ভাবার্থ - যেমন কোন সুদক্ষ কীট কোন প্রকারে চারদিকে কণ্টক দ্বারা কুটির নির্মাণ করতঃ স্বকীয় ব্যবহার নিষ্পাদনের নিমিত্ত আয়ুর শেষকাল পর্যন্ত কুটীর লয়েই চেষ্টা করে থাকে, সেইরূপ জীবও নানাবিধ আচরণ অর্থাৎ ক্রিয়মাণসঞ্চিতরূপ কর্ম এবং তৎসহকৃত প্রারব্ধ কর্ম দ্বারা স্থুল দেহ নির্মাণ করে তাতেই স্থিত হয়ে সর্বদা শরীরে আবদ্ধ হয়েই পৃথিবীতে অবস্থান করেন ||||

|| দেহাদি কল্পিত ||

স্বীকুর্বন্ ব্যাঘ্রবেষং স্বজঠরভৃতয়ে ভীষয়ন্ যশ্চ মুগ্ধান্

মত্বা ব্যাঘ্রোঽহমিত্থং নরপশুমুখান্বাধতে কিং নু সত্ত্বান্

মত্বা স্ত্রীবেষধারী স্ত্র্যহমিতি কুরুতে কিং নটো ভর্তুরিচ্ছাং

তদ্বচ্ছারীর আত্মা পৃথগনুভবতো দেহতো যৎ সাক্ষী ||||

ভাবার্থ - যে ব্যক্তি ( বহুরূপী ) উদরপূর্তির নিমিত্ত ব্যাঘ্রবেষ ধারণপূর্বক সুকুমারমতি বালকগণকে ভয় দেখিয়ে থাকে, সেই ব্যক্তি কি "আমি ব্যাঘ্র" এইরূপ অভিমান বরতঃ নর, পশু প্রভৃতি প্রাণীগণকে পীড়া দেয়? স্ত্রীবেষধারী নট কি "আমি স্ত্রী এইরূপ মনে করে পতির ইচ্ছা পূর্ণ করে থাকে? সেই রূপ যে হেতু শরীরাবিচ্ছিন্ন আত্মা শরীর হতে পৃথগরূপেই অনুভূত হন, এই নিমিত্ত ওই সাক্ষীস্বরূপই হয়ে থাকে||||

|| আত্মস্বরূপ শ্রুতিমাত্রগম্য ||

স্বং বালং রোদমানং চিরতরসময়ং শান্তিমানেতুমগ্রে

দ্রাক্ষাং খর্জূরমাম্রং সুকদলমথবা যোজয়ত্যম্বিকাস্য

তদ্বচ্চেতোঽতিমূঢ়ং বহুজননভবান্মৌঢ্যসংস্কারয়োগা-

দ্বোধোপায়ৈরনেকৈরবশমুপনিষদ্বোধয়ামাস সম্যক্ ||||

ভাবার্থ - যে বালক বহুক্ষণ যাবৎ রোদন করছে, তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার নিমিত্ত জননী যেমন তার সম্মুখে দ্রাক্ষা, খর্জ্জুর, আম্র অথবা সুমধুর কদলী ফল প্রদান করেন, সেইরূপ উপনিষৎ বহু জন্মের মোহজনিত সংস্কার দ্বারা অত্যন্ত মােহপ্রাপ্ত অবশচিত্তকে অনেক প্রকার আত্মজ্ঞানোপায় দ্বারা অববোধিত করেছেন ||||

|| আত্মাই সর্বাপেক্ষা প্রিয়তম ||

যৎপ্রীত্যা প্রীতিপাত্রং তনুয়ুবতিতনূজার্থমুখ্যং তস্মাৎ

প্রেয়ানাত্মাথ শোকাস্পদমিতরদতঃ প্রেয় এতৎকথং স্যাৎ

ভার্যাদ্যং জীবিতার্থী বিতরতি বপুঃ স্বাত্মনঃ শ্রেয় ইচ্ছন্

তস্মাদাত্মানমেব প্রিয়মধিকমুপাসীত বিদ্বান্ন চান্যৎ ||||

ভাবার্থ - যার প্রীতির জন্য শরীর, যুবতি স্ত্রী, পুত্র প্রভৃতি মুখ্য বিষয়সমুহ প্রীতিপাত্র হয়ে থাকে, সেই আত্মা এতৎসমুদয় হতে প্রিয়তর। অন্য বিষয়সমুহ শোকাস্পদ অর্থাৎ দুঃখপ্রদ, অতএব তা কিরূপে প্রিয় হতে পারে ? জীবনাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি স্বকীয় শ্রেয়ঃ সাধনমানসে ভার্য্যা, শরীর প্রভূতি ত্যাগ করে থাকে। অতএব বিদ্বানগণ সর্বাপেক্ষা প্রিয়তম আত্মারই উপাসনা করবেন, অন্য বিষয়ের সেবা করবেন না ||||

|| আত্মা সর্বকালের প্রিয় ||

যস্মাদ্যাবৎপ্রিয়ং স্যাদিহ হি বিষয়তস্তাবদস্মিন্প্রিয়ত্বং

যাবদ্দুঃখং যস্মাদ্ভবতি খলু ততস্তাবদেবাপ্রিয়ত্বম্

নৈকস্মিন্সর্বকালেঽস্ত্যুভয়মপি কদাপ্যপ্রিয়োঽপি প্রিয়ঃ স্যাৎ

প্রেয়ানপ্যপ্রিয়ো বা সততমপি ততঃ প্রেয় আত্মাখ্যবস্তু ||১০||

ভাবার্থ - এই সংসারে যে বিষয় হতে যে পরিমাণ সুখ পাওয়া যায়, সেই বিষয়ও সেই পরিমাপেই প্রিয় হয়ে থাকে, আর যা হতে যে পরিমাণ দুঃখ প্রাপ্তি হয়ে থাকে, সেই পরিমাণে সেই বিষয়ও অপ্রিয় হয়ে থাকে। একই বস্তুতে সর্বকালে সুখ, দুঃখ উভয় থাকতে পারে না। কখনও অপ্রিয় বস্তুই প্রিয় হয়ে থাকে, আবার অন্য সময় প্রিয় বস্তুও অপ্রিয় হয়ে উঠে। অতএব আত্মারূপ বস্তুই সর্বদা প্রিয় হয়ে থাকে ||১০||

|| শ্রেয়ঃ প্রেয়ঃ ||

শ্রেয়ঃ প্রেয়শ্চ লোকে দ্বিবিধমভিহিতং কাম্যমাত্যন্তিকং

কাম্যং দুঃখৈকবীজং ক্ষণলববিরসং তচ্চিকীর্ষন্তি মন্দাঃ

ব্রহ্মৈবাত্যন্তিকং যন্নিরতিশয়সুখস্যাস্পদং সংশ্রয়ন্তে

তত্ত্বজ্ঞাস্তচ্চ কাঠোপনিষদভিহিতং ষড্বিধায়াঞ্চ বল্ল্যাম্ ||১১||

ভাবার্থ - লোকে শ্রেয়ঃ এবং প্রেয়ঃ প্রত্যেকটি 'কাম্য এবং আত্যন্তিক' ভেদে দুই প্রকারে বলা হয়েছে। যা ক্ষণমাত্রেরও অংশমধ্যে অপ্রীতিকর হয় এবং যাহা দুঃখের নিদানস্বরূপ, তাই কাম্য। মন্দবুদ্ধিগণই ওটার আকাঙ্ক্ষা করে থাকে। ব্রহ্মই আত্যন্তিক শ্রেয়ঃ এবং প্রেয়স্বরূপ। তত্ত্বজ্ঞগণই সেই নিরতিশয় সুখস্বরূপকে আশ্রয় করেন। এই সকল বিষয় কঠোপনিষদের ছয়টি বল্লীতে বলা হয়েছে ||১১||

আত্মাম্ভোধেস্তরঙ্গোঽস্ম্যহমিতি গমনে ভাবয়ন্নাসনস্থঃ

সংবিৎসূত্রানুবিদ্ধো মণিরহমিতি বাস্মীন্দ্রিয়ার্থপ্রতীতৌ

হৃষ্টোঽস্ম্যাত্মাবলোকাদিতি শয়নবিধৌ মগ্ন আনন্দসিন্ধা-

বন্তর্নিষ্ঠো মুমুক্ষুঃ খলু তনুভৃতাং যো নয়ত্যেবমায়ুঃ ||১২||

ভাবার্থ - মনুষ্যসমাজে যিনি অন্তর্নিষ্ঠ এবং মুমুক্ষু, তিনি গমনকালে মনে করেন "আমি আত্মসমুদ্রের তরঙ্গ", উপবেশনকালে মনে করেন, "আমি চিৎসূত্র দ্বারা গ্রথিত

মণি", ইন্দ্রিয় দ্বারা অর্থোপলব্ধিকালে আত্মাকেই অবলোাকন করতঃ মনে করেন 'আমি আনন্দিত' শয়নকালে মনে করেন "আমি আনন্দসাগরে মগ্ন" -এইরূপ ভাবনা করেই তিনি আয়ু অতিবাহিত করেন ||১২||

|| জগৎ বিরাটের ব্যষ্টিরূপ ||

বৈরাজব্যষ্টিরূপং জগদখিলমিদং নামরূপাত্মকং স্যাৎ

অন্তঃস্থপ্রাণমুখ্যাৎ প্রচলতি পুনর্বেত্তি সর্বান্ পদার্থান্

নায়ং কর্তা ভোক্তা সবিতৃবদিতি যো জ্ঞানবিজ্ঞানপূর্ণঃ

সাক্ষাদিত্থং বিজানন্ ব্যবহরতি পরাত্মানুসন্ধানপূর্বম্ ||১৩||

ভাবার্থ - যিনি শাস্ত্রজ্ঞানযুক্ত এবং অনুভবরূপ বিজ্ঞানসম্পন্ন তিনি নামরূপাত্মক এই জগৎ বিরাটের ব্যষ্টিরূপ, ( শরীরাভ্যন্তরস্থিত ) মুখ্য প্রাণসম্বন্ধবশতঃই চলে থাকে এবং সকল পদার্থকে জেনে থাকে, কিন্তু আত্মা স্বয়ং সূর্য্যের ন্যায় কর্তা, ভোক্তা কিছুই ননএই প্রকার সাক্ষাৎ পরমাত্মার অনুসন্ধান পূর্বক ব্যবহার করেন ||১৩||

নৈর্বেদ্যং জ্ঞানগর্ভং দ্বিবিধমভিহিতং তত্র বৈরাগ্যমাদ্যং

প্রায়ো দুঃখাবলোকাদ্ভবতি গৃহসুহৃৎপুত্রবিত্তৈষণাদেঃ

অন্যজ্ জ্ঞানোপদেশাদ্ যদুদিতবিষয়ে বান্তবদ্ধেয়তা স্যাৎ

প্রব্রজ্যাপি দ্বিধা স্যান্নিয়মিতমনসাং গেহতো দেহতশ্চ ||১৪||

ভাবার্থ - বৈরাগ্য দুই প্রকার-নৈর্বেদ্য এবং জ্ঞানগর্ভ। প্রথম অর্থাৎ নৈর্বেদ্য, প্রায়ই গৃহ, ( বাসস্থান এবং গৃহিণী ) মিত্র, পুত্র, বিত্ত প্রভৃতির আকাঙ্ক্ষাতে দুঃখদর্শনবশতঃ হয়ে থাকে। অপরটি যা হতে পূর্বোক্ত বিষয়সমূহে বমনের ন্যায় হেয়ত্ব জ্ঞান হয়, তা জ্ঞানোপদেশবশতঃ হয়ে থাকে। সংযতচিত্ত পুরুষগণের গৃহ এবং দেহবিষয়ক সন্ন্যাসও দুই প্রকার অর্থাৎ প্রথমতঃ বৈরাগ্যবান্ পুরুষ গৃহত্যাগ করেন, তৎপরে

দেহাভিমানশূন্য হয়ে বিরাজ করেন ||১৪||

|| অনাত্মাতে আত্মবুদ্ধিপ্রযুক্তই দুঃখ ||

যঃ কশ্চিৎসৌখ্যহেতোস্ত্রিজগতি যততে নৈব দুঃখস্য হেতোঃ

দেহেঽহন্তা তদুত্থা স্ববিষয়মমতা চেতি দুঃখাস্পদে দ্বে

জানন্ রোগাভিঘাতাদ্যনুভবতি যতোনিত্যদেহাত্মবুদ্ধিঃ

ভার্যাপুত্রার্থনাশে বিপদমথ পরামেতি নারাতিনাশে ||১৫||

ভাবার্থ - ত্রিজগতে যে কোন লােক আপনার সুখের নিমিত্তই চেষ্টাপরায়ণ হয়, দুঃখের নিমিত্ত হয় না। দেহে অহংভাব এবং দেহাভিমানপ্রযুক্ত বিষয়ে মমত্ববুদ্ধিএই উভয়কে দুঃখাম্পদ জেনেও লােক রােগাদিজন্য এবং তাড়নাদি জন্য কেশ করে থাকে; কারণ, অনিত্য দেহে যাদের আত্মবুদ্ধি আছে তাদেরই ভার্যা, পুত্র এবং অর্থাদির নাশে অত্যন্ত বিষাদ প্রাপ্তি হয়ে থাকে, কিন্তু শক্রর নাশে ( মমতাশূন্যতা হেতু ) তাদৃশ বিষাদ প্রাপ্তি হয় না ||১৫||

তিষ্ঠন্ গেহে গৃহেশোঽপ্যতিথিরিব নিজং ধাম গন্তুং চিকীর্ষুঃ

দেহস্থং দুঃখসৌখ্যে ভজতি সহসা নির্মমত্বাভিমানঃ

আয়াত্রায়াস্যতীদং জলদপটলবদ্যাতৃ যাস্যত্যবশ্যং

দেহাদ্যং সর্বমেবং প্রবিদিতবিশয়ো যশ্চ তিষ্ঠত্যযত্নঃ ||১৬||

ভাবার্থ - ( যে পুরুষ গৃহত্যাগপূর্বক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে অসমর্থ, তাঁর নিমিত্ত গৃহেই ব্রহ্মপ্রাপ্তির উপায় বলছেনবিবেকীগৃহস্থ ) গৃহের অধিপতি হয়েও নিজগৃহে যেতে ইচ্ছুক অতিথির ন্যায় অবস্থান করেন এবং মমতাভিমানশূন্য হয়ে সুখদুঃখ প্রাপ্ত হন না। যিনি বিষয়ের স্বরূপ জেনেছেন, তিনি আগমনশীল দেহাদি আসবে এবং গমনশীল দেহাদি অবশ্যই মেঘমালার ন্যায় চলে যাবে, এইরূপ মনে করে নিশ্চেষ্ট হয়ে অবস্থান করেন ||১৬||

শক্ত্যা নির্মোকতঃ স্বাদ্বহিরহিরিব যঃ প্রব্রজন্স্বীয়গেহাৎ ছায়াং মার্গদ্রুমোত্থাং পথিক ইব মনাক্সংশ্রয়েদ্দেহসংস্থাম্

ক্ষুৎপর্যাপ্তং তরুভ্যঃ পতিতফলময়ং প্রার্থয়েদ্ভৈক্ষমন্নং

স্বাত্মারামং প্রবেষ্টুং খলু সুখময়ং প্রব্রজেদ্দেহতোঽপি ||১৭||

ভাবার্থ - সর্প যেমন নিজের শক্তিবলে খোলস ত্যাগ করতঃ বাইরে চলে যায়, সেইরূপ যে বিবেকী পুরুষ প্রব্রজ্যা গ্রহণপূর্বক শক্তিবলে নিজের গৃহ হতে বহির্গমন

করতঃ পথিক যেরূপ পথিস্থিত বৃক্ষের ছায়া আশ্রয় করে থাকে, সেইরূপ অল্পই জীবনােপায় অবলম্বন করেন, এবং ক্ষুণ্ণিবৃত্তির নিমিত্ত পর্যাপ্ত মনে করে বৃক্ষসমূহ হতে পতিত ফলই ভিক্ষান্নরূপে প্রার্থনা করেন, তিনি সুখময় আত্মরূপ প্রমােদবনে প্রবেশলাভের নিমিত্ত দেহ হতেও প্রব্রজিত হন ||১৭||

|| ত্রিবিধ পাপহেতু- কাম, ক্রোধ, লোভ ||

কামো বুদ্ধাবুদেতি প্রথমমিহ মনস্যুদ্দিশত্যর্থজাতং

তদ্গৃহ্ণাতীন্দ্রিয়াস্যৈস্তদনভিগমতঃ ক্রোধ আবির্ভবেচ্চ

প্রাপ্তাবর্থস্য সংরক্ষণমতিরুদিতো লোভ এতত্ত্রয়ং স্যাৎ

সর্বেষাং পাতহেতুস্তদিহ মতিমতা ত্যাজ্যমধ্যাত্ময়োগাৎ ||১৮||

ভাবার্থ - প্রথমে বুদ্ধিতে কামনা উদিত হয়, তদনন্তর সেই কামনা মনে বিষয়ের সঙ্কল্প রচনা করে এবং তৎপর ইন্দ্রিয়রূপ মুখ দ্বারা মানব সেই রূপ-রসাদি বিষয় গ্রহণ করে। বিষয়ের অপ্রাপ্তি হলে ক্রোধ আবির্ভূত হয়। আর বিষয়ের প্রাপ্তি হলে সেই বিষয়ের রক্ষণ নিমিত্ত যে বুদ্ধি অর্থাৎ স্বীয়ত্বাভিমান জন্মে, তাই লোভ। এই তিনটি অর্থাৎ কাম, ক্রোধ এবং লােভ-এরা সকলের পক্ষেই পাপের হেতু। অতএব মতিমান পুরুষ অধ্যাত্মযোগবলে অর্থাৎ বুদ্ধির পরে স্থিত আত্মার অনুসন্ধানরূপ অভ্যাস যােগ দ্বারা এই তিনটিকেই ত্যাগ করবেন ||১৮||

|| দানাদি মুক্তিসাধন এবং তদ্বিপরীত সেতুসংজ্ঞক বন্ধহেতু ||

দানং ব্রহ্মার্পণং যৎক্রিয়ত ইহ নৃভিঃ স্যাৎক্ষমাক্রোধসংজ্ঞা

শ্রদ্ধাস্তিক্যং সত্যং সদিতি পরমতঃ সেতুসংজ্ঞং চতুষ্কং

তৎ স্যাৎ বন্ধায় জন্তোরিতি চতুর ইমান্ দানপূর্বৈশ্চতুর্ভিঃ

তীর্ত্বা শ্রেয়োঽমৃতং শ্রয়ত ইহ নরঃ স্বর্গতিং জ্যোতিরাপ্তিম্ ||১৯||

ভাবার্থ - এই সংসারে মানবগণ যা ব্রহ্মে অর্পণ করন, তাই দান নামে অভিহিত হয়। অক্রোধই ক্ষমা, আস্তিক্য শ্রদ্ধা এবং সৎস্বরূপ ব্রহ্মই সত্য। এতদ্বিপরীত চারটি সেতু সংজ্ঞায় অভিহিত, ওটক বন্ধের হেতু হয়ে থাকে। অতএব দানাদি চারটি উপায় দ্বারা তদ্বিপরীত আদান, ক্রোধ, অশ্রদ্ধা এবং অসত্য রূপ সেতু চারিটিকে অতিকম করতঃ মানব শ্রেয়ঃ অর্থাৎ পুণ্যাতিশয়, অমৃত অর্থাৎ দেবত্ব, স্বর্গতি অর্থাৎ উর্দ্ধগতি এবং জ্যোতিঃপ্রাপ্তি অর্থাৎ প্রকাশস্বরূপ ব্রহ্মপ্রাপ্তি লাভ করে থাকেন ||১৯||

অন্নং দেবাতিথিভ্যোঽর্পিতমমৃতমিদং চান্যথা মোঘমন্নং

যশ্চাত্মার্থং বিধত্তে তদিহ নিগদিতং মৃত্যুরূপং হি তস্য

লোকেঽসৌকেবলাঘোভবতি তনুভৃতাং কেবলাদী যঃ স্যা-

ত্ত্যক্ত্বা প্রাণাগ্নিহোত্রং বিধিবদনুদিনং যোঽশ্নুতেসোঽপি মর্ত্যঃ ||২০||

ভাবার্থ - দেবতা এবং অতিথিদের অর্পিত অন্নই অমৃতস্বরূপ, অন্যথা অন্ন নিষ্ফল। যে কেবল নিজের জন্য অন্ন পাক করে, সেই ব্যক্তির পক্ষে সেই অন্ন মৃত্যুরূপ অর্থাৎ বিষোপম হয়ে থাকে। দেহধারীগণের মধ্যে যে ব্যক্তি কেবল স্বয়ং ভোগপরায়ণ হয়, সে কেবল পাপস্বরূপই হয়ে থাকে। যথাবিধি প্রাণাগ্নিহোত্র ত্যাগ করতঃ যে প্রত্যহ ভোজন করে, সেই ব্যক্তিও মর্ত্য ( মরণশীল ) হয়; অর্থাৎ জন্মমৃত্যুর হাত হতে মুক্তি পেতে পারে না ||২০||

লোকে ভোজঃ এবার্পয়তি গৃহগতায়ার্থিনেঽন্নং কৃশায়

যস্তস্মৈ পূর্ণমন্নং ভবতি মখবিধৌ জায়তেঽজাতশত্রুঃ

সখ্যেনান্নার্থিনে যোঽর্পয়তি সখা সেবমানায় নিত্যং

সংসক্তায়ান্নমস্মাদ্বিমুখ ইব পরাবৃত্তিমিচ্ছেৎকদর্যাৎ ||২১||

ভাবার্থ - যে ব্যক্তি গৃহাগত দারিদ্র্যপীড়িত যাচক ব্যক্তিকে অন্ন দান করেন, তিনিই সংসারে প্রকৃত অন্নদাতা। এবংবিধ দাতার এতাদৃশ অন্নদান যজ্ঞে পরিপূর্ণ অন্নদানের সমান হয়ে থাকে এবং এই অন্নদাতা অজাতশত্রু হন। যে অন্নপ্রার্থী সখাকে অন্ন দান করে না, সে সখা পদবাচ্য নন। যে ব্যক্তি নিত্য সেবাপরায়ণ

আসক্ত ব্যক্তিকে অন্ন দান করে, সেই কদর্য্য ব্যক্তি হতে যাচকগণ বিমুখ হয়েই যেন তার নিকট হতে পরাবৃত্ত হতে ইচ্ছা করে অর্থাৎ তার নিকট যাচ্ঞা করতে ইচ্ছা করে না ||২১||

স্বাজ্ঞানজ্ঞানহেতূ জগদুদয়লয়ৌ সর্বসাধারণৌ স্তো

জীবেষ্বাস্বর্ণগর্ভং শ্রুতয় ইতি জগুর্হূয়তে স্বপ্রবোধে

বিশ্বং ব্রহ্মণ্যবোধে জগতি পুনরিদং হূয়তে ব্রহ্ম যদ্বচ্ছু-

ক্তৌ রৌপ্যং রৌপ্যেঽধিকরণমথবা হূয়তেঽন্যোন্যমোহাৎ ||২২||

ভাবার্থ - আত্মার অজ্ঞানহেতু জগতের উদয় এবং জ্ঞানহেতু জগতের লয়, এই নিয়ম হিরণ্যগর্ভপর্যন্ত সকলজীবসাধারণ, এটাই শ্রতিসমূহ বলেছেন। ব্রহ্মাকার অন্তঃকরণবৃত্তির উদয়ে এই বিশ্ব চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্মে ( অগ্নিতে আহুতির ন্যায় ) হুত হয়ে থাকে এবং পুনরায় এই ব্রহ্ম জগতেই আহুত হয়। যেরূপ অন্যোন্যের অজ্ঞানবশতঃ শুক্তিতে রজত এবং রজতে অধিকরণস্বরূপ শুক্তি হুত হয়ে থাকে অর্থাৎ শুক্তির জ্ঞানে রজত বিলীন হয় এবং রজতের জ্ঞানে শুক্তি বিলীন হয়ে থাকে ||২২||

|| ব্যবহারিক সত্তাসম্পন্ন অবিদ্যাই জগতের উপাদান ||

তুচ্ছত্বান্নাসদাসীদ্ গগনকুসুমবদ্ভেদকং নো সদাসীৎ

কিন্ত্বাভ্যামন্যদাসীদ্ ব্যবহৃতিগতিসন্নাস লোকস্তদানীম্

কিন্ত্বর্বাগেব শুক্তৌ রজতবদপরো নো বিরাড্ ব্যোমপূর্বঃ

শর্মণ্যাত্মন্যথৈতৎ কুহকসলিলবৎ কিং ভবেদাবরীবঃ ||২৩||

ভাবার্থ - আকাশকুসুমের ন্যায় অতি তুচ্ছ, অসৎ জগদুপাদানকারণ কিছু ছিল না। আর সদ্বস্তু ব্রহ্মের অপর কোন সৎও ছিল না, কিন্তু সৎ এবং অসৎ হতে পৃথক্ ( সদসৎবিলক্ষণ ) ব্যবহৃতিগতি সৎ অর্থাৎ ব্যবহারিক সৎ ( অবিদ্যা ) ছিল। তখন লােক অর্থাৎ চতুর্দ্দশভূবন ছিল না, অথবা আকাশের পূর্ববর্তী আকাশের কারণ অপর বিরাট্, যাহা অর্বাক্ অর্থাৎ পরে সৃষ্ট, তাও ছিল না, যেমন শুক্তিতে প্রথমতঃ রজত থাকে না। ইন্দ্রজাল দ্বারা উৎপন্ন জল যেমন ( ভ্রমনিবৃত্তিতে মৃত্তিকার ) আবরক হয় না। তদ্রূপ সুখস্বরূপ আত্মার আবরক কি হতে পারে? ||২৩||

|| ব্রহ্মই মায়াবশে ঈশ্বর এবং জীব ||

বন্ধো জন্মাত্যয়াত্মা যদি পুনরভূত্তর্হি মোক্ষোঽপি নাসীৎ

যদ্বদ্রাত্রির্দিনং বা ভবতি তরণৌ কিন্তু দৃগ্দোষ এষঃ

অপ্রাণং শুদ্ধমেকং সমভবদথ তন্মায়যা কর্তৃসংজ্ঞং

তস্মাদন্যচ্চ নাসীৎ পরিবৃতমজয়া জীবভূতং তদেব ||২৪||

ভাবার্থ - জন্মমৃত্যুরূপ বন্ধ যদি না থাকত, তা হলে মোক্ষও থাকত নাযেমন সূর্যে রাত্রি অথবা দিন কিছুই নাই, কিন্তু দৃষ্টিদোষবশতঃই রাত্রি দিন প্রতীত হয়। প্রাণসম্বন্ধবিহীন শুদ্ধ এক ব্রহ্মই ছিলেন, তিনিই মায়াসম্বন্ধবশতঃ কর্তৃসংজ্ঞা প্রাপ্ত হলেন অর্থাৎ জগৎকর্তা ঈশ্বররূপে ব্যপদিষ্ট হলেন। সেই ব্রহ্মভিন্ন কোন পদার্থই ছিল না। তিনিই অজা অর্থাৎ অবিদ্যাবশতঃ জীব হয়েছেন ||২৪||

প্রাগাসীদ্ ভাবরূপং তম ইতি তমসা গূঢ়মস্মাদতর্ক্যং

ক্ষীরান্তর্যদ্বদম্ভো জনিরিহ জগতো নামরূপাত্মকস্য

কামাদ্ধাতুঃ সিসৃক্ষোরনুগতজগতঃ কর্মভিঃ সম্প্রবৃত্তাদ্

রেতোরূপৈর্মনোভিঃ প্রথমমনুগতৈঃ সন্ততৈঃ কার্যমাণৈঃ ||২৫||

ভাবার্থ - ভাবরূপ অজ্ঞানই সৃষ্টির পূর্বে ছিল, অতএব ( সেই সময় ) জগৎ অজ্ঞানের দ্বারাই আচ্ছাদিত ছিল, যেমন দুধের মধ্যে জল নিহিত থাকে। অতএব এই জগতের বীজাবস্থা অতর্ক্য। প্রবাহরূপে অনাদি জগতে অনাদিকাল হতেই সংযুক্ত বীজভূত মন দ্বারা কৃতকর্মের প্রেরণায় সৃষ্টি করতে ইচ্ছুক বিধাতার অর্থাৎ ঈশ্বরের ইচ্ছা হতে অজ্ঞাসেই এই নামরূপাত্মক জগতের উৎপত্তি হয়েছে ||২৫||

চত্বারোঽস্যাঃ কপর্দা যুবতিরথ ভবেন্নুতনা নিত্যমেষা

মায়া বা পেশলা স্যাদঘটনঘটনাপাটবং যাতি যস্মাৎ

স্যাদারম্ভে ঘৃতাস্যা শ্রুতিভববয়ুনান্যেবমাচ্ছাদয়ন্তী

তস্যামেতৌ সুপর্ণাবিব পরপুরুষৌ তিষ্ঠতোঽর্থপ্রতীত্যা ||২৬||

ভাবার্থ - এই মায়ার চার প্রকার উৎকর্ষ আছে। ( ) নিত্যই যুবতি এবং নিত্যই নুতন। ( ) আর যেহেতু মায়া অঘটনঘাটনাপটীয়সী, সেই হেতু অতীব কৌশলসম্পন্না। ( ) মায়া ঘৃতাস্যা অর্থাৎ আরম্ভে মধুরা ( পরিণামে বিষোপমা ) এবং ( ) শ্রুতিপ্রতিপাদিত আত্মজ্ঞানের আচ্ছাদিকা। পরমাত্মা এবং জীবাত্মা বিষয়ভাসকতাগুণহেতু দুইটি পাখির ন্যায় এই অজ্ঞানে অবস্থান করেন ||২৬||

|| জীবাত্মা এবং পরমাত্মার স্বরূপতঃ অভিন্ন ||

একস্তত্রাস্ত্যসঙ্গস্তদনু তদপরোঽজ্ঞানসিন্ধুং প্রবিষ্টো

বিস্মৃত্যাত্মস্বরূপং বিবিধজগদাকারমাভাসমৈক্ষৎ

বুদ্ধ্যান্তর্যাবদৈক্ষদ্বিসৃজতি তমজা সোঽপি তামেবমেকঃ

তাবদ্বিপ্রাস্তমেকং কথমপি বহুধা কল্পয়ন্তি স্ববাগ্ভিঃ ||২৭||

ভাবার্থ - তন্মধ্যে অর্থাৎ পরমাত্মা এবং জীবাত্মার মধ্যে একটি অসঙ্গ এবং অপরটি অজ্ঞানসমুদ্রে নিমগ্ন। যিনি অজ্ঞানসমুদ্রে নিমগ্ন তিনি আত্মস্বরূপ বিস্মৃত হওয়াতেই বিবিধ জগদাকার আভাস দর্শন করেছেন। নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা অভ্যন্তরে দৃষ্ট হলে অর্থাৎ স্বস্বরূপের দর্শন হলে অবিদ্যা তাকে ত্যাগ করে,

তিনিও অবিদ্যাকে ত্যাগ করেন। অতএব জীব এবং পরমাত্মা স্বরূপতঃ একই। ( শিষ্যদের বোধসৌকর্য্যার্থ ) বেদজ্ঞগণ নিজ নিজ বাক্য দ্বারা সেই এককেই বহুরূপে

কল্পনা করেন ||২৭||

|| লিঙ্গদেহই গমনাগমনশীল ||

নায়াতি প্রত্যগাত্মা প্রজননসময়ে নৈব যাত্যন্তকালে

যৎ সোঽখণ্ডোঽস্তি লৈঙ্গং মন ইহ বিশতি প্রব্রজত্যূর্দ্ধমর্বাক্

তৎকার্শ্যং স্থূলতাং বা ভজতি বপুষঃ কিন্তু সংস্কারজাতে

তেজোমাত্রা গৃহীত্বা ব্রজতি পুনরিহায়াতি তৈস্তৈঃ সহৈব ||২৮||

ভাবার্থ - প্রত্যগাত্মা অখণ্ড এই হেতু আবির্ভাবকালে তিনি (গর্ভে ) আসেন না অথবা মৃত্যুকালে ( শরীর ত্যাগ করে ) গমনও করেন না। লৈঙ্গ অর্থাৎ পঞ্চদশ অবয়বযুক্ত মনই ( অন্তঃকরণ ) প্রবেশ করে এবং পরে উর্দ্ধে চলে যায়। মন দেহের কৃশতা অথবা স্থুলতা প্রাপ্ত হয় না, কিন্তু দেহের সংস্কারসমূহই মাত্র প্রাপ্ত হয়ে থাকে। ( অতএব ) মনই তেজোমাত্রা অর্থাৎ সূক্ষ্ম শরীরের আরম্ভক উপাদান লয়ে সংসার হতে চলে যায় এবং তেজোমাত্রা লয়েই সংসারে আগমন করে ||২৮||

|| মনের প্রবেশ নির্গমে বৈদিক সংবাদ ||

আসীৎ পূর্বং সুবন্ধুর্ভৃশমবনিসুরো যঃ পুরোধাঃ সনাতেঃ

ব্রাহ্ম্যাৎকূটাভিচারাৎস খলুমৃতিমিতস্তন্মনোঽগাৎ কৃতান্তম্

তদ্ভ্রাতা শ্রৌতমন্ত্রৈঃ পুনরনয়দিতি প্রাহ সূক্তেন বেদ-

স্তস্মাদাত্মাভিয়ুক্তং ব্রজতি ননু মনঃ কর্হিচিন্নান্তরাত্মা ||২৯||

ভাবার্থ - পুরাকালে সুবন্ধু নামক একজন উৎকৃষ্ট ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি সনাতির পুরোহিত ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণ কর্তৃক প্রযুক্ত কপট অভিচারের ফলে মৃত্যু প্রাপ্ত হলে তার মন যমের নিকট চলে যায়। তাঁর ভ্রাতা বৈদিক মন্ত্রের প্রয়োগে সেই মনকে পুনরায় ফিরিয়ে এনেছিলেনএই আখ্যায়িকা বেদের সূক্তে উক্ত হয়েছে। অতএব আত্মাভিযুক্ত অর্থাৎ আত্মপ্রতিবিম্বযুক্ত মনই ( শরীর হতে ) চলে যায়, আত্মা কখনও গমন করে না ||২৯||

|| মনের ক্রিয়া আত্মাতে উপচরিত ||

একো নিষ্কম্প আত্মা প্রচলতি মনসা ধাবমানেন তস্মিন্

তিষ্ঠন্নগ্রেঽথ পশ্চান্ন হি তমনুগতং জানতে চক্ষুরাদ্যাঃ

যদ্বৎপাথস্তরঙ্গৈঃ প্রচলতি পরিতো ধাবমানৈস্তদন্তঃ

প্রাক্ পশ্চাদস্তি তেষাং পবনসমুদিতৈস্তৈঃ প্রশান্তৈর্যথাবৎ ||৩০||

ভাবার্থ - আত্মা এক এবং নিষ্কম্প, মন প্রচলিত হলে আত্মাও প্রচলিত হন, অর্থাৎ "আত্মা প্রচলিত" এইরূপ মনে হয়। মনে স্থিত হলেও আত্মা অগ্রে এবং পশ্চাৎ বিদ্যমান, অর্থাৎ সর্বত্র বিদ্যমান। চক্ষুঃ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গণ সর্বত্র অনুগত আত্মাকে জানতে পারে না। যেমন জল, পবন পরিচালিত হয়ে চারদিকে ধাবমান তরঙ্গের সহিত প্রচলিত হয়। তরঙ্গের অভ্যন্তরে সম্মুখে এবং পশ্চাতে জল থাকে, আর তরঙ্গ শান্ত হলে জলও শান্ত হয় ||৩০||

একাক্যাসীৎ পূর্বং মৃগয়তি বিষয়ানানুপূর্ব্যাঽন্তরাত্মা

জায়া মে স্যাৎ প্রজা বা ধনমুপকরণং কর্ম কুর্বংস্তদর্থম্

ক্লেশৈঃ প্রাণাবশেষৈর্মহদপি মনুতে নান্যদস্মাদ্গরীয়ঃ

ত্বেকালাভেঽপ্যকৃৎস্নো মৃত ইব বিরমত্যেকহান্যাঽকৃতার্থঃ ||৩১||

ভাবার্থ - পূর্বে সেই অন্তরাত্মা একাকীই ছিলেন, তার পর তিনি- আমার জায়া, পুত্র, ধন, উপকরণ হোক- এইরূপ আকাঙ্ক্ষা করে অনুক্রমে বিষয়ের অন্বেষণ

করতে লাগলেন। সকল বিষয়ের জন্য প্রাণান্ত ক্লেশ স্বীকারপূর্বক কর্ম করেও অন্য কোন বস্তুকে "ওটা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট বস্তু নাই" এইরূপ মনে করেন। সকল বিষয়ের একটির লাভ না হলেও নিজেকে অসম্পূর্ণ এবং মৃতবৎ মনে করে বিরাম প্রাপ্ত হন, অর্থাৎ ভগ্নোদ্যম হয়ে পড়েন। একটির হানি হলেও নিজেকে অকৃতার্থ মনে করেন ||৩১||

নাসীৎ পূর্বং পশ্চাদতনুদিনকরাচ্ছাদকো বারিবাহো

দৃশ্যঃ কিন্ত্বন্তরাঽসৌ স্থগয়তি দৃশং পশ্যতো নার্কবিম্বম্

নো চেদেবং বিনাঽর্কং জলধরপটলং ভাসতে তর্হি কস্মাৎ

তদ্বদ্বিশ্বং পিধত্তে দৃশমথ পরং ভাসকং চালকং স্বম্ ||৩২||

ভাবার্থ - অতি বৃহৎ সূর্যমণ্ডলের আচ্ছাদকরূপে মেঘ পূ্র্বেও ছিল না, পরেও থাকবে না; মেঘ সূর্যমণ্ডল এবং নয়নের মধ্যবর্তী হয়ে যখন দৃশ্য হয়, তখন ওটা দ্রষ্টার নয়নকেই আচ্ছাদন করে। যদি তা হয়, তা হলে সূর্য্য বিনা মেঘমালা কিরূপে দৃষ্ট হবে? ( অর্থাৎ মেঘ যদি সূর্যকে আচ্ছাদন করে, তা হলে মেঘ দৃষ্টিগােচরই হত না। মেঘ দৃষ্টিগোচর হয়, অতএব বলতে হবে, মেঘ সূর্যকে আচ্ছাদন করে না ) অতএব এই বিশ্ব অর্থাৎ দৃশ্য, অবিদ্যা এবং তৎকার্য দৃষ্টি অর্থাৎ জ্ঞানকেই আচ্ছাদন করে, কিন্তু নিজের ভাসক এবং চালক পরমাত্মাকে আচ্ছাদন করে না। ( টিকানুসারে অনুবাদ কিঞ্চিৎ অন্যপ্রকার হবে ) ||৩২||

ভুঞ্জানঃ স্বাপ্নরাজ্যং সসকলবিভবো জাগরং প্রাপ্য ভূয়ো

রাজ্যভ্রষ্টোঽহমিত্থং ভজতি বিষমং তন্মৃষা মন্যমানঃ

স্বপ্নে কুর্বন্নগম্যাগমনমুখমঘং তেন প্রত্যবায়ী

তদ্বজ্জাগ্রদ্দশায়াং ব্যবহৃতিমখিলাং স্বপ্নবদ্বিস্মরেচ্চেৎ ||৩৩||

ভাবার্থ - যে ব্যক্তি স্বপ্ন সকল বিভবসম্পন্ন হয়ে রাজ্য ভােগ করে, সে পুনরায় জাগ্রত হয়ে স্বপ্নকে মিথ্যা মনে করে "আমি রাজ্যভ্রষ্ট হয়েছি" এইরূপ শোক করে না।

যেরূপ স্বপ্প অগম্যাগমনপ্রমুখ পাপ করলে প্রায়শ্চিত্ত হয় না, তদ্রপ জাগ্রদ্দশাতেও যিনি সকল ব্যবহারকে স্বপ্নবৎ মনে করে তা বিস্মৃত হন তিনিও প্রত্যবায়ভাগী হন না ||৩৩||

স্বপ্নাবস্থানুভূতং শুভমথ বিষমং তন্মৃষা জাগরে স্যাৎ

জাগ্রত্যাং স্থূলদেহব্যবহৃতিবিষয়ং তন্মৃষা স্বাপকালে

ইত্থং মিথ্যাত্বসিদ্ধাবনিশমুভয়থা সজ্জতে তত্র মূঢঃ

সত্যে তদ্ভাসকেঽস্মিন্নিহ হি কুত ইদং তন্ন বিদ্মো বয়ং হি ||৩৪||

ভাবার্থ - স্বপ্নকালে অনুভূত শুভ অথবা অশুভ উভয়ই জাগ্রদ্দশায় মিথ্যা হয়ে থাকে, আবার জাগ্রদ্দশায় স্থূলদেহের ব্যবহারবিষয়ক শুভাশুভও স্বপ্নকালে মিথ্যা হয়ে থাকে। এইরূপে নিরন্তর উভয়তঃই মিথ্যাত্বসিদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু তবুও মূর্খগণ সেই মিথ্যাতেই আসক্ত হয়। মিথ্যার অবভাসক সত্য থাকতেও কেন তারা আসক্ত হয়, তা আমরা জানি না ||৩৪||

জীবন্তং জাগ্রতীহ স্বজনমথ মৃতং স্বপ্নকালে নিরীক্ষ্য

নির্বেদং যাত্যকস্মান্মৃতমমৃতমমুং বীক্ষ্য হর্ষং প্রয়াতি

স্মৃত্বাঽপ্যেতস্য জন্তোর্নিধনমসুযুতিং ভাষতে তেন সাকং

সত্যেবং ভাতি ভূয়োঽল্পকসময়বশাৎসত্যতা বা মৃষাত্বম্ ||৩৫||

ভাবার্থ - জাগ্রদ্দশায় জীবিত স্বজনকে স্বপ্নদশায় মৃত নিরীক্ষণ করে লোক খেদপ্রাপ্ত হয় এবং জাগ্রতে মৃত স্বজন ব্যক্তিকে স্বপ্নে জীবিত দেখে লোক হর্ষপ্রাপ্ত হয়।

জাগ্রদ্দশায় জন্তুর নিধন স্মরণ করে স্বপ্নকালে জীবন স্মরণ করে তার সহিত বার্তালাপ করে থাকে। এইরূপ হলে অধিককাল স্থায়িত্বনিবন্ধন এবং অল্পকাল

স্থায়িত্বনিবন্ধনই সত্যত্ব এবং মিথ্যাত্ব প্রতীত হয়ে থাকে, (বস্তুতঃ উভয়ই মিথ্যা, অল্পকালস্থায়িত্ব অথবা দীর্ঘকালস্থায়িত্ব মিথ্যাত্ব এবং সত্যত্বের সিদ্ধির প্রতি অপ্রয়োজক )

( এই শ্লোকের তৃতীয় চরণটি অস্পষ্টার্থক, ওতে কষ্টন্বয়তা দোষ রয়েছে। টীকা অধিকতর অস্পষ্ট; অতএব আমরা প্রকরণসঙ্গতিবলে এতাদৃশ অন্বয় এবং

অনুবাদই সঙ্গত মনে করলাম ) ||৩৫||

স্বাপ্নস্ত্রীসঙ্গসৌখ্যাদপি ভৃশমসতো যা রেতশ্চ্যুতিঃ স্যাৎ

সাদৃশ্যা তদ্বদেতৎ স্ফুরতি জগদসৎকারণং সত্যকল্পম্

স্বপ্নে সত্যঃ পুমান্স্যাদ্যুবতিরিহ মৃষৈবানয়োঃ সংয়ুতিশ্চ

প্রাতঃ শুক্রেণ বস্ত্রোপহতিরিতি যতঃ কল্পনামূলমেতৎ ||৩৬||

ভাবার্থ - ব্যবহারিক স্ত্রীসাদৃশ্য স্বাপ্রস্ত্রীতে থাকাতে যেরূপ অত্যন্ত অসৎ, স্বল্পকালীন স্ত্রীসঙ্গজনিত সুখ হতেও রেতস্খলন হয়ে থাকে, সেইরূপ এই জগৎ মিথ্যা, অবিদ্যা যার কারণ, তাও সত্যের ন্যায় প্রতীয়মান হয়। স্বপ্নকালে পুরুষ সত্যই থাকে, কিন্তু যুবতী মিথ্যা এবং উভয়ের সংযোগও মিথ্যাই, কিন্তুর তবুও প্রাতঃকালে শুক্র দ্বারা বস্ত্র নষ্ট হয়েছে দেখা যায়। অতএব এই দৃশ্য কল্পনামূলকই ||৩৫||

পশ্যন্ত্যারামমস্য প্রতিদিবসমমী জন্তবঃ স্বাপকালে

পশ্যত্যেনং কশ্চিৎকরণগণমৃতে মায়য়া ক্রীড়মানম্

জাগ্রত্যর্থব্রজানামথ তনুভৃতাং ভাসকং চালকং বা

নো জানীতে সুষুপ্তৌ পরমসুখময়ং কশ্চিদাশ্চর্যমেতৎ ||৩৭||

ভাবার্থ - প্রাণিগণ প্রত্যহ স্বপ্নাবস্থায় এই পরমাত্মার ক্রীড়া দর্শন করে থাকে, কিন্তু বাহ্যোন্দ্রিয় ব্যতিরেকে মায়া দ্বারা ক্রীড়াপরায়ণ একে কেউ দেখে না। অথবা জাগ্রৎকালে বিষয়ের প্রকাশক এবং প্রাণিগণের চালককেও কেউ দেখে না। সুষুপ্তিকালে পরমসুখস্বরূপ পরমাত্মাকেও কেউ জানে নাএটাই আশ্চর্য ||৩৭||

স্বপ্নে মন্ত্রোপদেশঃ শ্রবণপরিচিতঃ সত্য এষঃ প্রবোধে

স্বাপ্নাদ্দেব প্রসাদাদভিলষিতফলং সত্যতাং প্রাতরেতি

সত্যপ্রাপ্তিস্ত্বসত্যাদপি ভবতি তথা কিং তৎস্বপ্রকাশং

যেনেদং ভাতি সর্বং চরমচরমথোচ্চাবচং দৃশ্যজাতম্ ||৩৮||

ভাবার্থ - স্বপ্নে যে মন্ত্রোপদেশ শ্রুতিগােচর হয়ে থাকে, জাগ্রদ্দশায় তা সত্য অর্থাৎ ফলোপধায়কই হয়ে থাকে। স্বপ্নকালীন দেবতার প্রসাদে লব্ধ অভিলষিত

ফল প্রাতঃকালে সত্যই হয়ে থাকে। অসত্য হতেও সত্য প্রাপ্তি হয়ে থাকে। সেইরূপ যা দ্বারা এই ( মিথ্যাভূত ) নানাবিধ চরাচর জগৎ প্রকাশিত হচ্ছে, তিনি স্বপ্রকাশস্বরূপই ||৩৮||

মধ্যপ্রাণং সুষুপ্তৌ স্বজনিমনুবিশন্ত্যগ্নিসূর্যাদয়োঽমী

বাগাদ্যাঃ প্রাণবায়ুং তদিহ নিগদিতা গ্লানিরেষাং বায়োঃ

তেভ্যো দৃশ্যাবভাসো ভ্রম ইতি বিদিতঃ শুক্তিকারৌপ্যকল্পঃ

প্রাণায়ামব্রতং তচ্ছ্রুতিশিরসি মতং স্বাত্মলব্ধৌ চান্যৎ ||৩৯||

ভাবার্থ - অগ্নি, সূর্য্য প্রভৃতি বাগাদির অধিষ্ঠাত্রী দেবতা সুষুপ্তিতে স্বকারণ মধ্যপ্রাণে অর্থাৎ বিরাটে প্রবেশ করেন, আর বাগাদি ইন্দ্রিয়গণও প্রাণবায়ুতে প্রবেশ করেন। স্থলে দেবতা এবং ইন্দ্রিয়গণেরই অস্তময় বলা হয়েছে কিন্তু প্রাণবায়ুর নয়। সকল চক্ষুরাদি হতে যে দৃশ্যের অবভাস হয়ে থাকে, শুক্তিতে প্রতীয়মান রৌপ্যের ন্যায় ভ্রম বলেই বিদিত হয়ে থাকে। অতএব সৎ প্রাণায়ামব্রতই উপনিষদে আত্মোপলব্ধির জন্য অভিমত, অন্য কিছু নয় ||৩৯||

|| অশুদ্ধচিত্তে জ্ঞানসিদ্ধি অসম্ভব ||

নোঽকস্মাদার্দ্রমেধঃ স্পৃশতি দহনঃ কিন্তু শুষ্কং নিদাঘাৎ

আর্দ্রং চেতোঽনুবন্ধৈঃ কৃতসুকৃতমপি স্বোক্তকর্মপ্রজার্থৈঃ

তদ্বৎ জ্ঞানাগ্নিরেতৎস্পৃশতি সহসা কিন্তু বৈরাগ্যশুষ্কং

তস্মাচ্ছুদ্ধো বিরাগঃ প্রথমমভিহিতস্তেন বিজ্ঞানসিদ্ধিঃ ||৪০||

ভাবার্থ - অগ্নি হঠাৎ আর্দ্র কাষ্ঠকে স্পর্শ করে না, কিন্তু আতপ দ্বারা শুষ্ক কাষ্ঠকেই স্পর্শ করে থাকে। সেইরূপ ভার্য্যাদি বিষয়রসে আর্দ্র, অথবা বিহিতকর্ম পুত্র এবং অর্থ অর্থাৎ অর্থসাধ্য যজ্ঞাদির দ্বারা যে চিত্তে পুণ্য হয়েছে, সেইরূপ চিত্তকেও জ্ঞানাগ্নি সহসা স্পর্শ করে থাকে। অতএব প্রথমতঃ শুদ্ধ বৈরাগের বিষয় উপদেশ দেওয়া হয়েছে। সেই বৈরাগ্য দ্বারাই বিজ্ঞানসিদ্ধি হয়ে থাকে ||৪০||

যৎকিঞ্চিন্নামরূপাত্মকমিদমসদেবোদিতং ভাতি ভূমৌ

যেনানেকপ্রকারৈর্ব্যবহরতি জগদ্ যেন তেনেশ্বরেণ

তদ্বৎ প্রচ্ছাদনীয়ং নিভৃতরশনয়া যদ্বদেষ দ্বিজিহ্বঃ

তেন ত্যক্তেন ভোজ্যং সুখমনতিশয়ং মা গৃধোঽন্যদ্ধনাদ্যম্ ||৪১||

ভাবার্থ - পৃথিবীতে অসৎরূপে কথিত এই নামরূপাত্মক জগত যাঁর দ্বারা প্রকাশিত হচ্ছে, এবং যাঁর দ্বারা অনেক প্রকার ব্যবহার নিষ্পন্ন হচ্ছে, সেই ঈশ্বর দ্বারা ( এই সমুদায় ) প্রচ্ছাদন করবে, যেরূপ রজ্জুর নিশ্চয়াত্মক জ্ঞান দ্বারা সর্প আচ্ছাদিত হয়ে যায়। অতএব ত্যাগের দ্বারা নিরতিশয় সুখ করবে, অন্য ধনাদির লোভ করবে না ||৪১||

|| জীবন্মুক্তি এবং পরমমুক্তি। অভ্যাসযোগ এবং জ্ঞানযোগ ||

জীবন্মুক্তির্মুমুক্ষোঃ প্রথমমথ ততো মুক্তিরাত্যন্তিকী

তেঽভ্যাসজ্ঞানয়োগাদ্ গুরুচরণকৃপাপাঙ্গসঙ্গেন লব্ধাৎ

অভ্যাসোঽপি দ্বিধা স্যাদধিকরণবশাদ্ দৈহিকো মানসশ্চ

শারীরস্ত্বাসনাদ্যো হ্যুপরতিরপরো জ্ঞানযোগঃ পুরোক্তঃ ||৪২||

ভাবার্থ - মুমুক্ষুর প্রথমে জীবন্মুক্তি এবং তৎপর আত্যন্তিকী মুক্তি হয়ে থাকে। উভয় প্রকার মুক্তি গুরুচরণকৃপাকটাক্ষপাতে লব্ধ অভ্যাসযোগ এবং জ্ঞানযোগ হতেই হয়। অধিকরণের ভেদে অভ্যাসযােগও দৈহিক এবং মানস-এই দুই প্রকার। দৈহিক অভ্যাসযােগ আসনাদির অভ্যাস, মানস অভ্যাসযোগ উপরতি। জ্ঞানযােগ পূর্বে বলা হয়েছে ||৪২||

সর্বানুন্মূল্য কামান্ হৃদি কৃতনিলয়ান্ ক্ষিপ্তশঙ্কূনিবোচ্চৈঃ

দীর্য্যদ্দেহাভিমানস্ত্যজতি চপলতামাত্মদত্তাবধানঃ

যাত্যূর্ধ্বস্থানমুচ্চৈঃ কৃতসুকৃতভরো নাড়িকাভির্বিচিত্রং

নীলশ্বেতারুণাভিঃ স্রবদমৃতভরং গৃহ্যমাণাত্মসৌখ্যঃ ||৪৩||

ভাবার্থ - আত্মাতে অবহিত হওয়া বশতঃ যাঁর দেহাভিমান জীর্ণ হয়ে আসছে, তিনি হৃদয়স্থিত কামনাসমূহকে উৎক্ষিপ্ত শঙ্কু অর্থাৎ কীলকের ন্যায়ই উন্মুলিত করে চপলতা পরিত্যাগ করেন। পুণ্যপুঞ্জভরে আত্মসুখ প্রাপ্ত হয়ে নীল, শ্বেত এবং অরুণবর্ণের নাড়ী দ্বারা অত্যুর্ধ্বে অবস্থিত অমৃতস্রাবী বিচিত্র স্থানে ( সহস্রদল কমলে ) গমন করেন ||৪৩||

প্রাপশ্যদ্বিশ্বমাত্মেত্যয়মিহ পুরুষঃ শোকমোহাদ্যতীতঃ

শুক্রং ব্রহ্মাধ্যগচ্ছৎ খলু সকলবিৎ সর্বসিদ্ধ্যাস্পদং হি

বিস্মৃত্য স্থূলসূক্ষ্মপ্রভৃতিবপুরসৌ সর্বসঙ্কল্পশূন্যো

জীবন্মুক্তস্তুরীয়ং পদমধিগতবান্ পুণ্যপাপৈর্বিহীনঃ ||৪৪||

ভাবার্থ - এই পুরুষ এই শরীরে বিশ্বকে আত্মারূপেই দেখেছিলেন এরং শােকমােহাদির অতীত হয়ে শুক্রব্রহ্ম অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভকে অধিগত হয়ে অর্থাৎ প্রাপ্ত হয়ে সর্বজ্ঞ হলেন এবং সকলসিদ্ধি লাভ করলেন। তৎপরে স্থূল সূক্ষ্ম প্রভূতি শরীর বিস্তৃত হয়ে সকল সঙ্কল্পবিহীন পুণ্যপাপবিহীন হলেন এবং জীবন্মুক্ত হয়ে তুরীয় পদ প্রাপ্ত হলেন।

( টিপ্পনী-এই অনুবাদ টীকানুসারে প্রদত্ত হল। এই শ্লোক ঈশাবাস্যোপনিষদের কোন, মন্ত্র অনুবাদস্বরূপ-টীকায় অর্থতঃ এই বলা হয়েছে; কিন্তু এতে উপনিষদের যে মন্ত্রের উল্লেখ আছে, তাতে শুক্রব্রহ্ম অর্থ- "শবল ব্রহ্ম" অর্থাৎ "হিরণ্যগর্ভ"-এরূপ করা হয় নাই। শুক্র শব্দের তাদৃশ অর্থ প্রসিদ্ধও নাই। শুক্রব্রহ্ম অর্থ শুদ্ধব্রহ্ম করলে অর্থের কোন ব্যাঘাতও হয় না- ওটা ভাষ্যসম্মতও হতে পারে ) ||৪৪||

|| ক্রমমুক্তিউৎক্রান্তি ||

যঃ সত্ত্বাকারবৃত্তৌ প্রতিফলতি যুবা দেহমাত্রাবৃতোঽপি

তদ্ধর্মৈর্বাল্যবার্দ্ধ্যাদিভিরনুপহতঃ প্রাণ আবির্বভূব

শ্রেয়ান্ সাধ্যস্তমেতং সুনিপুণমতয়ঃ সত্যসংকল্পভাজো-

ঽত্যভ্যাসাদ্দেবয়ন্তঃ পরিণতমনসা সাকমূর্ধ্বং নয়ন্তি ||৪৫||

ভাবার্থ - যে যুবা অর্থাৎ নিত্য একরস আত্মা সাত্ত্বিক অন্তঃকরণবৃত্তিতে প্রতিফলিত হন, তিনি দেহমাত্রাবৃত হলেও দেহের ধর্ম বাল্যবার্দ্ধক্যাদি দ্বারা অভিভূত না

হয়ে কল্যাণরূপ এবং উত্তমগতিলাভের যোগ্য প্রাণ অর্থাৎ জীবরূপে আবির্ভূত হন। সুনিপুণমতি, সত্যসঙ্কল্প এবং পূর্বোক্ত অভ্যাসযােগ দ্বারা যাঁরা দেবত্ব পাতে ইচ্ছুক, তাঁরা পরিণত মন অর্থাৎ শুদ্ধ মনের সহিত একে উর্দ্ধলোকে লয়ে যান ||৪৫||

|| নির্বাণমুক্তি উৎক্রান্তিসাধ্য নয় ||

প্রায়োঽকামোঽস্তকামো নিরতিশয়সুখায়াত্মকামস্তদাসৌ

তৎপ্রাপ্তাবাপ্তকামঃ স্থিতচরমদশস্তস্য দেহাবসানে

প্রাণা নৈবোৎক্রমন্তি ক্রমবিরতিমিতাঃ স্ব স্ব হেতৌ তদানীং

ক্বায়ং জীবো বিলীনো লবণমিব জলেঽখণ্ড আত্মৈব পশ্চাৎ ||৪৬||

ভাবার্থ - কামনা অন্তরগত হওয়াতে জীবন্মুক্ত প্রায় অকাম হয়ে থাকেন নিরতিশয় সুখপ্রাপ্তির জন্য কেবলমাত্র আত্মারই কামনা করেন। তার পর আত্মার প্রাপ্তি হলে চরম দশায় স্থিত হয়ে আপ্তকাম হন। এতাদৃশ পুরুষের শরীর ত্যাগ হলে তাঁর প্রাণ উৎক্রান্ত হয় না। দেহারম্ভক কারণপুলি ক্রমশঃ বিনষ্ট হলে তখন এই জীবদশাপন্ন আত্মা কোথায় থাকে? অর্থাৎ জলে লবণের ন্যায় বিলীন হয়ে যায়। তখন অখণ্ড আত্মাই অবশিষ্ট থাকেন ||৪৬||

পিণ্ডীভূতং যদন্তর্জলনিধিসলিলং যাতি তৎ সৈন্ধবাখ্যং

ভূয়ঃ প্রক্ষিপ্তমস্মিন্ বিলয়মুপগতং নামরূপে জহাতি

প্রাজ্ঞস্তদ্বৎ পরাত্মন্যথ ভজতি লয়ং তস্য চেতো হিমাংশৌ

বাগগ্নৌ চক্ষুরর্কে পয়সি পুনরসৃগ্রেতসী দিক্ষু কর্ণৌ ||৪৭||

ভাবার্থ - যেমন সমুদ্রের অভ্যন্তরস্থ জল পিণ্ডীভূত হয়ে সৈন্ধবত্ব প্রাপ্ত হয়, পুনরায় সেই সৈন্ধব সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হলে বিলীন হয়ে যায় এবং নামরূপ ত্যাগ করে, তদ্রূপ এই প্রাজ্ঞ আত্মাও পরমাত্মাতে লয় প্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাঁর চিত্ত চন্দ্রে, বাক অগ্নিতে, চক্ষু সূর্যে, শােণিত এবং রেতঃ জলে এবং কর্ণদ্বয় দিক সমূহে বিলীন হয়ে যায় ||৪৭||

ক্ষীরান্তর্যদ্বদাজ্যং মধুরিমবিদিতং তৎপৃথগ্ ভূতমস্মাৎ

ভূতেষু ব্রহ্ম তদ্বৎ ব্যবহৃতিবিদিতং শ্রান্তবিশ্রান্তিবীজম্

যং লব্ধ্বা লাভমন্যং তৃণমিব মনুতে যত্র নোদেতি ভীতিঃ

সান্দ্রানন্দং যদন্তঃ স্ফুরতি তদমৃতং বিদ্ধ্যতো হ্যন্যদার্তম্ ||৪৮||

ভাবার্থ - যেরূপ মাধুর্যের দ্বারা জ্ঞাত ঘৃত, দুগ্ধের মধ্যেই থাকে কিন্তু ঘৃত দুগ্ধ হতে ভিন্ন, সেইরূপ ব্যবহার দ্বারা জ্ঞাত অর্থাৎ চৈতন্য দ্বারা অনধিষ্ঠিত হয়ে জড় শরীরাদি ব্যবহার সাধনে অসমর্থ, অতএব জড়াধিষ্ঠানরূপে জ্ঞাত এবং শ্রান্ত জীবগণের বিশ্রামের কারণ অর্থাৎ সুষুপ্তিতে যে ব্রহ্মের আশ্রয়ে জাগ্রতে পরিশ্রান্ত জীব আরাম লাভ করে, সেই ব্রহ্মও সকলভূতে তদ্রূপই ভূতসমূহ হতে পৃথগ্রূপে অবস্থান করেন। যাঁকে করলে জীব অন্য লাভকে তৃণের ন্যায় তুচ্ছ মনে করে, যাঁতে ভয়ের উদয় হয় না এবং আনন্দঘনরূপে যাঁর অন্তঃকরণে প্রকাশিত থাকেন, সেই ব্রহ্মকেই তুমি অমৃত অর্থাৎ মৃত্যুর অতীতরূপে জানবে; তদ্ভিন্ন অন্য নাশশীল পদার্থজাতকে অমৃত মনে করও না ||৪৮||

ওতঃ প্রোতশ্চ তন্তুষ্বিহ বিততপটশ্চিত্রবর্ণেষু চিত্রঃ

তস্মিন্ জিজ্ঞাস্যমানে ননু ভবতি পটঃ সূত্রমাত্রাবশেষঃ

তদ্বৎ বিশ্বং বিচিত্রং নগনগরনরগ্রামপশ্বাদিরূপং

প্রোতং বৈরাজরূপে রিয়তি তদপি ব্রহ্মণি প্রোতমোতম্ ||৪৯||

ভাবার্থ - লোকে যেমন দেখা যায় বিস্তৃত চিত্রবর্ণ বস্ত্র নানাবর্ণে রঞ্জিত সূত্রের ওতপ্রোতভাবে বিদ্যমান থাকে এবং বস্ত্রের স্বরূপ আলোচনা করলে সূত্রমাত্রাতিরিক্ত বস্ত্রের আর পৃথক্ সত্তা পাওয়া যায় না, সেইরূপ পর্বত, নগর, মনুষ্য, গ্রাম এবং পশু প্রভৃতিস্বরূপ বিচিত্র এই বিশ্ব বিরাটরূপেই ওতপ্রোতভাবে বিদ্যমান, বিরাট্ আবার আকাশে বিদ্যমান এবং আকাশ ব্রহ্মে ওতপ্রোতভাবে বিদ্যমান ||৪৯||

রূপং রূপং প্রতীদং প্রতিফলনবশাৎ প্রাতিরূপ্যং প্রপেদে

হ্যেকো দ্রষ্টা দ্বিতীয়ো ভবতি সলিলে সর্বতোঽনন্তরূপঃ

ইন্দ্রো মায়াভিরাস্তে শ্রুতিরিতি বদতি ব্যাপকং ব্রহ্ম তস্মাৎ

জীবত্বং যাত্যকস্মাদতিবিমলতরে বিম্বিতং বুদ্ধ্যুপাধৌ ||৫০||

ভাবার্থ - ব্রহ্ম প্রতিফলনবশতঃ প্রত্যেকরূপেই প্রতিবিম্বিত হয়েছেন অর্থাৎ সর্বত্র অধিষ্ঠানরূপে অনুস্যূত হয়েছেন। এক আত্মাই দ্বিতীয় হয়েছেন; কারণ, শ্রুতি বলেছেন অতি স্বচ্ছ ( সলিল ) ইন্দ্র অর্থাৎ পরব্রহ্ম স্বকীয় মায়াবশতঃ অনন্তরূপ হয়েছেন। অতএব ( বলতে হবে ) ব্যাপক ব্রহ্মই অত্যন্ত স্বচ্ছ বুদ্ধিরূপ উপাধিতে প্রতিবিম্বিত হয়ে অকস্মাৎ জীবত্ব প্রাপ্ত হন ||৫০||................

চলবে। 


আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...