অতীন্দ্রিয় হলেও ব্রহ্ম ভক্তি ও ধ্যানাদিগম্যঃ-

 

পূর্ববর্তী লেখায় আলোচনা করেছি পরব্রহ্ম অব্যক্ত অর্থাৎ তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নন। কিন্তু ব্রহ্মের গ্রহণ (—ব্রহ্মবিষয়ক জ্ঞান) না হলে মোক্ষ হবে না, এপ্রকার যদি বলা হয়? এই হেতু ভগবান্ সূত্রকার বাদরায়ণ বলছেন—

অপি চ সংরাধনে প্রত্যক্ষানুমানাভ্যম্।।

-(ব্রহ্মসূত্র -৩.২.২৪)

—পরন্তু ইন্দ্রিয়সকলের দ্বারা গৃহীত না হলেও এই পরমাত্মাকে সংরাধনকালে যোগিগণ দর্শন করেন, এটা প্রত্যক্ষ ও অনুমান হতে অবগত হওয়া যায়।

অর্থাৎ সমস্তপ্রপঞ্চবিবর্জিত ও অব্যক্ত এই আত্মাকে যোগিগণ সংরাধনকালে দর্শন করেন। ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য এই সংরাধনশব্দের অর্থ করেছেন— ভক্তি ধ্যান ও প্রণিধানাদির অনুষ্ঠান। প্রণিধান শব্দের অর্থ ভক্তিবিশেষ, পরমগুরু ঈশ্বরে কর্ম ও তার ফল সমর্পণ। আচ্ছা কি প্রকারে অবগত হওয়া যায় যে, সংরাধনকালে যোগিগণ পরমাত্মাকে দর্শন করেন? তদুত্তরে সূত্রকার বলছেন— প্রত্যক্ষ ও অনুমান হতে অর্থাৎ শ্রুতি ও স্মৃতি হতে এটা অবগত হওয়া যায়। সেই শ্রুতি এই —

'পরাঞ্চি খানি ব্যতৃণৎস্বযংভূস্তস্মাৎ পরাঙ্ পশ্যতি নান্তরাত্মন্৷ কশ্চিদ্ধীরঃ প্রত্যগাত্মানমৈক্ষদাবৃত্তচক্ষুরমৃতত্বমিচ্ছন্'-(কঠ উপনিষৎ-২.১.১)

"পরমেশ্বর বহির্মুখ ইন্দ্রিয়সকলকে (অনাত্মগ্রাহকরূপে সৃষ্টি করে) হিংসা করেছিলেন, সেহেতু (জীব রূপরসাদি) বহির্বিষয়সকলকেই দর্শন করে, অন্তরাত্মাকে নয়। অমৃতত্ত্বের অভিলাষী কোন কোন ধীমান্ (—বিবেকী) আবৃতচক্ষু হয়ে (—ইন্দ্রিয়সকলকে বিষয় হতে প্রত্যাহার করে) প্রত্যাগাত্মাকে দর্শন করেন", আর—

'জ্ঞানপ্রসাদেন বিশুদ্ধসত্ত্বস্ততস্তু তং পশ্যতে নিষ্কলং ধ্যায়মানঃ'-(মুণ্ডক উপনিষৎ -৩.১.৮)

"জ্ঞানপ্রসাদের দ্বারা বিশুদ্ধ অন্তঃকরণযুক্ত হন, সেহেতু ধ্যানপরায়ণ ব্যক্তি সেই নিষ্কলকে (—নিরবয়ব ব্রহ্মকে) দর্শন করেন", ইত্যাদি এ সকল শ্রুতিও আছে। আর—

'যে বিনিদ্রা জিতশ্বাসাঃ সংতুষ্টাঃ সংযতেন্দ্রিয়াঃ৷ জ্যোতিঃ পশ্যন্তি যুঞ্জানাস্তস্মৈ যোগাত্মনে নমঃ৷'-(মহাভারত, শান্তিপর্ব, ৪৭/৫৪)

"বিনিদ্র (—তমোগুণরহিত), জিতশ্বাস (—প্রাণায়ামপরায়ণ), সন্তুষ্ট এবং সংযতেন্দ্রিয় ধ্যানশীল ব্যক্তিগণ যাঁকে জ্যোতিঃরূপে দর্শন করেন; সেই যোগাত্মাকে (—যোগলভ্য পরমাত্মাকে) নমস্কার করি। ইত্যাদি এই সকল স্মৃতিও আছে।.....

তথ্যসূত্রঃ-

১.ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের শারীরক-মীমাংসা ভাষ্য।

২.পাতঞ্জল যোগদর্শন, ব্যাসভাষ্য।

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ৮, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।