পূর্বপক্ষ- সূর্যাদি পরিচ্ছিন্ন বস্তুরই প্রতিবিম্ব সম্ভব হয়, অপরিচ্ছিনতা যার ধর্ম, তার প্রতিবিম্বতা কখনো সম্ভব হয় না। নির্মল পুরুষে ধর্মাধর্ম ও সুখদুঃখ ভোগ অসম্ভব। (মায়াবাদ শতদুষণী দ্রষ্টব্য)
উত্তরপক্ষ- ভগবান্ সূত্রকার বাদরায়ণ বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রে বলেছেন— "আভাস এব চ"-(ব্রহ্মসূত্র-২.৩.৫০) ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য এই সূত্রের ভাষ্যে বলছেন—"আভাস এব চ এষ জীবঃ পরস্যাত্মনো জলসূর্যকাদিবত্প্রতিপত্তব্যঃ, ন স এব সাক্ষাত্, নাপি বস্ত্বন্তরম্৷" অর্থাৎ "জলসূর্য (জলে সূর্যপ্রতিবিম্ব) যেমন বিম্বভূত সূর্যের আভাস (প্রতিবিম্ব), তেমনি জীবও পরমাত্মার আভাস (প্রতিবিম্ব) এটা জানতে হবে। যেহেতু আভাস সেহেতু জীব সাক্ষাৎ পরমাত্মা নয়, পদার্থান্তরও নয়।" যেমন একটি জলসূর্য কম্পিত হলে অন্য জলসূর্য কম্পিত হয় না, তেমনি এক জীবে কর্মফল-সম্বন্ধ ঘটলেও অন্য জীবকে তা স্পর্শ করে না। সূর্যের এই উপমাটি ভগবান্ বাদরায়ণ তার ব্রহ্মসূত্রে স্পষ্ট গ্রহণ করেছেন—"অত এব চোপমা সূর্যকাদিবৎ৷"-(ব্রহ্মসূত্র-৩.২.১৮)
শ্রুতিও তাই বলছে—"এক এব হি ভূতাত্মা ভূতে ভূতে ব্যবস্থিতঃ। একধা বহুধা চৈব দৃশ্যতে জলচন্দ্রবৎ॥"-(ব্রহ্মবিন্দু উপনিষৎ-১২) অর্থাৎ 'যেহেতু প্রাণিগণের এই একই আত্মা বিভিন্ন প্রাণীতে বিশেষভাবে অবস্থিত আছেন, তিনি জলমধ্যস্থ চন্দ্রের ন্যায় একরূপে ও বহুরূপে পরিদৃষ্ট হন।' যেমন জ্যোতিঃস্বরূপ এই সূর্য্য এক হলেও বিভিন্ন জলকে অনুগমনকরতঃ বিভিন্ন পাত্রস্থ জলে প্রতিবিম্বিত হয়ে বহুপ্রকার হয়ে থাকেন, এইপ্রকারে এই স্বয়ংপ্রকাশ দেব জন্মরহিত আত্মা, মায়ারূপ উপাধির দ্বারা ক্ষেত্রসকলে অর্থাৎ মায়ার পরিণামভূত দেহেন্দ্রিয়াদি সংঘাত সকলে অনুগমন করতঃ প্রতিবিম্বিত হয়ে বিভিন্নরূপে কৃত বা প্রতিভাত হন।
শঙ্কা—এখন সংশয় সূর্য তো মূর্তিমান, তাহলে সর্বব্যাপী পরব্রহ্মের ক্ষেত্রে সূর্যাদি দৃষ্টান্তের তাৎপর্য কি?
উত্তর—পরব্রহ্মের পক্ষে সূর্যাদি দৃষ্টান্তের তাৎপর্য এই যে, সূর্য যেমন জলে প্রতিবিম্ব হয়ে জলগত বৃদ্ধি, হ্রাস, কম্পন প্রভৃতি উপাধি ধর্মের অধীন হয়, ব্রহ্মও সেরূপ অন্তঃকরণাদিপরিচ্ছিন্ন হয়ে অন্তঃকরণগত সুখ, দুঃখ, শোক, মোহ প্রভৃতি বিবিধ ধর্মের অধীন হয়ে থাকে। ব্রহ্ম সূর্যের মত প্রতিবিম্বিত হন, সূর্যাদি দৃষ্টান্তের এরূপ তাৎপর্য নয়।
No comments:
Post a Comment