Wednesday, 20 December 2023

বেদান্তদর্শন কি?

 


বেদ, উপনিষদ্ প্রভৃতি আকর গ্রন্থে বেদান্তচিন্তা পরিপুষ্টরূপে আত্মপ্রকাশ লাভ করলেও তখনও ওটা প্রকৃত দর্শনাকারে গড়ে উঠে নি। আচার্য বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্রেই প্রথমতঃ আমরা বেদান্তের দার্শনিক রূপের পরিচয় পাই। তর্কই দর্শনের প্রাণ, তর্কের সূত্রে বেদান্তের বিক্ষিপ্ত চিন্তা-কুসুমকে গ্রথিত করে ভগবান্ বাদরায়ণাচার্য ব্রহ্মসূত্র রচনা করেছেন। ব্রহ্মসূত্রের অপর নাম বেদান্তদর্শন। পরবর্তীযুগে ভগবান্ শঙ্করাদি বৈদান্তিক মহাচার্যগণ উক্ত ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তদর্শনের উপর ভাষ্য, বার্তিক, টীকা, বিবৃতি প্রভৃতি রাশি রাশি গ্রন্থ প্রণয়ন করলেন। খণ্ডনমণ্ডনে বাণীর পাদপীঠ ভরে উঠল। বেদান্ত চিন্তার ইতিহাসে নবযুগের সূচনা দেখা দিল।

মহাভারতের রচয়িতা বেদব্যাস ব্রহ্মসূত্রের রচয়িতা কিনা, এবিষয়ে কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করেন; কিন্তু মহাভারতের সময় যে ব্রহ্মসূত্র রচিত হয়েছিল তার প্রমাণ আমরা মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়ই দেখতে পাই। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় "ব্রহ্মসূত্রপদৈঃ"-(শ্রীগীতা-১৩।৪) বলে যে ব্রহ্মসূত্রের উল্লেখ আছে এবং তা যে বেদান্তদর্শনকেই বুঝিয়ে থাকে সে বিষয়ে সুধীগণের কোন সন্দেহ নেই। ব্রহ্মসূত্রের প্রাচীনতার আরেকটি নিদর্শন এই যে, পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী সূত্রে পারাশর্য্য ভিক্ষুসূত্রের উল্লেখ করেছেন। পারাশর্য্যের অর্থ পরাশরের পুত্র অর্থাৎ বেদব্যাস। পাণিনী বুদ্ধদেবের বহু পূর্ববর্তী। পাণিনীর আবির্ভাবকাল খৃষ্টপূর্ব দশম শতক বলে মনে করা হয়।

বেদব্যাস তাঁর ব্রহ্মসূত্রে আত্রেয়, জৈমিনি, কার্ষ্ণাজিনি, কাশকৃৎস্ন, ঔড়ুলোমি, আশ্মরথ্য বাদরি প্রভৃতি প্রাচীন আচার্যগণের নামোল্লেখ করেছেন এবং তাদের সূত্রাকারে গ্রথিত মতবাদের পরিচয়ও দিয়েছেন। ভগবান্ সূত্রকার কখনও স্বীয় মতের পোষকতায় কখনও বা প্রতিপক্ষ মতের দোষ উদ্ভাবনে সকল প্রাচীন আচার্যগণের মত উদ্ধার করেছেন। এটা হতে এরূপ মনে করা অসঙ্গত নয় যে, ব্রহ্মসূত্র রচনার বহু পূর্বেই সূত্রাকারে বিভিন্ন বৈদান্তিক মত নিবদ্ধ করবার চেষ্টা চলতেছিল এবং তার ফলে কতগুলো সূত্রও রচিত হয়েছিল। সূত্রগুলো অসম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন আকারে বিদ্যমান ছিল, পরে ভগবান্ সূত্রকার সকল প্রাচীন সূত্রের আদর্শে উপনিষদের ভিত্তিতে এক পূর্ণাবয়ব সূত্রগ্রন্থ রচনা করেন। এটাই বর্তমান ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তদর্শন।

ব্রহ্মসূত্রে সর্বমোট ৫৫৫ সূত্র আছে। সূত্রগুলো চার অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রত্যেকটি অধ্যায় আবার চারটি পাদে বিভক্ত সুতরাং ব্রহ্মসূত্রে ষোলটি পাদ বা পরিচ্ছেদ আছে। প্রত্যেক পাদে কতগুলো অধিকরণ আছে। বিভিন্ন বিচার্য বিষয় ভিন্ন ভিন্ন এক একটি অধিকরণে আলোচিত এবং মীমাংসিত হয়েছে। এইরূপ বিচার পদ্ধতি অনুসরণ করেই সূত্রোক্ত দার্শনিক রহস্য আলোচনা করা হয়েছে।

ব্রহ্মই বেদান্তের চরম পরম তত্ত্ব। ভগবান্ বেদব্যাস এই জন্য প্রথম সূত্রেই সমুদায় বেদবেদান্ত শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য পরব্রহ্মকে জানা অবশ্য কর্তব্য হয়েছে, উল্লেখ করে শ্রুতি এবং শ্রুতিসম্মত বিচারের দ্বারা দেখলেন যে, ব্রহ্মের স্বরূপ কোন মতে জানতে পারা যায় না, অর্থাৎ ব্রহ্ম কি, আর কেমন, এমত নিদর্শন হতে পারে না। অতএব বেদব্যাস দ্বিতীয় সূত্রে ব্রহ্মের স্বরূপ বর্ণনের প্রয়াস না করে তটস্থরূপে তাঁর নিরূপণ করছেন অর্থাৎ এক বস্তুকে অন্য বস্তুর দ্বারা জানাচ্ছেন; যেমন সূর্যকে দিবসের নির্ণয় কর্তা করে নিরূপণ করা যায়। এইরূপে ব্রহ্মকে নিরূপণ করতে গিয়ে সূত্রকার বলছেন, এই জগতের জন্ম, স্থিতি, নাশ যাঁ হতে হয় তিনিই ব্রহ্ম। তৃতীয় সূত্রে প্রদীপের ন্যায় সর্বার্থপ্রকাশক মহৎ যে ঋগ্বেদাদি শাস্ত্র, যা বেদাঙ্গ, পুরাণ, স্মৃতি ধর্ম্মশাস্ত্র প্রভৃতি অনেক বিদ্যাস্থান দ্বারা পুষ্ট এবং যা সর্বজ্ঞকল্প অর্থাৎ সর্ব্বপ্রকার জ্ঞানের আকর হলেও অচেতন হওয়াই যাকে প্রায় সর্বজ্ঞ বলা যায়, তার যোনি অর্থাৎ উপাদান এবং নিমিত্ত কারণ ব্রহ্ম। সর্বজ্ঞ সর্বশক্তি ব্রহ্মই এই দৃশ্য জগতের সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়ের কারণ বা নিদান। এটা সিদ্ধ হয় কিরূপে? সমন্বয় হতে। সমুদায় বেদান্তের প্রায় সমুদায় বাক্যই ব্রহ্মপর এবং ব্রহ্মেই সমস্ত বেদান্তবাক্যের তাৎপর্য পর্যবসিত। এটাই চতুর্থ সূত্রে ভগবান্ সূত্রাকারের অভিপ্রায়। উপরে কথিত এই চতুঃসুত্রীর ব্যাখ্যায় সমস্ত ব্রহ্মসূত্রের সার নিহিত। শুধুমাত্র এই চারটি সূত্রের আলোকেই অনেক আচার্যের সুবিশাল টীকা টিপ্পনী রয়েছে।.....

তথ্যসূত্রঃ-

. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের শারীরক-মীমাংসা ভাষ্য।

. বেদান্তদর্শনঅদ্বৈতবাদ, ১ম খণ্ড, আশুতোষ শাস্ত্রী কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি।

. কালীবর বেদান্তবাগীশের অনুবাদকৃত "বেদান্ত-সারঃ" অবতরণিকা।

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ২১, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ।


No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...