Sunday, 31 December 2023

আচার্য চিদ্বিলাস বা অদ্বৈতানন্দ বোধেন্দ্র—

 


শ্রীহর্ষ প্রকটার্থ বিবরণকারের সমসাময়িক কালেই আনুমানিক খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতকে শ্রীমদ্অদ্বৈতানন্দ বোধেন্দ্র সরস্বতী আবির্ভূত হন। তিনি চিদ্বিলাস নামেও পরিচিত। ১১৬৬-১২০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কাঞ্চীকামকোটি সর্বজ্ঞ পীঠের মঠাধীশ ছিলেন। শ্রীহর্ষের বৃদ্ধ বয়সে তিনি প্রবল হয়ে উঠেন। প্রবাদ আছেইনি না কি শ্রীহর্ষকেও তর্কশাস্ত্রবিচারে পরাজিত করেছিলেন। তাছাড়া অভিনব গুপ্ত নামক একজন প্রসিদ্ধ তান্ত্রিককেও তিনি বিচারে পরাজিত করেছিলেন বলে জানা যায়। পরমতখণ্ডনে যেমন শ্রীহর্ষ, স্বমতস্থাপনে তদ্রূপ অদ্বৈতানন্দ অদ্বিতীয় হন। ইনি শাঙ্করভাষ্যের উপর "ব্রহ্মবিদ্যাভরণ" নামক এক অতি অপূর্ব টীকা রচনা করে ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ভাষ্যধারার বিশেষ পুষ্টি সাধন করেছিলেন। এতদ্ব্যতীত শান্তিবিবরণ গুরুপ্রদীপ গ্রন্থও ইনি রচনা করেন।

তাঁর পিতার নাম প্রেমেশ। দক্ষিণ ভারতের পিণাকিনী নদীর তীরে একটি গ্রামে আচার্য প্রকট হন। পূর্বাশ্রমে তাঁর নাম ছিল সীতাপতি। তিনি প্রায়শই চিদাম্বরমে আদি আচার্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মুক্তি লিঙ্গের পূজার্চনা করতেন। শিবস্বরূপ আচার্য তখন সর্বকর্ম বিস্মৃত হয়ে পরমানন্দে বিলীন হতেন। অবশেষে, চিদাম্বরমে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা দশমীতে চিদাকাশে দীপ্তিময় দেহ বিলীন করে তিনি বিদেহমুক্তি লাভ করেন।

তথ্যসূত্রঃ-

. শ্রীযোগেন্দ্রনাথ তর্কসাংখ্যবেদান্ততীর্থ অনুবাদিত "অদ্বৈতসিদ্ধিঃ" গ্রন্থের ভূমিকা।

. https://www.kamakoti.org/peeth/origin.html

শ্রীশুভ চৌধুরী

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ খৃষ্টাব্দ।

আচার্য বিদ্যারণ্য মুনীশ্বর—

 


বিদ্যারণ্য খৃষ্টীয় ১৩শ শতকের শেষভাগে আবির্ভূত হন এবং ১৪শ শতকের শেষভাগে বিদেহমুক্তি লাভ করেন। বিদ্যারণ্য মুনীশ্বরকে ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের অবতার বা দ্বিতীয় শঙ্করাচার্য বলা হয়ে থাকে। তিনি মাধবাচার্য নামেও পরিচিত। সর্বশাস্ত্রে আচার্যের ন্যায় পণ্ডিত ভারতের বুকে কমই জন্মগ্রহণ করেছেন। ইনি একাধারে অসামান্য পণ্ডিত এবং চাণক্যের ন্যায় কূটনীতি-বিশারদ ছিলেন। মাধবাচার্যই বিজয় নগর রাজ্যের সংস্থাপক। তিনি ১৩৩৫-৩৬ খৃষ্টাব্দে বিজয়নগর রাজ্য স্থাপন করে রাজ্যের মন্ত্রীপদে অভিষিক্ত হন; এবং ৩০ বৎসর কাল বিজয়নগর-রাজ বীরবুক্কের মন্ত্রিপদে আসীন থেকে বিজয়নগর রাজ্য পরিচালনা করেন। তাঁর পরিচালনা-গুণে বিজয়নগর দক্ষিণ ভারতে একচ্ছত্র সাম্রাজ্যরূপে পরিণত হয়। বীরবুক্কের আদেশে তিনি কিছুকালের জন্য জয়ন্তীপুরে রাজত্ব করেছিলেন বলে জানা যায়। মাধবাচার্য তদীয় অসাধারণ রাজনৈতিক প্রতিভা-বলে দক্ষিণ ভারত হতে মুসলমান আগ্রাসন বিদূরিত করেন এবং মুসলমান সাম্রাজ্য ধ্বংস করে হিন্দু সাম্রাজ্য সংগঠন করেন।

গুরুতর রাজকার্যের অবসরে তাঁর গ্রন্থকর্তৃ জীবন প্রস্ফুটিত হয়। বিভিন্ন শাস্ত্রে অসংখ্য গ্রন্থমালা রচনা করে মাধব ভারতীর পাদপীঠ সুষমা-মণ্ডিত করেছেন। এরূপ প্রতিভা কদাচিৎ দৃষ্ট হয়। কূটনীতিবিৎ, অক্লান্তকর্মা মাধবাচার্য পরিণত বয়সে সন্ন্যাস অবলম্বন করেন এবং দক্ষিণাম্নায় শৃঙ্গেরী শারদা পীঠের মঠাধীশ হয়ে শেষ জীবন যাপন করেন। এরূপ জীবনও বড় দেখা যায় না। যিনি রাজনৈতিক চূড়ামণি, তিনিই আবার সন্ন্যাসীর অগ্রণী, অক্লান্তকর্মা অথচ সর্বকর্ম-সন্ন্যাসী মুনীশ্বর। আচার্য শঙ্করানন্দ বিদ্যারণ্যের সন্ন্যাস গুরু ছিলেন। বিবরণ-প্রমেয়-সংগ্রহের প্রারম্ভে গুরু শঙ্করানন্দের পাদপদ্মে তাঁর প্রণতি জানিয়েছেন এবং গ্রন্থের সমাপ্তিতে তিনি বিদ্যাতীর্থ পরমগুরুর পাদপদ্মে গ্রন্থার্পণ করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। শৃঙ্গেরি পীঠাধীশ আচার্য বিদ্যা তীর্থ শঙ্করানন্দ ভারতী তীর্থের গুরু ছিলেন।

জৈমিনীয়-ন্যায়মালা-বিস্তরে বিদ্যারণ্য ভারতীতীর্থকেও গুরু বলে সম্বোধন করেছেন। শঙ্করানন্দ ভারতী তীর্থ উভয়েই বিদ্যারণ্যের শিক্ষক ছিলেন। বিদ্যাতীর্থের দেহান্তের পর মাধব ভারতীতীর্থের নিকট বিদ্যালাভ করেন এবং পরিণত জীবনে শঙ্করানন্দের নিকট সন্ন্যাস দীক্ষা গ্রহণ করেন। ১৩৮০ থেকে ১৩৮৬ পর্যন্ত শ্রী বিদ্যারণ্য মুনীশ্বর শৃঙ্গেরী শারদা পীঠের মঠাধীশ ছিলেন। তাঁর সময়কালে শৃঙ্গেরী একটি আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। দ্বৈতবাদী মধ্বাচার্যের শিষ্য অক্ষোভ্য মুনি খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতকে বিদ্যারণ্য স্বামীকে বাদযুদ্ধে আহ্বান করেন। মহামতি বেদান্তদেশিকাচার্য উক্ত বিচারে মধ্যস্থের কার্য করেছিলেন বলে শুনা যায়। বিদ্যারণ্য বিচারে বিজয়-মাল্যের অধিকারী হন—"অক্ষোভ্যং ক্ষোভয়ামাস বিদ্যারণ্যো মহামুনিঃ।" মধ্বমতাবলাম্বীরা যদিও এটা স্বীকার করেন না।

মাধবাচার্য আর মধ্বাচার্য দুইজন কিন্তু আলাদা ব্যক্তি, তাই পাঠকের মনে যাতে কোন সংশয় না হয়। মাধবাচার্য বা বিদ্যারণ্য মুনীর পরিচয়টা জানা যাক এবার। মাধব তৎকৃত "পরাশর-মাধবের" প্রারম্ভে নিজ পরিচয় প্রদান করেছেন। পরিচয়মূলে জানা যায় যে, তাঁর পিতার নাম মায়ন আর মাতার নাম শ্রীমতী, এবং প্রসিদ্ধ বেদ-ভাষ্যকার সায়নাচার্য এবং ভোগনাথ নামে মাধবের দুই সহোদর ছিল। বোধায়ন-সূত্রসেবী সায়ন মাধব যজুঃশাখীয় ব্রাহ্মণ কুলে ভরদ্বাজ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন।

বিদ্যারণ্য মুনীশ্বর দর্শন, স্মৃতি, জ্যোতিষ, ব্যাকরণ প্রভৃতি বিভিন্ন শাস্ত্রেই গ্রন্থরাজি রচনা করে তাঁর বাণী পূজা সাফল্য-মণ্ডিত করেছেন। শঙ্কর বেদান্তের ব্যাখ্যায় তিনি বিবরণ মত অনুসরণ করেছেন। প্রকাশাত্ম যতির পঞ্চপাদিকা-বিবরণের বিশ্লেষণে তিনি বিবরণপ্রমেয়-সংগ্রহ রচনা করেছেন। বিদ্যারণ্যের "পঞ্চদশী" অদ্বৈতবেদান্তের কয়েকটি কালজয়ী গ্রন্থের মধ্যে একটি। তাছাড়া জীবন্মুক্তি-বিবেক, অনুভূতি-প্রকাশ, শঙ্করাচার্যের অপরোক্ষানুভূতির উপর টীকা, সূতসংহিতার টীকা, ঐতরেয় উপনিষদ্-দীপিকা, তৈত্তিরীয় উপনিষদ্দীপিকা, ছান্দোগ্যোপনিষদ্দীপিকা, বৃহদারণ্যক-বার্তিকসার, আর ভগবান শঙ্করাচার্যের জীবনলীলা বিষয়ক প্রামাণিক গ্রন্থ শঙ্কর-বিজয় বিদ্যারণ্যের অক্ষয় কীর্তি। তাঁর সর্বদর্শন সংগ্রহ বিভিন্ন দার্শনিক মতের অপূর্ব সার সংকলন। মীমাংসা দর্শনে তিনি জৈমিনীয়-ন্যায়মালা-বিস্তর রচনা করে পূর্বমীমাংসার অধিকরণগুলোর আলোচনার পথ সুগম করে দিয়েছেন। ব্যাকরণে তিনি মাধবীয় ধাতুবৃত্তি রচনা করেছেন। স্মৃতিতে তিনি পরাশর-মাধব নামে পরাশর সংহিতার ব্যাখ্যা রচনা করেন। মাধবাচার্যের কালমাধব স্মৃতিশাস্ত্রের অন্যতম প্রামাণিক সংগ্রহ গ্রন্থ। প্রসিদ্ধ স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন ভট্টাচার্যও স্বীয় মতের সমর্থনে কাল-মাধবের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। জ্যোতিঃশাস্ত্রে বিদ্যারণ্যের কীর্তি অতুলনীয়। তিনি বিদ্যাশঙ্করের যে সমাধি মন্দির রচনা করেছিলেন, মন্দিরের গাত্রে প্রভাত সূর্যের অরুণালোক-পাত দেখে মাস, তিথি প্রভৃতি নির্ণয় করা যায়। এটা জ্যোতিঃশাস্ত্রে তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব উদ্ভাবনী শক্তির পরিচায়ক।......

তথ্যসূত্রঃ-

. বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ, আশুতোষ শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি।

. https://sringeri.net/jagadgurus

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ৩০, ২০২৩ খৃষ্টাব্দ।

আচার্য শঙ্করানন্দ—

 


খৃষ্টীয় ১৩শশতকে আচার্য শঙ্করানন্দ আবির্ভূত হন। শঙ্করানন্দ বিদ্যারণ্যের গুরু ছিলেন। বিদ্যারণ্য তৎকৃত পঞ্চদশী বিবরণ-প্রমেয়-সংগ্রহের প্রারম্ভে গুরু শঙ্করানন্দের পাদপদ্মে তাঁর প্রণতি জানিয়েছেন। শঙ্করানন্দ (শঙ্করানন্দেন্দ্র সরস্বতী) কাঞ্চীকামকোটি সর্বজ্ঞ পীঠে ১৩৮৫-১৪১৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত মঠাধীশ ছিলেন বলে জানা যায়। আবার অনেকের মতে তিনি শৃঙ্গেরি শারদা পীঠের মঠাধীশ ছিলেন, কিন্তু শৃঙ্গেরির প্রচলিত পরম্পরায় আচার্যের নাম উল্লেখ নেই। পূর্বাশ্রমে আচার্যের নাম ছিল মহেশ, জন্মস্থান ভারতের মধ্যার্জুনে, পিতার নাম বালচন্দ্র। তাঁর গুরু ছিলেন তৎকালীন শৃঙ্গেরি মঠাধীশ আচার্য বিদ্যাতীর্থ। তাঁর গুরুর সাথে শঙ্করানন্দ কর্ণাটক অঞ্চলে সনাতন ধর্ম অদ্বৈতবেদান্তের পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন। শঙ্করানন্দই কর্ণাটকে আটটি অদ্বৈত মঠ প্রতিষ্ঠায় প্রধানত ভূমিকা রেখেছিলেন। এরপরে তিনি হিমালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হন এবং গুরুসেবায় মনোনিবেশ করেন, যিনি তথায় ১৫ বৎসর ধরে সিদ্ধির জন্য তপস্যা করছিলেন। গুরুর সিদ্ধির পর কাঞ্চীতে ফিরে এসে তিনি পীঠের আচার্য হিসেবে পুনরায় দায়িত্ব পালন শুরু করেন।

শঙ্করানন্দ একাধারে অসামান্য পণ্ডিত সাধক ছিলেন। দ্বৈতবাদী মধ্বাচার্য তিনবার শঙ্করানন্দের সাথে বিচার করে পরাজিত হন বলে শুনা যায়। এটা হতেই শঙ্করানন্দের অলৌকিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর "ব্রহ্ম-সূত্র-দীপিকা" ব্রহ্মসূত্রের শঙ্কর ভাষ্যানুসারী অতি সরল প্রাঞ্জল টীকা। দীপিকাকে ব্রহ্মসূত্রের বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করা যায়। শঙ্করানন্দের ভগবদ্গীতা টীকাও অতি মনোরম। তিনি ১০৮ খানা উপনিষদের উপর বৃত্তি রচনা করে ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ভাষ্য ধারার পুষ্টি সাধন করেছেন। এতদ্ব্যতীত তিনি আত্মপুরাণ নামে এক অতি উপাদেয় গ্রন্থ রচনা করে অদ্বৈতবাদের যাবতীয় সিদ্ধান্ত, শ্রুতির রহস্য এবং যোগবিদ্যা প্রভৃতি সাধক জীবনের বহু জ্ঞাতব্য বিষয় উক্ত পুরাণে সন্নিবেশ করেন। শঙ্করানন্দের আত্মপুরাণ আত্ম-জিজ্ঞাসুর অমুল্য রত্ন। আচার্য শঙ্করানন্দই মধ্বাচার্যের আক্রমণ প্রতিহত করে অদ্বৈতবেদান্তের বিজয় গৌরব অক্ষুণ্ন রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।....

তথ্যসূত্রঃ-

. বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ, প্রথম খণ্ড, আশুতোষ শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ বিদ্যাবাচস্পতি।

. https://www.kamakoti.org/peeth/origin.html

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩ খৃষ্টাব্দ।

আচার্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনি

 



ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের পর শঙ্করোক্ত অদ্বৈতবাদকে যারা পরিপূর্ণ রূপ দান করেছেন তাঁদের মধ্যে আচার্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনির নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এই সকল ধুরন্ধর দার্শনিকগণের পাণ্ডিত্য প্রতিভার অমল জ্যোতিতে শঙ্করবেদান্তের উৎকর্ষতা বিকশিত হয়েছে। সর্বজ্ঞাত্ম মুনি কাঞ্চীকামকোটি সর্বজ্ঞ পীঠের মঠাধীশ ছিলেন। কাঞ্চীপীঠের মতানুসারে আচার্যের সময়কাল ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ (মতান্তরে খৃষ্টীয় অষ্টম শতক)। ভারতের ব্রহ্মদেশম্, তাম্রপর্ণি নদীর তীরে তিরুনেলভেলির কাছে একটি গ্রামে আচার্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনির আবির্ভাব। আচার্যের পিতার নাম বর্ধন। পূর্বাশ্রমে সর্বজ্ঞাত্ম মুনির নাম ছিল মহাদেব।

ইনি ব্রহ্মসূত্র শাঙ্করভাষ্যের উপর "সংক্ষেপ-শারীরক" নামে একখানা অতি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করে শঙ্করের ভাবধারার বিশেষ পুষ্টি সাধন করেন। সংক্ষেপ-শারীরকের সমাপ্তি শ্লোকে সর্বজ্ঞাত্ম মুনি দেবেশ্বরের শিষ্য বলে নিজের পরিচয় প্রদান করেছেন। টীকাকার রামতীর্থ দেবশব্দ সুরশব্দের অর্থ অভিন্ন বলে দেবেশ্বরাচার্য শব্দে সুরেশ্বরাচার্যকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ সর্বজ্ঞাত্ম মুনি ভগবৎপাদ্ শঙ্করের সাক্ষাৎ শিষ্য সুরেশ্বরাচার্যের শিষ্য। তিনি বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। আচার্যের সন্ন্যাস নাম সর্বজ্ঞাত্মেন্দ্র সরস্বতী। তিনি দীর্ঘ ১১২ বছর কাঞ্চী সর্বজ্ঞ পীঠের শঙ্করাচার্য পদে আসীন ছিলেন। কাঞ্চীপীঠের প্রবাদ অনুসারে তিনি ৩৬৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বৈশাখ কৃষ্ণ চতুর্দশীতে বিদেহ মুক্তি লাভ করেন।

সর্বজ্ঞাত্মমুনি-কৃত সংক্ষেপ-শারীরক নামে সংক্ষেপ হলেও এটা সুবিশাল গ্রন্থ। এই গ্রন্থে শঙ্কর-বেদান্তের রহস্য অপূর্ব মনীষার সাথে ব্যাখ্যাত হয়েছে। ব্রহ্মসূত্র শারীরক-ভাষ্য যেমন চার অধ্যায়ে বিভক্ত, এই গ্রন্থও সেরূপ চতুরধ্যায়ে সমাপ্ত। শারীরকের সমন্বয়, অবিরোধ, সাধন ফল, এই চার প্রকার বিষয়-বিভাগই এই গ্রন্থে অনুসৃত হয়েছে।

এই গ্রন্থ শারীরক-ভাষ্যের বার্ত্তিকের ন্যায় শ্লোকাকারে লিখিত। এটাকে ভাষ্যের "প্রকরণবার্ত্তিক" বলা হয়ে থাকে। এটার প্রথম অধ্যায়ে ৫৬৩ শ্লোকে অদ্বয় ব্রহ্মে বেদান্তের সমন্বয় প্রদর্শিত হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ২৪৮ শ্লোকে অদ্বৈত বেদান্ত মতের সাথে অপরাপর দার্শনিক ভাবধারার এবং দ্বৈতপ্রতিপাদক প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের অবিরোধ প্রদর্শিত হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে ৩৬৫ শ্লোকে ব্রহ্ম-জ্ঞানের সাধন নির্ণীত হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে ৬৩ শ্লোকে ব্রহ্ম-বিজ্ঞানের ফল বা মুক্তি ব্যাখ্যাত হয়েছে। গ্রন্থের সাবলীল ভাষা, ভাব বিচার গ্রন্থকর্তার অপূর্ব মনীষা অসামান্য পাণ্ডিত্যের পরিচয় প্রদান করে। পরবর্তী কালে অনেক আচার্য সংক্ষেপ-শারীরকের উক্তি প্রমাণ হিসেবে উদ্ধৃত করেছেন।

সংক্ষেপ-শারীরকের উপর নৃসিংহাশ্রমের তত্ত্ববোধিনী টীকা, পুরুষোত্তম দীক্ষিতের সুবোধিনী টীকা, রাঘবানন্দের বিদ্যামৃত বর্ষিণী টীকা, মধুসূদন সরস্বতীর সার-সংগ্রহ টীকা রামতীর্থের অন্বয়ার্থ-প্রকাশিকা টীকা প্রসিদ্ধ।....

তথ্যসূত্রঃ-

1. https://www.kamakoti.org/peeth/origin.html

2."বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ আশুতোষ শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতি।

শ্রীশুভ চৌধুরী

নভেম্বর , ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।


আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...