অবিদ্যায় চৈতন্যের যে প্রতিবিম্ব পড়ে, তাই জীব। স্বয়ংজ্যোতিঃ চিদাত্মা বিম্ব, জীব তাঁর প্রতিবিম্ব। বিম্ব ও প্রতিবিম্ব অভিন্ন, সুতরাং জীব ও ব্রহ্ম বস্তুতঃ অভিন্ন। এই হল বিবরণোক্ত প্রতিবিম্ববাদ। অদ্বৈতবেদান্তের অবচ্ছেদবাদী আচার্যগণ প্রতিবিম্ববাদের বিরুদ্ধে একটি আপত্তি উপস্থাপন করেন।
আপত্তি—যার
রূপ নাই তার প্রতিবিম্ব পড়ে না। জলাশয় প্রভৃতিতে রূপবান চন্দ্র-সূর্যেরই প্রতিবিম্ব
পড়তে দেখা যায়। সুতরাং নীরূপ ব্রহ্মের বা কূটস্থের প্রতিবিম্ব পড়ে এরূপ কল্পনা নিতান্তই
অবাস্তব।
উত্তর—
প্রথমত আত্মাকে নীরূপ দ্রব্য বলে প্রতিবাদী যে আপত্তি উত্থাপন করেছেন, এই আপত্তি অদ্বৈতবেদান্তীর
বিরুদ্ধে প্রযোজ্য হয় কি? নৈয়ায়িক ও বৈশেষিক প্রভৃতির মতে আত্মার কতগুলো গুণ স্বীকৃত
হয়েছে বলে আত্মাকে দ্রব্য বলা যেতে পারে। অদ্বৈতবাদীর মতে আত্মা নির্গুণ ও নিষ্ক্রিয়।
এই নির্গুণ, নিস্ক্রিয় আত্মাকে নীরূপ দ্রব্য বলা যায় কি হিসেবে? আরও যদি বলি, শব্দ
দ্রব্য পদার্থ অথচ শব্দের রূপ নেই, কিন্তু ঐ নীরূপ শব্দের প্রতিবিম্ব আছে, প্রতিধ্বনিই
শব্দের প্রতিবিম্ব। বৈশেষিকের মতেও আকাশ দ্রব্য পদার্থ অথচ তার রূপ নেই, নীরূপ দ্রব্য;
অভ্র-নক্ষত্র-খচিত আকাশের জলে যে প্রতিবিম্ব পড়ে, তা কে অস্বীকার করতে পারে? যদি বল
যে ওটা আকাশের প্রতিবিম্ব নয়, অনন্ত আকাশে সূর্যের যে কিরণমালা তরঙ্গ তুলে খেলে বেড়াচ্ছে
ওটা তারই প্রতিবিম্ব; ঐ প্রতিবিম্বই আকাশের প্রতিবিম্ব বলে ভ্রম হয়ে থাকে। এর উত্তরে
বক্তব্য এই যে, ওটা যদি সৌরকিরণেরই প্রতিবিম্ব হয়, তবে প্রতিবিম্বটিকে একটি বিশাল
কড়াইয়ের মত দেখায় কেন? ঐরূপ প্রতিবিম্বকে আকাশের প্রতিবিম্ব বলেই দার্শনিকগণ সিদ্ধান্ত
করেছেন। নীরূপ অমূর্ত আকাশ যেমন জলে প্রতিবিম্বিত হয়, সেইরূপ নীরূপ, অমূর্ত চিদাত্মার
বুদ্ধিতে প্রতিবিম্ব পড়তে বাধা কি?
নীরূপ দ্রব্যের প্রতিবিম্ব হতে পারে না, প্রতিবাদীর এরূপ কল্পনার মূল কি? রূপবান দ্রব্যেরই প্রতিবিম্ব পড়তে দেখা যায়, নীরূপ দ্রব্য প্রত্যক্ষগোচর হয় না সুতরাং তার প্রতিবিম্বও প্রত্যক্ষগোচর হয় না, এপর্যন্তই প্রতিবাদী বলতে পারেন। প্রতিবিম্ব পড়ে না এমন কথা নিশ্চয় করে তিনি বলেন কিরূপে? কারণ, বস্তুর অস্তিত্বের প্রতি প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ নয়। নীরূপ দ্রব্য অপ্রত্যক্ষ হলেও প্রমাণান্তর সিদ্ধ বলে ঐ নীরূপ দ্রব্যের অস্তিত্ব যেমন মেনে নিতে হয়, উহার প্রতিবিম্বও সেরূপ মেনে নিতে হয়। এরূপে শ্রুতি-প্রমাণ -মূলে আত্মার প্রতিবিম্বের অস্তিত্বই বা মেনে নিতে বাধা কি? "জীবেশাবভাসেন করোতি মায়া চাবিদ্যা চ" অর্থাৎ "আভাসের (প্রতিবিম্ব) দ্বারা জীব ও ঈশ্বর সৃজন করে এবং স্বয়ং মায়া ও অবিদ্যা হয়ে থাকে"-(নৃসিংহ উত্তর তাপনীয় উপনিষৎ-৯) এই শ্রুতি হতে তা সিদ্ধ। তাছাড়া "আভাস এব চ"-(ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৫০) ও "অত এব চোপমা সূর্যকাদিবত্"-(ব্রহ্মসূত্র-৩/২/১৮) প্রভৃতি সূত্রও প্রতিবিম্ববাদই সমর্থন করে।
তথ্য
সূত্রঃ-
১.
আচার্য অপ্পয় দীক্ষিতের বেদান্তকল্পতরু-পরিমল।
২.
ভগবান শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্র ভাষ্য ও আচার্য বিদ্যারণ্য মুনির পঞ্চদশী।
৩.
"বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি
শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।
...............................................................................
শ্রীশুভ
চৌধুরী।
নভেম্বর
৩০ , ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment