Saturday, 3 July 2021

অদ্বৈতবেদান্তে বিবর্তবাদঃ-

 


“কোন কিছু কখন কোথাও বস্তুতঃ উৎপন্ন হয়না, বিনষ্টও হয়না। জগদ্-বিবর্তরূপে একমাত্র ব্রহ্মই সদা বিরাজমান।“-(যোগবাশিষ্ঠ সার, বৈরাগ্য প্রকরণ-২৩)

কখনো কোথাও কোন বস্তু কোন প্রকারেই উৎপন্ন বা বিনাশপ্রাপ্ত হয় না, ব্রহ্মই জগদ্-বিবর্তরূপে প্রকাশমান। যেমন রজ্জুতে ত্রিকালেও সর্পাদি নাই, তথাপি রজ্জুতে সর্প উৎপন্ন হয় এবং বিনষ্ট হয়, ভ্রমবশতঃ এইরূপ মনে হয়, সংসারও তদ্রূপ। অদ্বৈতবেদান্তে বিবর্তবাদই মুখ্য-ইহাই অভিপ্রায়।

'সংক্ষেপ-শারীরক'কার সর্বজ্ঞাত্ম মুনি চারটি বাদের কথা উল্লেখ করিয়াছেন, যথা-"আরম্ভবাদ কণাদ বা বৈশেষিকপক্ষ, সংঘাতবাদ সুগতপক্ষ, পরিনামবাদ সাংখ্যাদিপক্ষ এবং বিবর্তবাদ বেদান্তপক্ষ।"

-(সংক্ষেপ শারীরকম্-২।৬৩)

আরম্ভবাদঃ- বহুমৃৎকণিকা সংযোগে পূর্বে অবিদ্যমান ঘটের উৎপত্তির ন্যায় বহু অণুর সংযোগে পূর্বে অবিদ্যমান জগতের উৎপত্তি হয় ইহাই ন্যায় বৈশেষিক শাস্ত্র-কথিত 'আরম্ভবাদ' ।

সংঘাতবাদঃ- সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক বৌদ্ধ ঘটাদি কার্যকে পরমাণু-সংঘাত মাত্র মানিয়া থাকেন, উহা ভিন্ন বস্ত্বন্তর স্বীকার করেন না ইহাই 'সংঘাতবাদ'।

পরিণামবাদঃ- একই বস্তুর পূর্বাবস্থা ত্যাগপূর্বক সমসত্তা-বিশিষ্ট অবস্থান্তর প্রাপ্তির নাম পরিণাম। দধিরূপে দুগ্ধের পরিণামের ন্যায় প্রকৃতি বা মায়ার জগদাকারে পরিণাম ইহাই সাংখ্যশাস্ত্রসম্মত 'পরিণামবাদ'।

বিবর্তবাদঃ- উপাদানের বিষমসত্তাবিশিষ্ট কার্যাপত্তির নাম 'বিবর্ত'। যেমন রজ্জুরূপে স্থিত বস্তুর ভ্রান্তিবশতঃ সর্পরূপে প্রতীতির নাম 'বিবর্ত'। এখানে রজ্জুর ব্যাবহারিক সর্পের প্রতিভাসিক সত্তা বলিয়া উহারা বিষম-সত্তাবিশিষ্ট। অতএব বস্তু ( এখানে রজ্জু ) স্বরূপ পরিত্যাগ না করিয়াই দোষবশতঃ অন্যরূপে প্রতীত হইতেছে ইহাই অদ্বৈতবেদান্তসম্মত 'বিবর্তবাদ'। মায়াবশেই নির্বিকার ব্রহ্মে জগৎ প্রতীতি হইয়া থাকে। ব্রহ্মবিবর্ত জগৎ ব্রহ্মভিন্ন নহে। অতএব এক ব্রহ্মই সদা বিরাজমান রহিয়াছেন। বিবর্তবাদে কার্য একটি মিথ্যা প্রতীত মাত্র; কার্য বস্তুতঃ কোন কালে হয়ই নাই। ইহাকেই 'অজাতবাদ' বলা হয়। বিবর্তবাদই অজাতবাদে পর্যবসিত হয়।

সুরেশ্বরাচার্য শিষ্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনি আর বলিতেছেন-"শ্রুতি ও সূত্রকার পূর্বভূমি (পরিনামবাদ) 'আপাততঃ' অবলম্বন করিয়া বিবর্তবাদ প্রতিপাদন করিবার জন্য ঐ পরিণামবাদের কথা কোথাও কোথাও বলিয়াছেন।"

-(সংক্ষেপ শারীরকম্-২।৬১,৬৪)

এই এই বাদগুলির মধ্যে আরম্ভবাদ ও সংঘাতবাদ শ্রৌততত্ত্ব প্রতিপত্তির প্রতিকূল বলিয়া উপেক্ষণীয়। অবশিষ্ট পরিণাম ও বিবর্তবাদ উহার অনুকূল। এই দুইটি বাদ পূর্বোত্তরভূমি রূপে

সোপানারোহন-ন্যায়-ক্রমে সমন্বিত। এই ক্রমানুসারে ব্রহ্মসূত্রকার ভগবান বাদরায়ণ "ভোক্ত্রাপত্তেরবিভাগশ্চেত্স্যাল্লোকবৎ"-(ব্রহ্মসূত্র-২.১.১৩) সূত্রে পরিণামবাদ প্রতিপাদন করিয়া তৎপর "তদনন্যত্বমারম্ভণশব্দাদিভ্যঃ"-(ব্রহ্মসূত্র-২.১.১৪) সূত্রে বিবর্তবাদ প্রতিপাদন করিয়াছেন। ব্রহ্মেজগৎকারণতা সিদ্ধির উদ্দেশ্যে কার্যকারণভাব প্রতিপালন অত্যাবশক। সেইজন্যই পরিণামবাদের অবতারণা। পুনঃ পরিণামবাদ দ্বারা প্রসক্ত কূটস্থ ব্রহ্মগত পরিণামিতা সর্বদা অনুপপন্ন বলিয়া বিবর্তবাদ স্বয়ংই আসিয়া পড়ে। এইরূপে পরিণামবাদ বিবর্তবাদে পর্যবসিত হয়। তাই পূজ্যপাদ সর্বজ্ঞাত্ম মুনি বলিতেছেন-

"মন্দবুদ্ধি পুরুষের নিকট পরিণামবাদ উপাদেয় হইয়া থাকে, বিশুদ্ধান্তঃকরণ ভাগ্যবান পুরুষই সাদরে বিবর্তবাদের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া থাকেন।"

-(সংক্ষেপ শারীরকম্-২।৮৯)

No comments:

জ্ঞানবিজ্ঞানযোগ-

  শ্রীভগবানুবাচ ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্মদাশ্রয়ঃ৷ অসংশয়ং সমগ্রং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু ৷৷ ১   ‘শাঙ্করভাষ্য’   অনুস...