চেতন পরমাত্মাই এই সুন্দর জগতের নির্ম্মাণকর্তা। সেই নিত্য, মুক্ত, পরিতৃপ্ত ব্রহ্ম কী প্রয়োজনে সৃষ্টি করেন? যেহেতু প্রবৃত্তিসকল প্রয়োজন বিশিষ্ট। যদি চেতন পরমাত্মার এই প্রবৃত্তিকে তাঁহার নিজের প্রয়োজনের উপযোগিরূপে কল্পনা করা হয়, তাহা হইলে "আপ্তকামম্", "আত্মকামম্"- বৃহদারণ্যক উপনিষৎ ৪।৩।২১ ইত্যাদি শ্রুতিতে বর্ণিত পরমাত্মার পরিতৃপ্ততা বাধিত হইয়া পড়িবে। অথবা প্রয়োজনের অভাবে জগন্নির্ম্মাণে প্রবৃত্তির অভাবও হইয়া পড়িতে পারে, ফলে জগতের উৎপত্তি হইবে না। আর যদি বলা হয়-চেতন হইলেও উন্মক্তব্যক্তিকে যেমন বুদ্ধির অপরাধ বশতঃ নিজের প্রয়োজন ব্যতিরেকেই প্রবৃত্ত হইতে দেখা যায়, এইরূপে পরমাত্মাও স্বপ্রয়োজন ব্যতিরেকেই প্রবৃত্ত হইবেন। তাহা হইলে পরমাত্মার যে সর্ব্বজ্ঞতা শ্রুতিতে বর্ণিত হইতেছে, তাহা বাধিত হইয়া পড়িবে। সেইহেতু চেতন ব্রহ্ম হইতে সৃষ্টি অসঙ্গত এইরূপ অনেক আপত্তি উত্থাপিত হয়। এই আপত্তির উত্তরে ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-
‘লোকবত্তু লীলাকৈবল্যম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৩)।
শারীরকভাষ্য অনুবাদঃ-পূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল- 'তু' শব্দটীর দ্বারা আক্ষেপ পরিহার করিতেছেন। যেমন লোকমধ্যে লীলা ব্যতিরিক্ত কোনপ্রকার প্রয়োজনের আকাঙ্ক্ষা না করিয়া কোন পূর্ণকাম রাজা বা রাজমন্ত্রীর ক্রীড়াবিহারাদিতে কেবল লীলারূপা (বিলাসরূপা) প্রবৃত্তিসকল হইয়া থাকে। অথবা যেমন বাহ্য কোন প্রয়োজনের আকাঙ্ক্ষা না করিয়া শ্বাস ও প্রশ্বাস প্রভৃতি স্বভাববশতঃই সম্ভব হইয়া থাকে। এইরূপে অন্য কোন প্রয়োজন ব্যতিরেকেই ঈশ্বরেরও কাল ও কর্ম্মসহকৃত মায়াশক্তিরূপ স্বভাববশতঃই কেবল লীলারূপা প্রবৃত্তি হয়।
ঈশ্বরের অন্য যে প্রয়োজন নিরূপণ করা হয়, শ্রুতির আপ্তকামত্বাদি যুক্তি এবং "আনন্দং ব্রহ্ম"-বৃহদারণ্যক ৩।৯।২৮।৭ ইত্যাদি শ্রুতির বলে তাহা নিশ্চয়ই সম্ভব হয় না। আর স্বভাবকে দোষারোপ করিতে পারা যায় না। যদিও এই জগৎ-বিম্বরচনা আমাদিগের নিকট অতিশয় আয়াসসাধ্যরূপেই প্রতিভাত হইতেছে, তাহা হইলেও ইহা পরমেশ্বরের পক্ষে কেবল লীলামাত্রই, যেহেতু তিনি মায়ারূপ অপরিমিত শক্তিযুক্ত। আর যদি লোকমধ্যে রাজা প্রভৃতির লীলাসকলেও কোনপ্রকার সূক্ষ্মফল কল্পনা করা হয়, তাহা হউক, কিন্তু তাহা হইলেও এখানে ঈশ্বরের জগন্নির্ম্মাণ প্রবৃত্তিতে স্বকীয় বা পরকীয় কোনপ্রকার প্রয়োজন কল্পনা করিতে পারা যায় না, যেহেতু আপ্তকামত্ববোধক শ্রুতিবাক্য আছে। আর অপ্রবৃত্তি, অথবা উন্মত্ত পুরুষের ন্যায় প্রবৃত্তি কল্পনা করিতে পারা যায় না, যেহেতু "ইমান্ লোকান্ অসৃজত"- ঐতরেয়োপনিষৎ ১।১।২ ইত্যাদি সৃষ্টিপ্রতিপাদিকা শ্রুতি এবং "য সর্বজ্ঞঃ"-মুণ্ডক উপনিষৎ ২।২।৭ ইত্যাদি সর্ব্বজ্ঞত্বপ্রতিপাদিকা শ্রুতিসকল আছে।
আচ্ছা তাহা হইলে সৃষ্টিবিষয়ক শ্রুতির প্রামাণ্যবলেই ব্রহ্মের নিজের কোন প্রয়োজন কল্পনা করিতেছ না কেন? উত্তর- আর এই সৃষ্টিপ্রতিপাদিকা শ্রুতি পরমার্থবিষয়িণী নহে, যেহেতু ইহা অবিদ্যার দ্বারা কল্পিত নাম ও রূপাত্মক ব্যবহারের বিষয় এবং যেহেতু ব্রহ্মাত্মভাব (জীব ও ব্রহ্মের একত্ব) প্রতিপাদনপর ইত্যাদি ইহাও বিস্মৃত হওয়া উচিত নহে।
ইতি ভাষ্যানুবাদ।..
No comments:
Post a Comment