Wednesday, 20 December 2023

ব্রহ্মসূত্র শাঙ্করভাষ্য ও তদনুযায়ী বিরচিত অন্যান্য টীকা সমূহের পরিচয়ঃ-

 


বেদান্তদর্শনের চিন্তারাজ্যে ভগবান শঙ্করাচার্য অবিসংবাদী সম্রাট। ব্রহ্মসূত্রের প্রাচীনতম ভাষ্যগুলোর মধ্যে যুক্তির দৃঢ়তায়, ভাবের গভীরতায় এবং চিন্তার সাবলীলগতিতে শাঙ্করভাষ্য যে অতি উচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছে, বিষয়ে সুধীগণের কোন মতদ্বৈধ নাই। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য অদ্বৈতবেদান্ত সিদ্ধান্তকে পরিপূর্ণ রূপ দান করিবার জন্য ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন।  পরবর্ত্তীকালে শারীরক-মীমাংসা-ভাষ্যকে অবলম্বন করিয়াও বহু গবেষণাপূর্ণ গ্রন্থ রচিত হইয়াছে, তন্মধ্যে শঙ্করের সাক্ষাৎ শিষ্য পদ্মপাদাচার্যের পঞ্চপাদিকার নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। পঞ্চপাদিকা শাঙ্কর-ভাষ্যের অপূর্ব বিশ্লেষণ। ইহা ভাষ্যের যথার্থ আলোক। আলোকসম্পাতে ভাষ্যের গূঢ় রহস্য জিজ্ঞাসুর নিকট উজ্জ্বল প্রাণস্পর্শী হইয়াছে।

খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতকে প্রকাশাত্ম যতি পদ্মপাদের পঞ্চপাদিকার উপর পঞ্চপাদিকা-বিবরণ নামে অতি উপাদেয় টীকা রচনা করেন। খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতকে আনন্দগিরির শিষ্য অখণ্ডানন্দ প্রকাশাত্মযতির পঞ্চপাদিকা বিবরণের উপর তত্ত্বদীপন নামে টীকা রচনা করেন। প্রায় ঐরূপ সময়েই বিষ্ণু ভট্টোপাধ্যায় পঞ্চপাদিকা বিবরণের উপর ঋজুবিবরণ নামে এক টীকা রচনা করেন। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতকে আচার্য নৃসিংহাশ্রম পঞ্চপাদিকা বিবরণের ভাবপ্রকাশিকা নামে টীকা প্রণয়ন করেন। পঞ্চপাদিকা বিবরণের ছায়া অবলম্বন করিয়া খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতকের মধ্য ভাগে বিদ্যারণ্য বিবরণপ্রমেয়সংগ্রহ নামে পঞ্চপাদিকার উপর এক নিবন্ধ রচনা করেন। খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতকের প্রথম ভাগে পণ্ডিত রামানন্দ সরস্বতী বিবরণের উপর বিবরণোপন্যাস নামে অপর একখানি নিবন্ধ-গ্রন্থ রচনা করেন। বিবরণোপন্যাস বিবরণপ্রমেয়সংগ্রহ এই গ্রন্থদ্বয় ঠিক টীকা নহে। টীকা না হইলেও বিবরণপ্রস্থানের বেদান্তমত এই দুইখানি গ্রন্থে যেরূপ বিশদভাবে আলোচিত ব্যাখ্যাত হইয়াছে, তাহাতে বিবরণ-মতের পরিচয়প্রসঙ্গে গ্রন্থদ্বয়ের নাম অবশ্য উল্লেখযোগ্য।

পঞ্চপাদিকায় বিবরণে চতুঃসূত্রীর ব্যাখ্যামাত্রই পাওয়া যায়। উহা ভাষ্যের পূর্ণাঙ্গ টীকা নহে। খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতকে প্রকটার্থ-বিবরণের রচয়িতা প্রকটার্থ-বিবরণ নামে সম্পূর্ণ শারীরক-মীমাংসা-ভাষ্যের উপর বিবরণমতানুসারী এক অতি উপাদেয় পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেন। প্রকাশাত্মযতির পঞ্চপাদিকা বিবরণকে গূঢ়ার্থ বিবরণ বলা হইয়া থাকে, তাহার তুলনায় প্রকটার্থ-বিবরণের রচনা ভঙ্গী সরল সহজবোধ্য বলিয়াই এই গ্রন্থকেপ্রকটার্থ বিবরণ' নামে অভিহিত করা হইয়া থাকে বলিয়া অনেক মনীষী মনে করেন। বস্তুতঃ প্রকটার্থ-বিবরণ বিবরণপ্রস্থানের অমূল্য সম্পদ।

সুরেশ্বরাচার্যের শিষ্য আচার্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনি ব্রহ্মসূত্র শাঙ্করভাষ্যের উপর "সংক্ষেপ-শারীরক" নামে একখানা অতি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করিয়া শঙ্করের ভাবধারার বিশেষ পুষ্টি সাধন করেন। এই গ্রন্থ শারীরক-ভাষ্যের বার্ত্তিকের ন্যায় শ্লোকাকারে লিখিত। এটাকে ভাষ্যের "প্রকরণবার্ত্তিক" বলা হইয়া থাকে। সংক্ষেপ-শারীরকের উপর নৃসিংহাশ্রমের তত্ত্ববোধিনী টীকা, পুরুষোত্তম দীক্ষিতের সুবোধিনী টীকা, রাঘবানন্দের বিদ্যামৃত বর্ষিণী টীকা, মধুসূদন সরস্বতীর সার-সংগ্রহ টীকা রামতীর্থের অন্বয়ার্থ-প্রকাশিকা টীকা প্রসিদ্ধ।

শাঙ্কর-ভাষ্যের রহস্য ব্যাখ্যা করিয়া খৃষ্টীয় ১৩শ শতকে অদ্বৈতানন্দ ব্রহ্মবিদ্যাভরণ রচনা করেন। ব্রহ্মবিদ্যাভরণ অতি উপাদেয় টীকা। ইহাকে শাঙ্কর-ভাষ্যের বৃত্তিরূপে গ্রহণ করা যায়। বাচস্পতি মিশ্রের ভামতী বুঝিতে হইলে, ব্রহ্মবিদ্যাভরণের সাহায্য একান্ত আবশ্যক। খৃষ্টীয় ১৪শ শতকে শঙ্করীনন্দ ব্রহ্মসূত্রদীপিকা রচনা করেন। ব্রহ্মসূত্রদীপিকায় শঙ্করানন্দ অতি সরল সরস ভাষায় শঙ্করের ভাষ্যের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন। খৃষ্টীয় পঞ্চদশ শতকে আনন্দজ্ঞান ন্যায়নির্ণয় নামে ব্রহ্মসূত্রভাষ্যের এক অতি সরস সহজবোধ্য টীকা রচনা করেন। খৃষ্টীয় ১৬শ শতকের শেষভাগে গোবিন্দানন্দ ভাষ্যরত্নপ্ৰভা নামে শারীরক-ভাষ্যের অতি অপূর্ব টীকা রচনা করেন। ভাষ্যরত্নপ্রভা বিবরণের ছায়া অবলম্বনে রচিত উপাদেয় টীকা। শতকের মধ্যভাগে অপ্যয়দীক্ষিত ন্যায়রক্ষামণি নামে ব্রহ্মসূত্রের শঙ্কর ভাষ্যানুসারী এক ব্যাখ্যাগ্রন্থ প্রণয়ন করেন।

শারীরক ভাষ্যের ভামতী টীকাও অতি প্ৰসিদ্ধ টীকা। পঞ্চপাদিকাবিবরণ হইতে যেমন বিবরণ প্রস্থানের সৃষ্টি হইয়াছে, সেইরূপ বাচস্পতিমিশ্রের ভামতী টীকা হইতে ভামতীপ্রস্থানের সৃষ্টি হইয়াছে। খৃষ্টীয় নবম শতকে বাচস্পতিমিশ্র ভামতী টীকা রচনা করেন। খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকে অমলানন্দ ভামতীর উপর বেদান্ত-কল্পতরু নামে টীকা প্রণয়ন করেন। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতকে অপ্যয়দীক্ষিত অমলানন্দের বেদান্ত-কল্পতরুর উপর বেদান্ত-কল্পতরু পরিমল নামে এক অতি বিস্তৃত বিচারবহুল টীকা প্রণয়ন করিয়া, ভামতী-মতের চরম উৎকর্ষ সাধন করেন। কল্পতরুর উপর খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতকের শেষভাগে কোণ্ডভট্টের পুত্র শ্রীমৎলক্ষ্মীনৃসিংহ আভোগ নামে এক টীকা রচনা করেন। লক্ষ্মীনৃসিংহ তদীয় টীকা রচনায় অনেক স্থলে অপ্যয়দীক্ষিতের বেদান্ত-কল্পতরু-পরিমলের প্রভাবে প্রভাবিত হইয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। এতদ্ব্যতীত ভামতীতিলক, ভামতীবিলাস, ভামতীব্যাখ্যা প্রভৃতি ভামতীর বিবিধ টীকার নাম শুনা যায়। ইহা হইতে ভামতী-মত যে অদ্বৈতবেদান্তে বিশেষ স্থান লাভ করিয়াছিল, তাহা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ভামতী মত বিবরণমতের পার্থক্য অনেকস্থলে অতি স্পষ্ট। এই উভয় মতের দৃষ্টিভঙ্গী বিশ্লেষণ করিয়া খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের প্রথম ভাগে চিৎসুখাচার্য শাঙ্কর-ভাষ্যের উপর ভাষ্য-ভাবপ্রকাশিকা নামে এক টীকা রচনা করেন।

নারায়ণ সরস্বতী শারীরক-ভাষ্যের উপর এক বিস্তৃত বার্তিক প্রণয়ন করেন। ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যের উপর ব্রহ্মানন্দ যতির ব্রহ্মসূত্রভাষ্যার্থ সংগ্রহ, বেঙ্কটের ব্রহ্মসূত্রার্থ-দীপিকা, অনুভট্টের ব্ৰহ্মসূত্রবৃত্তি জ্ঞানোত্তমের ব্রহ্মসূত্রভাষ্য-ব্যাখ্যা, ধর্মভট্টের ব্রহ্মসূত্রবৃত্তি, রামানন্দ সরস্বতীর ব্রহ্মামৃতবর্ষিণী, সদাশিবেন্দ্রের ব্রহ্মতত্ত্ব প্রকাশিকা, সুব্রহ্মণ্যের শারীরক মীমাংসাসূত্র-সিদ্ধান্তকৌমুদী, অনুভবানন্দের শারীরক-ন্যায়মণিমালা, প্ৰকাশাত্মনের শারীরক-মীমাংসান্যায়সংগ্রহ প্রভৃতি অনেক টীকার পরিচয় পাওয়া যায়। মোট কথা, এক ব্রহ্মসূত্রশারীরক-ভাষ্যকে অবলম্বন করিয়াই রাশি রাশি গ্রন্থমালার সৃষ্টি পুষ্টি হইয়াছে। শারীরক-ভাষ্যের টীকা, টীকার টীকা, তস্য টীকা এইরূপে শারীরকে ভিত্তিতে বেদান্তচিন্তার যে অভ্রভেদী সৌধ গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহা সুধীমাত্ৰেরই সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাচস্পতিমিশ্র, পদ্মপাদাচার্য, প্রকাশাত্মযতি, সর্বজ্ঞাত্মমুনি, সুরেশ্বরাচার্য প্রভৃতি ধুরন্ধর দার্শনিকগণ কেবল শঙ্করের টীকাকার হিসাবেই প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন, এমন নহে তাঁহাদের গ্রন্থে বহু মৌলিক চিন্তার সমাবেশ আছে। তাঁহারা অদ্বৈত চিন্তায় যুগান্তর আনয়ন করিয়াছেন।............

তথ্যসূত্রঃ-

"বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ", প্রথম খণ্ড, শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি।

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ১২, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...