আচার্য
শঙ্কর ব্রহ্মসূত্রের (২/৪/৫) ভাষ্যে এই বিষয়ে বিভিন্ন শ্রুতির উল্লেখ করিতেছেন-কোন
কোন স্থলে সাতটি ইন্দ্রিয় বর্ণিত হইতেছে-
'সপ্ত
প্রাণাঃ প্রভবন্তি তস্মাৎ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২/১/৮)
"ব্রহ্ম
হইতে সাতটি ইন্দ্রিয় (-পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়, বাক্ ও মন) উৎপন্ন হয়।"
আবার
কোন কোন স্থলে উক্ত সাতটি ও হস্ত নিয়ে আটটি ইন্দ্রিয় গ্রহত্বরূপ গুণের দ্বারা বর্ণিত
হইতেছে-
'অষ্টৌ
গ্রহা অষ্টাবতিগ্রহাঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩/২/১)
"আটটি
গ্রহ ও আটটি অতিগ্রহ" ইত্যাদি।
কোন
কোন স্থলে নয়টি ইন্দ্রিয় বর্ণিত হইতেছে-
'সপ্ত
বৈ শীর্ষণ্যাঃ প্রাণা দ্বাববাঞ্চৌ'-(তৈত্তিরীয় সংহিতা ৫/১/৭/১)
"মস্তকস্থ
ইন্দ্রিয় নিশ্চয় সাতটি (চক্ষুর্দ্বয়, কর্ণদ্বয়, নাসাছিদ্রদ্বয় ও বাক্) এবং (পায়ু
ও উপস্থ) এই দুইটি নিম্নে অবস্থিত।"
কোথাও
দশটি বর্ণিত হইতেছে-'নব বৈ পুরুষে প্রাণা নাভির্দশমী'-(তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ-২/১/৭)
"পুরুষে
(-পুরুষাকার দেহে উপরোক্ত) নয়টি অবশ্যই আছে, নাভি দশম।"
কোথাও
এগারটি বর্ণিত হইতেছে-'দশেমে পুরুষে প্রাণা আত্মৈকাদশঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ-৩/৯/৪)
"পুরুষে
(-পুরুষোপাধি দেহে, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়) এই দশটি ইন্দ্রিয় বর্তমান
আছে, মন একাদশ।"
তাছাড়া
কোন কোন স্থলে দ্বাদশটি বর্ণিত হইতেছে, যেমন- 'সর্বেষাং স্পর্শানাং ত্বগেকায়নম্'-(বৃহদারণ্যক
উপনিষৎ-২/৪/১১)
"ত্বগিন্দ্রিয়ই
সকলপ্রকার স্পর্শের একমাত্র আশ্রয়", ইত্যাদি।
আবার
কোথাও ত্রয়োদশটিও বর্ণিত হইয়াছে-'চক্ষুশ্চ দ্রষ্টব্যং চ'-(প্রশ্ন উপনিষৎ-৪/৮)
"চক্ষু
এবং দ্রষ্টব্য বিষয়" ইত্যাদি এইস্থলে।
এই
প্রকারে ইন্দ্রিয়সকলের সংখ্যা নির্দ্ধারণের প্রতি শ্রুতি সকল বিরোধগ্রস্ত হইতেছে।
একপক্ষের মতে ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা সাতটিই। যেহেতু উপরোক্ত মুণ্ডক ও তৈত্তিরীয় শ্রুতিতে
ইহারা বিশেষিত হইয়াছে। আর যে একাদশাদি সংখ্যান্তরের শ্রবণ তাহা ইন্দ্রিয়ের বিভিন্ন
বৃত্তিকে অপেক্ষা করে। এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত সূত্র হইল-
হস্তাদয়স্তু
স্থিতেতো নৈবম্৷৷ ব্রহ্মসূত্র-২.৪.৬৷৷
অর্থাৎ
'তু' এই শব্দটি পূর্বসূত্রের একপক্ষীয় মতকে নিরাকরণ করিতেছে। হস্তদ্বয় ইত্যাদিকেও
শ্রুতিতে ইন্দ্রিয় হিসেবেই গ্রহণ করা হইয়াছে। ইহা যেহেতু অবধারিত বিষয়, সেইহেতু
ইন্দ্রিয়সমূহ সপ্তসংখ্যক মাত্র নহে।
আচার্য
শঙ্কর ভাষ্যে সিদ্ধান্ত করিতেছেন- 'হস্তো বৈ গ্রহঃ স কর্মণাতিগ্রহেণ গৃহীতো হস্তাভ্যাং
হি কর্ম করোতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩/২/৮)
"হস্তদ্বয়ই
গ্রহ, তাহা কর্ম্মরূপ (-গ্রহণকরারূপ) অতিগ্রহের দ্বারা গৃহীত (-আবদ্ধ), যেহেতু হস্তদ্বারায়
কর্ম্মানুষ্ঠান করে", ইত্যাদি এইসকল শ্রুতিতে সাতটি হইতে অতিরিক্ত হস্ত প্রভৃতি
অপর ইন্দ্রিয়সকল পঠিত হইতেছে।
তাহা
হইলে ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা কত? ভাষ্যকার সিদ্ধান্ত করিতেছেন একাদশটি। সেই বিষয়ে শ্রুতি
উদাহৃতা হইয়াছে-'দশেমে পুরুষে প্রাণা আত্মৈকাদশঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষদ-৩/৯/৪)
"পুরুষে
(-পুরুষোপাধি দেহে, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়) এই দশটি ইন্দ্রিয় বর্তমান
আছে, আত্মা (-মন) একাদশস্থানীয়।" আত্মশব্দে কিন্তু অন্তঃকরণ পরিগৃহীত হইতেছে,
যেহেতু ইহা করণের (-বিষয়গ্রাহক ইন্দ্রিয়ের প্রকরণ।
কিন্তু
একাদশ হইতেও অধিক দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ সংখ্যা উদাহৃত হইয়াছে। হ্যাঁ সত্য, উদাহৃত হইয়াছে;
কিন্তু একাদশটি কার্য (—ইন্দ্রিয়ের বিষয়) হইতে অধিক কার্য্য বিদ্যমান নাই, তাহার
জন্য অধিক করণ কল্পনা করিতে হইবে। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধবিষয়ক পাঁচপ্রকার বিভিন্ন
বুদ্ধি (—জ্ঞান), তাহাদিগের জন্য পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় আবশ্যক।
আর
বচন (—বাগ্ ব্যবহার), আদান (—গ্রহণ), বিহরণ (—চলন), উৎসর্গ (—মলত্যাগ) ও আনন্দ , এই
পাঁচপ্রকার বিভিন্ন কর্ম্ম, তাহাদিগের জন্য পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় আবশ্যক। সকল পদার্থই
যাহার বিষয় এবং কালত্রয়েই যাহার বৃত্তি (—ক্রিয়া) হয়, সেই মন কিন্তু এক ও অনেক
বৃত্তিযুক্ত। কোন কোন স্থলে বৃত্তির বিভিন্নতাবশতঃ তাহাই বিভিন্নের ন্যায় কথিত হয়,
যথা—মন বুদ্ধি অহঙ্কার ও চিত্ত, এইপ্রকার। আর দেখ শ্রুতি কাম প্রভৃতি নানাবিধ বৃত্তিসকলকে
উল্লেখ করিয়া বলিতেছেন-
'এতত্সর্বং
মন এব'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-১/৫/৩) "এইসমস্ত মনই", ইত্যাদি।
অতএব
কার্য্যলিঙ্গক অনুমানপুষ্ট আগমপ্রমাণবলে ইন্দ্রিয়ের একাদশত্ব সংখ্যা নিরূপিত হইল।.......
প্রকারান্তরে
ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা নিরূপণঃ-
ইতোমধ্যে
বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রাবলম্বনে আলোচনা করিয়াছি ইতর ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা একাদশটী। এক্ষণে
সেই সিদ্ধান্তই আর পুষ্ট করা হইবে। ব্রহ্মসূত্রের সপ্তগত্যধিকরণের দ্বিতীয় বর্ণকে
ইন্দ্রিয় সকলই বিষয়। জীবের সহিত কতগুলি প্রাণ উৎক্রমণ করে, ইহা এখানে বিচারিত হইয়াছে।
ভগবান
শঙ্করাচার্য সিদ্ধান্ত সূত্রের (২/৪/৬) ভাষ্যে বলিতেছেন-"হস্তদ্বয় নিশ্চয় গ্রহ"-(বৃহদারণ্যক
উপনিষৎ-৩/২/৮), ইত্যাদি শ্রুতি বাক্যসকলে কিন্তু সাতটী হইতে অতিরিক্ত হস্ত প্রভৃতি
অপর ইন্দ্রিয়সকল প্রতীত হইতেছে। আর গ্রহত্ব বলিতে বন্ধনভাব অবগত হওয়া যাইতেছে, যেহেতু
ক্ষেত্রজ্ঞ (-জীব) এই গ্রহ নামক বন্ধনের দ্বারা বদ্ধ হয়। আর এই ক্ষেত্রজ্ঞ একটী মাত্র
শরীরেই বদ্ধ হয় না, যেহেতু অন্য শরীরসকলেও তাহার বন্ধন সমানই হইয়া থাকে। সেইহেতু
এই গ্রহনামক বন্ধন অন্য শরীরেও সঞ্চরণ করে, ইহা অর্থবলে কথিত হইতেছে। যেমন দেখ,
"প্রাণ যাহার আদি, সেই পূর্য্যষ্টকাত্মক লিঙ্গের দ্বারা জীব বদ্ধ হন। তাহার দ্বারা
যিনি বদ্ধ, তাঁহারই বন্ধন এবং তাহা হইতে যিনি মুক্ত তাঁহারই মুক্তি।" ব্রহ্মপুরাণোক্ত
ইত্যাদি স্মৃতি মোক্ষের পূর্ব্ব পর্য্যন্ত এই গ্রহসংজ্ঞক বন্ধনের সহিত অবিয়োগ প্রদর্শন
করিতেছেন।......
এখন
প্রশ্ন পূর্য্যষ্টক কি? অর্থাৎ দেহরাজ জীবের আটটী পুরী। সুরেশ্বরাচার্য্য 'পঞ্চীকরণ'
সূত্রের বার্ত্তিকে স্পষ্ট করিতেছেন-
"১.আকাশ,
বায়ু, অগ্নি, জল ও পৃথিবী- এই পাঁচটী অপঞ্চীকৃত ভূতসূক্ষ্ম একটী পুরী; ২. অবিদ্যা
একটী পুরী; ৩. কাম একটী পুরী; ৪. কর্ম্ম একটী পুরী; লিঙ্গশরীর অর্থাৎ ৫. পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়
একটী পুরী; ৬. পঞ্চ কর্ম্মেন্দ্রিয় একটী পুরী; ৭. পঞ্চ প্রাণ একটী পুরী; ৮. মন, বুদ্ধি,
অহঙ্কার এবং চিত্তরূপ অন্তঃকরণ একটী পুরী- দেহরাজ জীবের এই অষ্টপুর বলিয়া জানিবে।"-(পঞ্চীকরণ
বার্ত্তিক- ৩৬)
ভগবান
ভাষ্যকার উক্ত সূত্রের ভাষ্যে আরও একটী শ্রুতিপ্রমাণ প্রদর্শন করিয়া ইহা সিদ্ধ করিলেন
যে ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা একাদশটী। যথা-
'দশেমে
পুরুষে প্রাণা আত্মৈকাদশস্তে যদাস্মাচ্ছরীরান্মর্ত্যাদুত্ক্রামন্ত্যথ রোদয়ন্তি'-(বৃহদারণ্যক
উপনিষৎ-৩/৯/৪)
"পুরুষে
(-তদাকার দেহে) এই দশটী ইন্দ্রিয়, আত্মা(-মন) একাদশ, তাহারা যখন এই মরণশীল শরীর হইতে
উৎক্রমণ করে, তখন (-কুটুম্বগণকে) রোদন করায়", এইপ্রকারে শ্রুতি একাদশটী ইন্দ্রিয়ের
উৎক্রান্তি প্রদর্শন করিতেছেন।
No comments:
Post a Comment