Sunday, 31 December 2023

আচার্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনি

 



ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্যের পর শঙ্করোক্ত অদ্বৈতবাদকে যারা পরিপূর্ণ রূপ দান করেছেন তাঁদের মধ্যে আচার্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনির নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এই সকল ধুরন্ধর দার্শনিকগণের পাণ্ডিত্য প্রতিভার অমল জ্যোতিতে শঙ্করবেদান্তের উৎকর্ষতা বিকশিত হয়েছে। সর্বজ্ঞাত্ম মুনি কাঞ্চীকামকোটি সর্বজ্ঞ পীঠের মঠাধীশ ছিলেন। কাঞ্চীপীঠের মতানুসারে আচার্যের সময়কাল ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ (মতান্তরে খৃষ্টীয় অষ্টম শতক)।ভারতের ব্রহ্মদেশম্, তাম্রপর্ণি নদীর তীরে তিরুনেলভেলির কাছে একটি গ্রামে আচার্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনির আবির্ভাব। আচার্যের পিতার নাম বর্ধন। পূর্বাশ্রমে সর্বজ্ঞাত্ম মুনির নাম ছিল মহাদেব।

ইনি ব্রহ্মসূত্র শাঙ্করভাষ্যের উপর "সংক্ষেপ-শারীরক" নামে একখানা অতি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করে শঙ্করের ভাবধারার বিশেষ পুষ্টি সাধন করেন। সংক্ষেপ-শারীরকের সমাপ্তি শ্লোকে সর্বজ্ঞাত্ম মুনি দেবেশ্বরের শিষ্য বলে নিজের পরিচয় প্রদান করেছেন। টীকাকার রামতীর্থ দেবশব্দ সুরশব্দের অর্থ অভিন্ন বলে দেবেশ্বরাচার্য শব্দে সুরেশ্বরাচার্যকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ সর্বজ্ঞাত্ম মুনি ভগবৎপাদ্ শঙ্করের সাক্ষাৎ শিষ্য সুরেশ্বরাচার্যের শিষ্য। তিনি বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। আচার্যের সন্ন্যাস নাম সর্বজ্ঞাত্মেন্দ্র সরস্বতী। তিনি দীর্ঘ ১১২ বছর কাঞ্চী সর্বজ্ঞ পীঠের শঙ্করাচার্য পদে আসীন ছিলেন। কাঞ্চীপীঠের প্রবাদ অনুসারে তিনি ৩৬৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বৈশাখ কৃষ্ণ চতুর্দশীতে বিদেহ মুক্তি লাভ করেন।

সর্বজ্ঞাত্মমুনি-কৃত সংক্ষেপ-শারীরক নামে সংক্ষেপ হলেও এটা সুবিশাল গ্রন্থ। এই গ্রন্থে শঙ্কর-বেদান্তের রহস্য অপূর্ব মনীষার সাথে ব্যাখ্যাত হয়েছে। ব্রহ্মসূত্র শারীরক-ভাষ্য যেমন চার অধ্যায়ে বিভক্ত, এই গ্রন্থও সেরূপ চতুরধ্যায়ে সমাপ্ত। শারীরকের সমন্বয়, অবিরোধ, সাধন ফল, এই চার প্রকার বিষয়-বিভাগই এই গ্রন্থে অনুসৃত হয়েছে।

এই গ্রন্থ শারীরক-ভাষ্যের বার্ত্তিকের ন্যায় শ্লোকাকারে লিখিত। এটাকে ভাষ্যের "প্রকরণবার্ত্তিক" বলা হয়ে থাকে। এটার প্রথম অধ্যায়ে ৫৬৩ শ্লোকে অদ্বয় ব্রহ্মে বেদান্তের সমন্বয় প্রদর্শিত হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে ২৪৮ শ্লোকে অদ্বৈত বেদান্ত মতের সাথে অপরাপর দার্শনিক ভাবধারার এবং দ্বৈতপ্রতিপাদক প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের অবিরোধ প্রদর্শিত হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে ৩৬৫ শ্লোকে ব্রহ্ম-জ্ঞানের সাধন নির্ণীত হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে ৬৩ শ্লোকে ব্রহ্ম-বিজ্ঞানের ফল বা মুক্তি ব্যাখ্যাত হয়েছে। গ্রন্থের সাবলীল ভাষা, ভাব বিচার গ্রন্থকর্তার অপূর্ব মনীষা অসামান্য পাণ্ডিত্যের পরিচয় প্রদান করে। পরবর্তী কালে অনেক আচার্য সংক্ষেপ-শারীরকের উক্তি প্রমাণ হিসেবে উদ্ধৃত করেছেন। সংক্ষেপ-শারীরকের উপর নৃসিংহাশ্রমের তত্ত্ববোধিনী টীকা, পুরুষোত্তম দীক্ষিতের সুবোধিনী টীকা, রাঘবানন্দের বিদ্যামৃত বর্ষিণী টীকা, মধুসূদন সরস্বতীর সার-সংগ্রহ টীকা রামতীর্থের অন্বয়ার্থ-প্রকাশিকা টীকা প্রসিদ্ধ।

 সংক্ষেপ-শারীরক ব্যতীত আচার্য সর্বজ্ঞাত্ম মুনি বিরচিত 'পঞ্চপ্রক্রিয়া' নামক বেদান্তের আরেকটি প্রকরণগ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। বেদান্তবাক্যের মাধ্যমে ব্রহ্মবিচারের দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান উৎপত্তির প্রক্রিয়াই এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়। এই গ্রন্থটিতে পাঁচটি প্রকরণ রয়েছে। যথা.শব্দবৃত্তিবিবেক: বিভিন্ন বৃত্তির বিষয়ের ব্যাখ্যা, যেমনঅভিধা, লক্ষণা ইত্যাদি; .মহাবাক্যার্থবিবরণ: তত্ত্বমসি বাক্যের ব্যাখ্যা, .তত্ত্বম্পদার্থব্যাখ্যানম্: উপরোক্ত প্রকরণের মহাবাক্যের তৎ ত্বম্ পদের বিস্তৃত ব্যাখ্যা, .অবান্তরবাক্যার্থব্যাখ্যানম্: উপনিষদের অন্যান্য বাক্যের ব্যাখ্যা, যথা— 'সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম' ইত্যাদি; . বন্ধমোক্ষবিচার: অদ্বৈতমতে বন্ধন মুক্তির প্রকৃতির ব্যাখ্যা। সর্বজ্ঞাত্ম মুনির এই গ্রন্থের উপরও আনন্দগিরির টীকা শ্রীপূর্ণবিদ্যমুনির বিদ্যানন্দী টীকা রয়েছে।....

তথ্যসূত্রঃ-

. https://www.kamakoti.org/peeth/origin.html

."বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ", প্রথম খণ্ড, কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ আশুতোষ শাস্ত্রী বিদ্যাবাচস্পতি।

. দক্ষিণামূর্তি মঠ প্রকাশন, প্রাক্ কথন।

শ্রীশুভ চৌধুরী

নভেম্বর , ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।

Photo editing credit Thākur Vishāl






No comments:

তুরীয় ব্রহ্মের স্বরূপঃ-

  মাণ্ডুক্য উপনিষদে তুরীয় ব্রহ্মতত্ত্বের উপদেশ রয়েছে। ঐ দুর্জ্ঞেয় তুরীয় তত্ত্ব বুঝানোর জন্য ওঁকার বা প্রণবকে ব্রহ্মের প্...