"নিগমাচার্যবাক্যেষু
ভক্তিঃ শ্রদ্ধেতি বিশ্রুতা" অর্থাৎ শাস্ত্র ও আচার্য বাক্যে ভক্তিই শ্রদ্ধা নামে
বিশ্রুতা। এটা ভগবান্ শঙ্করাচার্যের কথা। শ্রদ্ধা একটি সাধনসম্পত্তি। বেদান্তে ‘সাধনসম্পত্তি’
বলতে বোঝায় শম্, দম্, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান ও শ্রদ্ধা। যোগভাষ্যকার ব্যাস 'শ্রদ্ধা'র
একটি অতি সুন্দর সংজ্ঞা দিয়েছেন—
'শ্রদ্ধা
চেতসঃ সম্প্রসাদ্ঃ' অর্থাৎ 'শ্রদ্ধা হলো চিত্তের সম্প্রসাদ অর্থাৎ চিত্তের সত্যাত্মক
প্রসন্নতাজন্য প্রযত্ন বিশেষ।'
শ্রদ্ধা
হল মনে প্রাণে গুরু ও শাস্ত্রবাক্যে ভক্তি। অচল অটল সূমেরুবৎ বিশ্বাস। এই বিশ্বাস মানুষকে
অসীম সাহসী করে তুলে। নচিকেতা এই শ্রদ্ধাবলেই যম সমীপে উপস্থিত হয়ে বহু প্রলোভনকে
জয় করে ব্রহ্মবিদ্যা লাভে সমর্থ হয়েছিলেন। সর্বশাস্ত্রে শ্রদ্ধার একটি বিশিষ্ট স্থান
রয়েছে।
ঋগ্বেদ্
সংহিতার ১০ম মণ্ডলের ১৫১ সূক্তে বর্ণিত আছে—"শ্রদ্ধয়াগ্নিঃ সমিধ্যতে শ্রদ্ধয়া
হুয়তে হবিঃ।" অর্থাৎ শ্রদ্ধার গুণে অগ্নি প্রজ্বলিত হন। শ্রদ্ধাপ্রযুক্তই যজ্ঞসামগ্রী
আহুতি দেওয়া হয়।
তাছাড়া বেদে অন্যত্র বলা হয়েছে— "শ্রদ্ধামাগোতি শ্রদ্ধয়া সত্যমাপ্যতে"-(শুক্লযজুর্বেদ-১৯/৩০) অর্থাৎ শ্রদ্ধার দ্বারা সত্যব্রহ্মকে (সত্যস্বরূপ জ্ঞানস্বরূপ ও অনন্তস্বরূপ ব্রহ্মকে) প্রাপ্ত হওয়া যায়।
শ্রীগীতায় ভগবানও একই গীত গেয়েছেন। "শ্রদ্ধাবাঁল্লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ৷ জ্ঞানং লব্ধ্বা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি"-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৪/৩৯) অর্থাৎ শ্রদ্ধাবান্ জ্ঞান লাভ করে। শ্রদ্ধালু হলেও কেউ কেউ হয়ত তত্ত্বজ্ঞান সম্বন্ধে মন্দপ্রযত্ন হতে পারে, সেইজন্য বলছেন জ্ঞানলাভের উপায়ে তৎপর অর্থাৎ গুরু উপসনাদিতে অভিযুক্ত হতে হবে। শ্রদ্ধাবান্ এবং তৎপর হয়েও যদি অজিতেন্দ্রিয় হয়, সেইজন্য বলছেন সংযতেন্দ্রিয় হতে হবে অর্থাৎ বিষয় থেকে নিবর্তিত হয়েছে যাঁর ইন্দ্রিয়সকল তিনি সংযতেন্দ্রিয়। যিনি এইরূপ শ্রদ্ধাবান্, তৎপর ও শ্রদ্ধালু তিনি অবশ্যই জ্ঞান লাভ করেন। জ্ঞানলাভ করে পরা অর্থাৎ মোক্ষাখ্য শান্তি বা উপরতি অচিরে অর্থাৎ শীঘ্রই লাভ হয়ে থাকে। সম্যক্ দর্শন হতে শীঘ্র মোক্ষ হয়ে থাকে-এটাই সর্বশাস্ত্রন্যায় প্রসিদ্ধ সুনিশ্চিত অর্থ৷
গীতার
এই শ্লোকের ভাষ্যে ভগবৎপাদ্ শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য বলছেন—"প্রণিপাতাদিস্তু বাহ্যোনৈকান্তিকোপি
ভবতি, মাযাবিত্বাদিসংভবাত্; ন তু তত্ শ্রদ্ধাবত্ত্বাদৌ ইত্যেকান্ততঃ জ্ঞানলব্ধ্যুপাযঃ৷"
অর্থাৎ প্রণিপাতাদি কিন্তু জ্ঞানলাভের বাহ্য কারণ, কপটতাদির সম্ভবনাহেতু জ্ঞানরূপ ফলপ্রাপ্তি
সম্বন্ধে অনিশ্চিত হতে পারে, পরন্তু শ্রদ্ধাবত্ত্বাদি নিশ্চিতরূপে জ্ঞান লাভের উপায়।
শ্রদ্ধাই কল্যানকারিণী মায়ের মতো যোগীদেরকে রক্ষা করে থাকে। সেই শ্রদ্ধাবান বিবেক আকাঙ্ক্ষীদেরই বীর্য অর্থাৎ বল উৎপন্ন হয়। 'সা হি জননীব কল্যাণী যোগিনং পাতি। তস্য হি শ্রদ্দধানস্য বিবেকার্থিনঃ বীর্যম্ উপজায়তে' এটা যোগসূত্রের ভাষ্যে ব্যাস বচন।
শ্রীশুভ
চৌধুরী
ডিসেম্বর
২৫, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment