আমরা এক্ষণে জীব এবং ব্রহ্মের মধ্যে কিরূপ সম্বন্ধ তাহার সম্পর্কে জিজ্ঞাসু হইয়াছি। ইঁহাদের মধ্যে সম্বন্ধ কি প্রভু-ভৃত্যের ন্যায় অথবা অগ্নি ও স্ফুলিঙ্গের সম্পর্কের ন্যায়? বেদান্ত মীমাংসা শাস্ত্রের অংশাধিকরণে ভগবান্ সূত্রকার বাদরায়ণ সিদ্ধান্ত করিতেছেন—
'অংশো নানাব্যপদেশাদন্যথা
চাপি দাশকিতবাদিত্বমধীয়ত একে৷' -(ব্রহ্মসূত্র- ২.৩.৪৩)
ভগবান্
ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য এই সূত্রের ভাষ্যে
বলিতেছেন—এই হেতু সূত্রকার
বলিতেছেন—'অংশ' ইত্যাদি। জীব
ঈশ্বরের অংশ, ইহাই সঙ্গত;
যেমন বিস্ফুলিঙ্গ অগ্নির অংশ। এইখানে অংশ
বলিতে 'যেন অংশ' অর্থাৎ
কল্পিত অংশ বুঝিতে হইবে,
কারণ নিরবয়ব ব্রহ্মের মুখ্য অংশ সম্ভব নহে।
জীব
ব্রহ্মাগ্নির স্ফুলিঙ্গ। উপনিষৎ বলিয়াছেন—"যথা সুদীপ্তাৎপাবকাদ্বিস্ফুলিঙ্গাঃ সহস্রশঃ প্রভবন্তে সরূপাঃ"-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২.১.১)
যেমন প্রদীপ্ত অগ্নি হইতে সহস্র সহস্র
বিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়, সেইরূপ অক্ষর
পুরুষ হইতে বিবিধ জীব
উৎপন্ন হইয়া থাকে এবং পরিণামে
তাহাতেই বিলীন হয়।
শ্রীগীতায়
ভগবান্ বাসুদেব স্পষ্টবাক্যেই জীবকে ব্রহ্মাংশ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। 'মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-১৫।৭) ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য গীতার এই শ্লোকের ভাষ্যে
বলিয়াছেন— "জীবলোকে অর্থাৎ সংসারে কর্তাভোক্তারূপে প্রসিদ্ধ জীব আমারই (পরমাত্মারই)
সনাতন অংশ অর্থাৎ ভাগ
বা অবয়ব বা একদেশ
অর্থাৎ এইগুলি পরমাত্মা হইত পৃথক কোন
অর্থান্তর নয়। সেই জীব
আমার (পরমাত্মার) অংশ রূপে কল্পিত।
জলরূপ নিমিত্ত অপসৃত হইলে সূর্যাংশ জল-সূর্য যেইরূপ সূর্যে লীন হয়, অথবা
মহাকাশের অভিন্ন অংশ ঘটস্থ আকাশ
যেইরূপ ঘট নষ্ট হইলে
মহাকাশে মিলিত হয়, আর প্রত্যাগমন
করে না, সেইরূপ ব্রহ্মাংশ
জীব অবিদ্যাকৃত উপাধি-অপগমে ব্রহ্মস্বরূপতা প্রাপ্ত হইয়া আর পুনরাবৃত্ত হয়
না। কারণ জীব স্বরূপত
ব্রহ্মই।"
জীব
ঘটাকাশ, ব্রহ্ম মহাকাশ। অনন্ত, অখণ্ড মহাব্যোম যেমন ঘটাদি অবচ্ছেদ
বা আবেষ্টনীর মধ্যে পড়িয়া ঘটাকাশ বলিয়া অভিহিত হয়, সেইরূপ অন্তঃকরণের
আবেষ্টনীর মধ্যে পড়িয়া অখণ্ড সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম, জীব সংজ্ঞা লাভ
করিয়া থাকে। ঘটাকাশ মহাকাশের সখণ্ড বা আংশিক অভিব্যক্তি,
জীবও সেইরূপ পরমাত্মার আংশিক বিকাশ। ইহাকেই অদ্বৈতবেদান্তে "অবচ্ছেদবাদ" বলা হয়।
আচ্ছা,
নিরবয়ব হওয়ায় ব্রহ্মই জীব হন না
কেন? যেহেতু শ্রুতিতে নানাত্বের বর্ণনা আছে।
'সোন্বেষ্টব্যঃ স
বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৮।৭।১)
'তাঁহাকে শাস্ত্র
ও আচার্যের উপদেশ দ্বারা অন্বেষণ করিতে হবে।'
'এতমেব বিদিত্বা
মুনির্ভবতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৪।২২)
'ইহাকেই অবগত
হইয়া মুনি হইয়া থাকে।
'য আত্মনি
তিষ্ঠন্নাত্মানমন্তরো যময়তি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৭।১০)
'যিনি আত্মাতে
(-বুদ্ধিতে) অবস্থানকরতঃ অভ্যন্তরবর্ত্তী হইয়া আত্মাকে নিয়মন
করেন', ইত্যাদি এইজাতীয় জীব ও ঈশ্বরের
মধ্যে ভেদনির্দ্দেশক শ্রুতি আছে।
কিন্তু
এই ভেদনির্দ্দেশ স্বামীভৃত্যের সারূপ্যে অধিকতর সঙ্গত; এইরূপ শঙ্কা জন্মিলে তদুত্তরে বলিতেছেন— শ্রুতিতে অন্যপ্রকারও অর্থাৎ অনানাত্বের (-জীব ও ঈশ্বরের
অভিন্নতার) বর্ণনাও আছে। যেমন দেখ,
অথর্ব্ববেদের কোন কোন শাখাধ্যায়িগণ
ব্রহ্মসুক্তে 'ব্রহ্মই দাশ, ব্রহ্মই দাস,
ব্রহ্মই এইসকল কিতব', ইত্যাদি বাক্যের দ্বারা ব্রহ্মের দাশকিতবাদিভাব পাঠ করিয়া থাকেন।
এই প্রকার অন্য স্থলেও (ব্রহ্মবোধক
প্রকরণেই) এই বিয়টীই বিস্তৃতভাবে
বর্ণিত হইতেছে—
'ত্বং স্ত্রী
ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত
বা কুমারী৷ ত্বং জীর্ণো দণ্ডেন
বঞ্চসি ত্বং জাতো ভবতি
বিশ্বতোমুখঃ'-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৪।৩)
'তুমি স্ত্রী,
তুমি পুরুষ, তুমি কুমার এবং
তুমিই কূমারী। তুমি জীর্ণ হইয়া
দণ্ডসহায়ে গমন করিতেছ এবং
তুমিই জন্মগ্রহণ করিয়া নানারূপ ধারণ করিয়া থাক',
ইত্যাদি। আর-
'সর্বাণি রূপাণি
বিচিত্য ধীরো নামানি কৃত্বাভিবদন্যদাস্তে'-(তৈত্তিরীয় আরণ্যক-৩।১২।৭)
'সেই ধীর
(-পরমাত্মা) রূপ-সকল নির্ম্মাণ
করিয়া অভিবদন (-বাগাদিব্যবহার) করতঃ বর্ত্তমান আছেন',
এই প্রকার শ্রুতিও আছে। আবার
'নান্যোতোস্তি দ্রষ্টা'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৭।২৩)
'ইহা হইতে
ভিন্ন দ্রষ্টা কেহ নাই", ইত্যাদি
শ্রুতিসকল হইতেও এই অর্থের অর্থাৎ
ব্রহ্মই জীবরূপে অবস্থান করেন এই বিষয়ের
সিদ্ধি হয়। জীব ও
ঈশ্বরের যে চৈতন্য, তাহা
অবশিষ্ট (-তাহাতে) কোন ভেদ নাই,
যেমন অগ্নি ও বিস্ফুলিঙ্গের উষ্ণতা।
অতএব জীব ও ঈশ্বরের
ভিন্নতা ও অভিন্নতার জ্ঞান
হয় বলিয়া অংশতাবিষয়ক জ্ঞান হয় অর্থাৎ জীব
ঈশ্বরের কল্পিত অংশ, ইহা অবগত
হওয়া যায়।.............
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের 'শারীরক-মীমাংসা' ভাষ্য ও 'শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা' ভাষ্য।
২.
'বেদান্তদর্শন অদ্বৈতবাদ', প্রথম খণ্ড, আশুতোষ শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
জুন
৭, শুক্রবার, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment