ইতোমধ্যে আলোচনা করিয়াছি মায়ারূপ অপরিমিত শক্তিযুক্ত পরমেশ্বর কোন প্রয়োজন ব্যতিরেকেই লীলাচ্ছলেই সৃষ্টিকর্ম করেন। কিন্তু এখন আপত্তি হইল, এই সৃষ্টির মধ্যে যে জাগতিক বৈষম্য বা নিষ্ঠুরতা দেখা যায়, যেমন দেবতা প্রভৃতি কাহাকেও কাহাকেও নিরতিশয় সুখভাগী করেন আবার পশু প্রভৃতি কাহাকেও কাহাকেও অত্যন্ত দুঃখভাগী করেন, এবং মনুষ্য প্রভৃতিকে কাহাকেও কাহাকেও মধ্যম (সুখদুঃখমিশ্রিত) ভোগভাগী করেন ইত্যাদি এইপ্রকারে বিষমা সৃষ্টি যিনি নির্ম্মাণ করেন, সেই ঈশ্বরের দুর্বৃত্ত ব্যক্তির ন্যায় আসক্তি ও দ্বেষ যুক্তিযুক্ত হওয়ায় শ্বেতাশ্বতর(৬।১৯) শ্রুতিতে যে 'নিরবদ্যং অর্থাৎ অনিন্দনীয়, নিরঞ্জনম্ অর্থাৎ নির্লেপ' এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতে(৯।২৯) যে 'আমার প্রিয় ও অপ্রিয় নাই', এইরূপ অবধারিত স্বচ্ছতা (কূটস্থতা) প্রভৃতিরূপ ঈশ্বরের স্বভাব, তাহার বিলোপ হইয়া পড়িবে। এই আপত্তির উত্তরে ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-
বৈষম্যনৈর্ঘৃণ্যে ন, সাপেক্ষত্বাৎ, তথা হি দর্শয়তি’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৪)।।
শাঙ্করভাষ্য অনুবাদঃ- আচার্য্য শঙ্করের ভাষ্য হইল- এইরূপ আপত্তির উত্তরে আমরা বলিতেছি-ঈশ্বরের পক্ষপাতিতা ও নিষ্ঠুরতা হইয়া পড়ে না। কোন হেতু বলে? যেহেতু সাপেক্ষতা আছে। যেহেতু যদি নিরপেক্ষ, অর্থাৎ কেবল অন্য নিমিত্তনিরপেক্ষ ঈশ্বর বিষম সৃষ্টি নির্ম্মাণ করিতেন, তাহা হইলে বৈষম্য ও অতিক্রূরত্ব, এই দোষ হইতে পারিত। কিন্তু নিরপেক্ষের নির্ম্মাতৃত্ব নাই। কারণ সাপেক্ষ ঈশ্বর বিষম (উচ্চাবচ ভেদবিশিষ্ট) সৃষ্টি নির্ম্মাণ করেন। আচ্ছা, তিনি কাহাকে অপেক্ষা করেন? তাহার উত্তরে আমরা বলিতেছি-ধর্ম্ম ও অধর্ম্মকে অপেক্ষা করেন। অতএব যে প্রাণিগণ সৃষ্ট হয়, তাহাদের ধর্ম্ম ও অধর্ম্মকে অপেক্ষা করিয়া বিষম সৃষ্টি হইয়া থাকে, এইহেতু ইহা ঈশ্বরের অপরাধ নহে।
ঈশ্বরকে কিন্তু পর্জ্জন্যের (মেঘের) ন্যায় অবগত হইতে হইবে। দেখ, যেমন ধান্য ও যবাদির উৎপত্তিতে মেঘ সাধারণ কারণ, কিন্তু এইটী ধান্য, এইটী যব, এইপ্রকারে ধান্য ও যবাদিগত বিভিন্নতাতে তত্তৎ বীজগত অসাধারণ শক্তি সকলই কারণ হইয়া থাকে; এইপ্রকারে দেবতা ও মনুষ্য প্রভৃতির সৃষ্টিতে ঈশ্বর হন সাধারণ কারণ। দেবতা ও মনুষ্যাদির বিভিন্নতাতে কিন্তু তত্তৎ জীবগত অসাধারণ কর্ম্মসকলই কারণ। এইপ্রকারে সাপেক্ষ হন বলিয়া অর্থাৎ প্রাণিগণের কর্ম্মকে অপেক্ষা করেন বলিয়া পক্ষপাতিতা ও নিষ্ঠুরতার দ্বারা ঈশ্বর দূষিত হন না।
আচ্ছা, কি প্রকারে ইহা অবগত হওয়া যায় যে, ধর্ম্ম অধর্ম্ম সাপেক্ষ ঈশ্বর (পশ্বাদি, মনুষ্য ও দেবাদিরূপ) অধম, মধ্যম ও উত্তম সংসার নির্ম্মাণ করেন? শ্রুতি সেইপ্রকারই প্রদর্শন করিতেছে-
'এষ হ্যেব সাধু কর্ম কারযতি তং যমেভ্যো লোকেভ্য উন্নিনীষত এষ উ এবাসাধু কর্ম কারযতি তং যমধো নিনীষতে'।-(কৌষিতকি ব্রাহ্মণ ৩।৮)
অর্থাৎ 'ইনিই (পূর্ব্বানুষ্ঠিত কর্ম্মের সংস্কারানুযায়ী) তাহাকে অর্থাৎ সেই মনুষ্যকে সাধু কর্ম্ম করান, যাহাকে এই লোক হইতে উর্ধ্বে অর্থাৎ স্বর্গে লইয়া যাইতে ইচ্ছা করেন, ইনিই (পূর্ব্বানুষ্ঠিত কর্ম্মের সংস্কারানুযায়ী) তাহাকে অসাধু কর্ম্ম করান, যাহাকে নিম্নে অর্থাৎ পশ্বাদি যোনিতে লইয়া যাইতে ইচ্ছা করেন।'
আবার শ্রুতিতে অন্যত্র বর্ণিত আছে-'পুণ্যো বৈ পুণ্যেন কর্মণা ভবতি পাপঃ পাপেন'।-(বৃহদারণ্যক উপনষৎ-৩।২।১৩)
অর্থাৎ পুণ্য কর্ম্মের দ্বারা পুণ্যবান্ ও পাপ কর্ম্মের দ্বারা পাপী হয়।'
আবার 'যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্' -(শ্রীদ্ভগবদ্গীতা-৪।১১) অর্থাৎ 'যে, যে প্রকারে, যে প্রয়োজনে, যে ফলের অর্থী হইয়া আমাকে উপাসনা করে, তাহাকে আমি সেই ফলদানের দ্বারা অনুগৃহীত করি।'
ইত্যাদি এইজাতীয় স্মৃতিও ঈশ্বরের অনুগ্রহকারিতা ও নিগ্রহকারিতা প্রাণিগণের কর্ম্মবিশেষকে অপেক্ষা করিয়াই হইয়া থাকে, ইহা প্রদর্শন করিতেছে।
No comments:
Post a Comment