বিদ্যারণ্য
খৃষ্টীয় ১৩শ শতকের শেষভাগে আবির্ভূত হন এবং ১৪শ
শতকের শেষভাগে বিদেহমুক্তি লাভ করেন। বিদ্যারণ্য মুনীশ্বরকে ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের অবতার বা দ্বিতীয় শঙ্করাচার্য
বলা হয়ে থাকে। তিনি মাধবাচার্য নামেও পরিচিত। সর্বশাস্ত্রে আচার্যের ন্যায় পণ্ডিত ভারতের বুকে কমই জন্মগ্রহণ করেছেন। ইনি একাধারে অসামান্য পণ্ডিত এবং চাণক্যের ন্যায় কূটনীতি-বিশারদ ছিলেন। মাধবাচার্যই বিজয় নগর রাজ্যের সংস্থাপক। তিনি ১৩৩৫-৩৬ খৃষ্টাব্দে বিজয়নগর
রাজ্য স্থাপন করে ঐ রাজ্যের মন্ত্রীপদে
অভিষিক্ত হন; এবং ৩০ বৎসর কাল
বিজয়নগর-রাজ বীরবুক্কের মন্ত্রিপদে আসীন থেকে বিজয়নগর রাজ্য পরিচালনা করেন। তাঁর পরিচালনা-গুণে বিজয়নগর দক্ষিণ ভারতে একচ্ছত্র সাম্রাজ্যরূপে পরিণত হয়। বীরবুক্কের আদেশে তিনি কিছুকালের জন্য জয়ন্তীপুরে রাজত্ব করেছিলেন বলে জানা যায়। মাধবাচার্য তদীয় অসাধারণ রাজনৈতিক প্রতিভা-বলে দক্ষিণ ভারত হতে মুসলমান আগ্রাসন বিদূরিত করেন এবং মুসলমান সাম্রাজ্য ধ্বংস করে হিন্দু সাম্রাজ্য সংগঠন করেন।
গুরুতর
রাজকার্যের অবসরে তাঁর গ্রন্থকর্তৃ জীবন প্রস্ফুটিত হয়। বিভিন্ন শাস্ত্রে অসংখ্য গ্রন্থমালা রচনা করে মাধব ভারতীর পাদপীঠ সুষমা-মণ্ডিত করেছেন। এরূপ প্রতিভা কদাচিৎ দৃষ্ট হয়। কূটনীতিবিৎ, অক্লান্তকর্মা মাধবাচার্য পরিণত বয়সে সন্ন্যাস অবলম্বন করেন এবং দক্ষিণাম্নায় শৃঙ্গেরী শারদা পীঠের মঠাধীশ হয়ে শেষ জীবন যাপন করেন। এরূপ জীবনও বড় দেখা যায় না। যিনি রাজনৈতিক চূড়ামণি, তিনিই আবার সন্ন্যাসীর অগ্রণী, অক্লান্তকর্মা অথচ সর্বকর্ম-সন্ন্যাসী মুনীশ্বর। আচার্য শঙ্করানন্দ বিদ্যারণ্যের সন্ন্যাস গুরু ছিলেন। বিবরণ-প্রমেয়-সংগ্রহের প্রারম্ভে গুরু শঙ্করানন্দের পাদপদ্মে তাঁর প্রণতি জানিয়েছেন এবং ঐ গ্রন্থের সমাপ্তিতে
তিনি বিদ্যাতীর্থ পরমগুরুর পাদপদ্মে গ্রন্থার্পণ করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। শৃঙ্গেরি পীঠাধীশ আচার্য বিদ্যা তীর্থ শঙ্করানন্দ ও ভারতী তীর্থের
গুরু ছিলেন।
জৈমিনীয়-ন্যায়মালা-বিস্তরে বিদ্যারণ্য ভারতীতীর্থকেও গুরু বলে সম্বোধন করেছেন। শঙ্করানন্দ ও ভারতী তীর্থ
উভয়েই বিদ্যারণ্যের শিক্ষক ছিলেন। বিদ্যাতীর্থের দেহান্তের পর মাধব ভারতীতীর্থের
নিকট বিদ্যালাভ করেন এবং পরিণত জীবনে শঙ্করানন্দের নিকট সন্ন্যাস দীক্ষা গ্রহণ করেন। ১৩৮০ থেকে ১৩৮৬ পর্যন্ত শ্রী বিদ্যারণ্য মুনীশ্বর শৃঙ্গেরী শারদা পীঠের মঠাধীশ ছিলেন। তাঁর সময়কালে শৃঙ্গেরী একটি আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। দ্বৈতবাদী মধ্বাচার্যের শিষ্য অক্ষোভ্য মুনি খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতকে বিদ্যারণ্য স্বামীকে বাদযুদ্ধে আহ্বান করেন। মহামতি বেদান্তদেশিকাচার্য উক্ত বিচারে মধ্যস্থের কার্য করেছিলেন বলে শুনা যায়। বিদ্যারণ্য বিচারে বিজয়-মাল্যের অধিকারী হন—"অক্ষোভ্যং ক্ষোভয়ামাস বিদ্যারণ্যো মহামুনিঃ।" মধ্বমতাবলাম্বীরা যদিও এটা স্বীকার করেন না।
মাধবাচার্য
আর মধ্বাচার্য দুইজন কিন্তু আলাদা ব্যক্তি, তাই পাঠকের মনে যাতে কোন সংশয় না হয়। মাধবাচার্য
বা বিদ্যারণ্য মুনীর পরিচয়টা জানা যাক এবার। মাধব তৎকৃত "পরাশর-মাধবের" প্রারম্ভে নিজ পরিচয় প্রদান করেছেন। ঐ পরিচয়মূলে জানা
যায় যে, তাঁর পিতার নাম মায়ন আর মাতার নাম
শ্রীমতী, এবং প্রসিদ্ধ বেদ-ভাষ্যকার সায়নাচার্য এবং ভোগনাথ নামে মাধবের দুই সহোদর ছিল। বোধায়ন-সূত্রসেবী সায়ন মাধব যজুঃশাখীয় ব্রাহ্মণ কুলে ভরদ্বাজ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন।
বিদ্যারণ্য
মুনীশ্বর দর্শন, স্মৃতি, জ্যোতিষ, ব্যাকরণ প্রভৃতি বিভিন্ন শাস্ত্রেই গ্রন্থরাজি রচনা করে তাঁর বাণী পূজা সাফল্য-মণ্ডিত করেছেন। শঙ্কর বেদান্তের ব্যাখ্যায় তিনি বিবরণ মত অনুসরণ করেছেন।
প্রকাশাত্ম যতির পঞ্চপাদিকা-বিবরণের বিশ্লেষণে তিনি বিবরণপ্রমেয়-সংগ্রহ রচনা করেছেন। বিদ্যারণ্যের "পঞ্চদশী" অদ্বৈতবেদান্তের কয়েকটি কালজয়ী গ্রন্থের মধ্যে একটি। তাছাড়া জীবন্মুক্তি-বিবেক, অনুভূতি-প্রকাশ, শঙ্করাচার্যের অপরোক্ষানুভূতির উপর টীকা, সূতসংহিতার টীকা, ঐতরেয় উপনিষদ্-দীপিকা, তৈত্তিরীয় উপনিষদ্দীপিকা, ছান্দোগ্যোপনিষদ্দীপিকা, বৃহদারণ্যক-বার্তিকসার, আর ভগবান শঙ্করাচার্যের
জীবনলীলা বিষয়ক প্রামাণিক গ্রন্থ শঙ্কর-বিজয় বিদ্যারণ্যের অক্ষয় কীর্তি। তাঁর সর্বদর্শন সংগ্রহ বিভিন্ন দার্শনিক মতের অপূর্ব সার সংকলন। মীমাংসা দর্শনে তিনি জৈমিনীয়-ন্যায়মালা-বিস্তর রচনা করে পূর্বমীমাংসার অধিকরণগুলোর আলোচনার পথ সুগম করে
দিয়েছেন। ব্যাকরণে তিনি মাধবীয় ধাতুবৃত্তি রচনা করেছেন। স্মৃতিতে তিনি পরাশর-মাধব নামে পরাশর সংহিতার ব্যাখ্যা রচনা করেন। মাধবাচার্যের কালমাধব স্মৃতিশাস্ত্রের অন্যতম প্রামাণিক সংগ্রহ গ্রন্থ। প্রসিদ্ধ স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন ভট্টাচার্যও স্বীয় মতের সমর্থনে কাল-মাধবের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। জ্যোতিঃশাস্ত্রে বিদ্যারণ্যের কীর্তি অতুলনীয়। তিনি বিদ্যাশঙ্করের যে সমাধি মন্দির
রচনা করেছিলেন, ঐ মন্দিরের গাত্রে
প্রভাত সূর্যের অরুণালোক-পাত দেখে মাস, তিথি প্রভৃতি নির্ণয় করা যায়। এটা জ্যোতিঃশাস্ত্রে তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব ও উদ্ভাবনী শক্তির
পরিচায়ক।......
তথ্যসূত্রঃ-
১.
বেদান্তদর্শন—অদ্বৈতবাদ, আশুতোষ শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি।
২.
https://sringeri.net/jagadgurus
শ্রীশুভ
চৌধুরী
ডিসেম্বর
৩০, ২০২৩ খৃষ্টাব্দ।