যোগদার্শনিক পতঞ্জলি তাঁর যোগসূত্রে যোগের সংজ্ঞা দিচ্ছেন এইভাবে-
‘যোগশ্চিত্তবৃত্তি
নিরোধঃ’- (যোগসূত্র, সমাধিপাদ্-২)
অর্থাৎ
চিত্তবৃত্তির নিরোধই যোগ।
ব্যাসভাষ্য
অনুসারে ভাবার্থঃ- চিত্ত যেহেতু প্রখ্যা বা প্রকাশশীলতায় সত্ত্বগুণযুক্ত, তাই তা প্রকাশস্বরূপ।
প্রবৃত্তিশীলতা ও স্থিতিশীলতায় চিত্ত সত্ত্ব,রজঃ ও তমঃ ত্রিগুণাত্মক। যেহেতু প্রকাশস্বরূপ
চিত্ত এই ত্রিগুণের দ্বারা বিজড়িত, তাই সে ঐশ্বর্য্য ও বিষয়প্রিয় হয়। সেই চিত্ত তমোগুণভাবাপন্ন
অধর্ম্ম, অজ্ঞান, অবৈরাগ্য ও অনৈশ্বর্য্য প্রভৃতিতে উপগত হয়। সেই চিত্ত আবার নিজ মোহ
আবরণের অত্যন্ত ক্ষীণতায় প্রজ্ঞাসম্পন্নে সবদিক দিয়ে আবিষ্ট হলে পর রজোগুণমাত্র স্বীকারে
ধর্ম্ম, জ্ঞান, বৈরাগ্য ও ঐশ্বর্য্যে উপগত হয়। সেই চিত্ত আবার রজোগুণরূপ মল-লেশ বিযুক্ত
অবস্থায় নিজস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজগতবুদ্ধি ও পুরুষের (আত্মা) মধ্যে অন্যতাখ্যাতিমাত্র
উদয়ে অর্থাৎ পূর্ণ সাত্ত্বিক-প্রসাদ গুণবিশিষ্ট বিবেকখ্যাতি উদয়ে ধর্ম্মমেঘ ধ্যানে
উপগত হয়।
ধ্যানশীল
যোগীরা এই অবস্থাকে উত্তম প্রসংখ্যান বা জ্ঞানের পরাকাষ্ঠা বলে থাকেন। চিতিশক্তি অপরিণামিনী,
অপ্রতিসংক্রমা অর্থাৎ কোন প্রকার কার্য্যে বা বিষয়ে সঞ্চারশূন্যা,তাই চিতিশক্তি দর্শিতবিষয়া
অর্থাৎ বিষয়রূপ পরিণতিতে সে সেই বিষয় পুরুষকে প্রদর্শন করায়, এই ভাবের হওয়ায় চিতিশক্তি
শুদ্ধা ও অনন্তা। অতএব এই বিবেকখ্যাতি সত্ত্বগুণাত্মিকা, তাই তার বিপরীত হল চিতিশক্তি।
এইজন্য বিবেকখ্যাতির উপর সে বিরক্ত চিত্ত, সেই বিবেকখ্যাতিকেও সে নিরুদ্ধ করে। সেই
নিরুদ্ধ অবস্থায় চিত্ত মাত্র সংস্কারে অবস্থান করে। তা হলো নির্বীজ সমাধি, আর সেখানে
কোনকিছু জ্ঞান না থাকায় তা অসম্প্রজ্ঞাত। এভাবে দু-রকমে চিত্তবৃত্তি নিরোধই যোগ বলা
হয়ে থাকে। ইতি ভাষ্যানুবাদ।
স্বয়ং
শ্রুতিও চিত্তভূমির এই একাত্মতার অভাবে চিত্তের অসমাহিত অবস্থা বর্ণনা করছে-
নাবিরতো
দুশ্চরিতান্নাশান্তো নাসমাহিতঃ ৷
নাশান্তমানসো
বাপি প্রজ্ঞানেনৈনমাপ্নুয়াৎ ৷৷কঠ উপনিষৎ ১.২.২৪৷৷
শাঙ্করভাষ্য
অনুবাদঃ-এই শ্রুতি অবলম্বনে ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হল- তবে এক কথা, যে দুশ্চরিত
হতে অর্থাৎ শ্রুতি ও স্মৃতিতে অবিহিত নিষিদ্ধ পাপকর্ম্ম হতে যে অবিরত অর্থাৎ নিবৃত্ত
নয়; ইন্দ্রিয়ের চঞ্চলতাবশতঃ যে অশান্ত বা উপরতিশূন্য তাঁর ব্রহ্মপ্রাপ্তি হয় না। যে
অসমাহিত অর্থাৎ যাঁর চিত্ত একাগ্র নয় অর্থাৎ যে বিক্ষিপ্তচিত্ত তাঁরও প্রত্যাগাত্মা
প্রাপ্তি হয় না। আর একাগ্রচিত্ত হয়েও এই একাগ্রতার ফল কামনায় যে অশান্তচিত্ত অর্থাৎ
ফলবিষয়ে ব্যাপৃতচিত্ত, সেজনও ব্রহ্মতত্ত্বের সহায়ে প্রস্তাবিত সেই প্রত্যাগাত্মাকে
প্রাপ্ত হতে পারে না। পক্ষান্তরে যিনি দুশ্চরিত্রতা ও ইন্দ্রিয়ের চঞ্চলতা হতে বিরত,
একাগ্রচিত্ত এবং ঐ একাগ্রতার ফল হতে যাঁর মন নিবৃত্ত এবং আচার্য্য কর্তৃক উপদিষ্ট,
তিনি ব্রহ্মতত্ত্বের সহায়ে পূর্বোক্ত নিশ্চল নির্বিশেষ প্রত্যাগাত্মাকে প্রাপ্ত হন।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়ও
স্বয়ং শ্রীভগবান অর্জুনকে বিভিন্নভাবে যোগের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এক জায়গায় তিনি যোগের
ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলছেন-
বুদ্ধিযুক্তো
জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে৷
তস্মাদ্যোগায়
যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্৷ ৷(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-২।৫০)
শাঙ্করভাষ্য
অনুবাদঃ- যিনি সমত্ববিষয়ক বুদ্ধিযুক্ত, ইহলোকে তিনি সুকৃত দুষ্কৃত অর্থাৎ পূণ্য ও পাপ
উভয়ই সত্ত্বশুদ্ধিজ্ঞান প্রাপ্তি দ্বারা পরিত্যাগ করেন। তজ্জন্য তুমি সমত্ব বুদ্ধিযুক্ত
যোগের অনুষ্ঠান কর। যেহেতু যোগ হইতেছে কর্ম্মের কৌশল। স্বধর্ম্মাখ্য কর্ম্মে যিনি বর্ত্তমান
তাঁহার ঈশ্বরার্পিত চিত্ততাহেতু সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে সমত্ববুদ্ধি তাহাই কৌশল অর্থাৎ
কুশলভাব। এই কৌশল হইতেছে- যাহা বন্ধস্বভাব কর্ম্ম সকলকে সমত্ববুদ্ধি দ্বারা তাহাদের
স্বভাব হইতে নিবর্তিত করে; সেইহেতু তুমি সমত্ববুদ্ধিযুক্ত হও।
.................................................................
No comments:
Post a Comment