মায়াবশেই নির্বিকার ব্রহ্মে জগৎ প্রতীতি হইয়া থাকে। ব্রহ্মবিবর্ত জগৎ ব্রহ্মভিন্ন নহে। অতএব এক ব্রহ্মই সদা বিরাজমান রহিয়াছেন। বিবর্তবাদে কার্য একটি মিথ্যা প্রতীত মাত্র; কার্য বস্তুতঃ কোন কালে হয়ই নাই। সৃষ্টির পূর্বে নিত্যমুক্ত অবিক্রিয় এক পরংব্রহ্মই বর্তমান ছিলেন। অর্থাৎ ব্রহ্ম দেশকালরূপ বস্তুপরিচ্ছেদশূন্য, অতএব সৃষ্টিরপূর্বে এক সজাতীয় বিজাতীয়-স্বগতভেদশূন্য পরম অর্থাৎ পরমানন্দস্বরূপ, নিত্যমূক্ত, ত্রিকালেই সর্ব অনর্থরূপ প্রপঞ্চসম্বন্ধশূন্য সচ্চিদানন্দত্মক পরংব্রহ্মই বর্তমান ছিলেন।
শ্রুতিও তাই বলিতেছেন -'সদেব সোম্যেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ম্'- (ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/২/১)।
‘হে প্রিয়দর্শন, এই জগৎ উৎপত্তির পূর্ব্বে এক অদ্বিতীয় সৎ রূপেই বিদ্যমান ছিল।
এইরূপ অন্যস্থলেও শ্রুতি বলিতেছে-
'আত্মা বা ইদমেক এবাগ্র আসীত্৷ নান্যৎ কিঞ্চন মিষত্৷-(ঐতরেয় উপনিষৎ-১/১/১)
ইহা অর্থাৎ এই জগৎ উৎপত্তির পূর্ব্বে একমাত্র আত্মস্বরূপেই বিদ্যমান ছিল, ব্যাপারবান্ অন্য কিছুই ছিল না।
এইরূপ আরম্ভ করিয়া 'তদৈক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি তত্তেজোসৃজত'।-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬/২/৩)।
'তিনি ইক্ষণ করিলেন, আমি বহু হইব, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হইব, তিনি তেজকে সৃষ্টি করিলেন' ইত্যাদি।
উক্ত শ্রুতিবাক্যে ইদম্ শব্দবাচ্য এবং নাম ও রূপের দ্বারা অভিব্যক্ত এই জগৎকে উৎপত্তির পূর্ব্বে সৎস্বরূপ আত্মরূপে অবধারণ করিয়া সেই প্রস্তাবিত সৎশব্দবাচ্য ব্রহ্মের ইক্ষণপূর্ব্বক তেজঃ প্রভৃতির স্রষ্টৃত্ব প্রদর্শন করিতেছেন। এইরূপ অন্যস্থলেও শ্রুতি বলিতেছে-
'সঃ ঈক্ষত লোকান্নু সৃজা ইতি৷ স ইমা্লোকানসৃজত।'-(ঐতরেয় উপনিষৎ-১/১/২)
সেই আত্মা ঈক্ষণ করিলেন, আমি লোকসমূহকে সৃজন করিব, তিনি এইলোক সকলকে সৃজন করিলেন।' এইপ্রকারে ঈক্ষণপূর্বক সৃষ্টির কথাই শ্রুতি বলিতেছেন।
আবার কোনস্থলে ষোড়শকলাযুক্ত পুরুষের প্রস্তাব করিয়া শ্রুতি বলিতেছেন-'স ঈক্ষাংচক্রে, স প্রাণমসৃজত'।-(প্রশ্ন উপনিষৎ-৬।৩-৪) 'তিনি ঈক্ষণ করিয়াছিলেন'।'তিনি প্রাণকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন।'
যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিদ্যস্য জ্ঞানময়ং তপঃ৷ তস্মাদেতব্রহ্ম নাম রূপমন্নং চ জায়তে'।(মুণ্ডক উপনিষৎ-১।১।৯)
'যিনি সর্ব্বজ্ঞ এবং সর্ব্ববিৎ, যাহাঁর তপস্যা জ্ঞানময় অর্থাৎ জ্ঞানাত্মক ঈক্ষণক্রিয়াই যাহাঁর তপস্যা, তাঁহা হইতেই এই হিরণ্যগর্ভ, নামরূপ এবং অন্ন উৎপন্ন হয়।'
সেই ব্রহ্মতে শক্তিভূতা এবং নিজেতেই (ব্রহ্মতেই) অধ্যস্তা যে মায়া, মায়াশক্তিবিশিষ্ট সেই আবৃত, সুতরাং অজ্ঞাত ব্রহ্মেই জগৎ প্রপঞ্চ বিক্ষিপ্ত (-সৃষ্ট) হয়। পরমেশ্বরের অধীন এই মায়া ব্যতিরেকে পরমেশ্বরের জগৎস্রষ্টৃত্ব সম্ভব নহে। কারণ যিনি শক্তিরহিত, তাহার (সৃষ্ট্যাদিকর্ম্মে) প্রবৃত্তি যুক্তি সঙ্গত নহে। সেই প্রসিদ্ধা মায়াই অব্যক্ত যা ব্যক্ত নয় তাই অব্যক্ত বা অব্যাকৃত অর্থাৎ ঈশ্বর-শক্তি, যাহা সম্পূর্ণ জগতের বীজভূত অর্থাৎ উপাদান কারণ স্বরূপ।
সদানন্দযোগীন্দ্র সরস্বতী বেদান্তসারে বলিতেছেন—"যেমন রজ্জুর অজ্ঞান রজ্জুকে আবৃত করে রজ্জুতে নিজশক্তির দ্বারা সর্প প্রভৃতি কল্পনা করে, সেরূপ (আত্মাশ্রিত) অজ্ঞান আত্মাকে আবৃত করে আত্মাকে নিজশক্তি বলে আকাশাদি জগৎ সৃষ্টি করে। (এভাবে কল্পনা-বলে) সৃষ্টি করার এই সামর্থ্যকে বিক্ষেপশক্তি বলে। এই সম্পর্কে বাক্যসুধায় শঙ্করাচার্য বলিতেছেন—'বিক্ষেপশক্তি সূক্ষ্মশরীর থেকে আরম্ভ করে ব্রহ্মাণ্ড পর্যন্ত জগৎ সৃষ্টি করে।'-(বাক্যসুধা-১৩)"
মায়াশক্তি বিশিষ্ট ব্রহ্ম হইতে আকাশ, আকাশভাবাপন্ন ব্রহ্ম হইতে বায়ু, ইত্যাদি এই ক্রমে ব্রহ্ম হইতে পঞ্চ অপঞ্চীকৃত ভূতের (তন্মাত্রার) উৎপত্তি হয়। অনন্তর মুখ্যপ্রাণ মন ও ইন্দ্রিয় সকলের উৎপত্তি পরমেশ্বরাধিষ্ঠিত এই ভূতসকল হইতেই হইয়া থাকে। অনন্তর পরমেশ্বর কর্ত্তৃক পঞ্চীকরণ ও স্থুল ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্ট হয়। ইহাই অদ্বৈত বেদান্তে সৃষ্টিক্রম।
প্রথমত
সেই ব্রহ্মের ব্যাকৃত সত্তা হইতে আকাশ, আকাশ হইতে বায়ু, বায়ু হইতে অগ্নি, অগ্নি হইতে
জল, জল হইতে ক্ষিতি, ক্ষিতি হইতে ওষধিসকল, ওষধিসকল হইতে অন্ন এবং অন্ন হইতে দেহ- এই
যে ক্রম, কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় উপনিষদের দ্বিতীয়া ব্রহ্মানন্দবল্লীতে এর একটী
স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়-
তস্মাদ্বা
এতস্মাদাত্মন আকাশঃ সম্ভূতঃ । আকাশাদ্বায়ুঃ ।
বায়োরগ্নিঃ
। অগ্নেরাপঃ । অদ্ভ্যঃ পৃথিবী ।
পৃথিব্যা
ওষধয়ঃ । ওষধীভ্যোন্নম্ । অন্নাৎপুরুষঃ ।
স বা এষ পুরুষোঽন্নরসময়ঃ......॥ ১॥ ইতি প্রথমোঽনুবাকঃ ॥
শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্যে বলিতেছেন- সেই এই আত্মস্বরূপ ব্রহ্মের নিমিত্ত আকাশ উৎপন্ন হইল। এখন শব্দগুণসম্পন্ন আকাশ হইতেছে আকারবিশিষ্ট দ্রব্যসকলের স্থানদাতা। আর সেই আকাশ হইতে স্বীয় গুণ 'স্পর্শ' ও পূর্ববর্তী আকাশের শব্দগুণের সহযোগে দুইগুণবিশিষ্ট বায়ু সম্ভূত (উৎপন্ন) হইল। এবং স্বীয় গুণ 'রূপ' ও পূর্ববর্তী (শব্দস্পর্শ) গুণদ্বয়ের সহযোগে বায়ু হইতে ত্রিগুণবিশিষ্ট অগ্নি উৎপন্ন হইল। আর স্বীয় গুণ রস ও পূর্ববর্ত্তী (শব্দস্পর্শরূপ) গুণত্রয়ের সহযোগে অগ্নি হইতে চতুর্গুণবিশিষ্ট জল উৎপন্ন হইল এবং স্বীয় গুণ গন্ধ ও পূর্ববর্তী (শব্দস্পর্শরূপরস) গুণ চতুষ্টয়ের সহযোগে জল হইতে পঞ্চগুণবিশিষ্ট পৃথিবী উৎপন্ন হইল। আর পৃথিবী হইতে ওষধিসমূহ, ওষধিসমূহ হইতে অন্ন। আর রেতোরূপে পরিণত অন্ন হইতে শিরঃ হস্তাদি আকৃতিবিশিষ্ট পুরুষ (মানবদেহ) সমুৎপন্ন হইল।
এই সেই প্রসিদ্ধ পুরুষ (মানবদেহ) অন্নরসময়-অন্নরসের বিকার অর্থাৎ সমস্ত অঙ্গাদি হইতে তেজসম্ভূত পুরুষাকৃতিপ্রাপ্ত রেতোরূপ বীজ হয়। আর সেই বীজ হইতে যে শরীর জন্মে তাহাও সেইরূপ পুরুষাকৃতি বিশিষ্টই হইয়া থাকে, কেননা সকল জাতিতে জায়মানগণের মধ্যে জনকের আকৃতি প্রাপ্তির নিয়ম দেখা যায়।..................
No comments:
Post a Comment