Friday, 31 July 2020

অনাদি সৃষ্টিতে পূর্ব্ব পূর্ব্ব কর্ম্মই উত্তরোত্তর সৃষ্টিবৈচিত্রের হেতু, ঈশ্বর নহেনঃ-


ইতোমধ্যে আলোচনা করিয়াছি জাগতিক বৈষম্য বা ক্রূরতার জন্য ঈশ্বরের প্রতি দোষারোপ করা অনুচিত,কারণ যে প্রাণিগণ সৃষ্ট হয়, তাহাদের ধর্ম্ম ও অধর্ম্মকে অপেক্ষা করিয়া বিষম সৃষ্টি হইয়া থাকে। এখন পুনরায় সূত্রকার শ্রীমৎমহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ আপত্তি উপস্থাপন পূর্ব্বক সিদ্ধান্ত করিতেছেন এইভাবে-

ন কর্মাবিভাগাদিতি চেৎ, ন, অনাদিত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৫)।।

শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- পরমহংসপরিব্রাজক ভগবৎপূজ্যপাদ্ শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য শারীরকমীমাংসা ভাষ্যে বলিতেছেন-

'সদেব সোম্যেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ম্'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ ৬।২।১)
অর্থাৎ হে সোম্য, সৃষ্টির পূর্ব্বে এই জগৎ এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মরূপে বর্তমান ছিল।"

-এইপ্রকার শ্রুতিবলে সৃষ্টির পূর্ব্বে ব্রহ্ম ও জগতের অবিভাগ নিশ্চিত হয় বলিয়া প্রথম সৃষ্টির পূর্ব্বে কর্ম্ম থাকে না, যাহাকে অপেক্ষা করিয়া পরবর্তী বিষমসৃষ্টি হইবে। সৃষ্টির পরবর্তীকালেই শরীরাদিরূপ বিভাগকে অপেক্ষা করিয়া কর্ম্ম অনুষ্ঠিত হয় এবং কর্ম্মকে অপেক্ষা করিয়া হয় শরীরাদিরূপ বিভাগ, এইপ্রকার ইতরেতরাশ্রয়দোষ হইয়া পড়ে। সেইহেতু বিভাগের পরবর্ত্তিকালে কর্ম্মকে অপেক্ষা করিয়া ঈশ্বর যদি প্রবৃত্ত হন, তাহা হউন; কিন্তু শরীরাদিরূপে বিভাগের পূর্ব্বে সৃষ্টির বিচিত্রতার হেতুভূত কর্ম্মের অভাববশতঃ প্রথম সৃষ্টিতুল্য উচ্চাবচ দেবতির্য্যগাদি ভেদবিহীন হইয়া পড়িতেছে, এইপ্রকার যদি আপত্তি করা হয় তদুত্তরে সিদ্ধান্ত হইল-

ইহা দোষ নহে, যেহেতু জগৎ সংসার অনাদি। এই দোষ হইতে পাড়িত যদি সংসার সাদি হইত। কিন্তু অনাদি সংসারে বীজ ও অঙ্কুরের ন্যায় হেতু ও হেতুমদ্ভাবে অর্থাৎ কারণ ও কার্য্যভাবে কর্ম্মের ও সৃষ্টিবৈষম্যের যে প্রবৃত্তি, তাহার বিরোধ হয় না।

আচ্ছা, কি প্রকারে অবগত হওয়া যায় যে, এই জগৎ সংসার অনাদি? এই হেতু ভগবান্ সূত্রকার পূনরায় বলিতেছেন-

‘উপপদ্যতে চাপ্যুপলভ্যতে চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৬)।।

শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- আচার্য্য শঙ্কর ভগবতের ভাষ্য হইল-জগৎ সংসারের অনাদিত্ব যুক্তিসঙ্গত। যেহেতু সংসার সাদি হইলে অকস্মাৎ অর্থাৎ বিনাকারণে তাহার উৎপত্তি হওয়ায় (তৎপরর্বর্তী সৃষ্টিও বিনা কারণে সম্ভব হইতে পারে বলিয়া পূর্ব্বসৃষ্টিতে) মুক্তপুরুষগণের (সংসারের হেতুভূত অবিদ্যাদি না থাকিলেও) পুনরায় সংসারে উদ্ভূতি অর্থাৎ জন্ম হইয়া পড়িবে। (তাহাতে বেদের জ্ঞানকাণ্ড মোক্ষশাস্ত্র ব্যর্থ হইয়া পড়ে)।

আবার অকৃতাভ্যাগমও (অর্থাৎ যে ব্যক্তি যে কর্ম্মের অনুষ্ঠান করে নাই, তৎকর্তৃক সেই কর্ম্মের ফলভোগও) হইয়া পড়িবে, যেহেতু সুখ ও দুঃখ প্রভৃতির যে বৈষম্য, তাহার কোন হেতু নাই।(তাহাতে শুভকর্ম্মের বিধায়ক এবং অশুভকর্ম্মের নিবর্ত্তক যে বিধিনিষেধ শাস্ত্র অর্থাৎ বেদের কর্ম্মকাণ্ড ব্যর্থ হইয়া পড়ে।)

আর ঈশ্বর যে বৈষম্যের হেতু নহেন তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। কেবল অর্থাৎ অন্য সহায়বিহীন মূলা অবিদ্যাও বৈষম্যের কারণ নহে, যেহেতু তাহা একরূপ। কিন্তু রাগাদি ক্লেশবাসনার দ্বারা আক্ষিপ্ত অর্থাৎ প্রবর্ত্তিত কর্ম্মকে অপেক্ষা করিয়াই অবিদ্যা হয় বৈষম্যকারী। কিন্তু কর্ম্ম ব্যতিরেকে শরীর সম্ভব নহে এবং শরীর ব্যতিরেকে কর্ম্ম সম্ভব নহে, এই প্রকারে ইতরেতরাশ্রয় দোষ হইয়া পড়ে। অনাদি হইলেই কিন্তু বীজাঙ্কুরের ন্যায় কার্য্যকারণ ভাব উপপন্ন হওয়ায় কোন দোষ হয় না।(অগ্রে বীজ উৎপন্ন হয়, পরে তাহা হইতে অঙ্কুর উৎপন্ন হয়, অথবা অগ্রে অঙ্কুর উৎপন্ন হয়, পরে তাহা হইতে বীজ উৎপন্ন হয়; ইহা নিরূপণ করা যায় না বলিয়া এই বীজাঙ্কুর প্রবাহকে অনাদিরূপে অঙ্গীকার করা হয়।)

আর শ্রুতি এবং স্মৃতি উভয়েই এই জগৎ সংসারের অনাদিত্ব উপলব্ধ হয়। শ্রুতি এইপ্রকার আছে-'অনেন জীবেনাত্মনা'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ ৬।৩।২) অর্থাৎ "এই জীবাত্মারূপে", এইরূপ সৃষ্টির নব কল্পারম্ভের প্রারম্ভে শরীরসম্বন্ধী আত্মাকে প্রাণধারণের নিমিত্তক জীবশব্দের দ্বারা অভিহিত করিয়া সংসার যে অনাদি, ইহা শ্রুতি প্রদর্শন করিতেছেন। কিন্তু সংসার সাদি হইলে পূর্ব্বে প্রাণধারণ না করিয়া প্রাণধারণরূপ নিমিত্তবশতঃ যে জীবশব্দের প্রয়োগ হয়, তাহার দ্বারা সৃষ্টির প্রারম্ভে পরমাত্মা কি প্রকারে অভিহিত হইবেন? আর প্রাণকে ধারণ করিবেন, এই হেতু পরমাত্মা জীব শব্দে অভিহিত হইবেন, ইহা বলা যায় না, যেহেতু অনাগত সম্বন্ধ অপেক্ষা অতীত সম্বন্ধ বলবান, কারণ তাহা সম্পাদিত হইয়া গিয়াছে। আর শাস্ত্রেও জগৎ যে সৃষ্টির পূর্ব-কল্পেও বর্তমান ছিলো তা এ-জাতীয় শ্রুতিতেই আছে-

‘সূর্যাচন্দ্রমসৌ ধাতা যথাপূর্বমকল্পয়ৎ।
দিবং চ পৃথিবীং চান্তরিক্ষমথো স্বঃ’।। (ঋগ্বেদ-১০/১৯০/৩)।।
অর্থাৎ বিধাতা পূর্ববৎ-ই অর্থাৎ পূর্ব্বকল্পানুযায়ী সূর্য ও চন্দ্রকে সংস্থাপিত করিলেন এবং স্বর্গ, পৃথিবী ও আকাশ সৃষ্টি করিলেন।

স্মৃতিতেও সংসারের অনাদিত্ব উপলব্ধ হইতেছে- 'ন রূপমস্যেহ তথোপলভ্যতে নান্তো ন চাদির্ন চ সংপ্রতিষ্ঠা'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ১৫।৩)

'ইহলোকে এই সংসাররূপ অশ্বত্থের উক্তপ্রকার রূপ উপলব্ধ হয় না, কারণ স্বপ্ন-মরীচিকার ন্যায় ইহা দৃষ্ট-নষ্ট-স্বরূপ । এই সংসারের আরম্ভ নাই, কারণ ইহা অনাদি।'

আর পুরাণে অতীত ও ভবিষ্যৎ কল্পসকলের পরিমাণ নাই, ইহা স্থাপিত হইয়াছে। অতএব অনাদি ক্লেশকর্ম্মাদিই জগৎ বৈষম্যের হেতু হওয়ায় পরমেশ্বরে পক্ষপাতিতা ও নির্দ্দয়তাদোষ প্রসক্ত হয় না বলিয়া নিরবদ্য, নিরঞ্জন ব্রহ্মই জগৎকারণ, ইহা সিদ্ধ হইল

Thursday, 30 July 2020

বেদান্তে মহাবাক্য ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’-


চতুর্বেদের চতুর্মহাবাক্যের মধ্যে ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ একটী। ঋগ্বেদীয় ঐতরেয় উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের প্রথম খণ্ডের তৃতীয় শ্রুতিতে এই মহাবাক্যের উল্লেখ রহিয়াছে।
‘এষঃ ব্রহ্ম, এষঃ ইন্দ্রঃ, এষঃ প্রজাপতিঃ, এতে সর্বে দেবাঃ, ইমানি চ পঞ্চ মহাভূতানি-পৃথিবী বায়ুরাকাশ আপো জ্যোতীংষীত্যেতানি, ইমানি চ ক্ষুদ্রমিশ্রাণীব বীজানি, ইতরাণি, চেতরাণি চ-অণ্ডজানি চ জারুজানি চ স্বেদজানি চোদ্ভিজ্জানি চ-অশ্বা গাবঃ পুরুষা হস্তিনঃ, যৎকিঞ্চেদং প্রাণি জঙ্গমং চ পতত্রি চ যচ্চ স্থাবরম;- সর্বং তৎ প্রজ্ঞানেত্রং প্রজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিতং, প্রজ্ঞানেত্রো লোকঃ, প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠা, প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম।’- (ঐতরেয় উপনিষদ-৩।১।৩)
শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ-ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল-সেই এই প্রজ্ঞানস্বরূপ আত্মাই অপরব্রহ্ম (উপাধিযুক্ত ব্রহ্ম) ; ইহাই সর্ব্বশরীরস্থিত প্রাণ ও প্রজ্ঞাত্মা এবং বিভিন্ন জলপাত্রে পতিত জল সূর্য্যপ্রতিবিম্বের ন্যায় ইহাও অন্তঃকরণরূপ উপাধিমধ্যে প্রবেশ করিয়া হিরণ্যগর্ভ প্রাণ ও প্রজ্ঞাত্মা। ইন্দ্র শব্দের প্রকৃতি প্রত্যয় অনুসারে হিরণ্যগর্ভ কিংবা সাক্ষাৎ দেবরাজ অর্থও গ্রহণ করা যাইতে পারে। ইনিই প্রজাপতি, যিনি প্রথমোৎপন্ন শরীরধারী পুরুষ; যাঁহার মুখছিদ্র ইত্যাদি প্রকাশের ফলে লোকপাল ইন্দ্র, অগ্নি প্রভৃতি উৎপন্ন হইয়াছেন, সেই প্রজাপতিও ইনিই। এবং এই যে, অগ্নি প্রভৃতি দেবতাগণ, তাঁহারাও ইনিই অর্থাৎ ব্রহ্মস্বরূপই বটে। আর এই যে সমস্ত শরীরের উপাদানরূপে এবং অন্ন ও অন্নভোজনকারী রূপে পরিণত পৃথিবী(মাটি), বায়ু, আকাশ, জল ও তেজঃ প্রভৃতি পঞ্চমহাভূত, ইহারা, এবং মশক প্রভৃতি ক্ষুদ্র প্রাণীদের সহিত সর্প প্রভৃতি।
বীজ অর্থাৎ কারণ- কার্য্যোৎপাদক, অবীজ অর্থাৎ কার্য্যের অনুৎপাদক, এইদুইভাগে বিভক্ত যে সমুদয় প্রাণী (ইতরাণি, চেতরাণি চ বলিয়া যাহাদের নির্দ্দেশ করা হইয়াছে) তাহারা কাহারা? বলা হইতেছে অণ্ডজ-পক্ষি প্রভৃতি, জারুজ-জরায়ুজ মনুষ্য প্রভৃতি, স্বেদজ-উকুন প্রভৃতি, উদ্ভিজ্জ-বৃক্ষলতা প্রভৃতি। অশ্ব, গো, পুরুষ ও হস্তি প্রভৃতি, আরও যে কিছু প্রাণী। তাহা কি কি? জঙ্গম-যাহারা পায়ের দ্বারা গমন করিয়া থাকে; আর পতত্রি, যাহারা আকাশপথে উড়িয়া থাকে; যাহা স্থাবর অর্থাৎ চলিতে পারে না; সে সমুদয়ই প্রজ্ঞানেত্র। প্রজ্ঞা অর্থ প্রকৃষ্ট জ্ঞান, তাহা নিশ্চিতই ব্রহ্মস্বরূপ; নেত্র অর্থাৎ যাহা দ্বারা নীত হয় (সত্তালাভ হয়)। সেই প্রজ্ঞা যাহার নেত্র, তাহার নাম প্রজ্ঞানেত্র; উৎপত্তি, স্থিতি ও লয় এই তিন সময়েই যাহা প্রজ্ঞাস্বরূপ ব্রহ্মে অবস্থিত অর্থাৎ প্রজ্ঞাতে আশ্রিত; এইজন্য উহারা প্রজ্ঞানেত্র। লোক অর্থাৎ ভূঃ প্রভৃতি লোকও প্রজ্ঞানেত্র; অথবা প্রজ্ঞাই সমস্ত জগতের প্রতিষ্ঠা বা স্থিতির মূল; সেই কারণে উহারা প্রজ্ঞান ব্রহ্মস্বরূপ।
সেই যে, এই সকল উপাধিশূন্য নিত্য, নিরঞ্জন, নির্ম্মল ও নিষ্ক্রিয়; অতএব শান্ত এক অদ্বিতীয়; 'নেতি নেতি' প্রণালীক্রমে সমস্ত বিশেষণ-পরিত্যক্তরূপে বিজ্ঞেয় এবং শব্দজাত সর্ব্বপ্রকার জ্ঞানের অগোচর ব্রহ্ম, তাহাই আবার অত্যন্ত বিশুদ্ধবুদ্ধিসত্ত্বরূপ উপাধিসম্পর্কবশতঃ সর্ব্বজ্ঞ ঈশ্বরভাবে সর্ব্বজীবভোগ্য সমস্ত অব্যক্ত (অপ্রকাশিত) জগতের প্রবর্ত্তক বা আবির্ভাবের কারণ এং সর্ব্ববস্তুর নিয়ন্ত্রণকারীরূপে অন্তর্যামী বলিয়া কথিত হন। তিনিই আবার যখন ব্যক্ত (প্রকাশিত) জগতের বীজস্বরূপ বুদ্ধি ও আত্মারূপ উপাধিগ্রহণ করেন, তখন হিরণ্যগর্ভ নাম লাভ করেন। তিনিই আবার ব্রহ্মাণ্ডমধ্যে প্রথম উৎপন্ন শরীররূপ বৈশিষ্ট্য লাভ করিয়া বিরাট ও প্রজাপতি নাম লাভ করিয়া থাকেন। তিনিই আবার প্রকাশিত অগ্নি প্রভৃতি উপাধিবিশেষযোগে দেবতা নামে কথিত হইয়া থাকেন। এইরূপ ব্রহ্ম হইতে আরম্ভ করিয়া তৃণ পর্য্যন্ত বিশেষ বিশেষ শরীরসম্বন্ধবশতঃ সেই ব্রহ্মেরই বিশেষ বিশেষ নাম লাভ হইয়া থাকে। নানাপ্রকার উপাধিভেদে ভিন্নপ্রকার সেই ব্রহ্মকেই সমস্তপ্রাণী ও তার্কিকগণ বিভিন্ন প্রকারে জানিয়া থাকেন এবং নানা প্রকারে তাহার কল্পনা করিয়া থাকেন। মনুস্মৃতি বলিয়াছেন-
'একশ্রেণীর লোকেরা ইঁহাকে অগ্নি বলিয়া নির্দেশ করেন; অপরে প্রজাপতি মনু বলিয়া নির্দ্দেশ করেন; অপরে প্রজাপতি মনু বলিয়া বর্ণনা করেন, কেহ কেহ ইন্দ্র বলেন, কেহ বা প্রাণ বলেন; কেহ আবার শাশ্বত ব্রহ্ম বলিয়াও জানেন' ইত্যাদি।........

স্বামী বিদ্যারণ্য মুনি (মাধবাচার্য) পঞ্চদশীতে বলিতেছেন-"চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়সকল দিয়া নির্গত যে অন্তঃকরণবৃত্তি-উপহিত চৈতন্যের দ্বারা পুরুষ রূপসকল দর্শন করে, শব্দসকল শ্রবণ করে, গন্ধসমূহের আঘ্রাণ লয়, বাক্য-সকল উচ্চারণ করে, সুস্বাদু ও অস্বাদু রস আস্বাদন করে, তাহা 'প্রজ্ঞান' বলিয়া কথিত হয়। ব্রহ্মা-ইন্দ্র প্রভৃতি উত্তম জীবে, মনুষ্যাদি মধ্যম জীবে এবং অশ্ব-গবাদি অধম জীবে-সর্বত্র যে একমাত্র চৈতন্যরূপে বিরাজিত, তাহাই ব্রহ্ম। সুতরাং আমাতে অবস্থিত প্রজ্ঞানও ব্রহ্ম।"

-(পঞ্চদশী, মহাবাক্যবিবেক-প্রকরণ-১,২)


তত্ত্বজ্ঞানীর দেহে থাকাঃ-


আচার্য্য শঙ্কর ভগবদ্গীতার (৫।১৩) ভাষ্যে বলিতেছেন-'দেহ ও ইন্দ্রিয়াদি সংঘাত হইতে আত্মা ভিন্ন' এইরূপ বিবেকীর 'আমি শরীরে থাকি' এইরূপ প্রত্যয় হইতে পারে। পরাত্মাতে অবিদ্যা দ্বারা অধ্যারোপিত অপরের অর্থাৎ দেহেন্দ্রিয়াদি জাত কর্ম্মসকলের, বিবেকজ্ঞানরূপ বিদ্যাবিশিষ্ট মনের দ্বারা তত্ত্বজ্ঞানীর সংন্যাস উৎপন্ন হয়। উৎপন্ন-বিবেকজ্ঞান সর্ব্বকর্ম্ম সংন্যাসীরও দেহেই বিশেষ বিজ্ঞান হওয়ায়, গৃহের মত নবদ্বার যুক্ত দেহপুরে তাঁহার থাকা কেবল প্রারব্ধ কর্ম্মের অবশিষ্ট সংস্কার সকলের ফলভোগের অনুবৃত্তিহেতু।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এই তত্ত্বটিকে অপূর্ব্ব দৃষ্টান্ত দ্বারা উপস্থাপন করিতেছেন-'নারকেলের ফোঁপল শুকিয়ে গেলে যেমন খোল থেকে আলাদা হয়ে যায়, তেমনিভাবে তত্ত্বজ্ঞানী দেহে অবস্থান করেন। তবে একটা না একটা জায়গায় একটু লেগে থাকে-এরই নাম প্রারব্ধ।'

সেই পরমাত্মাই জীবভাব প্রাপ্ত হইয়া নবদ্বার-যুক্ত দেহপুরে অবস্থান করে। এই বিষয়ে কৃষ্ণযজুর্ব্বেদীয় শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্ এ বর্ণিত আছে-
নবদ্বারে পুরে দেহী হংসো লেলায়তে বহিঃ৷

বশী সর্বস্য লোকস্য স্থাবরস্য চরস্য চ৷৷-(শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ -৩।১৮)

শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- নবদ্বারযুক্ত পুরে অর্থাৎ মস্তকস্থ দুই চক্ষু, দুই কর্ণ, দুই নাসিকা এবং মুখ এই সাতটি আত্মার রূপ, শব্দ, গন্ধ এবং রস উপলব্ধির দ্বার, বাকি দুইটী নিম্নাঙ্গে মুত্র ও পুরীষ ত্যাগের জন্য উপস্থ এবং পায়ু; সর্ব্বসমেত এই নয়টী দ্বারযুক্ত শরীরে দেহী তথা বিজ্ঞানাত্মা অর্থাৎ ভূত ও ইন্দ্রিয়রূপ উপাধিযুক্ত হইয়া হংস অর্থাৎ পরমাত্মা বহির্বিষয় গ্রহণার্থ সচেষ্ট হন। এখানে অবিদ্যাজনিত কার্যকে হনন করিবার জন্য তিনি হংস। তথা স্থাবরজঙ্গম সমস্ত লোকের নিয়ন্তা তিনিই। এভাবেই এই শ্রুতিতে ব্রহ্মের সর্বাত্মকভাব প্রতিপাদন করা হইয়াছে।

Friday, 17 July 2020

ঈশ্বরে পক্ষপাতিত্ব এবং নিষ্ঠুরতারূপ দোষের অভাবঃ-


ইতোমধ্যে আলোচনা করিয়াছি মায়ারূপ অপরিমিত শক্তিযুক্ত পরমেশ্বর কোন প্রয়োজন ব্যতিরেকেই লীলাচ্ছলেই সৃষ্টিকর্ম করেন। কিন্তু এখন আপত্তি হইল, এই সৃষ্টির মধ্যে যে জাগতিক বৈষম্য বা নিষ্ঠুরতা দেখা যায়, যেমন দেবতা প্রভৃতি কাহাকেও কাহাকেও নিরতিশয় সুখভাগী করেন আবার পশু প্রভৃতি কাহাকেও কাহাকেও অত্যন্ত দুঃখভাগী করেন, এবং মনুষ্য প্রভৃতিকে কাহাকেও কাহাকেও মধ্যম (সুখদুঃখমিশ্রিত) ভোগভাগী করেন ইত্যাদি এইপ্রকারে বিষমা সৃষ্টি যিনি নির্ম্মাণ করেন, সেই ঈশ্বরের দুর্বৃত্ত ব্যক্তির ন্যায় আসক্তি ও দ্বেষ যুক্তিযুক্ত হওয়ায় শ্বেতাশ্বতর(৬।১৯) শ্রুতিতে যে 'নিরবদ্যং অর্থাৎ অনিন্দনীয়, নিরঞ্জনম্ অর্থাৎ নির্লেপ' এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতে(৯।২৯) যে 'আমার প্রিয় ও অপ্রিয় নাই', এইরূপ অবধারিত স্বচ্ছতা (কূটস্থতা) প্রভৃতিরূপ ঈশ্বরের স্বভাব, তাহার বিলোপ হইয়া পড়িবে। এই আপত্তির উত্তরে ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-
বৈষম্যনৈর্ঘৃণ্যে ন, সাপেক্ষত্বাৎ, তথা হি দর্শয়তি’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৪)।।
শাঙ্করভাষ্য অনুবাদঃ- আচার্য্য শঙ্করের ভাষ্য হইল- এইরূপ আপত্তির উত্তরে আমরা বলিতেছি-ঈশ্বরের পক্ষপাতিতা ও নিষ্ঠুরতা হইয়া পড়ে না। কোন হেতু বলে? যেহেতু সাপেক্ষতা আছে। যেহেতু যদি নিরপেক্ষ, অর্থাৎ কেবল অন্য নিমিত্তনিরপেক্ষ ঈশ্বর বিষম সৃষ্টি নির্ম্মাণ করিতেন, তাহা হইলে বৈষম্য ও অতিক্রূরত্ব, এই দোষ হইতে পারিত। কিন্তু নিরপেক্ষের নির্ম্মাতৃত্ব নাই। কারণ সাপেক্ষ ঈশ্বর বিষম (উচ্চাবচ ভেদবিশিষ্ট) সৃষ্টি নির্ম্মাণ করেন। আচ্ছা, তিনি কাহাকে অপেক্ষা করেন? তাহার উত্তরে আমরা বলিতেছি-ধর্ম্ম ও অধর্ম্মকে অপেক্ষা করেন। অতএব যে প্রাণিগণ সৃষ্ট হয়, তাহাদের ধর্ম্ম ও অধর্ম্মকে অপেক্ষা করিয়া বিষম সৃষ্টি হইয়া থাকে, এইহেতু ইহা ঈশ্বরের অপরাধ নহে।
ঈশ্বরকে কিন্তু পর্জ্জন্যের (মেঘের) ন্যায় অবগত হইতে হইবে। দেখ, যেমন ধান্য ও যবাদির উৎপত্তিতে মেঘ সাধারণ কারণ, কিন্তু এইটী ধান্য, এইটী যব, এইপ্রকারে ধান্য ও যবাদিগত বিভিন্নতাতে তত্তৎ বীজগত অসাধারণ শক্তি সকলই কারণ হইয়া থাকে; এইপ্রকারে দেবতা ও মনুষ্য প্রভৃতির সৃষ্টিতে ঈশ্বর হন সাধারণ কারণ। দেবতা ও মনুষ্যাদির বিভিন্নতাতে কিন্তু তত্তৎ জীবগত অসাধারণ কর্ম্মসকলই কারণ। এইপ্রকারে সাপেক্ষ হন বলিয়া অর্থাৎ প্রাণিগণের কর্ম্মকে অপেক্ষা করেন বলিয়া পক্ষপাতিতা ও নিষ্ঠুরতার দ্বারা ঈশ্বর দূষিত হন না।
আচ্ছা, কি প্রকারে ইহা অবগত হওয়া যায় যে, ধর্ম্ম অধর্ম্ম সাপেক্ষ ঈশ্বর (পশ্বাদি, মনুষ্য ও দেবাদিরূপ) অধম, মধ্যম ও উত্তম সংসার নির্ম্মাণ করেন? শ্রুতি সেইপ্রকারই প্রদর্শন করিতেছে-
'এষ হ্যেব সাধু কর্ম কারযতি তং যমেভ্যো লোকেভ্য উন্নিনীষত এষ উ এবাসাধু কর্ম কারযতি তং যমধো নিনীষতে'।-(কৌষিতকি ব্রাহ্মণ ৩।৮)
অর্থাৎ 'ইনিই (পূর্ব্বানুষ্ঠিত কর্ম্মের সংস্কারানুযায়ী) তাহাকে অর্থাৎ সেই মনুষ্যকে সাধু কর্ম্ম করান, যাহাকে এই লোক হইতে উর্ধ্বে অর্থাৎ স্বর্গে লইয়া যাইতে ইচ্ছা করেন, ইনিই (পূর্ব্বানুষ্ঠিত কর্ম্মের সংস্কারানুযায়ী) তাহাকে অসাধু কর্ম্ম করান, যাহাকে নিম্নে অর্থাৎ পশ্বাদি যোনিতে লইয়া যাইতে ইচ্ছা করেন।'
আবার শ্রুতিতে অন্যত্র বর্ণিত আছে-'পুণ্যো বৈ পুণ্যেন কর্মণা ভবতি পাপঃ পাপেন'।-(বৃহদারণ্যক উপনষৎ-৩।২।১৩)
অর্থাৎ পুণ্য কর্ম্মের দ্বারা পুণ্যবান্ ও পাপ কর্ম্মের দ্বারা পাপী হয়।'

আবার 'যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্' -(শ্রীদ্ভগবদ্গীতা-৪।১১) অর্থাৎ 'যে, যে প্রকারে, যে প্রয়োজনে, যে ফলের অর্থী হইয়া আমাকে উপাসনা করে, তাহাকে আমি সেই ফলদানের দ্বারা অনুগৃহীত করি।'
ইত্যাদি এইজাতীয় স্মৃতিও ঈশ্বরের অনুগ্রহকারিতা ও নিগ্রহকারিতা প্রাণিগণের কর্ম্মবিশেষকে অপেক্ষা করিয়াই হইয়া থাকে, ইহা প্রদর্শন করিতেছে।

বেদান্তে বিশ্বপ্রেম ও হিতবাদঃ-


প্রথমেই এই বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দের কিছু উদ্ধৃতি উল্লেখ করব। স্বামীজী বলছেন-"আজকাল দেখা যায় অনেকে বলে, তাহাদের নীতির ভিত্তি হিতবাদ। এই নীতির ভিত্তি কি? সর্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক লোকের সর্বাধিক সুখের ব্যবস্থা করা-কেন এরূপ করিব? যদি আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, তাহা হইলে আমি অধিকাংশ লোকের অত্যধিক অনিষ্ট সাধন করিব না কেন? হিতবাদিগণ এই প্রশ্নের কি উত্তর দিবেন? কোনটি ভাল কোনটি মন্দ, তাহা তুমি কি করিয়া জানিবে? আমি আমার সুখের বাসনার দ্বারা পরিচালিত হইয়া উহার তৃপ্তিসাধন করিলাম, উহা আমার স্বভার, উহা অপেক্ষা অধিক কিছু জানি না। আমার এইসব বাসনা আছে, আমি এগুলি পূর্ণ করিব, তোমার আপত্তি করিবার কি অধিকার আছে? নীতি, আত্মার অমরত্ব, ঈশ্বর, প্রেম ও সহানুভূতি, সাধুত্ব ও সর্বোপরি নিঃস্বার্থতা-মনুষ্যজীবনের এই-সকল ভাব ও মহৎ সত্যগুলি কোথা হইতে আসিল?
তাহার যুক্তি দেখাও। অবশ্য কবিত্ব হিসাবে নিঃস্বার্থতা অতি সুন্দর হইতে পারে, কিন্তু কবিত্ব তো যুক্তি নয়। আমাকে যুক্তি দেখাও-কেন আমি নিঃস্বার্থ হইব, কেন আমি সৎ হইব? অমুক এই কথা বলে-এরূপ কথার কোন মূল্য আমার কাছে নাই। আমার নিঃস্বার্থ হওয়ার উপযোগিতা কোথায়? ‘হিত’ বলিতে যদি ‘অধিকতম সুখ’ বুঝায়, তবে স্বার্থপর হইলেই আমার পক্ষে হিত। ইহার কি উত্তর? হিতবাদিগণ ইহার কোন উত্তর দিতে পারেন না। ইহার উত্তর-এই পরিদৃশ্যমান জগৎ এক অনন্ত সমুদ্রের একটি ক্ষুদ্র বিন্দু, অনন্ত শৃঙ্খলের একটি ক্ষুদ্র শিকলি। যাঁহারা নিঃস্বার্থতা প্রচার করিয়াছিলেন ও মনুষ্য-জাতিকে উহা শিক্ষা দিয়াছিলেন, তাঁহারা এ তত্ত্ব কোথায় পাইলেন? আমরা জানি, ইহা সহজাত বৃত্তি নয়। সহজাত-জ্ঞানসম্পন্ন পশুগণ ইহা জানে না, বিচার বুদ্ধিতেও ইহা পাওয়া যায় না, যুক্তিদ্বারা এই-সকল তত্ত্বের কিছুমাত্র জানা যায় না। তবে ঐ-সকল তত্ত্ব কোথা হইতে আসিল?"- (স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী » ০১ম খণ্ড » ০৫. রাজযোগ » ০৭. ধ্যান ও সমাধি)
বেদ বেদান্তই ইহার উৎস। বস্তুত ইহার উত্তর বেদান্ত ভিন্ন আর কেহ দিতে পারে না । যদি শুক্লযজুর্বেদের বাজসনেয় সংহিতার শেষ অধ্যায় ঈশ উপনিষৎ পাঠ করি, তবে দেখব-
যস্তু সর্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি ৷
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে ৷৷ ঈশ উপনিষৎ- ৬৷৷

শাঙ্করভাষ্য অনুবাদঃ- ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল- "যে মুমুক্ষু পরিব্রাজক সন্ন্যাসী অব্যক্ত প্রকৃতি হইতে স্থাবর বৃক্ষলতাদি পর্য্যন্ত সমস্ত শরীরকে আত্মাতেই দেখেন অর্থাৎ তাহাদিগকে আত্মা হইতে পৃথক্ দেখেন না; আবার সেই সমস্ত শরীরেতেই আত্মাকে দেখেন, মানে সেই সকল শরীরের আত্মাকে নিজের আত্মা বলিয়া জানেন অর্থাৎ এই বোঝেন যে, যেভাবে আমি এই কার্য্যকারণ সংঘাতরূপ দেহের আত্মা এবং ইহার সমস্ত প্রতীতির সাক্ষী, চেতন, কেবল নির্গুণ হইয়া থাকি, ঠিক সেইভাবে এইরূপ স্বরূপে অব্যক্ত প্রকৃতি হইতে স্থাবর পর্য্যন্ত পদার্থের আত্মা আমিই। এই প্রকার যিনি সকল প্রাণিতে নির্বিশেষ আত্মাকে দেখেন তিনি এইরূপ উপলব্ধির ফলে কাহাকেও বিজুগুপ্সা অর্থাৎ ঘৃণা করেন না। নিজ হইতে অন্যকে দোষযুক্ত দর্শনহেতুই সব ঘৃণা হইয়া থাকে। অত্যন্ত বিশুদ্ধ ব্যবধানরহিত আত্মাকে দর্শনহেতু ঘৃণার নিমিত্ত অন্য কোন পদার্থ থাকে না, এই ঘৃণার অভাব জ্ঞাতই। সেই কারণে সম্যগ্দর্শী ঘৃণা করেন না।"
অপরদিকে বৃহদারণ্যক শ্রুতিতেও একই তত্ত্ব প্রস্ফুটিত হচ্ছে-
'লোকসমূহের প্রতি অনুরাগবশত লোকসমূহ জীবগণের প্রিয় হয় না, জীবগণের আত্মপ্রয়োজনেই লোকসমূহ প্রিয় হয়। সর্বভূতের প্রতি অনুরাগবশত সর্বভূত প্রিয় হয় না, আত্মার জন্য সর্বভূত প্রিয় হয়।' - (বৃহদারণ্যক উপনিষদৎ-২|৪|৫)

Thursday, 16 July 2020

মায়াপঞ্চকম্ঃ-




শঙ্করাচার্য্য বিরচিত মায়াপঞ্চকম্ঃ-
নিরুপমনিত্যনিরংশকে প্যখণ্ডে
ময়ি চিতি সর্ববিকল্পনাদিশূন্যে।
ঘটয়তি জগদীশজীবভেদং
ত্বঘটিতঘটনাপটীয়সী মায়া।। ১

যাহা পূর্বে ঘটে নাই, এইরূপ বস্তুর নির্ম্মাণে নিপূণতরা মায়া উপমাবিহীন, নিত্য, নিরবয়ব, অখণ্ড, সমস্ত কল্পনাশূন্য, জ্ঞানস্বরূপ আত্মাতে জগৎ, ঈশ্বর ও জীববিশেষ অথবা জীবভেদ সৃষ্টি করে।১
শ্রুতিশতনিগমান্তশোধকান-
প্যহহ ধনাদিনিদর্শনেন সদ্যঃ।
কলুষয়তি চতুষ্পদাদ্যভিন্নান্
ত্বঘটিতঘটনাপটীয়সী মায়া।। ২

অঘটিত বস্তুর উৎপাদনে পটীয়সী মায়া চতুষ্পদ-পশ্বাদিতুল্য জনগণকে শত শত শ্রুতিবাক্য ও বেদান্ত দ্বারা শোধিত করিলেও হায়! সর্ব্বদা ধনাদি প্রদর্শনের দ্বারা তাহাদিগকে সদ্যঃ কলুষিত করে।২
সুখচিদখণ্ডবিবোধমদ্বিতীয়ং
বিয়দনিলাদিবিনির্মিতে নিয়োজ্য।
ভ্রময়তি ভবসাগরে নিতান্তং
ত্বঘটিতঘটনাপটীয়সী মায়া।। ৩

অঘটিত বস্তুর উৎপাদনে পটীয়সী মায়া, আনন্দ, জ্ঞান ও অখণ্ড অববোধস্বরূপ অদ্বিতীয় আত্মাকে আকাশ, বহ্নি ইত্যাদি দ্বারা নির্ম্মিত সংসার সাগরে প্রেরণ করিয়া তাহাতে সর্ব্বদা ভ্রমণ করাইতেছে। ৩
অপগতগুণবর্ণ জাতিভেদে
সুখচিতি বিপ্রবিডাদ্যহংকৃতিং চ।
স্ফুটয়তি সুতদারগেহ মোহং
ত্বঘটিতঘটনাপটীয়সী মায়া।। ৪

অঘটিত বস্তুর উৎপাদনে পটীয়সী মায়া, গুণ, বর্ণ, জাতিভেদরহিত, আনন্দ ও জ্ঞানস্বরূপ আত্মাতে ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ইত্যাদি অহঙ্কার এদং পুত্র, কলত্র (পত্নী) ও গৃহ বিষয়ে মোহ উৎপাদন করে। ৪
বিধিহরিহরভেদমপ্যখণ্ডে
বত বিরচয্য বুধানপি প্রকামম্।
ভ্রময়তি হরিহরবিভেদভাবান্
নঘটিতঘটনাপটীয়সী মায়া।। ৫

অনুৎপাদিত পদার্থের উৎপাদনে পটিয়সী মায়া, হায় অখণ্ডব্রহ্ম-স্বরূপে হরি (বিষ্ণু) ও হর (শিব) ইত্যাদি ভেদ নির্ম্মাণ করিয়া পণ্ডিতগণকেও হরিহরের ভেদ বুদ্ধিতে ভাবিত করিয়া তাঁহাদিগকে সংসারে ভ্রমণ করাইতেছে। ৫
ইতি শ্রীমৎপরমহংসপরিব্রাজকাচার্যস্য
শ্রীগোবিন্দভগবৎপূজ্যপাদশিষ্যস্য
শ্রীমচ্ছঙ্করভগবতঃ কৃতৌ
মায়াপঞ্চকম্
সম্পূর্ণম্ ॥

পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্য গোবিন্দভগবৎপাদ্ শিষ্য শ্রীমৎ শঙ্কর ভগবৎ প্রণীত 'মায়াপঞ্চকম্' সম্পূর্ণ ॥

Monday, 13 July 2020

মনীষাপঞ্চকম্ঃ-


সত্যাচার্যস্য গমনে কদাচিন্মুক্তি দায়কম্ ।
কাশীক্ষেত্রং প্রতি সহ গৌর্যা মার্গে তু শঙ্করম্ ॥
অন্ত্যবেশধরং দৃষ্ট্বা গচ্ছ গচ্ছেতি চাব্রবীৎ ।
শঙ্করঃসোঽপি চাণ্ডালস্তং পুনঃ প্রাহ শঙ্করম্ ॥

সত্যাচার্য্য শঙ্কর মুক্তিপ্রদ কাশীক্ষেত্রে (অবগাহন মানসে উত্তর-বাহিনী সুর-তরঙ্গিণীতে) গমন করিতেছিলেন, মহাদেব শঙ্করও গৌরীর সহিত সেইপথে যাইতেছিলেন। শঙ্করাচার্য্য (কুকুর চতুষ্টয়যুক্ত) চণ্ডালবেশধারী শিবকে দেখিয়া বলিলেন-“সরিয়া যাও, সরিয়া যাও”। সেই চণ্ডালও শঙ্করের উক্তি শ্রবণ করিয়া হাস্য বদনে বেদান্ত সংসিদ্ধ এই ন্যায়যুক্ত বাক্য কহিলেন-
অন্নময়াদন্নময়মথবা চৈতন্যমেব চৈতন্যাৎ ।
যতিবর দূরীকর্তুং বাঞ্ছসি কিং ব্রূহি গচ্ছ গচ্ছেতি ॥

অর্থাৎ হে যতিবর! তুমি “সরিয়া যাও সরিয়া যাও’ কি কহিতেছ? অন্নময় হইতে অন্নময়কে, কি চৈতন্য হইতে চৈতন্যকে, দূরীকৃত করিতে বাঞ্ছা করিয়াছ? তোমার শরীরও অন্নের বিকার আমার শরীরও অন্নময়, তাহা হইলে তোমার দেহ আর আমার দেহের মধ্যে কি পার্থক্য আছে যে আমি সরিয়া যাইব? আর দেহ ছাড়িয়া যদি চৈতন্য ধর, তাহা হইলে বা আমি সরিয়া যাইব কেন? তোমার চৈতন্য আর আমার চৈতন্যে কি পার্থক্য আছে?
প্রত্যগ্বস্তুনি নিস্তরঙ্গসহজানন্দাববোধাম্বুধৌ
বিপ্রোঽয়ং শ্বপচোঽয়মিত্যপি মহান্কোঽয়ং বিভেদভ্রমঃ ।
কিং গঙ্গাম্বুনি বিম্বিতেঽম্বরমণৌ চাণ্ডালবীথীপয়ঃ
পূরে বাঽন্তরমস্তি কাঞ্চনঘটীমৃৎকুম্ভয়োর্বাঽম্বরে ॥

তরঙ্গহীন সহজানন্দ বোধ-সিন্ধু প্রত্যগাত্মাতে, এ বিপ্র (ব্রাহ্মণ), এ শ্বপচ (চাণ্ডাল) ইত্যাদি ভেদ কল্পনা কি? গঙ্গাতে বা চাণ্ডাল বীথিকাস্থ (গৃহাঙ্গনস্থ) জলে প্রতিবিম্বিত সূর্য্যের, আর কাঞ্চন-ঘটে ও মৃৎ-কুম্ভে আকাশের কি অন্তর আছে?
চাণ্ডালরূপী শিব এরূপ অনেক শ্লোক কহিয়া বিরত হইলে, শঙ্করাচার্য্য বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, হে উদার! তুমি যাহা কহিলে তাহা সত্য। অধুনা আমি ভেদবুদ্ধি পরিত্যাগ করিলাম। শ্রুতিশাস্ত্র-বিশারদ পণ্ডিতগণ অনেক আছেন, কিন্তু তন্মধ্যে কোন বিশুদ্ধ-বুদ্ধিরই অভেদ বুদ্ধি হয় ।
জাগ্রৎস্বপ্নসুষুপ্তিষু স্ফুটতরা যা সংবিদুজ্জৃম্ভতে
যা ব্রহ্মাদিপিপীলিকান্ততনুষু প্রোতা জগৎসাক্ষিণী ।
সৈবাহং ন চ দৃশ্যবস্ত্বিতি দৃঢপ্রজ্ঞাপি যস্যাস্তি চে-
চ্চাণ্ডালোঽস্তু স তু দ্বিজোঽস্তু গুরুরিত্যেষা মনীষা মম ॥ ১॥

অর্থঃ- যে সম্বিৎ (জ্ঞান) জাগ্ৰৎ, স্বপ্ন,সুষুপ্তি তিন অবস্থাতে প্রকাশ পাইতেছেন । যিনি ব্রহ্মাদি পিপীলিকা পৰ্য্যন্ত সকল শরীরে ওতপ্রোত ভাবে জগতের সাক্ষীরূপ হইয়া আছেন। আমি সেই সম্বিৎ (চৈতন্য), দৃশ্যবস্তু নহি, এরূপ দৃঢ় প্রজ্ঞা যাহার, তিনি চাণ্ডাল হউন বা দ্বিজই হউন, আমার গুরু, এই আমার জ্ঞান। ১.
ব্রহ্মৈবাহমিদং জগচ্চ সকলং চিন্মাত্রবিস্তারিতং
সর্বং চৈতদবিদ্যয়া ত্রিগুণয়াঽশেষং ময়া কল্পিতম্ ।
ইত্থং যস্য দৃঢ়া মতিঃ সুখতরে নিত্যে পরে নির্মলে
চাণ্ডালোঽস্তু স তু দ্বিজোঽস্তু গুরুরিত্যেষা মনীষা মম ॥ ২॥

অর্থঃ- আমি ব্রহ্মস্বরূপ, এই সমস্ত জগৎ কেবলমাত্র চৈতন্য দ্বারা অবভাসিত হইতেছে, এই সমস্ত জগৎ ত্রিগুণাত্মক অবিদ্যা দ্বারা আমাকর্তৃক অথবা আমাতে কল্পিত, যাঁহার সচ্চিদানন্দরূপ নিষ্কলঙ্ক পরমাত্মাতে এইরূপ দৃঢ়বুদ্ধি জন্মিয়াছে, তিনি চাণ্ডাল হউন বা ব্রাহ্মণই হউন, তিনি আমার গুরু, এই আমার মণীষা। ২.
শশ্বন্নশ্বরমেব বিশ্বমখিলং নিশ্চিত্য বাচা গুরো-
র্নিত্যং ব্রহ্ম নিরন্তরং বিমৃশতা নির্ব্যাজশান্তাত্মনা ।
ভূতং ভাতি চ দুষ্কৃতং প্রদহতা সংবিন্ময়ে পাবকে
প্রারব্ধায় সমর্পিতং স্ববপুরিত্যেষা মনীষা মম ॥ ৩॥

অর্থঃ- গুরুর বাক্যের দ্বারা এই সমুদায় জগৎকে সতত অনিত্য নিশ্চয় করিয়া, অকপট শান্তচিত্তে নিরন্তর নিত্যব্রহ্মের বিচার করিয়া এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সমস্ত পাপ দগ্ধ করিয়া জ্ঞানময় অগ্নিতে প্রারব্ধভোগের নিমিত্ত নিজদেহ অর্পিত হইয়াছে, ইহাই আমার মণীষা।৩
যা তির্যঙ্নরদেবতাভিরহমিত্যন্তঃ স্ফুটা গৃহ্যতে
যদ্ভাসা হৃদয়াক্ষদেহবিষয়া ভান্তি স্বতোঽচেতনাঃ ।
তাং ভাস্যৈঃ পিহিতার্কমণ্ডলনিভাং স্ফূর্তিং সদা ভাবয়-
ন্যোগী নির্বৃতমানসো হি গুরুরিত্যেষা মনীষা মম ॥ ৪॥

অর্থঃ- তির্য্যক, মনুষ্য ও দেবতাগণ যে আত্মপ্রকাশকে 'আমি' এইরূপে অন্তঃকরণে পরিস্ফুটরূপে জানিয়া থাকে, হৃদয়, ইন্দ্রিয়, দেহ ও বিষয়সমূহ স্বভাবতঃ অচেতন হইলেও যাহার প্রকাশের দ্বারা প্রকাশিত হইয়া থাকে, যে যোগী সূর্য্যপ্রকাশ্য মেঘের দ্বারা আবৃত সূর্য্যমণ্ডলসদৃশ স্বয়ং-প্রকাশ সংবিৎকে সর্ব্বদা চিন্তা করিয়া শান্তচিত্ত হইয়া থাকেন, তিনিই গুরু ইহাই আমার মণীষা।৪
যৎসৌখ্যাম্বুধিলেশলেশত ইমে শক্রাদয়ো নির্বৃতা
যচ্চিত্তে নিতরাং প্রশান্তকলনে লব্ধ্বা মুনির্নির্বৃতঃ ।
যস্মিন্নিত্যসুখাম্বুধৌ গলিতধীর্ব্রহ্মৈব ন ব্রহ্মবিদ্
যঃ কশ্চিৎস সুরেন্দ্রবন্দিতপদো নূনং মনীষা মম ॥ ৫॥

অর্থঃ- যে সুখসমুদ্রের কণারও কণা প্রাপ্ত হইয়া এই ইন্দ্রপ্রভৃতি প্রভৃতি দেবসকল শান্তিলাভ করিয়াছেন, যে মুনি প্রশান্ত চিত্তে যাহা লাভ করিয়া নিরতিশয় শান্তিলাভ করিয়াছেন, সেই নিত্য সুখসমুদ্রে যাহার চিত্ত বিগলিত হইয়াছে, তিনি ব্রহ্মবিৎ নহেন, কিন্তু ব্রহ্মই, তাঁহার চরণ দেবরাজও বন্দনা করেন-ইহাই আমার নিশ্চিত মতি।৫
শঙ্কর যাবৎ এইরূপ কহিতেছিলেন, ইতিমধ্যে সেই শরীরকে স্বয়ং শিব চতুৰ্ব্বেদ-যুক্ত দর্শন করিলেন। তখন তিনি ভক্তি ও ধৈৰ্য্যের সহিত প্রত্যগাত্মা মহেশ্বরের স্তুতি করিতে লাগিলেন।
দাসস্তেঽহং দেহদৃষ্ট্যাঽস্মি শংভো
জাতস্তেংঽশো জীবদৃষ্ট্যা ত্রিদৃষ্টে ।
সর্বস্যাঽঽত্মন্নাত্মদৃষ্ট্যাৎবমেবে-
ত্যেবং মে ধীর্নিশ্চিতা সর্বশাস্ত্রৈঃ ॥

হে শম্ভু! দেহ দৃষ্টিতে আমি তোমার দাস , জীব দৃষ্টিতে তোমার অংশ, এবং আত্ম দৃষ্টিতে তুমিই আমি, এই আমার নিশ্চিত মতি। আমি আমার বুদ্ধি এবং সর্ব্বশাস্ত্রগ্রন্থের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছি।
॥ ইতি শ্রীমচ্ছঙ্করভগবতঃ কৃতৌ মনীষাপঞ্চকং সম্পূর্ণম্ ॥
ইতি আচার্য্য শ্রীশঙ্কর ভগবৎ বিরচিত মনীষাপঞ্চকম্ সম্পূর্ণ॥

Saturday, 11 July 2020

সর্ব্বজ্ঞ, নিত্যতৃপ্ত চেতন ব্রহ্ম কী প্রয়োজনে সৃষ্টি করেন ?


চেতন পরমাত্মাই এই সুন্দর জগতের নির্ম্মাণকর্তা। সেই নিত্য, মুক্ত, পরিতৃপ্ত ব্রহ্ম কী প্রয়োজনে সৃষ্টি করেন? যেহেতু প্রবৃত্তিসকল প্রয়োজন বিশিষ্ট। যদি চেতন পরমাত্মার এই প্রবৃত্তিকে তাঁহার নিজের প্রয়োজনের উপযোগিরূপে কল্পনা করা হয়, তাহা হইলে "আপ্তকামম্", "আত্মকামম্"- বৃহদারণ্যক উপনিষৎ ৪।৩।২১ ইত্যাদি শ্রুতিতে বর্ণিত পরমাত্মার পরিতৃপ্ততা বাধিত হইয়া পড়িবে। অথবা প্রয়োজনের অভাবে জগন্নির্ম্মাণে প্রবৃত্তির অভাবও হইয়া পড়িতে পারে, ফলে জগতের উৎপত্তি হইবে না। আর যদি বলা হয়-চেতন হইলেও উন্মক্তব্যক্তিকে যেমন বুদ্ধির অপরাধ বশতঃ নিজের প্রয়োজন ব্যতিরেকেই প্রবৃত্ত হইতে দেখা যায়, এইরূপে পরমাত্মাও স্বপ্রয়োজন ব্যতিরেকেই প্রবৃত্ত হইবেন। তাহা হইলে পরমাত্মার যে সর্ব্বজ্ঞতা শ্রুতিতে বর্ণিত হইতেছে, তাহা বাধিত হইয়া পড়িবে। সেইহেতু চেতন ব্রহ্ম হইতে সৃষ্টি অসঙ্গত এইরূপ অনেক আপত্তি উত্থাপিত হয়। এই আপত্তির উত্তরে ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-
‘লোকবত্তু লীলাকৈবল্যম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৩)।
শারীরকভাষ্য অনুবাদঃ-পূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল- 'তু' শব্দটীর দ্বারা আক্ষেপ পরিহার করিতেছেন। যেমন লোকমধ্যে লীলা ব্যতিরিক্ত কোনপ্রকার প্রয়োজনের আকাঙ্ক্ষা না করিয়া কোন পূর্ণকাম রাজা বা রাজমন্ত্রীর ক্রীড়াবিহারাদিতে কেবল লীলারূপা (বিলাসরূপা) প্রবৃত্তিসকল হইয়া থাকে। অথবা যেমন বাহ্য কোন প্রয়োজনের আকাঙ্ক্ষা না করিয়া শ্বাস ও প্রশ্বাস প্রভৃতি স্বভাববশতঃই সম্ভব হইয়া থাকে। এইরূপে অন্য কোন প্রয়োজন ব্যতিরেকেই ঈশ্বরেরও কাল ও কর্ম্মসহকৃত মায়াশক্তিরূপ স্বভাববশতঃই কেবল লীলারূপা প্রবৃত্তি হয়।
ঈশ্বরের অন্য যে প্রয়োজন নিরূপণ করা হয়, শ্রুতির আপ্তকামত্বাদি যুক্তি এবং "আনন্দং ব্রহ্ম"-বৃহদারণ্যক ৩।৯।২৮।৭ ইত্যাদি শ্রুতির বলে তাহা নিশ্চয়ই সম্ভব হয় না। আর স্বভাবকে দোষারোপ করিতে পারা যায় না। যদিও এই জগৎ-বিম্বরচনা আমাদিগের নিকট অতিশয় আয়াসসাধ্যরূপেই প্রতিভাত হইতেছে, তাহা হইলেও ইহা পরমেশ্বরের পক্ষে কেবল লীলামাত্রই, যেহেতু তিনি মায়ারূপ অপরিমিত শক্তিযুক্ত। আর যদি লোকমধ্যে রাজা প্রভৃতির লীলাসকলেও কোনপ্রকার সূক্ষ্মফল কল্পনা করা হয়, তাহা হউক, কিন্তু তাহা হইলেও এখানে ঈশ্বরের জগন্নির্ম্মাণ প্রবৃত্তিতে স্বকীয় বা পরকীয় কোনপ্রকার প্রয়োজন কল্পনা করিতে পারা যায় না, যেহেতু আপ্তকামত্ববোধক শ্রুতিবাক্য আছে। আর অপ্রবৃত্তি, অথবা উন্মত্ত পুরুষের ন্যায় প্রবৃত্তি কল্পনা করিতে পারা যায় না, যেহেতু "ইমান্ লোকান্ অসৃজত"- ঐতরেয়োপনিষৎ ১।১।২ ইত্যাদি সৃষ্টিপ্রতিপাদিকা শ্রুতি এবং "য সর্বজ্ঞঃ"-মুণ্ডক উপনিষৎ ২।২।৭ ইত্যাদি সর্ব্বজ্ঞত্বপ্রতিপাদিকা শ্রুতিসকল আছে।
আচ্ছা তাহা হইলে সৃষ্টিবিষয়ক শ্রুতির প্রামাণ্যবলেই ব্রহ্মের নিজের কোন প্রয়োজন কল্পনা করিতেছ না কেন? উত্তর- আর এই সৃষ্টিপ্রতিপাদিকা শ্রুতি পরমার্থবিষয়িণী নহে, যেহেতু ইহা অবিদ্যার দ্বারা কল্পিত নাম ও রূপাত্মক ব্যবহারের বিষয় এবং যেহেতু ব্রহ্মাত্মভাব (জীব ও ব্রহ্মের একত্ব) প্রতিপাদনপর ইত্যাদি ইহাও বিস্মৃত হওয়া উচিত নহে।
ইতি ভাষ্যানুবাদ।..

Monday, 6 July 2020

দ্বাদশজ্যোতির্লিঙ্গস্তোত্রম্ঃ-


শঙ্করাচার্য্য বিরচিত দ্বাদশজ্যোতির্লিঙ্গস্তোত্রম্ঃ-
সৌরাষ্ট্রদেশে বসুধাবকাশে জ্যোতির্ময়ং চন্দ্রকলাবতংসম্ ।
ভক্তিপ্রদানায় কৃপাবতারং তং সোমনাথং শরণং প্রপদ্যে ॥ ১॥

অনুবাদঃ- ভূমণ্ডলের অনাবৃত অংশ সৌরাষ্ট্রদেশে ভক্তিপ্রদানার্থ অবতীর্ণ চন্দ্রকলাবতংস প্রসিদ্ধ জ্যোতির্ময় সোমনাথ শিবের শরণাপন্ন হইতেছি।১
শ্রীশৈলশৃঙ্গে বিবুধাতিসঙ্গে শেষাদ্রিশৃঙ্গেঽপি সদা বসন্তম্ ।
তমর্জুনং মল্লিকপূর্বমেনং নমামি সংসারসমুদ্রসেতুম্ ॥ ২॥

অনুবাদঃ- বিবিধ-প্রসঙ্গে শ্রীশৈলশৃঙ্গে এবং সদা শেষাদ্রিশৃঙ্গে অধিষ্ঠিত সেই যে মল্লিকার্জ্জুন শিব, ভবসাগরসেতুস্বরূপ-ইঁহাকে নমস্কার করি।২
অবন্তিকায়াং বিহিতাবতারং মুক্তিপ্রদানায় চ সজ্জনানাম্ ।
অকালমৃত্যোঃ পরিরক্ষণার্থং বন্দে মহাকালমহাসুরেশম্ ॥ ৩॥

অনুবাদঃ- সজ্জনগণের অকালমৃত্যু হইতে রক্ষা এবং মুক্তিপ্রদানের জন্য অবন্তীদেশে অবতীর্ণ মহাকাল মহাসুরেশ শিবকে আমি বন্দনা করি।৩
কাবেরিকানর্মদয়োঃ পবিত্রে সমাগমে সজ্জনতারণায় ।
সদৈবমান্ধাতৃপুরে বসন্তমোঙ্কারমীশং শিবমেকমীড়ে ॥ ৪॥

অনুবাদঃ- কাবেরী ও নর্মদা নদীর পবিত্রে সঙ্গমেক্ষেত্রে মান্ধাতৃপুরে সজ্জননিস্তার্থ অবতীর্ণ ওঙ্কারেশ্বর শিবের স্তব করি।৪
পূর্বোত্তরে পারলিকাভিধানে সদা শিবং গিরিজাসমেতম্ ।
সুরাসুরারাধিতপাদপদ্মং শ্রীবৈদ্যনাথং সততং নমামি ॥ ৫॥

অনুবাদঃ- পূর্বোত্তর প্রান্তে পারলিক-নামক স্থানে পার্ব্বতীসমন্বিত সেই সদাশিব- যাঁহার পাদপদ্ম সুরাসুরের দ্বারা অর্চ্চিত সেই শ্রীবৈদ্যনাথকে সতত নমস্কার করি। ৫
আর্ম্মদ্দসংজ্ঞে নগরে চ রম্যে বিভূষিতাঙ্গং বিবিধৈশ্চ ভোগৈঃ ।
সদ্ভুক্তিমুক্তিপ্রদমীশমেকং শ্রীনাগনাথং শরণং প্রপদ্যে ॥ ৬॥

অনুবাদঃ- আর্ম্মদ্দনামক রমণীয় নগরে বিবিধ ভোগযুক্ত বিভুষিতদেহ সজ্জনের ভুক্তিমুক্তি প্রদাতা শ্রীনাগনাথ মহাদেবের শরণাপন্ন হইতেছি॥ ৬॥


হিমাদ্রিপার্শ্বেহপি তটেহরমন্তং সম্পূজ্যমানং সততং মুনীন্দ্রৈঃ ।
সুরাসুরৈর্যক্ষ মহোরগাদ্যৈঃ কেদারসংজ্ঞং শিবমেকমীড়ে ॥ ৭॥

অনুবাদঃ- হিমালয়পার্শ্বতটে, মুনীন্দ্রবৃন্দ, সুরাসুর, যক্ষ ও মহোরগাদি কর্ত্তৃক পূজিত কামনাশন কেদারনাথ নামক এক শিবকে স্তব করি।৭
সিংহাদ্রিশৃঙ্গেহপি তটে রমন্তং গোদাবরিতীরপবিত্রদেশে ।
যদ্দর্শনাৎ পাতকজাতনাশঃ প্রজায়তে ত্র্যম্বকমীশমীড়ে ॥ ৮॥

অনুবাদঃ- যাঁহার দর্শনমাত্রে পাপসমূহ বিনষ্ট হয়, গোদাবরীর পবিত্র তীর প্রদেশে সিংহাদ্রিপার্শ্বতটে কমনীয় ( অথবা অকাম) সেই ত্র্যম্বকেশ্বরের স্তব করি।৮
শ্রীতাম্রপর্ণীজলরাশিয়োগে নিবধ্য সেতুং নিশি বিল্বপত্রৈঃ।
শ্রীরামচন্দ্রেণ সমর্চ্চিতং তং রামেশ্বরাখ্যং সততং নমামি ॥ ৯॥

অনুবাদঃ- শ্রীতাম্রপর্ণী-সাগরসঙ্গমক্ষেত্রে, সেতুবন্ধনান্তে রাত্রিকালে শ্রীরামচন্দ্র কর্ত্তৃক অর্চ্চিত সেই রামেশ্বর শিবকে সতত নমস্কার করি। ৯
যো ডাকিনীশাকিনিকা-সমাজে নিষেব্যমাণং পিশিতাশনৈশ্চ ।
সদৈব ভীমাদিপদপ্রসিদ্ধং তং শঙ্করং ভক্তহিতং নমামি ॥ ১০॥

অনুবাদঃ- যিনি ডাকিনীশাকিনী সমাজে এবং রাক্ষসগণ কর্ত্তৃক সদা সেবিত হইয়া আসিতেছেন সেই ভক্তহিতকারী 'ভীম' আদিপদ প্রসিদ্ধ ভীমেশ্বর শঙ্করকে নমস্কার করি। ১০
সানন্দমানন্দবনে বসন্তমানন্দকন্দং হতপাপবৃন্দম্ ।
বারাণসীনাথমনাথনাথং শ্রীবিশ্বনাথং শরণং প্রপদ্যে ॥ ১১॥

অনুবাদঃ- আনন্দকাননে সর্ব্বদা সানন্দে অবস্থিত, পাপরাশি বিনাশী, আনন্দমূল, অনাথনাথ শ্রীবিশ্বনাথের শরণাপন্ন হইতেছি॥ ১১
এলাপুরীরম্যশিবালয়েঽস্মিন্ সমুল্লসন্তং ত্রিজগদ্বরেণ্যম্ ।
বন্দে মহোদারতরস্বভাবং সদাশিবং তং ধিষণেশ্বরাখ্যম।। ১২॥

অনুবাদঃ- এই এলাপুরীস্থ রম্য শিবালয়ে বিরাজমান, ত্রিজগদ্বরেণ্য, মহোদার-তর-স্বভাব-অর্থাৎ যাঁহার স্বরূপ তুলনায় সর্ব্বশ্রেষ্ঠ মহামহিমপূর্ণ- সেই প্রসিদ্ধ ধিষণেশ্বর বা ঘৃষ্ণেশ্বর নামক সদাশিবকে বন্দনা করি।
এতানি লিঙ্গানি সদৈব মর্ত্ত্যাঃ প্রাতঃ পঠন্তোহমলমানসাশ্চ।
তে পুত্রপৌত্রৈশ্চ ধনৈরুদারৈঃ সৎকীর্ত্তিভাজঃ সুখিনো ভবন্তি।।১৩

অনুবাদঃ- যেসকল মানব প্রত্যহ প্রাতঃকালে নির্ম্মলমানসে এই সকল লিঙ্গস্তব পাঠ করে তাহারা সৎকীর্ত্তিভাজন হইয়া পুত্র, পৌত্র, ধনসমৃদ্ধি দ্বারা সুখী হইয়া থাকে।১৩
॥ ইতি পরমহংস শ্রীমদ্শঙ্করভগবতঃ বিরচিতং
দ্বাদশজ্যোতির্লিঙ্গস্তোত্রং সম্পূর্ণম্ ॥

পরমহংস ভগবান শ্রীশঙ্করাচার্য্য বিরচিত
দ্বাদশজ্যোতির্লিঙ্গস্তোত্র সম্পূর্ণ ॥

Friday, 3 July 2020

উপনিষৎসকলে 'যোনি' শব্দের দ্বারা বর্ণিত হইয়াছেন বলিয়া ব্রহ্ম জগতের উপাদান কারণঃ-


শ্রীমৎ মহর্ষি বাদরায়ণ ভগবৎ প্রণীত বেদান্ত মীমাংসাশাস্ত্রের প্রকৃত্যধিকরণে বর্ণিত আছে-

যোনিশ্চ হি গীয়তে৷৷ -(ব্রহ্মসূত্র ১.৪.২৭)

শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- আচার্য্য শঙ্কর ভগবৎ ভাষ্যে বলিতেছেন- আর এইহেতুবশতঃও ব্রহ্ম জগতের উপাদান কারণ, যেহেতু উপনিষৎ সকলে ব্রহ্ম 'যোনি', এইরূপেও পঠিত হইতেছেন, যথা-

'কর্তারমীশং পুরুষং ব্রহ্মযোনিম্'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-৩.১.৩)

অর্থাৎ 'জগতের কর্ত্তা ঈশ্বর পুরুষ ব্রহ্মযোনি অর্থাৎ যিনি ব্রহ্ম আবার সর্ব্বকারণও।'

তদব্যয়ং যদ্ভূতযোনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ৷৷-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১.১.৬)

অর্থাৎ 'এইরূপ লক্ষণবিশিষ্ট ভূতযোনি অর্থাৎ প্রাণিগণের সৃষ্টির কারণস্বরূপ, স্থাবর-জঙ্গমের কারণস্বরূপ পৃথিবীর ন্যায় যাঁহাকে তথা সকলের স্বরূপভূত সেই অব্যয়কে বিবেকিগণ সর্বত্র উপলব্ধি করেন।'ইত্যাদি শ্রুতি।

আর 'যোনি' শব্দটী প্রকৃতির (-উপাদানকারণের) বাচক, ইহা লোকমধ্যে অবগত হওয়া যায়, যথা-'পৃথিবী ওষধি ও বনস্পতিসকলের যোনি' ইত্যাদি। স্ত্রী যোনিও স্বীয় অবয়বের (-শোনিতের) দ্বারা হয় গর্ভের প্রতি উপাদানকারণ। কোন কোন স্থলে 'যোনি' শব্দ স্থানের বাচকরূপেও পরিদৃষ্ট হয়, যথা-

'যোনিষ্ট ইন্দ্র নিষদে অকারি'-(ঋগ্বেদ সংহিতা ১।১০৪।১)

অর্থাৎ 'হে ইন্দ্র!, তোমার উপবেশনের জন্য আমি যোনি (-স্থান) নির্ম্মাণ করিয়াছি।'

কিন্তু এখানে 'যথোর্ণনাভিঃ সৃজতে গৃহ্ণতে চ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-১.১.৭)

'মাকড়সা কোন অন্যকারণের অপেক্ষা না করিয়া নিজেই সৃষ্টি করে অর্থাৎ নিজ শরীর হইতে অভিন্ন তন্তুরাশিকে বাহিরে প্রসারিত করে, আবার সেই সকলকে গ্রহণও করে অর্থাৎ নিজের সহিত একীভূত করিয়া ফেলে।'

ইত্যাদি এইজাতীয় বাক্যশেষবশতঃ যোনিশব্দটীর উপাদানকারণতারূপ অর্থ পরিগৃহীত হইতেছে। এইপ্রকারে ব্রহ্মের উপাদানকারণতা প্রকৃষ্টরূপে সিদ্ধ হইল।...........ইতি ভাষ্যানুসারে ভাবার্থ।

এইরূপ মাকড়সার শরীরের তন্তুরূপে পরিণামের ন্যায় ঈশ্বরের উপাধিভূতা মায়ার জগদ্রূপে পরিণামে ঈশ্বরের উপাদানকারণতাও সিদ্ধ হয়। এইরূপে মায়া-শবলিত ঈশ্বররূপ ব্রহ্মই হন জগতের অভিন্ননিমিত্তোপাদান কারণ।

 

Thursday, 2 July 2020

জ্ঞানীর ও অজ্ঞানীর কৃত কর্ম্মফলের ভেদঃ-



ভগবান সনৎসুজাত বলিতেছেন- 
অস্মিন্ লোকেতপস্তপ্তং ফলমন্যত্র ভুজ্যতে। 
ব্রাহ্মণানাং তপঃসু-ঋদ্ধম্ অন্যেষাং তাবদেব তৎ।
-(শ্রীমহাভারত, উদ্যোগপর্ব, ৪৩তম অধ্যায়, সনৎ-সুজাতীয় সম্বাদ-১০)
শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ- ইহলোকে যে তপস্যাদি অনুষ্ঠিত হয় তাহার ফল পরলোকে ভোগ হইয়া থাকে-ইহাই সাধারণ নিয়ম। অনাত্মবিদ্ অর্থাৎ সকাম কর্ম্মীর অনুষ্ঠিত তপস্যা ততটাই ফল প্রদান করে যতটা শাস্ত্রে উল্লেখিত আছে কিন্তু ব্রহ্মবিদের তপস্যার ফল অধিক সমৃদ্ধ হইয়া থাকে।
ব্রহ্মবিদের তপস্যা ফলবৃদ্ধির হেতু হয়। কারণ শাস্ত্র বলেন-'যে কর্ম্মবিজ্ঞান, শ্রদ্ধা ও উপাসনাদিসহ সশ্রদ্ধচিত্তে জ্ঞানপূর্ব্বক অনুষ্ঠিত হয় তাহা অধিক ফলপ্রদ ও শক্তিশালী হইয়া থাকে।'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ ১।১।১০)
তাৎপর্য্য এই যে, সকাম কর্ম্মীর কর্ম্মফল পরলোকে ভোগ হয়, উহা সীমিত, স্বল্পকাল স্থায়ী। কিন্তু তত্ত্ববিদের যে জ্ঞানফল তাহা তিনি ইহলোকেই প্রাপ্ত হন এবং ঐ জ্ঞানফল মোক্ষ, অনন্তকাল স্থায়ী। কর্ম্ম অদৃষ্ট (পরলোক প্রাপ্তব্য) ফল প্রদান করে কিন্তু জ্ঞান দৃষ্ট ফল প্রদাতা-ইহাই বিশেষ। জ্ঞানী দৃষ্ট ফল মোক্ষ, বর্তমান শরীরেরই অনুভব করিয়া কৃতার্থ হইয়া থাকেন-ইহাই জ্ঞানের পরম বৈশিষ্ট্য।

তত্ত্বোপদেশ ১-৯


শঙ্করাচার্য্য বিরচিত তত্ত্বোপদেশঃ-

তত্ত্বংপদার্থশুদ্ধ্যর্থং গুরুঃ শিষ্যং বচোঽব্রবীৎ ।

বাক্যে তত্ত্বমসীত্যত্র ত্বং-পদার্থং বিবেচয় ॥ ১॥ 

গুরু শিষ্যকে বলিলেন-'তত্ত্বমসি'(তৎ, ত্বম্, অসি) এই শ্রুতিবাক্যে তৎ ও ত্বং পদের প্রতিপাদ্য পদার্থের শোধনের নিমিত্ত পূর্ব্বে ত্বং পদার্থের বিবেক কর, অর্থাৎ দেহাদি হইতে পৃথক করিয়া জান। ১

ন ত্বং দেহোঽসি দৃশ্যৎবাদুপজাত্যাদিমত্ত্বতঃ ।

ভৌতিকৎবাদশুদ্ধৎবাদনিত্যত্ত্বাত্তথৈব চ ॥ ২॥ 

ত্বং-পদের প্রতিপাদ্য তুমি শরীর নহ; কারণ দেহ-দৃশ্য জড়, ব্রাহ্মণত্বাদি অবান্তর জাতিযুক্ত, পঞ্চভূতনির্ম্মিত, অশুদ্ধ ও অনিত্য। ২

অদৃশ্যো রূপহীনস্ত্বং জাতিহীনোঽপ্যভৌতিকঃ ।

শুদ্ধনিত্যোঽসি দৃগ্রূপো ঘটো যদ্বন্ন দৃগ্ভবেৎ ॥ ৩॥ 

কিন্তু ত্বং পদ প্রতিপাদ্য তুমি অদৃশ্য, রূপহীন, জাতিশূন্য, ভূতসম্ভূত নহ, তুমি শুদ্ধ, নিত্য ও জ্ঞানস্বরূপ, ঘটাদি জড়বস্তু যেমন জ্ঞানস্বরূপ হয় না, দেহও তদ্রূপ জ্ঞানস্বরূপ হয় না। ৩

ন ভবানিন্দ্রিয়াণ্যেষাং করণৎবেন যা শ্রুতিঃ ।

প্রেরকস্ত্বং পৃথক্তেভ্যো ন কর্তা করণং ভবেৎ ॥ ৪॥ 

ত্বং পদ প্রতিপাদ্য তুমি ইন্দ্রিয়সমূহ নহ, কারণ শ্রুতিতে ইন্দ্রিয়সমূহকে করণ বলা হইয়াছে। তুমি সেই ইন্দ্রিয়গণের প্রেরকরূপ কর্ত্তা, এইজন্য সেইসকল ইন্দ্রিয় হইতে তুমি ভিন্ন, কারণ কর্ত্তা কখন করণ হয় না। ৪

নানৈতান্যেকরূপস্ত্বং ভিন্নস্তেভ্যঃ কুতঃ শৃণু ।

ন চৈকেন্দ্রিয়রূপস্ত্বং সর্বত্রাহম্প্রতীতিতঃ ॥ ৫॥ 

ইন্দ্রিয়গুলি নানারূপ, তুমি কিন্তু একরূপ, এইজন্য তুমি সেই সকল ইন্দ্রিয় হইতে ভিন্ন। কেন তুমি ইন্দ্রিয় হইতে ভিন্ন তাহা আমার নিকট শ্রবণ কর। সর্ব্বত্র 'আমি'-এইরূপ প্রতীতি হওয়ায় তুমি একটী ইন্দ্রিয়েরও স্বরূপ নহ। ৫

ন তেষাং সমুদায়োঽসি তেষামন্যতমস্য চ ।

বিনাশেঽপ্যাত্মধীস্তাবদস্তি স্যান্নৈবমন্যথা ॥ ৬॥

ইন্দ্রিয়সমষ্টি তুমি নহ, তাহাদের মধ্যে অন্যতম অর্থাৎ কোন একটী তুমি নহ, কারণ ইন্দ্রিয়ের বিনাশ হইলেও 'আমি' এইরূপ আত্মজ্ঞান অব্যাহত থাকে। অন্যথা যে আমি দেখিয়াছিলাম, সেই আমি স্মরণ করিতেছি এইরূপ অনুভব হইত না। ৬

প্রত্যেকমপি তান্যাত্মা নৈব তত্র নয়ং শৃণু ।

নানাস্বামিকদেহোঽয়ং নশ্যেদ্ভিন্নমতাশ্রয়ঃ ॥ ৭॥

সেইসকল ইন্দ্রিয়ের মধ্যে প্রত্যেক ইন্দ্রিয় আত্মা হইতে পারে না। কেন হয় না, তদ্বিষয়ে যুক্তি শ্রবণ কর। প্রত্যেক ইন্দ্রিয় আত্মা হইলে এইদেহের অনেক স্বামী হইল, স্বতন্ত্র অনেক স্বামীর অনেক মত, সুতরাং শরীর নষ্ট হইতে পারে। ৭

নানাত্মাভিমতং নৈব বিরুদ্ধবিষয়ৎবতঃ ।

স্বাম্যৈক্যে তু ব্যবস্থা স্যাদেকপার্থিবদেশবৎ ॥ ৮॥

যদি এইদেহের বহু স্বামী হয়, তাহা হইলে তাহাদের মত পরস্পর বিরুদ্ধ হইবে, সুতরাং নানা আত্মা, ইহা কাহারও অভিমত নহে। যেমন রাজ্যের একটী রাজা হইলে ব্যবস্থা হয়, দেহের স্বামী এক হইলে ব্যবস্থা সঙ্গত হয়। ৮

 মনস্ত্বং  বা প্রাণো জডত্বাদেব চৈতয়োঃ 

গতমন্যত্র মে চিত্তমিত্যন্যত্বানুভূতিতঃ  ৯॥

তুমি মন কিংবা প্রাণ হইতে পার না; কেননা, মন এবং প্রাণ উভয়ই জড়। আরও 'আমার মন অন্যত্র গিয়াছে' এইরূপ পার্থক্য অনুভব হয় বলিয়া মন আত্মা নহে। ৯

 

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...