Thursday, 30 July 2020

বেদান্তে মহাবাক্য ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’-


চতুর্বেদের চতুর্মহাবাক্যের মধ্যে ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ একটী। ঋগ্বেদীয় ঐতরেয় উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের প্রথম খণ্ডের তৃতীয় শ্রুতিতে এই মহাবাক্যের উল্লেখ রহিয়াছে।
‘এষঃ ব্রহ্ম, এষঃ ইন্দ্রঃ, এষঃ প্রজাপতিঃ, এতে সর্বে দেবাঃ, ইমানি চ পঞ্চ মহাভূতানি-পৃথিবী বায়ুরাকাশ আপো জ্যোতীংষীত্যেতানি, ইমানি চ ক্ষুদ্রমিশ্রাণীব বীজানি, ইতরাণি, চেতরাণি চ-অণ্ডজানি চ জারুজানি চ স্বেদজানি চোদ্ভিজ্জানি চ-অশ্বা গাবঃ পুরুষা হস্তিনঃ, যৎকিঞ্চেদং প্রাণি জঙ্গমং চ পতত্রি চ যচ্চ স্থাবরম;- সর্বং তৎ প্রজ্ঞানেত্রং প্রজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিতং, প্রজ্ঞানেত্রো লোকঃ, প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠা, প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম।’- (ঐতরেয় উপনিষদ-৩।১।৩)
শাঙ্করভাষ্য অনুসারে ভাবার্থঃ-ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের ভাষ্য হইল-সেই এই প্রজ্ঞানস্বরূপ আত্মাই অপরব্রহ্ম (উপাধিযুক্ত ব্রহ্ম) ; ইহাই সর্ব্বশরীরস্থিত প্রাণ ও প্রজ্ঞাত্মা এবং বিভিন্ন জলপাত্রে পতিত জল সূর্য্যপ্রতিবিম্বের ন্যায় ইহাও অন্তঃকরণরূপ উপাধিমধ্যে প্রবেশ করিয়া হিরণ্যগর্ভ প্রাণ ও প্রজ্ঞাত্মা। ইন্দ্র শব্দের প্রকৃতি প্রত্যয় অনুসারে হিরণ্যগর্ভ কিংবা সাক্ষাৎ দেবরাজ অর্থও গ্রহণ করা যাইতে পারে। ইনিই প্রজাপতি, যিনি প্রথমোৎপন্ন শরীরধারী পুরুষ; যাঁহার মুখছিদ্র ইত্যাদি প্রকাশের ফলে লোকপাল ইন্দ্র, অগ্নি প্রভৃতি উৎপন্ন হইয়াছেন, সেই প্রজাপতিও ইনিই। এবং এই যে, অগ্নি প্রভৃতি দেবতাগণ, তাঁহারাও ইনিই অর্থাৎ ব্রহ্মস্বরূপই বটে। আর এই যে সমস্ত শরীরের উপাদানরূপে এবং অন্ন ও অন্নভোজনকারী রূপে পরিণত পৃথিবী(মাটি), বায়ু, আকাশ, জল ও তেজঃ প্রভৃতি পঞ্চমহাভূত, ইহারা, এবং মশক প্রভৃতি ক্ষুদ্র প্রাণীদের সহিত সর্প প্রভৃতি।
বীজ অর্থাৎ কারণ- কার্য্যোৎপাদক, অবীজ অর্থাৎ কার্য্যের অনুৎপাদক, এইদুইভাগে বিভক্ত যে সমুদয় প্রাণী (ইতরাণি, চেতরাণি চ বলিয়া যাহাদের নির্দ্দেশ করা হইয়াছে) তাহারা কাহারা? বলা হইতেছে অণ্ডজ-পক্ষি প্রভৃতি, জারুজ-জরায়ুজ মনুষ্য প্রভৃতি, স্বেদজ-উকুন প্রভৃতি, উদ্ভিজ্জ-বৃক্ষলতা প্রভৃতি। অশ্ব, গো, পুরুষ ও হস্তি প্রভৃতি, আরও যে কিছু প্রাণী। তাহা কি কি? জঙ্গম-যাহারা পায়ের দ্বারা গমন করিয়া থাকে; আর পতত্রি, যাহারা আকাশপথে উড়িয়া থাকে; যাহা স্থাবর অর্থাৎ চলিতে পারে না; সে সমুদয়ই প্রজ্ঞানেত্র। প্রজ্ঞা অর্থ প্রকৃষ্ট জ্ঞান, তাহা নিশ্চিতই ব্রহ্মস্বরূপ; নেত্র অর্থাৎ যাহা দ্বারা নীত হয় (সত্তালাভ হয়)। সেই প্রজ্ঞা যাহার নেত্র, তাহার নাম প্রজ্ঞানেত্র; উৎপত্তি, স্থিতি ও লয় এই তিন সময়েই যাহা প্রজ্ঞাস্বরূপ ব্রহ্মে অবস্থিত অর্থাৎ প্রজ্ঞাতে আশ্রিত; এইজন্য উহারা প্রজ্ঞানেত্র। লোক অর্থাৎ ভূঃ প্রভৃতি লোকও প্রজ্ঞানেত্র; অথবা প্রজ্ঞাই সমস্ত জগতের প্রতিষ্ঠা বা স্থিতির মূল; সেই কারণে উহারা প্রজ্ঞান ব্রহ্মস্বরূপ।
সেই যে, এই সকল উপাধিশূন্য নিত্য, নিরঞ্জন, নির্ম্মল ও নিষ্ক্রিয়; অতএব শান্ত এক অদ্বিতীয়; 'নেতি নেতি' প্রণালীক্রমে সমস্ত বিশেষণ-পরিত্যক্তরূপে বিজ্ঞেয় এবং শব্দজাত সর্ব্বপ্রকার জ্ঞানের অগোচর ব্রহ্ম, তাহাই আবার অত্যন্ত বিশুদ্ধবুদ্ধিসত্ত্বরূপ উপাধিসম্পর্কবশতঃ সর্ব্বজ্ঞ ঈশ্বরভাবে সর্ব্বজীবভোগ্য সমস্ত অব্যক্ত (অপ্রকাশিত) জগতের প্রবর্ত্তক বা আবির্ভাবের কারণ এং সর্ব্ববস্তুর নিয়ন্ত্রণকারীরূপে অন্তর্যামী বলিয়া কথিত হন। তিনিই আবার যখন ব্যক্ত (প্রকাশিত) জগতের বীজস্বরূপ বুদ্ধি ও আত্মারূপ উপাধিগ্রহণ করেন, তখন হিরণ্যগর্ভ নাম লাভ করেন। তিনিই আবার ব্রহ্মাণ্ডমধ্যে প্রথম উৎপন্ন শরীররূপ বৈশিষ্ট্য লাভ করিয়া বিরাট ও প্রজাপতি নাম লাভ করিয়া থাকেন। তিনিই আবার প্রকাশিত অগ্নি প্রভৃতি উপাধিবিশেষযোগে দেবতা নামে কথিত হইয়া থাকেন। এইরূপ ব্রহ্ম হইতে আরম্ভ করিয়া তৃণ পর্য্যন্ত বিশেষ বিশেষ শরীরসম্বন্ধবশতঃ সেই ব্রহ্মেরই বিশেষ বিশেষ নাম লাভ হইয়া থাকে। নানাপ্রকার উপাধিভেদে ভিন্নপ্রকার সেই ব্রহ্মকেই সমস্তপ্রাণী ও তার্কিকগণ বিভিন্ন প্রকারে জানিয়া থাকেন এবং নানা প্রকারে তাহার কল্পনা করিয়া থাকেন। মনুস্মৃতি বলিয়াছেন-
'একশ্রেণীর লোকেরা ইঁহাকে অগ্নি বলিয়া নির্দেশ করেন; অপরে প্রজাপতি মনু বলিয়া নির্দ্দেশ করেন; অপরে প্রজাপতি মনু বলিয়া বর্ণনা করেন, কেহ কেহ ইন্দ্র বলেন, কেহ বা প্রাণ বলেন; কেহ আবার শাশ্বত ব্রহ্ম বলিয়াও জানেন' ইত্যাদি।........

স্বামী বিদ্যারণ্য মুনি (মাধবাচার্য) পঞ্চদশীতে বলিতেছেন-"চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়সকল দিয়া নির্গত যে অন্তঃকরণবৃত্তি-উপহিত চৈতন্যের দ্বারা পুরুষ রূপসকল দর্শন করে, শব্দসকল শ্রবণ করে, গন্ধসমূহের আঘ্রাণ লয়, বাক্য-সকল উচ্চারণ করে, সুস্বাদু ও অস্বাদু রস আস্বাদন করে, তাহা 'প্রজ্ঞান' বলিয়া কথিত হয়। ব্রহ্মা-ইন্দ্র প্রভৃতি উত্তম জীবে, মনুষ্যাদি মধ্যম জীবে এবং অশ্ব-গবাদি অধম জীবে-সর্বত্র যে একমাত্র চৈতন্যরূপে বিরাজিত, তাহাই ব্রহ্ম। সুতরাং আমাতে অবস্থিত প্রজ্ঞানও ব্রহ্ম।"

-(পঞ্চদশী, মহাবাক্যবিবেক-প্রকরণ-১,২)


No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...