কলিযুগের
প্রারম্ভে বেদান্তবেদ্য, সচ্চিৎ-সুখস্বরূপ, নিখিলাত্মা, বুদ্ধির অবেদ্য, অথচ অনবেদ্য, অনুভূতি
রূপ, যাঁর প্রকাশে জগৎ
প্রকাশ পাচ্ছে, সেই পূর্ণ পরমাত্মা
লোক-শঙ্কর মহেশ্বর, লোক সকলের হিত
সাধন ও বেদমত সংস্থাপন
জন্য নিজ মায়াতে শঙ্করাচার্যরূপে
অবনীতে অবতীর্ণ হয়ে অসার মত
সমস্ত নিরস্ত এবং শ্রুতিসম্মত অদ্বৈতমত
প্রচার ও সংস্থাপন করেছেন,
আর শাস্ত্ররূপ বাগ্জাল মহারণ্যে
ভ্ৰাম্যমান শ্রান্ত জনগণকে স্বধাম প্রাপ্তির সুন্দর ও সরল পথ
দেখিয়ে সকল তাপ হতে
বিমুক্ত করেছেন।
শ্রীকূর্ম
মহাপুরাণের পূর্বভাগের ২৯তম অধ্যায়ের ব্যাসার্জুন-সংবাদের যুগধর্মে মহর্ষি বেদব্যাস অর্জুনকে বলেছেন— কলিযুগে তমগুণসম্পন্ন মনুষ্যদের সৎমার্গ প্রদর্শন ও ভক্তগণের মঙ্গলার্থে
ভগবান্ শঙ্কর জগদ্গুরু রূপে অবতীর্ণ হবেন।
করিষ্যত্যবতারাশি
শঙ্করো নীললোহিতঃ।
শ্রৌতস্মার্ত্তপ্রতিষ্ঠার্থং
ভক্তানাং হিতকাম্যয়া।।৩৩
উপদেক্ষ্যতি
তজ্জ্ঞানং শিষ্যাণাং ব্রহ্মসংজ্ঞিতম্
সর্ববেদান্তসারং
হি ধর্ম্মান্ বেদনিদর্শিতান্।।৩৪
বঙ্গানুবাদ—
"নীললোহিত ভগবান্ শঙ্কর ভক্তের মঙ্গলের নিমিত্ত অবতীর্ণ হবেন এবং শ্রৌত
ও স্মার্ত্তমতের প্রতিষ্ঠার জন্য শিষ্যদের সকল
বেদান্তের সার ব্রহ্মজ্ঞান ও
বেদনির্দিষ্ট ধর্মসকল উপদেশ দিবেন।"
শিবরহস্য
পুরাণের ৯ অংশে ১৬
অধ্যায়ে দেখা যায় ভগবান্
শঙ্করের দ্বিজোত্তম্ শঙ্করাচার্যরূপে অবতার কথা অতি বিস্তৃতভাবেই
রয়েছে—
(শিব উবাচ)
"মদংশজাতম্ দেবেশি
কলাবপি তপোধনম্।
কেরলেষু
তথা বিপ্রম্ জনয়ামি মহেশ্বরী।।
তস্যৈব
চরিতম্ তেদ্য বক্ষ্যামি শৃণু শৈলজে।
কল্পাদিমে
মহাদেবি! সহস্রদ্বিতয়াৎ পরম্।।.........
কেরলে
শললগ্রামে বিপ্রপত্ন্যাং মদংশতঃ।
ভবিষ্যতি
মহাদেবি! শঙ্করাখ্যো দ্বিজোত্তমঃ।
উপনীতস্তদা
মাত্রা বেদান্ সাঙ্গান্ গ্রহিষ্যতি।।
অব্দাবধি
ততঃ শব্দে বিহত্য স তু তর্কজাম।।
মতিমীমাংসমানোসৌ
কৃত্বা শাস্ত্রেষু নিশ্চয়ম্।
বাদিমত্তদ্বিপবরান্
শঙ্করোত্তমকেশরী।।
ভিনত্ত্যেব
মহাবুদ্ধান্ সিদ্ধবিদ্যানপি দ্রুতম্।
জৈনান্
বিজিগ্মে তরসা তথাহন্যান্ কুমতানুগান্।।
তদা
মাতরমামন্ত্র্য পরিব্রাট্ স
ভবিষ্যতি।
পরিব্রাজকরূপেণ
বিশ্রানাশ্রমদূষকান্।।
দণ্ডহস্তস্তথা
কুণ্ডী কাষায়বসনোজ্জ্বলঃ।
ভস্মদিব্যত্রিপুণ্ড্রাঙ্কো
রুদ্রাক্ষাভরণোজ্জ্বলঃ।।
তাররুদ্রার্থপারীণঃ
শিবলিঙ্গার্চনপ্রিয়ঃ।
স্বশিষ্যৈস্তাদৃষৈর্যুষ্যন্
ভাষ্যবাক্যানি সোহম্বিকে।।
মদ্দত্তবিদ্যয়া
ভিক্ষুর্বিরাজতি শশাঙ্কবত্।
সো
দ্বৈতোচ্ছেদকান্ পাপানুচ্ছিদ্যাক্ষিপ্য তর্কতঃ।।"
-(শিবরহস্য পুরাণ
৯.১৬.৭-২২)
(ভগবান্ শিব
বললেন)—
"হে দেবেশ্বরী
! হে মহেশ্বরী ! কেরল ক্ষেত্রে আমার
অংশ রূপে চন্দ্রতুল্য ও
তপশ্চর্যায় বিশারদ হয়ে বিপ্ররূপে আবির্ভূত
হবে। হে শৈলজে শোনো
! আমি এখন তাঁরই চরিত
বলছি, হে মহাদেবী ! কলিযুগে
দুই হাজার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার
পরবর্তীকালের কথা। হে মহাদেবী
! ভবিষ্যতকালে
কেরলের শললগ্রামে বিপ্রপত্নী হতে দ্বিজোত্তম 'শঙ্কর'
নামে আমার অংশ উৎপন্ন
হবে। উপনয়ন হওয়া মাত্রই বেদ-বেদাঙ্গ গ্রহণ(অধ্যয়ন) করে মাত্র কয়েক
বছরের মধ্যেই সে শব্দ দ্বারা
বিপক্ষকে তর্কে পরাস্ত করার মতো বিদ্বান
হয়ে উঠবে। সেই মহামতি শাস্ত্রের
বিষয়সমূহের নিশ্চিতরূপে মীমাংসা করবে এবং বিদ্বানদের
দলের মধ্যে শঙ্কর এমনভাবে শোভায়মান হবে যেভাবে হাতির
দলে সিংহ শোভায়মান হয়।
অতপর সে বৌদ্ধদের প্রসিদ্ধ
মতবাদকে দ্রুত খণ্ডন করবে এবং জৈন
ও অন্যান্য কুমতাবলম্বীদেরকেও শীঘ্রই জয় করবে। সে
মাতা এবং পরিবারবর্গকে ত্যাগ
করে পরিব্রাজকরূপে বর্ণাশ্রমধর্ম দূষণকারীদেরকে নিরস্ত করবে। হাতে দণ্ড ও
কমণ্ডলু, শরীরে উজ্জ্বল গৈরিক বস্ত্র, ভস্মদ্বারা অঙ্কিত ত্রিপুণ্ড্র এবং রুদ্রাক্ষমালার অলঙ্করনে
তাঁর দিব্যবিগ্রহ দেদীপ্যমান হবে। হে অম্বিকে
! তাঁর শিষ্যরাও তাঁর মতোই মোক্ষপ্রদায়ক
শিবতত্ত্বে পারঙ্গম ও শিবলিঙ্গ অর্চনায়
ভাবাবিষ্ট হবে এবং তাঁর
মতোই বিদ্বান ও ভাষ্য রচনায়
নিপুণ হবে। দ্বৈতবুদ্ধিসম্পন্ন পাপিষ্ঠদেরকে তর্কের
দ্বারা দমন করে আমার
অংশ সেই সন্ন্যাসী চন্দ্রের
ন্যায় বিরাজমান থাকবে।"
তাছাড়া
বায়ুপুরাণে চারশিষ্য সমেত শঙ্করাবতারের অবতীর্ণ
হওয়া, শ্রুতি ও ব্যাসসূত্রের যথোচিত
অর্থ রচিত হওয়ার ইঙ্গিত
দেয়া আছে, যথা—"চতুর্ভিঃসহ শিষ্যৈস্তু
শঙ্করোহবতরিষ্যতি। ব্যাকুর্বন্ ব্যাসসূত্রার্থং শ্রুতেরথং যথোচিবান্।। শ্রুতের্ন্যায্যঃ স এবার্থঃ শঙ্করঃ
সবিতানন।"
তাছাড়া শক্তিসঙ্গমতন্ত্রের ছিন্নমস্তাখণ্ডে বর্ণিত আছে—
"যদা যদাসতাং
হানির্ধর্মগ্লানির্মহেশ্বরি।।
তদাবতারো
দেবেশি হরের্ভবতি পার্বতি।
হরিগর্বাপহারার্থং
ভক্তানুগ্রহণায় চ।।
ধর্মসংস্থাপনার্থং
হি শঙ্করোঽবতরিষ্যতি।
বারাহবক্ত্রনৃহরী
যথা গর্বেণ তর্পিতান্।।
তথা
কলিযুগে প্রাপ্তে শঙ্করঃ কলিশঙ্করঃ।
চতুর্দিক্ষু
চতুঃপ্রেতা মধ্যরূপেণ পার্বতি।।
মধ্যে
স্বয়ং শঙ্করো হি সদা তিষ্ঠতি
পার্বতি।
বর্ষষোড়শপর্যন্তং
সমরতং চ করিষ্যতি।।"
~ (শক্তিসঙ্গমতন্ত্র, ছিন্নমস্তাখণ্ড ৮.৬৫(১/২)-৬৯)
ভাবার্থ;
"হে মহেশ্বরী, হে পার্বতী, যখন
যখন সদাচারসম্পন্নগণের হানি এবং ধর্মের
গ্লানি হয়, হে দেবেশী,
তখনই ভগবান বিষ্ণুর অবতার সংঘটিত হয়। বুদ্ধরূপী হরির
গর্ব হরণ করার জন্য,
ভক্তগণকে অনুগ্রহ করার জন্য তথা
ধর্মসংস্থাপনার জন্যই শঙ্কর অবতরিত হবেন। ভগবান বরাহ এবং নৃসিংহ
যেমন গর্বদ্বারা তর্পিত অসুরগণকে নষ্ট করার জন্য
অবতরিত হয়েছিলেন, হে পার্বতী ! তেমনভাবে
কলিযুগে ভগবান শঙ্কর সাক্ষাৎ কলির শঙ্কররূপে অবতরণ
করে চারদিকে চারপ্রেতগণকে নিয়ে তাঁদের মধ্যমণিরূপে
সর্বদা মধ্যে অবস্থান করে সেই শঙ্কর
ষোলোবছর পর্যন্ত সমানভাবে অবতারলীলা করবেন।।"
এরপরে,
কলিযুগে ভগবান আদিশঙ্করাচার্য্যকেই দিব্যসাম্রাজ্যদীক্ষিত গুরু বলে উল্লেখ
করে সেই ক্রম বর্ণনা
করতে গিয়ে ক্রমান্বয়ে ভগবৎপাদাচার্য্য
কর্তৃক স্থাপিত চতুরাম্নায় মঠসমূহের উল্লেখ করা হয়েছে ;
"পঞ্চপ্রেতাশিনস্তে চ শঙ্করঃ
শঙ্করঃ স্বয়ম্।
পূর্বাম্নায়ো
ভবেত্ পূর্বভাগে গোবর্ধনো মঠঃ।।"
~ শক্তিসঙ্গমতন্ত্র , ছিন্নমস্তাখণ্ড (৮.৭৫)
"সেই পঞ্চপ্রেতগণ
প্রজ্ঞাবান এবং (তাঁদের মধ্যে
যিনি) ভগবৎপাদ শঙ্কর (তিনি) স্বয়ং শিব। (তাঁর দ্বারা) পূর্বভাগে
পূর্বাম্নায় গোবর্ধন মঠ স্থাপিত হবে।।"
"দক্ষিণে দক্ষিণাম্নায়ঃ
শৃঙ্গেরীমঠ এব চ।
ভূবারাখ্যঃ
সম্প্রদায়ঃ পদং চৈব সরস্বতী।।
শ্রীপুরী
ভারতী দেবি ক্ষেত্রং রামেশ্বরাভিধম্।
আদিবারাহরূপী
তু দেবতা পরিকীর্তিতা।।"
~ শক্তিসঙ্গমতন্ত্র, ছিন্নমস্তাখণ্ড (৮.৭৯-৮০)
"হে দেবী
! দক্ষিণে দক্ষিণাম্নায় শৃঙ্গেরীমঠ, ভূবার নামক সম্প্রদায়, সন্ন্যাসপদ
হলো সরস্বতী, পুরী এবং ভারতী।
রামেশ্বর ক্ষেত্র এবং আদিবারাহরূপী ভগবানকে
(সেই মঠের) দেবতা বলা হয়েছে।।"
"অথ বৈ
পশ্চিমাম্নায়ে শারদামঠ ঈরিতঃ।
সম্প্রদায়ঃ
কীটবাররতীর্থাশ্রমপদে ভবেত্।।"
~ শক্তিসঙ্গমতন্ত্র / ছিন্নমস্তাখণ্ড (৮.৮৪)
"এখন পশ্চিমাম্নায়ে
শারদামঠ, কীটবার সম্প্রদায় এবং তীর্থ ও
আশ্রম সন্ন্যাসপদ হবে।।"
"উত্তরে চোত্তরাম্নায়ঃ
শ্রীজ্যোতির্মঠ ইত্যপি।।
সম্প্রদায়ো
নন্দবারো গিরিপর্বতসাগরাঃ।
পদং
প্রোক্তং মহেশানি ক্ষেত্রং বদরিকা ভবেত্।।"
~ শক্তিসঙ্গমতন্ত্র / ছিন্নমস্তাখণ্ড [৮.৮৭(১/২)-৮৮]
"হে মহেশানী
! এবং উত্তরে উত্তরাম্নায় শ্রী জ্যোতির্মঠ, নন্দবার
সম্প্রদায়। গিরি, পর্বত, সাগর সন্ন্যাসপদ এবং
বদরিকা ক্ষেত্র হবে।।"
তদনন্তর
কিছু শ্লোক পরে বলা হচ্ছে
;
"চতুর্ভিঃ সহ
শিষ্যৈস্তু শঙ্করোঽবতরিষ্যতি।
শঙ্করঃ
শঙ্করঃ সাক্ষাত্ ব্যাসো নারায়ণো হরিঃ।।"
~ শক্তিসঙ্গমতন্ত্র , ছিন্নমস্তাখণ্ড (৮.৯৮)
"চারজন শিষ্যসহ
শঙ্কর (কলিযুগে) অবতরণ করবেন। ভগবৎপাদ শঙ্কর সাক্ষাৎ শিব এবং বেদব্যাস
স্বয়ং শ্রীহরি নারায়ণ।।"
এখানে
ভগবান বেদব্যাস এবং ভগবান আদিশঙ্করাচার্য্যের
অবতারত্বের বিষয় একত্রে উল্লেখ
করে এটাই প্রতিপাদন করা
হয়েছে যে ভগবান আদিশঙ্করাচার্য্যই
ভগবান ব্যাসের পরম্পরা প্রাপ্ত হয়েছেন। আরও
কিছু শ্লোক পরে ভগবান আদিশঙ্করাচার্য্যের
দশনামী পরম্পরায় সন্ন্যাসের যে দশ পদ
বা নাম রয়েছে সেগুলো
উল্লেখ করা হয়েছে,
"সরস্বতী ভারতী
চ পর্বতারণ্যসাগরাঃ।
গিরিঃ
পুরী বনস্তীর্থশ্চাশ্রমো দশমঃ স্মৃতঃ।।"
~ শক্তিসঙ্গমতন্ত্র / ছিন্নমস্তাখণ্ড (৮.১০৪)
"সরস্বতী, ভারতী,
পর্বত, অরণ্য, সাগর, গিরি, পুরী, বন, তীর্থ এবং
আশ্রম, এই দশ (সন্ন্যাসাশ্রমের
পদ/নাম) বলা হয়েছে।।"
অনন্তর
কয়েক শ্লোক পরে ভগবান আদিশঙ্করাচার্য্য
এবং তাঁর চার প্রমুখ
শিষ্যগণই (সুরেশ্বরাচার্য্য, ত্রোটক বা তোটকাচার্য্য, হস্তামলকাচার্য্য
এবং পদ্মপাদাচার্য্য) যে
পঞ্চপ্রেত তা পুনরায় নিশ্চিত
করা হয়েছে ;"শঙ্করশ্চ মহেশানি
হস্তামলক এব চ। সুরেশ্বরস্ততঃ
প্রোক্তস্ত্রোটকস্তদনন্তরম্।। পদ্মপাদঃ
পঞ্চমঃ স্যাদ্ পঞ্চপ্রেতানুকল্পনম্।" ~ শক্তিসঙ্গমতন্ত্র, ছিন্নমস্তাখণ্ড [৮.১১২-১১৩(১/২)]
ঋণঃ-
১. স্বামী চিদ্ঘনানন্দ পুরীর "আচার্য শঙ্কর ও রামানুজ" শীর্ষক গ্রন্থ।
২. বেশ কিছু তথ্যসংগ্রহ ও কৃতঞ্চতায় Thakur Vishal
......................................................................
শ্রীশুভ
চৌধুরী।
ডিসেম্বর
৯, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।