Friday, 23 December 2022

ভগভদ্ভক্তঃ

 


আচার্য বিদ্যারণ্য মুনি "জীবন্মুক্তিবিবেকঃ" এ বলেছেন ঈশ্বরে সর্বতোভাবে মন যাঁর অর্পিত হয়েছে সেরূপ সমাহিতচিত্ত ব্যক্তির অন্য বিষয়ের অনুসন্ধানে প্রবৃত্তি থাকে না। ব্যুত্থিত অবস্থায় থাকলেও বিষয়ানুসন্ধানে উদাসীন হওয়ায় তাঁর হর্ষবিষাদের অভাব হয় এবং সুখ-দুঃখে সমতা দেখা যায়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ভক্তিযোগে স্বয়ং শ্রীভগবান্ কর্তৃক ভগবদ্ভক্তের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে

"যিনি সকল প্রাণীর প্রতি দ্বেষহীন, মিত্রভাবাপন্ন, দয়ালু, মমত্ববুদ্ধিশূন্য, নিরহংকার, সুখে আসক্তি ও দুঃখে দ্বেষবর্জিত, ক্ষমাশীল, সর্বদা সন্তুষ্ট, সদা সমাহিতচিত্ত, সদা সংযতস্বভাব, সদা তত্ত্ববিষয়ে দৃঢ়নিশ্চয় এবং যাঁর মন ও বুদ্ধি সর্বদা আমাতে অর্পিত, তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত।"- (শ্রীগীতা, ১২/১৩-১৪)

যিনি সর্বতোভাবে ব্রহ্মভাবাপন্ন হয়েছেন তাঁর জাগতিক বিষয়ে আসক্তি সম্পূর্ণভাবে চলে যায়। ফলতঃ তিনি বৈষয়িক যাবতীয় দ্বন্দ্বসমূহে উদাসীন থাকেন। শত্রু-মিত্র-মান-অপমান, সুখ-দুঃখ-হর্ষ-বিষাদএসকল  জাগতিক বিষয়জ। নির্বিকার, নির্গুণ ব্রহ্মসত্তায় এই দ্বন্দ্বসমূহ থাকে না। ভগবদ্ভক্ত এরূপে বক্ষ্যমাণ দ্বন্দ্বসমূহেতেও সমভাবে অবস্থান করেন। শ্রীগীতায় ভগবান বলেছেন

"যিনি কাউকেও উদ্বিগ্ন করেন না, যিনি কারও দ্বারা উদ্বিগ্ন হন না এবং যিনি হর্ষ ও বিষাদ, ভয় ও উদ্বেগ হতে মুক্ত, তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত। যিনি নিঃস্পৃহ, বাহ্যাভ্যন্তর শুচি, দক্ষ, পক্ষপাতশূন্য, ভয়হীন এবং সকাম কর্মের অনুষ্ঠান-ত্যাগী, তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত। যিনি ইষ্টপ্রাপ্তিতে হৃষ্ট হন না, অনিষ্টপ্রাপ্তিতে দ্বেষ করেন না, প্রিয়বিয়োগে শোক করেন না, অপ্রাপ্ত ইষ্টবস্তু আকাঙ্ক্ষা করেন না এবং শুভাশুভ সকল কর্ম পরিত্যাগ করেছেন, তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত। যিনি আসক্তিহীন এবং শত্রু ও মিত্রে সমবুদ্ধি, যিনি সম্মানে ও অপমানে অবিচলিত, যিনি শীতোষ্ণজনিত সুখে ও দুঃখে নির্বিকার, পরমাত্মাতে স্থিরবুদ্ধি, প্রশংসায় হর্ষ ও নিন্দায় বিষাদশূন্য সুতরাং সংযতবাক্‌, সর্বাবস্থায় যৎকিঞ্চিৎ-লাভে সন্তুষ্ট এবং নির্দিষ্টবাসস্থানহীন তিনিই আমার প্রিয় ভক্ত।"-(শ্রীগীতা, ১২/১৫-১৯)

ভগবৎপরায়ণ ব্যক্তিগণ কোন বিষয়েই ভীত হন না। এটা ভাগবতের কথা। ঈশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক প্রেমের নাম ভক্তি। এই প্রেমের স্বরূপ বর্ণনার অতীত অর্থাৎ অনির্বচনীয়। সর্বগুণাতীত, সমস্ত বাসনার অতীত, চিরবর্ধমান, চিরবিচ্ছেদহীন, সূক্ষ্মতম অনুভূতি প্রেম। এই ভক্তি প্রেমামৃত। ভক্তি লাভ করলে মানুষ পূর্ণ হয়, অমর হয়, চিরতৃপ্তির অধিকারী হয়। তখন ভক্ত আর কিছুই চায় না এবং দ্বেষ ও অভিমান-শূন্য হয়। কোন বাসনাপূরণের জন্য ইহাকে ব্যবহার করা চলে না, কারণ তা সর্ববিধ বাসনার নিবৃত্তি-স্বরূপ। যার সমগ্র সত্তা ঈশ্বরে নিবদ্ধ, সেই-ই ভক্তিপথের সন্ন্যাসী; যা কিছু তার ভগবদ্‌ভক্তির বিরোধী, তাই সে ত্যাগ করে। অন্য সব আশ্রয় ত্যাগ করিয়া সে একমাত্র ভগবানের শরণাগত হয়। ভক্তিতে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হইলে দেহরক্ষার জন্য যাহা প্রয়োজন, তদতিরিক্ত সমস্ত লৌকিক আচরণই পরিত্যক্ত হয়। ভগবৎপ্রসঙ্গ করতে গেলে তাঁদের কথা কণ্ঠে রুদ্ধ হয়, তাঁরা কেঁদে ফেলেন; তীর্থকে তাঁরাই পবিত্র করেন; তাঁদের কর্ম শুভ; তাঁরা সদ্গ্রন্থকে অধিকতর সদ্‌ভাবাপন্ন করে তোলেন; কারণ তাঁরা ভগবানের সঙ্গে একাত্ম। ইতি নারদ বচন।

তাইতো স্বয়ং ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য বলেছেন

ভজ গোবিন্দম্ ভজ গোবিন্দম্

গোবিন্দম্ ভজ মূঢ়মতে।

সম্প্রাপ্তে সন্নিহিতে কালে

নহি নহি রক্ষতি ডুকৃঙ্করণে॥

ওরে ও অবোধ, আন ফিরিয়ে বোধ,

শ্রীগোবিন্দের নাম গা ।।

শেষের সময় আসবে যখন ,,

বৃথা হবে শিক্ষা- 'ব্যাকরণ '

সার হবে এক পতিতপাবন ,

সেই যে এক সাধা...

শ্রীগোবিন্দ -র নাম গা ।।

........................

শ্রীশুভ চৌধুরী

ডিসেম্বর ২৩, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...