Friday, 30 December 2022

অষ্টাঙ্গযোগে 'প্রত্যাহার' কি?

 


ভগবান্ শঙ্করাচার্য অপরোক্ষানুভূতিতে বলেছেন— "বিষয়েষ্বাত্মতাং দৃষ্ট্বা মনসশ্চিতি মজ্জনম্। প্রত্যাহারঃ স বিজ্ঞেয়োঽভ্যসনীয়ো মুমুক্ষুভিঃ" অর্থাৎ সমগ্র বিষয়েতে আত্মস্বরূপকে দেখে চৈতন্যসত্তায় মনের যে নিমজ্জন তাই প্রত্যাহার জানবে; তাই মুমুক্ষুর অভ্যাস করা উচিত৷

যোগসূত্রের সাধনপাদে বর্ণিত আছে—"স্বস্ববিষয়াসম্প্রয়োগে চিত্ত-স্বরূপানুকার ইবেন্দ্রিয়াণাং প্রত্যাহারঃ" অর্থাৎ যখন ইন্দ্রিয়গণ তাদের নিজ নিজ বিষয় পরিত্যাগ করে যেন চিত্তের স্বরূপ গ্রহণ করে, তখন তাকে ‘প্রত্যাহার’ বলা যায়। ভগবান্ ভাষ্যকার ব্যাস বলেছেন—"নিজ নিজ শব্দাদি বিষয়ের প্রতি সংযোগের অভাবে চিত্তের স্বরূপের অনুকরণ মতো ইন্দ্রিয়গুলি চিত্ত মতোই নিরুদ্ধ হয়ে যায়। যেমন উড়ে যাচ্ছে এমন মধুকররাজের পিছনেই অন্য মৌমাছি উড়ে চলে, আবার মৌমাছি রাজ যেখানে নেমে এসে বসে অন্য মৌমাছিগুলোও তাকে অনুসরণ করে সেখানে এসে বসে, ঠিকসেইভাবে ইন্দ্রিয়গুলিও চিত্তের নিরুদ্ধতায় নিরুদ্ধ হয়। এই হল প্রত্যাহার।"

এখন প্রত্যাহারের ফল কি? তা আলোচনা করব। শ্রীপাতঞ্জলে সাংখ্যপ্রবচনে বৈয়াসিকে সাধনপাদে বলা হচ্ছে— "ততঃ পরমা বশ্যতেন্দ্রিয়াণাম্।" অর্থাৎ প্রত্যাহার হতে ইন্দ্রিয়গণ সম্পূর্ণরূপে বশীভূত হয়ে থাকে। মহর্ষি জৈগীষ্যবের মতে—"চিত্তের একাগ্রতা হেতু, বিষয়ের সঙ্গে সংযোগ-রাহিত্য হলো ইন্দ্রিয় জয়।" তাই এটি হলো যোগীর পক্ষে পরম বশ্যতা, যাতে চিত্তের নিরোধেই ইন্দ্রিয়গুলির নিরোধতা।

শ্রীভগবান্ ভগবদ্গীতার সাংখ্যযোগে এই বিষয়ে স্পষ্ট বলছেন—

যদা সংহরতে চায়ং কূর্ম্মোহঙ্গানীব সর্ব্বশঃ। ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠাতা" অর্থাৎ কূর্ম্ম (কচ্ছপ) যেমন সকল বস্তু হতে ভয়হেতু আপনার অঙ্গসকল সংহরণ করে নেয় অর্থাৎ গুটিয়ে নেয়, তেমনি এই জ্ঞাননিষ্ঠায় প্রবৃত্ত যতিরা যখন ইন্দ্রিয়সকল ইন্দ্রিয়দের অর্থ হতে তথা রূপরসাদি সর্ব্ববিষয় হতে উপসংহরণ বা প্রত্যাহার করেন, তখন সেই জ্ঞাননিষ্ঠদের প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বুঝতে হবে।

আতুর ব্যাধিগ্রস্ত লোকদের ইন্দ্রিয়সকলও তো কূর্মাঙ্গের মত বিষয় গ্রহণ না করে উপসংহৃত হয়, কিন্তু তা বলে তাদের তদ্ বিষয়ক রাগ বা আসক্তি তো সংহৃত না? তাহলে সেই জ্ঞানী কি প্রকারে ইন্দ্রিয় সকল বিষয় হতে উপসংহার করে থাকেন তা বলা হচ্ছে—

"বিষয়া বিনিবর্ত্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ। রসবর্জ্জং রসোহপ্যস্য পরং দৃষ্ট্বা নিবর্ত্ততে" অর্থাৎ নিরাহার দেহীর অর্থাৎ যাঁরা বিষয় আহরণ করে না এইরূপ কষ্টে তপস্যায় স্থিত দেহীর ইন্দ্রিয়াদির বিষয় নিবৃত্ত হয়, কিন্তু তৎপ্রতি রস তথা অনুরাগ যায় না। কেবল পরমার্থতত্ত্ব ব্রহ্মদর্শন করে ‘অহম্ এব তৎ’ এইরূপ উপলব্ধিতে সেই রস অর্থাৎ রঞ্জনরূপ সূক্ষ্ম আসক্তি নিবৃত্ত তথা নির্বীজ বিষয়বিজ্ঞান সম্পন্ন হয়ে থাকে।

যেইহেতু সম্যগদর্শন না হলে বিষয়রস উচ্ছেদ হয় না, সেইহেতু সম্যগদর্শনাত্মিকা প্রজ্ঞায় পুনঃ পুনঃ অভ্যাসের দ্বারা স্থৈর্য্য কর্তব্য। সেই সম্যগদর্শনরূপ প্রজ্ঞাতে স্থৈর্য্য ইচ্ছুক জ্ঞানীদের পূর্ব্বে ইন্দ্রিয়সকল স্ববশে স্থাপন করা উচিত কিন্তু—

"যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষস্য বিপশ্চিতঃ। ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ" অর্থাৎ হে কৌন্তেয়! প্রমথনশীল অর্থাৎ চিত্তবিক্ষেপকারী ইন্দ্রিয়গণ প্রযত্নশীল মেধাবী কিন্তু বিষয়াভিমুখী পুরুষের মনকেও চিত্তাকুলপূর্ব্বক প্রসভ অর্থাৎ বলপূর্ব্বক বিষয়াভিমুখে হরণ করে থাকে।

"তানি সর্ব্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ। বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা" যেহেতু ইন্দ্রিয়সকল প্রবল, সেইজন্য সেই সকল ইন্দ্রিয় সংযম করে যুক্ত অর্থাৎ সমাহিত হয়ে; মৎপর অর্থাৎ আমি বাসুদেব সর্ব্বপ্রত্যাগাত্মা যাঁর নিকট পর তথা সর্ব্বোৎকৃষ্ট; 'ন অন্যোহং তস্মাত্'  এইরূপ আত্মস্থ হয়ে যিনি অবস্থান করেন, যাঁর ইন্দ্রিয়সকল বশীভূত হয়েছে, অভ্যাসের বলে তাঁর প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতি শ্রীগীতায় ভগবৎ বচন।..............

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ৩০, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

Monday, 26 December 2022

অষ্টাঙ্গযোগে 'যম' কি?

 


'সর্বং ব্রহ্মেতি বিজ্ঞানাদিন্দ্রিয়গ্রামসংয়মঃ যমোঽয়মিতি সম্প্রোক্তোঽভ্যসনীয়ো মুহুর্মুহুঃ' অর্থাৎ 'সকল বস্তুই ব্রহ্ম' এই বিজ্ঞান দ্বারা ইন্দ্রিয়সমূহের সংযমকেই 'যম' বলা হয়েছে, তা পুনঃ পুনঃ অভ্যাস করা উচিত। এটা ভগবান্ শঙ্করাচার্যের বচন। ছান্দোগ্য শ্রুতিতে পুরুষযজ্ঞের কথনে যে তপস্যাদি রয়েছে,'অথ যত্তপো দানমার্জবহিংসা সত্যবচনমিতি...'(ছান্দোগ্য উপনিষদ্-৩।১৭।৪) তপস্যা, দান, সরলতা, অহিংসা ও সত্যবচন-এইসবগুলিই যম-মূলক।

'যম' সম্পর্কে যোগসূত্রের সাধনপাদে বলা হয়েছে- "অহিংসা-সত্যাস্তেয়-ব্রহ্মচর্যাপরিগ্রহা যমাঃ" অর্থাৎ -অহিংসা, সত্য, অস্তেয় (অচৌর্য), ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ-এইগুলিকে যমবলে। এইগুলি জাতি, দেশ, কাল ও সময় দ্বারা অবচ্ছিন্ন বা সীমাবদ্ধ না হলে সার্বভৌম মহাব্রত বলে কথিত হয়। যোগভাষ্যকার এই বিষয়ে উদাহরণ দিচ্ছেন, দেশাবচ্ছিন্না অহিংসা যথাতীর্থে হনন করবে না ইত্যাদিরূপ। সময়াবচ্ছিন্ন অহিংসা যথাদেবব্রাহ্মণার্থে অথবা ক্ষত্রিয়দের যুদ্ধেতেই হিংসা কর্তব্য, অন্যত্র হিংসা না করা। কালাবচ্ছিন্না অহিংসা যথাচতুর্দশী বা পুণ্যদিনে হনন না করা ইত্যাদিরূপ।

যোগভাষ্যকার ভগবান্ ব্যাস এগুলোর অর্থ করেছেন এইভাবেএদের মধ্যে অহিংসা হলো সমস্তপ্রকারে, সর্বদা, সমস্ত ভূতের প্রতি অনভিদ্রোহ অর্থাৎ বৈরিতা না করা। শ্রতি বলেন'মা হিংস্যাৎ সর্বভূতানি' সত্য হলো বাক্যে ও মনে যথাযথ হওয়া। মুণ্ডক শ্রুতি বলছে'সত্যমেব জয়তে নানৃতং সত্যেন পন্থা বিততো দেবযানঃ'স্তেয় হলো, শাস্ত্রবিধি না মেনে অপরের দ্রব্য নিজের করা। তাই স্পৃহাশুন্যভাবে স্তেয়ের অর্থাৎ চুরির প্রতিষেধ হল অস্তেয়। এবিষয়ে শ্রুতি'মা গৃধ কস্যসিদ্ধনং' ব্রহ্মচর্য হলো গোপনীয় ইন্দ্রিয়-উপস্থের সংযম। তদ্বিষয়ে শ্রুতি যথা'সত্যেন লভ্যস্তপসা হ্যেষ আত্মা, সম্যগ্ জ্ঞানেন ব্রহ্মচর্য্যৈণ নিত্যম্।' বিষয়গুলির অর্জন, রক্ষণ, ক্ষয়, সঙ্গ ও হিংসাদি অনুভবে দোষ দর্শন হেতু সেগুলির স্বীকার না করা হল অপরিগ্রহ। শ্রুতি বলেন'ত্যাগেনৈকেনামৃতত্বমানশুঃ।'

যার অন্তরে অহিংসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার সমীপে অপরের স্বাভাবিক বৈরিতাও পরিত্যক্ত হয়। হৃদয়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হলে কোন কর্ম না করেই যোগী নিজের জন্য বা অপরের জন্য সেই কর্মের ফল লাভ করবার শক্তি অর্জন করেন। অচৌর্য প্রতিষ্ঠিত হলে যোগীর নিকট সমুদয় ধনরত্নাদি এসে থাকে। ব্রহ্মচর্য প্রতিষ্ঠিত হলে বীর্য বা শক্তি লাভ হয়। অপরিগ্রহ দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্বজন্ম স্মৃতিপথে উদিত হবে। এটাই যোগসূত্রকার ভগবান্ পতঞ্জলির অভিপ্রায়।.........

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ২৬, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

Sunday, 25 December 2022

শ্রদ্ধা

 

"নিগমাচার্যবাক্যেষু ভক্তিঃ শ্রদ্ধেতি বিশ্রুতা" অর্থাৎ শাস্ত্র ও আচার্য বাক্যে ভক্তিই শ্রদ্ধা নামে বিশ্রুতা। এটা ভগবান্ শঙ্করাচার্যের কথা। শ্রদ্ধা একটি সাধনসম্পত্তি। বেদান্তে ‘সাধনসম্পত্তি’ বলতে বোঝায় শম্, দম্, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান ও শ্রদ্ধা। যোগভাষ্যকার ব্যাস 'শ্রদ্ধা'র একটি অতি সুন্দর সংজ্ঞা দিয়েছেন—

'শ্রদ্ধা চেতসঃ সম্প্রসাদ্ঃ' অর্থাৎ 'শ্রদ্ধা হলো চিত্তের সম্প্রসাদ অর্থাৎ চিত্তের সত্যাত্মক প্রসন্নতাজন্য প্রযত্ন বিশেষ।'

শ্রদ্ধা হল মনে প্রাণে গুরু ও শাস্ত্রবাক্যে ভক্তি। অচল অটল সূমেরুবৎ বিশ্বাস। এই বিশ্বাস মানুষকে অসীম সাহসী করে তুলে। নচিকেতা এই শ্রদ্ধাবলেই যম সমীপে উপস্থিত হয়ে বহু প্রলোভনকে জয় করে ব্রহ্মবিদ্যা লাভে সমর্থ হয়েছিলেন। সর্বশাস্ত্রে শ্রদ্ধার একটি বিশিষ্ট স্থান রয়েছে।

ঋগ্বেদ্ সংহিতার ১০ম মণ্ডলের ১৫১ সূক্তে বর্ণিত আছে—"শ্রদ্ধয়াগ্নিঃ সমিধ্যতে শ্রদ্ধয়া হুয়তে হবিঃ।" অর্থাৎ শ্রদ্ধার গুণে অগ্নি প্রজ্বলিত হন। শ্রদ্ধাপ্রযুক্তই যজ্ঞসামগ্রী আহুতি দেওয়া হয়।

তাছাড়া বেদে অন্যত্র বলা হয়েছে— "শ্রদ্ধামাগোতি শ্রদ্ধয়া সত্যমাপ্যতে"-(শুক্লযজুর্বেদ-১৯/৩০) অর্থাৎ শ্রদ্ধার দ্বারা সত্যব্রহ্মকে (সত্যস্বরূপ জ্ঞানস্বরূপ ও অনন্তস্বরূপ ব্রহ্মকে) প্রাপ্ত হওয়া যায়।

শ্রীগীতায় ভগবানও একই গীত গেয়েছেন। "শ্রদ্ধাবাঁল্লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ৷ জ্ঞানং লব্ধ্বা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি"-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৪/৩৯) অর্থাৎ শ্রদ্ধাবান্ জ্ঞান লাভ করে। শ্রদ্ধালু হলেও কেউ কেউ হয়ত তত্ত্বজ্ঞান সম্বন্ধে মন্দপ্রযত্ন হতে পারে, সেইজন্য বলছেন জ্ঞানলাভের উপায়ে তৎপর অর্থাৎ গুরু উপসনাদিতে অভিযুক্ত হতে হবে। শ্রদ্ধাবান্ এবং তৎপর হয়েও যদি অজিতেন্দ্রিয় হয়, সেইজন্য বলছেন সংযতেন্দ্রিয় হতে হবে অর্থাৎ বিষয় থেকে নিবর্তিত হয়েছে যাঁর ইন্দ্রিয়সকল তিনি সংযতেন্দ্রিয়। যিনি এইরূপ শ্রদ্ধাবান্, তৎপর ও শ্রদ্ধালু তিনি অবশ্যই জ্ঞান লাভ করেন। জ্ঞানলাভ করে পরা অর্থাৎ মোক্ষাখ্য শান্তি বা উপরতি অচিরে অর্থাৎ শীঘ্রই লাভ হয়ে থাকে। সম্যক্ দর্শন হতে শীঘ্র মোক্ষ হয়ে থাকে-এটাই সর্বশাস্ত্রন্যায় প্রসিদ্ধ সুনিশ্চিত অর্থ৷

গীতার এই শ্লোকের ভাষ্যে ভগবৎপাদ্ শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য বলছেন—"প্রণিপাতাদিস্তু বাহ্যোনৈকান্তিকোপি ভবতি, মাযাবিত্বাদিসংভবাত্; ন তু তত্ শ্রদ্ধাবত্ত্বাদৌ ইত্যেকান্ততঃ জ্ঞানলব্ধ্যুপাযঃ৷" অর্থাৎ প্রণিপাতাদি কিন্তু জ্ঞানলাভের বাহ্য কারণ, কপটতাদির সম্ভবনাহেতু জ্ঞানরূপ ফলপ্রাপ্তি সম্বন্ধে অনিশ্চিত হতে পারে, পরন্তু শ্রদ্ধাবত্ত্বাদি নিশ্চিতরূপে জ্ঞান লাভের উপায়।

শ্রদ্ধাই কল্যানকারিণী মায়ের মতো যোগীদেরকে রক্ষা করে থাকে। সেই শ্রদ্ধাবান বিবেক আকাঙ্ক্ষীদেরই বীর্য অর্থাৎ বল উৎপন্ন হয়। 'সা হি জননীব কল্যাণী যোগিনং পাতি। তস্য হি শ্রদ্দধানস্য বিবেকার্থিনঃ বীর্যম্ উপজায়তে' এটা যোগসূত্রের ভাষ্যে ব্যাস বচন।

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ২৫, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

Friday, 23 December 2022

ব্রহ্মবিজ্ঞান কাকে বলে? ব্রহ্মজ্ঞান আর ব্রহ্মবিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য কি?


 

আচার্য বিদ্যারণ্য স্বামী "বিবরণ-প্রমেয়-সংগ্রহঃ" শীর্ষক গ্রন্থে বলছেন"শম, দম প্রভৃতি সাধনানুষ্ঠানে তৎপর সাধকের মনন ও নিদিধ্যাসনের পরে, বেদবাক্যরূপ প্রমাণ হতে সর্বাত্মভূত ব্রহ্মবিষয়িণী যে বিশুদ্ধ মানসী বৃত্তি উৎপন্ন হয়, তাতে যে চিদভিব্যক্তি হয়ে থাকে, তা স্বতঃপ্রমাণ এবং তাই 'শাঙ্করী' বা ভগবান্ শঙ্করের প্রসাদে লব্ধ হয়। এই চিদভিব্যক্তিই ব্রহ্মবিজ্ঞান এবং এটাই জীবের সকল প্রকার অজ্ঞানকে বিনষ্ট করে থাকে।"—(পরাশর উপপুরাণ, ১৪ অধ্যায়)

তাৎপর্য হল শম, দম, তিতিক্ষা, উপরতি প্রভৃতি বক্ষ্যমাণ সাধন-সমূহের অভ্যাসে যার চিত্ত বিশুদ্ধ হয়েছে, এরূপ সাধকমনন ও নিদিধ্যাসনের ফলে তার অন্তঃকরণে বেদান্ত-প্রতিপাদ্য অদ্বয় ব্রহ্ম বিষয়ে সর্বপ্রকার বিশুদ্ধ বৃত্তি উদিত হয়, সেই মানসীবৃত্তিতে চিদাত্মার যে স্ফুরণ বা প্রতিবিম্ব পতিত হয়, তাই হল জীবের চরম ও স্বতঃসিদ্ধ প্রমা। ভগবান্ শঙ্করের অনুগ্রহেই এই প্রকার চিদভিব্যক্তি ঘটে থাকে। এইরূপ চিদভিব্যক্তিকেই আচার্যগণ ব্রহ্মবিজ্ঞান বলে থাকেন। যে পর্যন্ত এরূপ চিদভিব্যক্তি সাধকের মানসী বৃত্তিতে না হয়, সে পর্যন্ত তার সকল অনর্থের মূলভূত যে অজ্ঞান, তার নাশ হবার সম্ভাবনা নেই। এ দ্বারা এটাই বুঝানো হচ্ছে যে, বেদান্তবাক্য শ্রবণের দ্বারা আপাততঃ পরোক্ষ যে ব্রহ্মজ্ঞান হয়ে থাকে, তা দ্বারা অজ্ঞান নিবৃত্তি হয় না।চিত্তকে সম্পূর্ণরূপে সাধনানুষ্ঠানের দ্বারা রাগদ্বেষ বিমুক্ত করতে না পারলে অজ্ঞান-নাশন ব্রহ্মসাক্ষাৎকার হবার সম্ভাবনা নেই। বেদান্তের অধ্যয়ন বা আলোচনা দ্বারা আপাততঃ যে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাকে ব্রহ্মজ্ঞান বলা যায়, কিন্তু তা ব্রহ্মবিজ্ঞান নয়।

......................................................................

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ২০, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

"পরমেশ্বর অপরিচ্ছিন্ন নির্মল, তাঁর কল্পিত প্রতিবিম্ব হতে পারে না", অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে দ্বৈতবাদীর এই আপত্তির খণ্ডন—



পূর্বপক্ষ- সূর্যাদি পরিচ্ছিন্ন বস্তুরই প্রতিবিম্ব সম্ভব হয়, অপরিচ্ছিনতা যার ধর্ম, তার প্রতিবিম্বতা কখনো সম্ভব হয় না। নির্মল পুরুষে ধর্মাধর্ম ও সুখদুঃখ ভোগ অসম্ভব। (মায়াবাদ শতদুষণী দ্রষ্টব্য)

উত্তরপক্ষভগবান্ সূত্রকার বাদরায়ণ বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রে বলেছেন "আভাস এব চ"-(ব্রহ্মসূত্র-২.৩.৫০) ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য এই সূত্রের ভাষ্যে বলছেন"আভাস এব চ এষ জীবঃ পরস্যাত্মনো জলসূর্যকাদিবত্প্রতিপত্তব্যঃ, ন স এব সাক্ষাত্, নাপি বস্ত্বন্তরম্৷" অর্থাৎ "জলসূর্য (জলে সূর্যপ্রতিবিম্ব) যেমন বিম্বভূত সূর্যের আভাস (প্রতিবিম্ব), তেমনি জীবও পরমাত্মার আভাস (প্রতিবিম্ব) এটা জানতে হবে। যেহেতু আভাস সেহেতু জীব সাক্ষাৎ পরমাত্মা নয়, পদার্থান্তরও নয়।" যেমন একটি জলসূর্য কম্পিত হলে অন্য জলসূর্য কম্পিত হয় না, তেমনি এক জীবে কর্মফল-সম্বন্ধ ঘটলেও অন্য জীবকে তা স্পর্শ করে না। সূর্যের এই উপমাটি ভগবান্ বাদরায়ণ তার ব্রহ্মসূত্রে স্পষ্ট গ্রহণ করেছেন—"অত এব চোপমা সূর্যকাদিবৎ৷"-(ব্রহ্মসূত্র-৩.২.১৮)

শ্রুতিও তাই বলছে—"এক এব হি ভূতাত্মা ভূতে ভূতে ব্যবস্থিতঃ। একধা বহুধা চৈব দৃশ্যতে জলচন্দ্রবৎ॥"-(ব্রহ্মবিন্দু উপনিষৎ-১২) অর্থাৎ 'যেহেতু প্রাণিগণের এই একই আত্মা বিভিন্ন প্রাণীতে বিশেষভাবে অবস্থিত আছেন, তিনি জলমধ্যস্থ চন্দ্রের ন্যায় একরূপে ও বহুরূপে পরিদৃষ্ট হন।' যেমন জ্যোতিঃস্বরূপ এই সূর্য্য এক হলেও বিভিন্ন জলকে অনুগমনকরতঃ বিভিন্ন পাত্রস্থ জলে প্রতিবিম্বিত হয়ে বহুপ্রকার হয়ে থাকেন, এইপ্রকারে এই স্বয়ংপ্রকাশ দেব জন্মরহিত আত্মা, মায়ারূপ উপাধির দ্বারা ক্ষেত্রসকলে অর্থাৎ মায়ার পরিণামভূত দেহেন্দ্রিয়াদি সংঘাত সকলে অনুগমন করতঃ প্রতিবিম্বিত হয়ে বিভিন্নরূপে কৃত বা প্রতিভাত হন।

শঙ্কাএখন সংশয় সূর্য তো মূর্তিমান, তাহলে সর্বব্যাপী পরব্রহ্মের ক্ষেত্রে সূর্যাদি দৃষ্টান্তের তাৎপর্য কি?

উত্তরপরব্রহ্মের পক্ষে সূর্যাদি দৃষ্টান্তের তাৎপর্য এই যে, সূর্য যেমন জলে প্রতিবিম্ব হয়ে জলগত বৃদ্ধি, হ্রাস, কম্পন প্রভৃতি উপাধি ধর্মের অধীন হয়, ব্রহ্মও সেরূপ অন্তঃকরণাদিপরিচ্ছিন্ন হয়ে অন্তঃকরণগত সুখ, দুঃখ, শোক, মোহ প্রভৃতি বিবিধ ধর্মের অধীন হয়ে থাকে। ব্রহ্ম সূর্যের মত প্রতিবিম্বিত হন, সূর্যাদি দৃষ্টান্তের এরূপ তাৎপর্য নয়।

সেই তত্ত্বজ্ঞান প্রাপ্তির বিধি কি?


স্বয়ং ভগবান্ শ্রীগীতায় বলেছেনগুরুচরণে দণ্ডবৎ প্রণামদ্বারা, বেদান্ততত্ত্ব-বিবেক বিষয়ক প্রশ্নদ্বারা এবং গুরুসেবা দ্বারা সেই জ্ঞান লাভ কর। "তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া ৷ উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ৷ -(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, জ্ঞানযোগ-৩৪অর্থাৎ সেই বিশিষ্ট জ্ঞান যে বিধির দ্বারা পাওয়া যায় তা জান। আচার্য্যের নিকট গমন করে প্রকৃষ্টরূপে সর্বাঙ্গ নিম্নকরণের দ্বারা প্রণিপাত অর্থাৎ দীর্ঘ নমস্কারের দ্বারাবন্ধন কি?’, ‘মোক্ষ কি?’, ‘বিদ্যা কি?’, ‘অবিদ্যাই বা কি?’ ইত্যাদি পরিপ্রশ্ন এবং সেবা অর্থাৎ গুরুশুশ্রূষার দ্বারা সেই ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া যায়। এইরূপ বিনয়াদির দ্বারা প্রসন্নভূত তত্ত্বদর্শী জ্ঞানী আচার্য্যেরা তোমাকে যথোক্ত-বিশেষণ অর্থাৎ তত্ত্বদর্শনরূপ জ্ঞান উপদেশ প্রদান করবেন।

যার দেবতার প্রতি পরাভক্তি, দেবতার ন্যায় গুরুর প্রতিও পরাভক্তি, তারই নিকট কথিত শাস্ত্রার্থ প্রকাশিত হয়ে থাকে। এটা শ্রুতি বলছে। "যস্য দেবে পরা ভক্তিঃ যথা দেবে তথা গুরৌ। তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ"-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-/২৩)

ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্যে বলছেন—"দেবতা গুরুর প্রতি যাদের ভক্তি আছে, তাদের পক্ষেই গুরূপদেশলব্ধ বিদ্যা অনুভবযোগ্য হয়ে থাকে। অখণ্ডৈকরস সৎ-চিৎ-আনন্দময় পরম জ্যোতিঃস্বরূপ দেবতায় অর্থাৎ পরমেশ্বরে যে অধিকারী পুরুষের পরাভক্তি অর্থাৎ উৎকৃষ্ট ভক্তি আছে, তা উপলক্ষণমাত্র, অচঞ্চলভাব শ্রদ্ধা, উভয় থাকাই আবশ্যক। যার দেবতার ন্যায় গুরুর প্রতিও এরূপ পরাভক্তি, তারই নিকট উপদিষ্ট শাস্ত্রার্থ প্রকাশিত অর্থাৎ অনুভবগোচর হয়ে থাকে। যেমন ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ভোজন ভিন্ন আর শান্তির উপায় নেই, তেমনি গুরুকৃপা ব্যতিরেকে ব্রহ্মবিদ্যাও দুর্লভ।"

মহাভারত প্রভৃতিতে এর বহু উদাহরণ আছে। নীতি শাস্ত্রবিৎ পণ্ডিতগণও বলে থাকেন'গুরু শুশ্রূষয়া বিদ্যা' আচার্য (গুরু) প্রাচার্যের (গুরুর গুরুর) উপস্থিতিতে শিষ্য পরম গুরুকে ভক্তি প্রদর্শন করে পরে গুরুকে ভক্তি প্রদর্শন করবে। এটা আপস্তম্ব বলেছেন। "আচার্য-প্রাচার্য-সন্নিপাতে প্রাচার্য্যারোপসংগৃহ্যোপসংজিঘৃক্ষেদাচার্য্যম্"- (আপস্তম্ব ধর্মসূত্র-/১৯) তাই প্রত্যেক পারম্পরিক আচার্যগণ স্বকৃত গ্রন্থের মঙ্গলাচরণে নিজ নিজ গুরু পরমগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে গুরু দ্বারা প্রাপ্ত বিদ্যার বিশুদ্ধি গ্রন্থের নির্দোষত্ব সূচনা করেছেন।

......................

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ২২, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

ভগভদ্ভক্তঃ

 


আচার্য বিদ্যারণ্য মুনি "জীবন্মুক্তিবিবেকঃ" এ বলেছেন ঈশ্বরে সর্বতোভাবে মন যাঁর অর্পিত হয়েছে সেরূপ সমাহিতচিত্ত ব্যক্তির অন্য বিষয়ের অনুসন্ধানে প্রবৃত্তি থাকে না। ব্যুত্থিত অবস্থায় থাকলেও বিষয়ানুসন্ধানে উদাসীন হওয়ায় তাঁর হর্ষবিষাদের অভাব হয় এবং সুখ-দুঃখে সমতা দেখা যায়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ভক্তিযোগে স্বয়ং শ্রীভগবান্ কর্তৃক ভগবদ্ভক্তের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে

"যিনি সকল প্রাণীর প্রতি দ্বেষহীন, মিত্রভাবাপন্ন, দয়ালু, মমত্ববুদ্ধিশূন্য, নিরহংকার, সুখে আসক্তি ও দুঃখে দ্বেষবর্জিত, ক্ষমাশীল, সর্বদা সন্তুষ্ট, সদা সমাহিতচিত্ত, সদা সংযতস্বভাব, সদা তত্ত্ববিষয়ে দৃঢ়নিশ্চয় এবং যাঁর মন ও বুদ্ধি সর্বদা আমাতে অর্পিত, তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত।"- (শ্রীগীতা, ১২/১৩-১৪)

যিনি সর্বতোভাবে ব্রহ্মভাবাপন্ন হয়েছেন তাঁর জাগতিক বিষয়ে আসক্তি সম্পূর্ণভাবে চলে যায়। ফলতঃ তিনি বৈষয়িক যাবতীয় দ্বন্দ্বসমূহে উদাসীন থাকেন। শত্রু-মিত্র-মান-অপমান, সুখ-দুঃখ-হর্ষ-বিষাদএসকল  জাগতিক বিষয়জ। নির্বিকার, নির্গুণ ব্রহ্মসত্তায় এই দ্বন্দ্বসমূহ থাকে না। ভগবদ্ভক্ত এরূপে বক্ষ্যমাণ দ্বন্দ্বসমূহেতেও সমভাবে অবস্থান করেন। শ্রীগীতায় ভগবান বলেছেন

"যিনি কাউকেও উদ্বিগ্ন করেন না, যিনি কারও দ্বারা উদ্বিগ্ন হন না এবং যিনি হর্ষ ও বিষাদ, ভয় ও উদ্বেগ হতে মুক্ত, তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত। যিনি নিঃস্পৃহ, বাহ্যাভ্যন্তর শুচি, দক্ষ, পক্ষপাতশূন্য, ভয়হীন এবং সকাম কর্মের অনুষ্ঠান-ত্যাগী, তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত। যিনি ইষ্টপ্রাপ্তিতে হৃষ্ট হন না, অনিষ্টপ্রাপ্তিতে দ্বেষ করেন না, প্রিয়বিয়োগে শোক করেন না, অপ্রাপ্ত ইষ্টবস্তু আকাঙ্ক্ষা করেন না এবং শুভাশুভ সকল কর্ম পরিত্যাগ করেছেন, তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত। যিনি আসক্তিহীন এবং শত্রু ও মিত্রে সমবুদ্ধি, যিনি সম্মানে ও অপমানে অবিচলিত, যিনি শীতোষ্ণজনিত সুখে ও দুঃখে নির্বিকার, পরমাত্মাতে স্থিরবুদ্ধি, প্রশংসায় হর্ষ ও নিন্দায় বিষাদশূন্য সুতরাং সংযতবাক্‌, সর্বাবস্থায় যৎকিঞ্চিৎ-লাভে সন্তুষ্ট এবং নির্দিষ্টবাসস্থানহীন তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত।"-(শ্রীগীতা, ১২/১৫-১৯)

ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তিগণ কোন বিষয়েই ভীত হন না। এটা ভাগবতের কথা। ঈশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক প্রেমের নাম ভক্তি। এই প্রেমের স্বরূপ বর্ণনার অতীত অর্থাৎ অনির্বচনীয়। সর্বগুণাতীত, সমস্ত বাসনার অতীত, চিরবর্ধমান, চিরবিচ্ছেদহীন, সূক্ষ্মতম অনুভূতি প্রেম। এই ভক্তি প্রেমামৃত। ভক্তি লাভ করলে মানুষ পূর্ণ হয়, অমর হয়, চিরতৃপ্তির অধিকারী হয়। তখন ভক্ত আর কিছুই চায় না এবং দ্বেষ ও অভিমান-শূন্য হয়। কোন বাসনাপূরণের জন্য ইহাকে ব্যবহার করা চলে না, কারণ তা সর্ববিধ বাসনার নিবৃত্তি-স্বরূপ। যার সমগ্র সত্তা ঈশ্বরে নিবদ্ধ, সেই-ই ভক্তিপথের সন্ন্যাসী; যা কিছু তার ভগবদ্‌ভক্তির বিরোধী, তাই সে ত্যাগ করে। অন্য সব আশ্রয় ত্যাগ করিয়া সে একমাত্র ভগবানের শরণাগত হয়। ভক্তিতে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হইলে দেহরক্ষার জন্য যাহা প্রয়োজন, তদতিরিক্ত সমস্ত লৌকিক আচরণই পরিত্যক্ত হয়। ভগবৎপ্রসঙ্গ করতে গেলে তাঁদের কথা কণ্ঠে রুদ্ধ হয়, তাঁরা কেঁদে ফেলেন; তীর্থকে তাঁরাই পবিত্র করেন; তাঁদের কর্ম শুভ; তাঁরা সদ্গ্রন্থকে অধিকতর সদ্‌ভাবাপন্ন করে তোলেন; কারণ তাঁরা ভগবানের সঙ্গে একাত্ম। ইতি নারদ বচন।

তাইতো স্বয়ং ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য বলেছেন

ভজ গোবিন্দম্ ভজ গোবিন্দম্

গোবিন্দম্ ভজ মূঢ়মতে।

সম্প্রাপ্তে সন্নিহিতে কালে

নহি নহি রক্ষতি ডুকৃঙ্করণে॥

ওরে ও অবোধ, আন ফিরিয়ে বোধ,

শ্রীগোবিন্দের নাম গা ।।

শেষের সময় আসবে যখন ,,

বৃথা হবে শিক্ষা- 'ব্যাকরণ '

সার হবে এক পতিতপাবন ,

সেই যে এক সাধা...

শ্রীগোবিন্দ -র নাম গা ।।

........................

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ২৩, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

পুরুষার্থ কি?

 


পুরুষ যার দ্বারা প্রযত্নবান হয়ে কর্ম করে, তাই পুরুষার্থ।সর্বতন্ত্র-স্বতন্ত্র মহাপ্রাজ্ঞ ধর্মরাজাধ্বরীন্দ্র বেদান্ত-পরিভাষায় বলেছেন—"ধর্মার্থকামমোক্ষাখ্যেষু চতুর্বিধ-পুরুষার্থেষু।"

ইতিহাস, পুরাণ প্রভৃতিতে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষকে পুরুষার্থ বলে উক্ত হয়েছে এবং লোকেও এরা পুরুষার্থ বলে প্রসিদ্ধ। মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত আছে— "ধর্মে চার্থে চ কামে চ মোক্ষে চ ভরতর্ষব। যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নেহাস্তি ন তৎ ক্কচিৎ।"-(মহাভারত-১.৬২.৫৩)

বিষ্ণুপুরাণে বর্ণিত আছে—"ধর্মার্থকামমোক্ষাখ্যাঃ পুরুষার্থা উদাহৃতাঃ-(বিষ্ণুপুরাণ-১.১৮.২১)

ধর্মের স্বরূপ সম্বন্ধে আচার্যগণের মধ্যে মতভেদ আছে। সাংখ্য মতে যাগাদির অনুষ্ঠান জন্য অন্তঃকরণের বৃত্তিবিশেষই ধর্ম। ন্যায় ও বৈশেষিক মতে যাগাদি জন্য আত্মার অদৃষ্ট নামক বিশেষ গুণই ধর্ম। ভট্ট কুমারিল শ্লোকবার্ত্তিকে এই সকল মতের খণ্ডন করে শবর স্বামীর মতানুসারে বেদ বিহিত যাগ, দান, হোম প্রভৃতি কর্মকেই ধর্ম বলেছেন। শ্লোকবার্তিক ও তার টীকা কাশিকা প্রভৃতি দেখলে এ সম্বন্ধে অনেক কথা জানা যাবে। ঐ কর্মগুলো স্বরূপতঃ ধর্ম নয়, শ্রেয়ঃ সাধনরূপেই ধর্ম। কর্ম স্বরূপতঃ প্রত্যক্ষ হলেও ওর ধর্ম শ্রেয়ঃসাধনত্ব প্রত্যক্ষ নয়। তাই কর্ম বা ধর্ম শ্রেয়ঃ সাধনরূপে অলৌকিক অতীন্দ্রিয়। অর্থ হল লোক প্রসিদ্ধ ধন-সম্পত্তি। ধর্ম ও অর্থ এই দুটি সুখের হেতু বলে গৌণ পুরুষার্থ। কাম হল বিষয় ও ইন্দ্রিয়ের সম্বন্ধবশতঃ উৎপন্ন সুখবিশেষ। মোক্ষ হল অবিদ্যা-নিবৃত্তি-স্বরূপ আনন্দময় ব্রহ্ম। এই দুটি সুখ-স্বরূপ বলে মুখ্য পুরুষার্থ। তন্মধ্যে ব্রহ্ম-রূপ মোক্ষ পরম পুরুষার্থ। অন্য কোন পুরুষার্থ পরম পুরুষার্থ নয়।.......................

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ২১, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

Tuesday, 13 December 2022

"নির্বিশেষ অদ্বৈতবাদ বা অভেদবাদে ভেদজ্ঞানমূলক কর্ম ও উপাসনা অসম্ভব, তাই বেদের কর্মকাণ্ড নিরর্থক হয়ে পড়ে", অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে এরূপ আপত্তির উত্তরঃ-

 


পূর্বপক্ষঃ- অগ্নিহোত্র প্রভৃতি যাগ যজ্ঞ এবং ভগবানের ধ্যান, পূজা, উপাসনা প্রভৃতি সমস্তই ভেদজ্ঞানমূলক (দ্বৈত সাপেক্ষ), নির্বিশেষ অদ্বৈতবাদ বা অভেদবাদে কর্ম ও উপাসনার স্থান কোথায়? জীব ও ব্রহ্মের ঐক্যই যদি বেদান্তের সিদ্ধান্ত হয়, তবে বেদের কর্মকাণ্ড বা সংহিতাভাগ ও উপাসনাশাস্ত্রসমূহের সহিত উপনিষদের বিরোধ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। 

উত্তরপক্ষঃঅদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে এরূপ আপত্তিকর প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠে থাকে। এই প্রশ্নের উত্তরে আচার্য গৌড়পাদ্ বলেন যে, কর্ম ও উপাসনার ফলে যে দ্বৈতমূলক অধ্যাত্মতত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়, তা প্রকৃত আত্মতত্ত্বজ্ঞান নয়, ওটা গৌণ বা ব্যবহারিক আত্মজ্ঞান। অবশ্য এই আত্মজ্ঞানও নিরর্থক নয়, কারণ তা মন্দ ও মধ্যম অধিকারীর প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞান লাভের উপায় স্বরূপ—"উপায়ঃ সোঽবতারায়"-(মাণ্ডুক্য কারিকা-৩/১৫) এই সোপানাবলী অতিক্রম করেই ঐ সকল অনুন্নত অধিকারীরা অদ্বৈত বিজ্ঞান মন্দিরের চত্বরে প্রবেশ করতে পারে।

বেদান্তদর্শনে ব্রহ্মবিদ্যা নিজের উৎপত্তিতে কাম্যবর্জ্জিত নিত্যনৈমিত্তিককর্ম্মরূপ বহিরঙ্গ সাধন এবং শমদমাদিরূপ অন্তরঙ্গ সাধনসাপেক্ষ। আচার্য শঙ্কর ব্রহ্মসূত্রের (৩/৪/২৬) এর ভাষ্যে স্পষ্ট বলছেন—"ব্রহ্মবিদ্যা আশ্রমবিহিত কাম্যবর্জ্জিত নিত্য ও নৈমিত্তিক সকল কর্ম্মকে অপেক্ষা করে, অত্যন্ত অনপেক্ষ অবশ্যই নয়।" তাতে প্রমাণ কি? যেহেতু যজ্ঞাদিবোধক শ্রতিবাক্য আছে, যথা-

'তমেতং বেদানুবচনেন ব্রাহ্মণা বিবিদিষন্তি যজ্ঞেন দানেন তপসানাশকেন '-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৪/২২)

অর্থাৎ সেই উপনিষৎপ্রতিপাদ্য ব্রহ্মকে ব্রাহ্মণগণ বেদপাঠ, যজ্ঞ, দান ও যথেচ্ছ ভোজন না করারূপ তপস্যার দ্বারা জানতে ইচ্ছা করেন।"

কর্ম্মের কি প্রয়োজন? উত্তর হল চিত্তশুদ্ধি, যথা—"এতেষাং নিত্যাদীনাং বুদ্ধিশুদ্ধিঃ পরং প্রয়োজনম্"-(বেদান্তসার-১৩) অর্থাৎ এই সকল নিত্যাদি কর্মের প্রধান প্রয়োজন বুদ্ধিকে শুদ্ধ করা।

আচার্য শঙ্কর ভগবদ্গীতার (৩/৪) ভাষ্যে বিষয়টা আরও স্পষ্ট করেছেন—"কর্ম্মনিষ্ঠা চিত্তশুদ্ধি দ্বারা জ্ঞাননিষ্ঠা বা পুরুষার্থের সাধক হয়। কর্মনিষ্ঠা জ্ঞাননিষ্ঠার হেতু বলে পরতন্ত্রভাবে পুরুষার্থের কারণ হয়, স্বতন্ত্রভাবে নয়। এই অর্থ দেখাবার জন্য ভগবান বলছেন- সত্ত্বশুদ্ধি ও জ্ঞানোৎপত্তিদ্বারা জ্ঞাননিষ্ঠার হেতু যজ্ঞাদি কর্ম্মসকলের অনারম্ভ অর্থাৎ প্রারম্ভ না করে পুরুষ ইহজন্মে বা জন্মান্তরে নৈষ্কর্ম্যভাব অর্থাৎ কর্ম্মশুন্যতা ও নিষ্ক্রিয় আত্ম-স্বরূপে অবস্থিতি প্রাপ্ত হয় না। আবার কেবলমাত্র সন্ন্যাস অর্থাৎ জ্ঞানশূন্য কর্ম্মত্যাগ হতে সিদ্ধি অর্থাৎ নৈষ্কর্ম্যলক্ষণা জ্ঞানযোগনিষ্ঠা সম্যক্ রূপে অধিগত হয় না।"

মহাভারতেও অন্যত্র বলা হচ্ছে-“পুরুষের পাপের ক্ষয় হলে জ্ঞান অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধি দ্বারা জ্ঞানাভ্যাস যোগ্যতা উৎপত্তি হয়।”-(শান্তিপর্ব-২০৪।৮).

ব্রহ্মলোকে ঈশ্বরীয় ঐশ্বর্যভোগ এবং মুক্তি, এই উভয়প্রকার আকাঙ্ক্ষাযুক্ত ব্যক্তির হয় উপাসনাতে প্রবৃত্তি। মায়াশক্তিযোগে নির্গুণপরব্রহ্মই সগুণপরব্রহ্মরূপে অঙ্গীকৃত হন। প্রতীকাবলম্বনা সাকার ব্রহ্মের উপাসনা অদ্বৈতবেদান্তে অঙ্গীকৃত হয়। ব্রহ্মসূত্রের (৩/২/১৫) ভাষ্যে শঙ্করাচার্য বলেছেন— "ব্রহ্মাপি পৃথিব্যাদ্যুপাধিসংবন্ধাত্ তদাকারতামিব প্রতিপদ্যতে; তদালম্বনো ব্রহ্মণ আকারবিশেষোপদেশ উপাসনার্থো ন বিরুধ্যতে" অর্থাৎ 'ব্রহ্মও পৃথিবী প্রভৃতি উপাধির সহিত সম্বন্ধবশতঃ যেন সেই আকারকেই প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। উপাধি যাহার অবলম্বন, এতাদৃশ যে ব্রহ্মের আকারবিশেষের উপদেশ, তাহা উপাসনার জন্য এইজন্য সবিশেষতা ও নির্বিশেষতা জ্ঞাপিকা শ্রুতি বিরোধগ্রস্ত হয় না।'

শ্রুতিতেও উপাসনার জন্য সাকার ব্রহ্মের বর্ণনা আছে, যথা— "হিরণ্ময়ঃ পুরুষঃ হিরণ্যশ্মশ্রুঃ হিরণ্যকেশঃ" (ছান্দোগ্য উপনিষৎ-১/৬/৬), "বহুশোভমানাম্ উমাং হৈমবতীম্" (কেন উপনিষৎ ৩/১২) ইত্যাদি। লক্ষ্য করতে হবে— 'সাকার উপাসনা' শব্দে শঙ্করাচার্য বিভিন্ন শাস্ত্রে প্রতিপাদিত শিব, বিষ্ণু, শক্তি প্রভৃতি যাবতীয় সাকার বিগ্রহই গ্রহণ করলেন; সুতরাং আচার্য শঙ্করের অদ্বৈত মতবাদকে অসাম্প্রদায়িক বলতে হবে।

প্রতিমাদি প্রতীকাবলম্বনা সাকার ব্রহ্মোপাসনাও ক্রমশঃ অপ্রতীকাবলম্বনা উপাসনাতে পরিণত হয়ে সিদ্ধ সাধককে ক্রমমুক্তি প্রদান করে। "সর্ব্বকালে সর্ব্বাবস্থাতে শ্রীভগবানের শ্রীমূর্ত্তি যাঁর হৃদয়ে প্রতিভাত হতে থাকেন, তিনিই সিদ্ধপুরুষ"। শমদমাদি সহকৃত শুভকর্মানুষ্ঠান, স্বাধ্যায়, বিষয়বৈরাগ্য, ভগবান্ নামগুণকীর্তন, তন্নামজপ, তন্মূর্তিধ্যান ইত্যাদি, প্রসিদ্ধ সাধনসকলই এই মতে সাধনরূপে অঙ্গীকৃত হয়। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের (২/২/৪২) ভাষ্যে বলছেন—

 "পরমেশ্বরংভগবন্তমভিগমনোপাদানেজ্যাস্বাধ্যাযযোগৈর্বর্ষশতমিষ্ট্বা ক্ষীণক্লেশো ভগবন্তমেব প্রতিপদ্যত ইতি৷" অর্থাৎ পরমেশ্বরকে অভিগমন, উপাদান, ইজ্যা, স্বাধ্যায় এবং যোগের দ্বারা শতবর্ষ অর্থাৎ যাবজ্জীবন উপাসনাকরতঃ ক্ষীণক্লেশ হয়ে জীব ভগবানকেই প্রাপ্ত হয়। এই সূত্রের ভাষ্যে ভাষ্যকার আর বলছেন—

"ভগবতোভিগমনাদিলক্ষণমারাধনমজস্রমনন্যচিত্ততযাভিপ্রেয়তে" অর্থাৎ 'সেই ভগবানের অভিগমনাদিরূপ আরাধনা অনন্যচিত্ত হয়ে অজস্রভাবে অভিপ্রায় করা হয়।' সর্বোপরি পরমেশ্বরের অনুগ্রহই ব্রহ্মবিদ্যালাভ ও মোক্ষের হেতুরূপে এই মতে অঙ্গীকৃত হয়, ব্রহ্মসূত্রের (২/৩/৪২) সূত্রের ভাষ্যে "তদনুগ্রহহেতুকেনৈব চ বিজ্ঞানেন মোক্ষসিদ্ধিঃ" অর্থাৎ 'তাঁর অনুগ্রহই যার হেতু, সেই বিজ্ঞান দ্বারা জীবের মোক্ষ সিদ্ধ হয়' ইত্যাদি ভাষ্যকারের বচন দ্রষ্টব্য।

…..........................................................

শ্রীশুভ চৌধুরী।

ডিসেম্বর ১১, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

Friday, 9 December 2022

অদ্বৈতবেদান্তে জীবের স্বরূপঃ-

 


বেদান্তে জীব ব্রহ্মেরই প্রতিচ্ছবি বা প্রতিবিম্ব। সূর্য যেমন বিভিন্ন জলপূর্ণ পাত্রে প্রতিফলিত হয়ে থাকে, ব্রহ্মও সেইরূপ বিভিন্ন অন্তঃকরণ বা বুদ্ধিদর্পনে প্রতিফলিত হয়ে থাকেন। এই প্রতিবিম্বই জীব। বিম্ব ও প্রতিবিম্ব অভিন্ন সুতরাং ব্রহ্ম ও ব্রহ্মপ্রতিবিম্ব জীব বস্তুতঃ অভিন্ন। এই মত অদ্বৈতবেদান্তে 'প্রতিবিম্ববাদ' বলে প্রসিদ্ধ।

ভগবান্ সূত্রকার বাদরায়ণ বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রে বলেছেন "আভাস এব চ"-(ব্রহ্মসূত্র-২.৩.৫০) ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য এই সূত্রের ভাষ্যে বলছেন"আভাস এব চ এষ জীবঃ পরস্যাত্মনো জলসূর্যকাদিবত্প্রতিপত্তব্যঃ, ন স এব সাক্ষাত্, নাপি বস্ত্বন্তরম্৷" অর্থাৎ "জলসূর্য (জলে সূর্যপ্রতিবিম্ব) যেমন বিম্বভূত সূর্যের আভাস (প্রতিবিম্ব), তেমনি জীবও পরমাত্মার আভাস (প্রতিবিম্ব) এটা জানতে হবে। যেহেতু আভাস সেহেতু জীব সাক্ষাৎ পরমাত্মা নয়, পদার্থান্তরও নয়।" যেমন একটি জলসূর্য কম্পিত হলে অন্য জলসূর্য কম্পিত হয় না, তেমনি এক জীবে কর্মফল-সম্বন্ধ ঘটলেও অন্য জীবকে তা স্পর্শ করে না। সূর্যের এই উপমাটি বাদরায়ণ তার ব্রহ্মসূত্রেও গ্রহণ করেছেন"অত এব চোপমা সূর্যকাদিবৎ৷"-(ব্রহ্মসূত্র-৩.২.১৮)

শ্রুতিও তাই বলছে "এক এব হি ভূতাত্মা ভূতে ভূতে ব্যবস্থিতঃ। একধা বহুধা চৈব দৃশ্যতে জলচন্দ্রবৎ॥"-(ব্রহ্মবিন্দু উপনিষৎ-১২) অর্থাৎ 'যেহেতু প্রাণিগণের এই একই আত্মা বিভিন্ন প্রাণীতে বিশেষভাবে অবস্থিত আছেন, তিনি জলমধ্যস্থ চন্দ্রের ন্যায় একরূপে ও বহুরূপে পরিদৃষ্ট হন।'

বুদ্ধি-প্রতিবিম্ব জীব স্বীয় অজ্ঞানবশতঃ বুদ্ধির ধর্ম সুখ, দুঃখ প্রভৃতি নিজের ধর্ম বলে মনে করে; মোহগ্রস্ত হয়ে শোক ও দৈন্যের অধীন হয়, স্বীয় নিত্যশুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্তস্বভাব বিস্মৃত হয়"অনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ"- মুণ্ডকশ্রুত্যোক্ত জীবের এই বিভ্রান্তিই জীবের মোহনিদ্রা। মায়াই এর মূল। ব্রহ্মের এই প্রতিবিম্ব অবিদ্যা কৃত সুতরাং জীবভাব ও জীবের সংসারলীলা প্রভৃতি সমস্তই অজ্ঞানের খেলা। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য ভাষ্যে বলছেন "আভাসস্য চ অবিদ্যাকৃতত্বাত্তদাশ্রয়স্য সংসারস্যাবিদ্যাকৃতত্বোপপত্তিরিতি" যেহেতু অবিদ্যা আভাসের জনক, সেহেতু আভাসাশ্রিত সংসারের অবিদ্যামূলকতা যুক্তিসিদ্ধ।

পরব্রহ্মের ঈশ্বরভাব যেরূপ মায়িক, জীবভাবও সেরূপ মায়িক। পার্থক্য এই যে ঈশ্বর সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তি, জীব অল্পজ্ঞ ও অল্পশক্তি। ঈশ্বর নিয়ন্তা, জীব তাঁর নিয়ম্য। মায়া ঈশ্বরের বশ, জীব মায়ার বশ। ঈশ্বরের উপাধি সমষ্টি মায়া, জীবের উপাধি ব্যষ্টি অবিদ্যা। সমষ্টি ও ব্যষ্টি উপাধির বিলয় হলে কি জীব, কি ঈশ্বর, সমস্তই অখণ্ড অনন্ত ভূমা ব্রহ্মে বিলীন হয়ে যাবে।

কোন কোন অদ্বৈতবেদান্তীর মতে জীব অখণ্ড ব্রহ্মের সখণ্ড অভিব্যক্তি। তাঁদের মতে জীব ঘটাকাশ, ব্রহ্ম মহাকাশ। অনন্ত, অখণ্ড মহাব্যোম যেমন ঘটাদি অবচ্ছেদ বা আবেষ্টনীর মধ্যে পড়ে ঘটাকাশ বলে অভিহিত হয়, সেইরূপ অন্তঃকরণের আবেষ্টনীর মধ্যে পড়ে অখণ্ড সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম, জীব সংজ্ঞা লাভ করে।ঘটাকাশ মহাকাশের সখণ্ড বা আংশিক অভিব্যক্তি, জীবও সেইরূপ পরমাত্মার আংশিক বিকাশ। এটাকেই অদ্বৈতবেদান্তে "অবচ্ছেদবাদ" বলা হয়। এই মতো বাদরায়ণ সম্মত এটা "অংশো নানাব্যপদেশাদন্যথা চাপি দাশকিতবাদিত্বমধীযত একে"-(ব্রহ্মসূত্র- ২.৩.৪৩) ইত্যাদি সূত্রে পরিলক্ষিত হয়। ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য ভাষ্যে বলিতেছেন-"এই হেতু সূত্রকার বলছেন- 'অংশ' ইত্যাদি। জীব ঈশ্বরের অংশ, এটাই সঙ্গত; যেমন বিস্ফুলিঙ্গ অগ্নির অংশ। এইখানে অংশ বলতে 'যেন অংশ' অর্থাৎ কল্পিত অংশ বুঝতে হবে, কারণ নিরবয়ব ব্রহ্মের মুখ্য অংশ সম্ভব নয়।"

জীবকে ব্রহ্মাগ্নির স্ফুলিঙ্গ, ব্রহ্মসিন্ধুর বিন্দুমাত্র। উপনিষৎ বলেছেন"যথা সুদীপ্তাৎপাবকাদ্বিস্ফুলিঙ্গাঃ সহস্রশঃ প্রভবন্তে সরূপাঃ"-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২.১.১) যেমন প্রদীপ্ত অগ্নি হতে সহস্র সহস্র বিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হয় সেইরূপ অক্ষর পুরুষ হতে বিবিধ জীব উৎপন্ন হয়ে থাকে এবং পরিণামে তাতেই বিলীন হয়।

শ্রীগীতায় ভগবান্ বাসুদেব স্পষ্টবাক্যেই জীবকে ব্রহ্মাংশ বলে বর্ণনা করেছেন। 'মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-১৫।৭) ভগবান্ শঙ্কর গীতার এই শ্লোকের ভাষ্যে বলছেন- "জীবলোকে অর্থাৎ সংসারে কর্তাভোক্তারূপে প্রসিদ্ধ জীব আমারই (পরমাত্মারই) সনাতন অংশ অর্থাৎ ভাগ বা অবয়ব বা একদেশ অর্থাৎ এইগুলি পরমাত্মা হইত পৃথক কোন অর্থান্তর নয়। সেই জীব আমার (পরমাত্মার) অংশ রূপে কল্পিত। জলরূপ নিমিত্ত অপসৃত হলে সূর্যাংশ জল-সূর্য যেরূপ সূর্যে লীন হয়, অথবা মহাকাশের অভিন্ন অংশ ঘটস্থ আকাশ যেরূপ ঘট নষ্ট হলে মহাকাশে মিলিত হয়, আর প্রত্যাগমন করে না, সেইরূপ ব্রহ্মাংশ জীব অবিদ্যাকৃত উপাধি-অপগমে ব্রহ্মপ্রাপ্ত হয়ে আর পুনরাবৃত্ত হয় না। কারণ জীব স্বরূপত ব্রহ্মই।"

পরমার্থতঃ ব্রহ্মভিন্ন জীব নামক কিছুই নেই। জীব স্বরূপতঃ ব্রহ্মই, বুদ্ধিরূপ উপাধিসম্বন্ধই জীবের জীবত্ব। সেই সম্বন্ধ ব্রহ্মাত্মজ্ঞানোদয় পর্য্যন্ত বর্তমান থাকে। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য ব্রহ্মসূত্রের (২.৩.৩০) শারীরকভাষ্যে তা স্পষ্ট করেছেন-

" বুদ্ধিসংযোগ (বুদ্ধির সহিত চৈতন্যের সম্বন্ধ) যাবদাত্মভাবী অর্থাৎ (ব্রহ্মাত্মজ্ঞানোৎপত্তি দ্বারা জীবাত্মভাবের উপশম না হওয়া পর্য্যন্ত স্থায়ী)। এই আত্মা যতকাল পর্য্যন্ত সংসারী থাকে, অর্থাৎ সম্যগ্ দর্শনের দ্বারা এর সংসারিত্ব যতকাল পর্য্যন্ত নিবৃত্ত না হয়, ততকাল পর্য্যন্ত বুদ্ধির সহিত এর সংযোগ নিবৃত্ত হয় না। আর যতকাল পর্যন্ত বুদ্ধিরূপ উপাধির সহিত এই সম্বন্ধ থাকে, ততকাল পর্যন্তই জীবের জীবত্ব ও সংসারিত্ব। পরমার্থতঃ কিন্তু বুদ্ধিরূপ উপাধির সহিত সম্বন্ধের দ্বারা পরিকল্পিত স্বরূপ ব্যতিরেকে জীব নামক কিছুই নেই। যেহেতু উপনিষদৎসকলের অর্থ নিরূপণ করলে নিত্যমুক্তস্বরূপ সর্ব্বজ্ঞ ঈশ্বর হতে ভিন্ন দ্বিতীয় চেতন ধাতু(-পদার্থ) উপলব্ধ হয় না;

'নান্যোতোস্তি দ্রষ্টা শ্রোতা মন্তা বিজ্ঞাতা'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৭।২৩)

অর্থাৎ 'ইঁহা হতে ভিন্ন কোন দ্রষ্টা, শ্রোতা, মননকর্ত্তা ও বিজ্ঞাতা নেই।'

'নান্যদতোস্তি দ্রষ্টৃ শ্রোতৃ মন্তৃ বিজ্ঞাতৃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৮।১১)

অর্থাৎ ''ইঁহা হতে ভিন্ন দ্রষ্টা, শ্রোতা, মনতা ও বিজ্ঞাতা কেউ নেই।'

'তত্ত্বমসি'-(ছান্দোগ্যোপনিষৎ ৬।৮।৭)

অর্থাৎ 'তুমিই তৎস্বরূপ।'

'অহং ব্রহ্মাস্মি' -(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-১।৪।১০)

অর্থাৎ 'আমিই ব্রহ্ম।'

ইত্যাদি শত শত শ্রুতি হতে তা অবগত হওয়া যায়।....."

তথ্যসূত্রঃ-

১. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের শ্রীগীতা ভাষ্য।

২. ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্র শারীরকমীমাংসা ভাষ্য।

৩. "বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।

........…....….…..........................................................

শ্রীশুভ চৌধুরী।

ডিসেম্বর ৮, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

শঙ্করাচার্য যে ভগবান শিবের অবতার, তার পুরাণাদি শাস্ত্রীয় প্রমাণঃ-

 


কলিযুগের প্রারম্ভে বেদান্তবেদ্য, সচ্চিৎ-সুখস্বরূপ, নিখিলাত্মা, বুদ্ধির অবেদ্য, অথচ অনবেদ্য, অনুভূতি রূপ, যাঁর প্রকাশে জগৎ প্রকাশ পাচ্ছে, সেই পূর্ণ পরমাত্মা লোক-শঙ্কর মহেশ্বর, লোক সকলের হিত সাধন বেদমত সংস্থাপন জন্য নিজ মায়াতে শঙ্করাচার্যরূপে অবনীতে অবতীর্ণ হয়ে অসার মত সমস্ত নিরস্ত এবং শ্রুতিসম্মত অদ্বৈতমত প্রচার সংস্থাপন করেছেন, আর শাস্ত্ররূপ বাগ্জাল মহারণ্যে ভ্ৰাম্যমান শ্রান্ত জনগণকে স্বধাম প্রাপ্তির সুন্দর সরল পথ দেখিয়ে সকল তাপ হতে বিমুক্ত করেছেন।

শ্রীকূর্ম মহাপুরাণের পূর্বভাগের ২৯তম অধ্যায়ের ব্যাসার্জুন-সংবাদের যুগধর্মে মহর্ষি বেদব্যাস অর্জুনকে বলেছেনকলিযুগে তমগুণসম্পন্ন মনুষ্যদের সৎমার্গ প্রদর্শন ভক্তগণের মঙ্গলার্থে ভগবান্ শঙ্কর জগদ্গুরু রূপে অবতীর্ণ হবেন।

করিষ্যত্যবতারাশি শঙ্করো নীললোহিতঃ।

শ্রৌতস্মার্ত্তপ্রতিষ্ঠার্থং ভক্তানাং হিতকাম্যয়া।।৩৩

উপদেক্ষ্যতি তজ্জ্ঞানং শিষ্যাণাং ব্রহ্মসংজ্ঞিতম্

সর্ববেদান্তসারং হি ধর্ম্মান্ বেদনিদর্শিতান্।।৩৪

বঙ্গানুবাদ"নীললোহিত ভগবান্ শঙ্কর ভক্তের মঙ্গলের নিমিত্ত অবতীর্ণ হবেন এবং শ্রৌত স্মার্ত্তমতের প্রতিষ্ঠার জন্য শিষ্যদের সকল বেদান্তের সার ব্রহ্মজ্ঞান বেদনির্দিষ্ট ধর্মসকল উপদেশ দিবেন।"

 

শিবরহস্য পুরাণের অংশে ১৬ অধ্যায়ে দেখা যায় ভগবান্ শঙ্করের দ্বিজোত্তম্ শঙ্করাচার্যরূপে অবতার কথা অতি বিস্তৃতভাবেই রয়েছে

(শিব উবাচ)

"মদংশজাতম্ দেবেশি কলাবপি তপোধনম্।

 কেরলেষু তথা বিপ্রম্ জনয়ামি মহেশ্বরী।।

তস্যৈব চরিতম্ তেদ্য বক্ষ্যামি শৃণু শৈলজে।

কল্পাদিমে মহাদেবি! সহস্রদ্বিতয়াৎ পরম্।।.........

কেরলে শললগ্রামে বিপ্রপত্ন্যাং মদংশতঃ।

ভবিষ্যতি মহাদেবি! শঙ্করাখ্যো দ্বিজোত্তমঃ।

উপনীতস্তদা মাত্রা বেদান্ সাঙ্গান্ গ্রহিষ্যতি।।

অব্দাবধি ততঃ শব্দে বিহত্য তু তর্কজাম।।

মতিমীমাংসমানোসৌ কৃত্বা শাস্ত্রেষু নিশ্চয়ম্।

বাদিমত্তদ্বিপবরান্ শঙ্করোত্তমকেশরী।।

ভিনত্ত্যেব মহাবুদ্ধান্ সিদ্ধবিদ্যানপি দ্রুতম্।

জৈনান্ বিজিগ্মে তরসা তথাহন্যান্ কুমতানুগান্।।

তদা মাতরমামন্ত্র্য পরিব্রাট্ ভবিষ্যতি।

পরিব্রাজকরূপেণ বিশ্রানাশ্রমদূষকান্।।

দণ্ডহস্তস্তথা কুণ্ডী কাষায়বসনোজ্জ্বলঃ।

ভস্মদিব্যত্রিপুণ্ড্রাঙ্কো রুদ্রাক্ষাভরণোজ্জ্বলঃ।।

তাররুদ্রার্থপারীণঃ শিবলিঙ্গার্চনপ্রিয়ঃ।

স্বশিষ্যৈস্তাদৃষৈর্যুষ্যন্ ভাষ্যবাক্যানি সোহম্বিকে।।

মদ্দত্তবিদ্যয়া ভিক্ষুর্বিরাজতি শশাঙ্কবত্।

সো দ্বৈতোচ্ছেদকান্ পাপানুচ্ছিদ্যাক্ষিপ্য তর্কতঃ।।"

-(শিবরহস্য পুরাণ .১৬.-২২)

 

(ভগবান্ শিব বললেন)—

"হে দেবেশ্বরী ! হে মহেশ্বরী ! কেরল ক্ষেত্রে আমার অংশ রূপে চন্দ্রতুল্য তপশ্চর্যায় বিশারদ হয়ে বিপ্ররূপে আবির্ভূত হবে। হে শৈলজে শোনো ! আমি এখন তাঁরই চরিত বলছি, হে মহাদেবী ! কলিযুগে দুই হাজার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরবর্তীকালের কথা। হে মহাদেবীভবিষ্যতকালে কেরলের শললগ্রামে বিপ্রপত্নী হতে দ্বিজোত্তম 'শঙ্কর' নামে আমার অংশ উৎপন্ন হবে। উপনয়ন হওয়া মাত্রই বেদ-বেদাঙ্গ গ্রহণ(অধ্যয়ন) করে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সে শব্দ দ্বারা বিপক্ষকে তর্কে পরাস্ত করার মতো বিদ্বান হয়ে উঠবে। সেই মহামতি শাস্ত্রের বিষয়সমূহের নিশ্চিতরূপে মীমাংসা করবে এবং বিদ্বানদের দলের মধ্যে শঙ্কর এমনভাবে শোভায়মান হবে যেভাবে হাতির দলে সিংহ শোভায়মান হয়। অতপর সে বৌদ্ধদের প্রসিদ্ধ মতবাদকে দ্রুত খণ্ডন করবে এবং জৈন অন্যান্য কুমতাবলম্বীদেরকেও শীঘ্রই জয় করবে। সে মাতা এবং পরিবারবর্গকে ত্যাগ করে পরিব্রাজকরূপে বর্ণাশ্রমধর্ম দূষণকারীদেরকে নিরস্ত করবে। হাতে দণ্ড কমণ্ডলু, শরীরে উজ্জ্বল গৈরিক বস্ত্র, ভস্মদ্বারা অঙ্কিত ত্রিপুণ্ড্র এবং রুদ্রাক্ষমালার অলঙ্করনে তাঁর দিব্যবিগ্রহ দেদীপ্যমান হবে। হে অম্বিকে ! তাঁর শিষ্যরাও তাঁর মতোই মোক্ষপ্রদায়ক শিবতত্ত্বে পারঙ্গম শিবলিঙ্গ অর্চনায় ভাবাবিষ্ট হবে এবং তাঁর মতোই বিদ্বান ভাষ্য রচনায় নিপুণ হবে। দ্বৈতবুদ্ধিসম্পন্ন পাপিষ্ঠদেরকে তর্কের দ্বারা দমন করে আমার অংশ সেই সন্ন্যাসী চন্দ্রের ন্যায় বিরাজমান থাকবে।"

 

তাছাড়া বায়ুপুরাণে চারশিষ্য সমেত শঙ্করাবতারের অবতীর্ণ হওয়া, শ্রুতি ব্যাসসূত্রের যথোচিত অর্থ রচিত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়া আছে, যথা"চতুর্ভিঃসহ শিষ্যৈস্তু শঙ্করোহবতরিষ্যতি। ব্যাকুর্বন্ ব্যাসসূত্রার্থং শ্রুতেরথং যথোচিবান্।। শ্রুতের্ন্যায্যঃ এবার্থঃ শঙ্করঃ সবিতানন।"

তাছাড়া শক্তিসঙ্গমতন্ত্রের ছিন্নমস্তাখণ্ডে বর্ণিত আছে

"যদা যদাসতাং হানির্ধর্মগ্লানির্মহেশ্বরি।।

 তদাবতারো দেবেশি হরের্ভবতি পার্বতি।

 হরিগর্বাপহারার্থং ভক্তানুগ্রহণায় চ।।

 ধর্মসংস্থাপনার্থং হি শঙ্করোঽবতরিষ্যতি।

 বারাহবক্ত্রনৃহরী যথা গর্বেণ তর্পিতান্।।

 তথা কলিযুগে প্রাপ্তে শঙ্করঃ কলিশঙ্করঃ।

 চতুর্দিক্ষু চতুঃপ্রেতা মধ্যরূপেণ পার্বতি।।

 মধ্যে স্বয়ং শঙ্করো হি সদা তিষ্ঠতি পার্বতি।

 বর্ষষোড়শপর্যন্তং সমরতং করিষ্যতি।।"

~ (শক্তিসঙ্গমতন্ত্রছিন্নমস্তাখণ্ড .৬৫(/)-৬৯)

 

ভাবার্থ; "হে মহেশ্বরী, হে পার্বতী, যখন যখন সদাচারসম্পন্নগণের হানি এবং ধর্মের গ্লানি হয়, হে দেবেশী, তখনই ভগবান বিষ্ণুর অবতার সংঘটিত হয়। বুদ্ধরূপী হরির গর্ব হরণ করার জন্য, ভক্তগণকে অনুগ্রহ করার জন্য তথা ধর্মসংস্থাপনার জন্যই শঙ্কর অবতরিত হবেন। ভগবান বরাহ এবং নৃসিংহ যেমন গর্বদ্বারা তর্পিত অসুরগণকে নষ্ট করার জন্য অবতরিত হয়েছিলেন, হে পার্বতী ! তেমনভাবে কলিযুগে ভগবান শঙ্কর সাক্ষাৎ কলির শঙ্কররূপে অবতরণ করে চারদিকে চারপ্রেতগণকে নিয়ে তাঁদের মধ্যমণিরূপে সর্বদা মধ্যে অবস্থান করে সেই শঙ্কর ষোলোবছর পর্যন্ত সমানভাবে অবতারলীলা করবেন।।"

এরপরে, কলিযুগে ভগবান আদিশঙ্করাচার্য্যকেই দিব্যসাম্রাজ্যদীক্ষিত গুরু বলে উল্লেখ করে সেই ক্রম বর্ণনা করতে গিয়ে ক্রমান্বয়ে ভগবৎপাদাচার্য্য কর্তৃক স্থাপিত চতুরাম্নায় মঠসমূহের উল্লেখ করা হয়েছে ;

"পঞ্চপ্রেতাশিনস্তে শঙ্করঃ শঙ্করঃ স্বয়ম্।

 পূর্বাম্নায়ো ভবেত্ পূর্বভাগে গোবর্ধনো মঠঃ।।"

শক্তিসঙ্গমতন্ত্র , ছিন্নমস্তাখণ্ড (.৭৫)

"সেই পঞ্চপ্রেতগণ প্রজ্ঞাবান এবং (তাঁদের মধ্যে যিনি) ভগবৎপাদ শঙ্কর (তিনি) স্বয়ং শিব। (তাঁর দ্বারা) পূর্বভাগে পূর্বাম্নায় গোবর্ধন মঠ স্থাপিত হবে।।"

 

"দক্ষিণে দক্ষিণাম্নায়ঃ শৃঙ্গেরীমঠ এব চ।

 ভূবারাখ্যঃ সম্প্রদায়ঃ পদং চৈব সরস্বতী।।

 শ্রীপুরী ভারতী দেবি ক্ষেত্রং রামেশ্বরাভিধম্।

 আদিবারাহরূপী তু দেবতা পরিকীর্তিতা।।"

শক্তিসঙ্গমতন্ত্র, ছিন্নমস্তাখণ্ড (.৭৯-৮০)

"হে দেবী ! দক্ষিণে দক্ষিণাম্নায় শৃঙ্গেরীমঠ, ভূবার নামক সম্প্রদায়, সন্ন্যাসপদ হলো সরস্বতী, পুরী এবং ভারতী। রামেশ্বর ক্ষেত্র এবং আদিবারাহরূপী ভগবানকে (সেই মঠের) দেবতা বলা হয়েছে।।"

"অথ বৈ পশ্চিমাম্নায়ে শারদামঠ ঈরিতঃ।

 সম্প্রদায়ঃ কীটবাররতীর্থাশ্রমপদে ভবেত্।।"

শক্তিসঙ্গমতন্ত্র / ছিন্নমস্তাখণ্ড (.৮৪)

"এখন পশ্চিমাম্নায়ে শারদামঠ, কীটবার সম্প্রদায় এবং তীর্থ আশ্রম সন্ন্যাসপদ হবে।।"

"উত্তরে চোত্তরাম্নায়ঃ শ্রীজ্যোতির্মঠ ইত্যপি।।

 সম্প্রদায়ো নন্দবারো গিরিপর্বতসাগরাঃ।

 পদং প্রোক্তং মহেশানি ক্ষেত্রং বদরিকা ভবেত্।।"

শক্তিসঙ্গমতন্ত্র / ছিন্নমস্তাখণ্ড [.৮৭(/)-৮৮]

"হে মহেশানী ! এবং উত্তরে উত্তরাম্নায় শ্রী জ্যোতির্মঠ, নন্দবার সম্প্রদায়। গিরি, পর্বত, সাগর সন্ন্যাসপদ এবং বদরিকা ক্ষেত্র হবে।।"

তদনন্তর কিছু শ্লোক পরে বলা হচ্ছে ;

"চতুর্ভিঃ সহ শিষ্যৈস্তু শঙ্করোঽবতরিষ্যতি।

 শঙ্করঃ শঙ্করঃ সাক্ষাত্ ব্যাসো নারায়ণো হরিঃ।।"

শক্তিসঙ্গমতন্ত্র , ছিন্নমস্তাখণ্ড (.৯৮)

"চারজন শিষ্যসহ শঙ্কর (কলিযুগে) অবতরণ করবেন। ভগবৎপাদ শঙ্কর সাক্ষাৎ শিব এবং বেদব্যাস স্বয়ং শ্রীহরি নারায়ণ।।"

এখানে ভগবান বেদব্যাস এবং ভগবান আদিশঙ্করাচার্য্যের অবতারত্বের বিষয় একত্রে উল্লেখ করে এটাই প্রতিপাদন করা হয়েছে যে ভগবান আদিশঙ্করাচার্য্যই ভগবান ব্যাসের পরম্পরা প্রাপ্ত হয়েছেন। আরও কিছু শ্লোক পরে ভগবান আদিশঙ্করাচার্য্যের দশনামী পরম্পরায় সন্ন্যাসের যে দশ পদ বা নাম রয়েছে সেগুলো উল্লেখ করা হয়েছে,

"সরস্বতী ভারতী পর্বতারণ্যসাগরাঃ।

 গিরিঃ পুরী বনস্তীর্থশ্চাশ্রমো দশমঃ স্মৃতঃ।।"

 শক্তিসঙ্গমতন্ত্র / ছিন্নমস্তাখণ্ড (.১০৪)

"সরস্বতী, ভারতী, পর্বত, অরণ্য, সাগর, গিরি, পুরী, বন, তীর্থ এবং আশ্রম, এই দশ (সন্ন্যাসাশ্রমের পদ/নাম) বলা হয়েছে।।"

অনন্তর কয়েক শ্লোক পরে ভগবান আদিশঙ্করাচার্য্য এবং তাঁর চার প্রমুখ শিষ্যগণই (সুরেশ্বরাচার্য্য, ত্রোটক বা তোটকাচার্য্য, হস্তামলকাচার্য্য এবং পদ্মপাদাচার্য্যযে পঞ্চপ্রেত তা পুনরায় নিশ্চিত করা হয়েছে ;"শঙ্করশ্চ মহেশানি হস্তামলক এব চ।  সুরেশ্বরস্ততঃ প্রোক্তস্ত্রোটকস্তদনন্তরম্।। পদ্মপাদঃ পঞ্চমঃ স্যাদ্ পঞ্চপ্রেতানুকল্পনম্।" ~ শক্তিসঙ্গমতন্ত্রছিন্নমস্তাখণ্ড [.১১২-১১৩(/)]

 

ঋণঃ- 

১. স্বামী চিদ্ঘনানন্দ পুরীর "আচার্য শঙ্কর ও রামানুজ" শীর্ষক গ্রন্থ।

২. বেশ কিছু তথ্যসংগ্রহ ও কৃতঞ্চতায় Thakur Vishal

......................................................................

শ্রীশুভ চৌধুরী।

ডিসেম্বর ৯, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...