উত্তর হল নিমিত্ত। অনুবন্ধ আর নিমিত্ত একই কথা। আচার্য সদানন্দ যোগী তৎকৃত বেদান্তসারে বলেছেন—"অত্রানুবন্ধো নাম অধিকারিবিষয়সম্বন্ধপ্রয়োজনানি।" অর্থাৎ অধিকারী, বিষয়, সম্বন্ধ ও প্রয়োজন—এই চার প্রকার অনুবন্ধ বা নিমিত্ত প্রত্যেক শাস্ত্রেই থাকে। অভিপ্রায় এই যে, অধিকারী অর্থাৎ বুঝতে ও করতে সক্ষম, এরূপ ব্যক্তি যদি না থাকে, তবে বলা না বলা তুল্য। অতএব বক্তব্য শাস্ত্রের অধিকারী কেউ আছে কিনা, দেখা আবশ্যক। অধিকারীর ন্যায় শাস্ত্রের বিষয় থাকাও আবশ্যক, তা না থাকলে আত্মহিতেচ্ছু লোকের তাতে প্রবৃত্তি হবে কেন? এবং সেই প্রতিপাদ্য বিষয় আর শাস্ত্র, এই উভয়ের পরস্পর প্রতিপাদ্য ও প্রতিপাদকরূপ সম্বন্ধ থাকাও আবশ্যক; নচেৎ সেই অসম্বন্ধ প্রলাপে কি ফল? শুধু অধিকারী, বিষয় ও সম্বন্ধ থাকলে হবে না, প্রয়োজন থাকাও আবশ্যক। কারণ বিনা প্রয়োজনে কেউই কোন কার্যে প্রবৃত্ত হয় না। এই জন্য প্রত্যেকে শাস্ত্রেই উল্লেখিত চারপ্রকার অনুবন্ধ থাকে, বেদান্তশাস্ত্রেও এই অনুবন্ধ চতুষ্ঠয় রয়েছে।
এখন
জিজ্ঞাস্য এই যে বেদান্ত
বিদ্যা-লাভের অধিকারী কে? এটার উত্তরে ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য বলেছেন—১.নিত্যানিত্যবস্তুবিবেক, ২.ইহামুত্রফলভোগবিরাগ, ৩.শমদমাদি
সাধনসম্পৎ এবং ৪.মুমুক্ষুত্ব। এই
চতুর্বিধ সাধন যিনি আয়ত্ত করতে সমর্থ হন তিনিই বেদান্ত
শ্রবণের যথার্থ অধিকারী।
১.
নিত্যানিত্যবস্তু-বিবেকঃ-একমাত্র ব্রহ্মই নিত্য ও সত্য এবং
জগৎপ্রপঞ্চ অনিত্য ও মিথ্যা এই
ধারণায় দৃঢ় প্রত্যয় হওয়াকেই নিত্য-অনিত্য-বস্তু-বিবেক বলে।
২.
ইহামুত্রফলভোগবিরাগঃ-নিজের দেহ থেকে আরম্ভ করে ব্রহ্মার দেহ-পর্যন্ত সমস্ত অনিত্য ভোগের সামগ্রীর দোষ-দর্শন ও সেসবের দোষের
কথা শোনার ফলে ভোগ্যবস্তুতে যে অনীহা জাগে
ও সে সমস্ত ত্যাগ
করার ইচ্ছা জন্মায় তাকেই বৈরাগ্য বলা হয়।
৩.
সাধনসম্পত্তিঃ- ‘সাধনসম্পত্তি’ বলতে বোঝায় শম্, দম্, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান ও শ্রদ্ধা। প্রতি
মুহূর্তে বিষয়সমূহে দোষ দেখতে পাওয়ার ফলে বিষয়ে যে বৈরাগ্য আসে
তা থেকে মনের নিজ লক্ষ্যস্থল ব্রহ্মে নিশ্চল স্থিতি লাভ হয়, একে শম বলা হয়।
উভয় প্রকারের ইন্দ্রিয়গুলিকে (অর্থাৎ কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়কে) সমস্ত বিষয়
থেকে বিমুখ করে তাদের নিজের নিজের জায়গায় নিশ্চল ভাবে ধরে রাখাকেই দম বলে। চিত্তবৃত্তিকে
বাহ্যবিষয় অবলম্বন না করতে দেওয়াই
শ্রেষ্ঠ উপরতি। কোন রকম চিন্তাভাবনা বা বিলাপ না
করে সব রকমের দুঃখকেই
গ্রহণ করে নেওয়া এবং বিনা প্রতিকারে তাদের সহ্য করে যাওয়াকে বলে তিতিক্ষা। শাস্ত্র ও গুরুবাক্যের সত্যতায়
দৃঢ় বিশ্বাস রাখা ও অন্তরে সেই
বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করাকে জ্ঞানীরা শ্রদ্ধা বলেন। এই শ্রদ্ধার সাহায্যে
আত্মবস্তু লাভ হয়। সবসময়, সবরকম ভাবে বুদ্ধিকে শুদ্ধব্রহ্মে লগ্ন করে রাখাকে সমাধান বলে। কিন্তু বেদান্ততত্ত্ব আলোচনা করে চিত্তের যে প্রসন্নতা হয়,
তা সমাধান নয়।
৪.
মুমুক্ষুত্বঃ- অহঙ্কার থেকে আরম্ভ করে স্থূল দেহ পর্যন্ত যেসব বন্ধন সেগুলো অজ্ঞান কল্পিত। নিজের স্বরূপজ্ঞানের দ্বারা সেইসব বন্ধন থেকে মুক্তি লাভের ইচ্ছাই মুমুক্ষুতা।
অধিকারী
নির্ণয় হল, এখন এই শাস্ত্রের বিষয়
কি? "জীব-ব্রহ্মৈক্যং শুদ্ধচৈতন্যং প্রমেয়ং',এই শাস্ত্রের বিষয়
অর্থাৎ প্রধান প্রতিপাদ্য, জীব ব্রহ্মের ঐক্য। মানুষ ভ্রান্তিক্রমেই নিজেকে ব্রহ্মনামক সর্বগুণাতীত বিশুদ্ধ চৈতন্য আত্মা হতে পৃথক বলে জানে; তাদের সেই ভ্রান্তিজ্ঞান বিদূরিত হলে যে জ্ঞানময় চৈতন্যময়
প্রমেয় পদার্থ অবশিষ্ট থাকে, সেই প্রমেয় (অভ্রান্তজ্ঞানের বিষয়;— জীবব্রহ্মের ঐক্য) পদার্থ বেদান্তের বিষয়। যেহেতু তাতেই বেদান্তশাস্ত্রের তাৎপর্য।
সম্বন্ধও
আছে; যেহেতু শাস্ত্র অসম্বন্ধ কথা বলেন না। সম্বন্ধ, প্রতিপাদ্য-প্রতিপাদক বা বোধ্য-বোধক
ভাব। "তদৈক্য প্রমেয়স্য তৎপ্রতিপাদক-উপনিষৎ-প্রমাণস্য চ বোধ্য-বোধকভাব-লক্ষণঃ।" জীব ও ব্রহ্মের ঐক্যরূপ
প্রমেয় বোধ্য বিষয় এবং বেদান্ত বাক্যরাশি তার বোধক—বিষয়ের সঙ্গে এরূপ ভাবলক্ষণ সম্বন্ধ। এই বোধ্য-বোধক
সম্বন্ধকে প্রতিপাদ্য-প্রতিপাদক সম্বন্ধও বলা হয়। যেহেতু সেই ঐক্যরূপ প্রমেয়, উপনিষদাদি শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য; সেহেতু শাস্ত্রও তার প্রতিপাদক।
শাশ্বতমুক্তিই
বেদান্ত জিজ্ঞাসার একমাত্র প্রয়োজন। "তৎ ঐক্য প্রমেয়গত
অজ্ঞান-নিবৃত্তিঃ স্বস্বরূপ-আনন্দ-অবাপ্তিঃ চ", অর্থাৎ সেই জীব ও ব্রহ্মের ঐক্য
না-জানারূপ অবিদ্যার সমূলে নিবৃত্তি ও আনন্দময় ব্রহ্মস্বরূপ
প্রাপ্তিই বেদান্ত জিজ্ঞাসার প্রয়োজন। এই মুক্তি জীবব্রহ্মের
একত্ব সাক্ষাৎকারের ফলে লাভ হয়ে থাকে। জীব ও ব্রহ্মের ঐক্য
সাক্ষাৎকার হলেই জীব "অহং ব্রহ্মাস্মি" অর্থাৎ আমিই ব্রহ্ম এইরূপে বুঝে মুক্ত হয়ে থাকে, বেদান্ত-অনুশীলনের চরম প্রয়োজন সাধিত হয়। শ্রুতিতে বলা হয়েছে—
"তরতি শোকম্
আত্মবিৎ"-(ছান্দোগ্যোপনিষৎ-৭.১.৩)
আত্মজ্ঞ
ব্যক্তি শোককে অতিক্রম করেন।
"ব্রহ্ম বেদ
ব্রহ্মৈব ভবতি"-(মুণ্ডক উপনিষৎ-৩.২.৯)
যিনি
ব্রহ্মকে জানেন, তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান।......
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবান শঙ্করাচার্যের শারীরক-মীমাংসা ভাষ্য ও বিবেকচূড়ামণি।
২.
সদানন্দ যোগীন্দ্র বিরচিত বেদান্ত-সারঃ, শ্রীকালীবর বেদান্তবাগীশ কৃত অনুবাদ।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
ডিসেম্বর
২০, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment