Friday, 17 July 2020

বেদান্তে বিশ্বপ্রেম ও হিতবাদঃ-


প্রথমেই এই বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দের কিছু উদ্ধৃতি উল্লেখ করব। স্বামীজী বলছেন-"আজকাল দেখা যায় অনেকে বলে, তাহাদের নীতির ভিত্তি হিতবাদ। এই নীতির ভিত্তি কি? সর্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক লোকের সর্বাধিক সুখের ব্যবস্থা করা-কেন এরূপ করিব? যদি আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, তাহা হইলে আমি অধিকাংশ লোকের অত্যধিক অনিষ্ট সাধন করিব না কেন? হিতবাদিগণ এই প্রশ্নের কি উত্তর দিবেন? কোনটি ভাল কোনটি মন্দ, তাহা তুমি কি করিয়া জানিবে? আমি আমার সুখের বাসনার দ্বারা পরিচালিত হইয়া উহার তৃপ্তিসাধন করিলাম, উহা আমার স্বভার, উহা অপেক্ষা অধিক কিছু জানি না। আমার এইসব বাসনা আছে, আমি এগুলি পূর্ণ করিব, তোমার আপত্তি করিবার কি অধিকার আছে? নীতি, আত্মার অমরত্ব, ঈশ্বর, প্রেম ও সহানুভূতি, সাধুত্ব ও সর্বোপরি নিঃস্বার্থতা-মনুষ্যজীবনের এই-সকল ভাব ও মহৎ সত্যগুলি কোথা হইতে আসিল?
তাহার যুক্তি দেখাও। অবশ্য কবিত্ব হিসাবে নিঃস্বার্থতা অতি সুন্দর হইতে পারে, কিন্তু কবিত্ব তো যুক্তি নয়। আমাকে যুক্তি দেখাও-কেন আমি নিঃস্বার্থ হইব, কেন আমি সৎ হইব? অমুক এই কথা বলে-এরূপ কথার কোন মূল্য আমার কাছে নাই। আমার নিঃস্বার্থ হওয়ার উপযোগিতা কোথায়? ‘হিত’ বলিতে যদি ‘অধিকতম সুখ’ বুঝায়, তবে স্বার্থপর হইলেই আমার পক্ষে হিত। ইহার কি উত্তর? হিতবাদিগণ ইহার কোন উত্তর দিতে পারেন না। ইহার উত্তর-এই পরিদৃশ্যমান জগৎ এক অনন্ত সমুদ্রের একটি ক্ষুদ্র বিন্দু, অনন্ত শৃঙ্খলের একটি ক্ষুদ্র শিকলি। যাঁহারা নিঃস্বার্থতা প্রচার করিয়াছিলেন ও মনুষ্য-জাতিকে উহা শিক্ষা দিয়াছিলেন, তাঁহারা এ তত্ত্ব কোথায় পাইলেন? আমরা জানি, ইহা সহজাত বৃত্তি নয়। সহজাত-জ্ঞানসম্পন্ন পশুগণ ইহা জানে না, বিচার বুদ্ধিতেও ইহা পাওয়া যায় না, যুক্তিদ্বারা এই-সকল তত্ত্বের কিছুমাত্র জানা যায় না। তবে ঐ-সকল তত্ত্ব কোথা হইতে আসিল?"- (স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী » ০১ম খণ্ড » ০৫. রাজযোগ » ০৭. ধ্যান ও সমাধি)
বেদ বেদান্তই ইহার উৎস। বস্তুত ইহার উত্তর বেদান্ত ভিন্ন আর কেহ দিতে পারে না । যদি শুক্লযজুর্বেদের বাজসনেয় সংহিতার শেষ অধ্যায় ঈশ উপনিষৎ পাঠ করি, তবে দেখব-
যস্তু সর্বাণি ভূতান্যাত্মন্যেবানুপশ্যতি ৷
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে ৷৷ ঈশ উপনিষৎ- ৬৷৷

শাঙ্করভাষ্য অনুবাদঃ- ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল- "যে মুমুক্ষু পরিব্রাজক সন্ন্যাসী অব্যক্ত প্রকৃতি হইতে স্থাবর বৃক্ষলতাদি পর্য্যন্ত সমস্ত শরীরকে আত্মাতেই দেখেন অর্থাৎ তাহাদিগকে আত্মা হইতে পৃথক্ দেখেন না; আবার সেই সমস্ত শরীরেতেই আত্মাকে দেখেন, মানে সেই সকল শরীরের আত্মাকে নিজের আত্মা বলিয়া জানেন অর্থাৎ এই বোঝেন যে, যেভাবে আমি এই কার্য্যকারণ সংঘাতরূপ দেহের আত্মা এবং ইহার সমস্ত প্রতীতির সাক্ষী, চেতন, কেবল নির্গুণ হইয়া থাকি, ঠিক সেইভাবে এইরূপ স্বরূপে অব্যক্ত প্রকৃতি হইতে স্থাবর পর্য্যন্ত পদার্থের আত্মা আমিই। এই প্রকার যিনি সকল প্রাণিতে নির্বিশেষ আত্মাকে দেখেন তিনি এইরূপ উপলব্ধির ফলে কাহাকেও বিজুগুপ্সা অর্থাৎ ঘৃণা করেন না। নিজ হইতে অন্যকে দোষযুক্ত দর্শনহেতুই সব ঘৃণা হইয়া থাকে। অত্যন্ত বিশুদ্ধ ব্যবধানরহিত আত্মাকে দর্শনহেতু ঘৃণার নিমিত্ত অন্য কোন পদার্থ থাকে না, এই ঘৃণার অভাব জ্ঞাতই। সেই কারণে সম্যগ্দর্শী ঘৃণা করেন না।"
অপরদিকে বৃহদারণ্যক শ্রুতিতেও একই তত্ত্ব প্রস্ফুটিত হচ্ছে-
'লোকসমূহের প্রতি অনুরাগবশত লোকসমূহ জীবগণের প্রিয় হয় না, জীবগণের আত্মপ্রয়োজনেই লোকসমূহ প্রিয় হয়। সর্বভূতের প্রতি অনুরাগবশত সর্বভূত প্রিয় হয় না, আত্মার জন্য সর্বভূত প্রিয় হয়।' - (বৃহদারণ্যক উপনিষদৎ-২|৪|৫)

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...