সত্যাচার্যস্য গমনে কদাচিন্মুক্তি দায়কম্ ।
কাশীক্ষেত্রং প্রতি সহ গৌর্যা মার্গে তু শঙ্করম্ ॥
অন্ত্যবেশধরং দৃষ্ট্বা গচ্ছ গচ্ছেতি চাব্রবীৎ ।
শঙ্করঃসোঽপি চাণ্ডালস্তং পুনঃ প্রাহ শঙ্করম্ ॥
সত্যাচার্য্য শঙ্কর মুক্তিপ্রদ কাশীক্ষেত্রে (অবগাহন মানসে উত্তর-বাহিনী সুর-তরঙ্গিণীতে) গমন করিতেছিলেন, মহাদেব শঙ্করও গৌরীর সহিত সেইপথে যাইতেছিলেন। শঙ্করাচার্য্য (কুকুর চতুষ্টয়যুক্ত) চণ্ডালবেশধারী শিবকে দেখিয়া বলিলেন-“সরিয়া যাও, সরিয়া যাও”। সেই চণ্ডালও শঙ্করের উক্তি শ্রবণ করিয়া হাস্য বদনে বেদান্ত সংসিদ্ধ এই ন্যায়যুক্ত বাক্য কহিলেন-
অন্নময়াদন্নময়মথবা চৈতন্যমেব চৈতন্যাৎ ।
যতিবর দূরীকর্তুং বাঞ্ছসি কিং ব্রূহি গচ্ছ গচ্ছেতি ॥
অর্থাৎ হে যতিবর! তুমি “সরিয়া যাও সরিয়া যাও’ কি কহিতেছ? অন্নময় হইতে অন্নময়কে, কি চৈতন্য হইতে চৈতন্যকে, দূরীকৃত করিতে বাঞ্ছা করিয়াছ? তোমার শরীরও অন্নের বিকার আমার শরীরও অন্নময়, তাহা হইলে তোমার দেহ আর আমার দেহের মধ্যে কি পার্থক্য আছে যে আমি সরিয়া যাইব? আর দেহ ছাড়িয়া যদি চৈতন্য ধর, তাহা হইলে বা আমি সরিয়া যাইব কেন? তোমার চৈতন্য আর আমার চৈতন্যে কি পার্থক্য আছে?
প্রত্যগ্বস্তুনি নিস্তরঙ্গসহজানন্দাববোধাম্বুধৌ
বিপ্রোঽয়ং শ্বপচোঽয়মিত্যপি মহান্কোঽয়ং বিভেদভ্রমঃ ।
কিং গঙ্গাম্বুনি বিম্বিতেঽম্বরমণৌ চাণ্ডালবীথীপয়ঃ
পূরে বাঽন্তরমস্তি কাঞ্চনঘটীমৃৎকুম্ভয়োর্বাঽম্বরে ॥
তরঙ্গহীন সহজানন্দ বোধ-সিন্ধু প্রত্যগাত্মাতে, এ বিপ্র (ব্রাহ্মণ), এ শ্বপচ (চাণ্ডাল) ইত্যাদি ভেদ কল্পনা কি? গঙ্গাতে বা চাণ্ডাল বীথিকাস্থ (গৃহাঙ্গনস্থ) জলে প্রতিবিম্বিত সূর্য্যের, আর কাঞ্চন-ঘটে ও মৃৎ-কুম্ভে আকাশের কি অন্তর আছে?
চাণ্ডালরূপী শিব এরূপ অনেক শ্লোক কহিয়া বিরত হইলে, শঙ্করাচার্য্য বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, হে উদার! তুমি যাহা কহিলে তাহা সত্য। অধুনা আমি ভেদবুদ্ধি পরিত্যাগ করিলাম। শ্রুতিশাস্ত্র-বিশারদ পণ্ডিতগণ অনেক আছেন, কিন্তু তন্মধ্যে কোন বিশুদ্ধ-বুদ্ধিরই অভেদ বুদ্ধি হয় ।
জাগ্রৎস্বপ্নসুষুপ্তিষু স্ফুটতরা যা সংবিদুজ্জৃম্ভতে
যা ব্রহ্মাদিপিপীলিকান্ততনুষু প্রোতা জগৎসাক্ষিণী ।
সৈবাহং ন চ দৃশ্যবস্ত্বিতি দৃঢপ্রজ্ঞাপি যস্যাস্তি চে-
চ্চাণ্ডালোঽস্তু স তু দ্বিজোঽস্তু গুরুরিত্যেষা মনীষা মম ॥ ১॥
অর্থঃ- যে সম্বিৎ (জ্ঞান) জাগ্ৰৎ, স্বপ্ন,সুষুপ্তি তিন অবস্থাতে প্রকাশ পাইতেছেন । যিনি ব্রহ্মাদি পিপীলিকা পৰ্য্যন্ত সকল শরীরে ওতপ্রোত ভাবে জগতের সাক্ষীরূপ হইয়া আছেন। আমি সেই সম্বিৎ (চৈতন্য), দৃশ্যবস্তু নহি, এরূপ দৃঢ় প্রজ্ঞা যাহার, তিনি চাণ্ডাল হউন বা দ্বিজই হউন, আমার গুরু, এই আমার জ্ঞান। ১.
ব্রহ্মৈবাহমিদং জগচ্চ সকলং চিন্মাত্রবিস্তারিতং
সর্বং চৈতদবিদ্যয়া ত্রিগুণয়াঽশেষং ময়া কল্পিতম্ ।
ইত্থং যস্য দৃঢ়া মতিঃ সুখতরে নিত্যে পরে নির্মলে
চাণ্ডালোঽস্তু স তু দ্বিজোঽস্তু গুরুরিত্যেষা মনীষা মম ॥ ২॥
অর্থঃ- আমি ব্রহ্মস্বরূপ, এই সমস্ত জগৎ কেবলমাত্র চৈতন্য দ্বারা অবভাসিত হইতেছে, এই সমস্ত জগৎ ত্রিগুণাত্মক অবিদ্যা দ্বারা আমাকর্তৃক অথবা আমাতে কল্পিত, যাঁহার সচ্চিদানন্দরূপ নিষ্কলঙ্ক পরমাত্মাতে এইরূপ দৃঢ়বুদ্ধি জন্মিয়াছে, তিনি চাণ্ডাল হউন বা ব্রাহ্মণই হউন, তিনি আমার গুরু, এই আমার মণীষা। ২.
শশ্বন্নশ্বরমেব বিশ্বমখিলং নিশ্চিত্য বাচা গুরো-
র্নিত্যং ব্রহ্ম নিরন্তরং বিমৃশতা নির্ব্যাজশান্তাত্মনা ।
ভূতং ভাতি চ দুষ্কৃতং প্রদহতা সংবিন্ময়ে পাবকে
প্রারব্ধায় সমর্পিতং স্ববপুরিত্যেষা মনীষা মম ॥ ৩॥
অর্থঃ- গুরুর বাক্যের দ্বারা এই সমুদায় জগৎকে সতত অনিত্য নিশ্চয় করিয়া, অকপট শান্তচিত্তে নিরন্তর নিত্যব্রহ্মের বিচার করিয়া এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সমস্ত পাপ দগ্ধ করিয়া জ্ঞানময় অগ্নিতে প্রারব্ধভোগের নিমিত্ত নিজদেহ অর্পিত হইয়াছে, ইহাই আমার মণীষা।৩
যা তির্যঙ্নরদেবতাভিরহমিত্যন্তঃ স্ফুটা গৃহ্যতে
যদ্ভাসা হৃদয়াক্ষদেহবিষয়া ভান্তি স্বতোঽচেতনাঃ ।
তাং ভাস্যৈঃ পিহিতার্কমণ্ডলনিভাং স্ফূর্তিং সদা ভাবয়-
ন্যোগী নির্বৃতমানসো হি গুরুরিত্যেষা মনীষা মম ॥ ৪॥
অর্থঃ- তির্য্যক, মনুষ্য ও দেবতাগণ যে আত্মপ্রকাশকে 'আমি' এইরূপে অন্তঃকরণে পরিস্ফুটরূপে জানিয়া থাকে, হৃদয়, ইন্দ্রিয়, দেহ ও বিষয়সমূহ স্বভাবতঃ অচেতন হইলেও যাহার প্রকাশের দ্বারা প্রকাশিত হইয়া থাকে, যে যোগী সূর্য্যপ্রকাশ্য মেঘের দ্বারা আবৃত সূর্য্যমণ্ডলসদৃশ স্বয়ং-প্রকাশ সংবিৎকে সর্ব্বদা চিন্তা করিয়া শান্তচিত্ত হইয়া থাকেন, তিনিই গুরু ইহাই আমার মণীষা।৪
যৎসৌখ্যাম্বুধিলেশলেশত ইমে শক্রাদয়ো নির্বৃতা
যচ্চিত্তে নিতরাং প্রশান্তকলনে লব্ধ্বা মুনির্নির্বৃতঃ ।
যস্মিন্নিত্যসুখাম্বুধৌ গলিতধীর্ব্রহ্মৈব ন ব্রহ্মবিদ্
যঃ কশ্চিৎস সুরেন্দ্রবন্দিতপদো নূনং মনীষা মম ॥ ৫॥
অর্থঃ- যে সুখসমুদ্রের কণারও কণা প্রাপ্ত হইয়া এই ইন্দ্রপ্রভৃতি প্রভৃতি দেবসকল শান্তিলাভ করিয়াছেন, যে মুনি প্রশান্ত চিত্তে যাহা লাভ করিয়া নিরতিশয় শান্তিলাভ করিয়াছেন, সেই নিত্য সুখসমুদ্রে যাহার চিত্ত বিগলিত হইয়াছে, তিনি ব্রহ্মবিৎ নহেন, কিন্তু ব্রহ্মই, তাঁহার চরণ দেবরাজও বন্দনা করেন-ইহাই আমার নিশ্চিত মতি।৫
শঙ্কর যাবৎ এইরূপ কহিতেছিলেন, ইতিমধ্যে সেই শরীরকে স্বয়ং শিব চতুৰ্ব্বেদ-যুক্ত দর্শন করিলেন। তখন তিনি ভক্তি ও ধৈৰ্য্যের সহিত প্রত্যগাত্মা মহেশ্বরের স্তুতি করিতে লাগিলেন।
দাসস্তেঽহং দেহদৃষ্ট্যাঽস্মি শংভো
জাতস্তেংঽশো জীবদৃষ্ট্যা ত্রিদৃষ্টে ।
সর্বস্যাঽঽত্মন্নাত্মদৃষ্ট্যাৎবমেবে-
ত্যেবং মে ধীর্নিশ্চিতা সর্বশাস্ত্রৈঃ ॥
হে শম্ভু! দেহ দৃষ্টিতে আমি তোমার দাস , জীব দৃষ্টিতে তোমার অংশ, এবং আত্ম দৃষ্টিতে তুমিই আমি, এই আমার নিশ্চিত মতি। আমি আমার বুদ্ধি এবং সর্ব্বশাস্ত্রগ্রন্থের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছি।
॥ ইতি শ্রীমচ্ছঙ্করভগবতঃ কৃতৌ মনীষাপঞ্চকং সম্পূর্ণম্ ॥
ইতি আচার্য্য শ্রীশঙ্কর ভগবৎ বিরচিত মনীষাপঞ্চকম্ সম্পূর্ণ॥
No comments:
Post a Comment