বেদান্তে জীব ব্রহ্মেরই প্রতিচ্ছবি বা প্রতিবিম্ব। সূর্য যেমন বিভিন্ন জলপূর্ণ পাত্রে প্রতিফলিত হয়ে থাকে, ব্রহ্মও সেইরূপ বিভিন্ন অন্তঃকরণ বা বুদ্ধিদর্পনে প্রতিফলিত হয়ে থাকেন। এই প্রতিবিম্বই জীব। বিম্ব ও প্রতিবিম্ব অভিন্ন সুতরাং ব্রহ্ম ও ব্রহ্মপ্রতিবিম্ব জীব বস্তুতঃ অভিন্ন। এই মত অদ্বৈতবেদান্তে 'প্রতিবিম্ববাদ' বলে প্রসিদ্ধ।
ভগবান্
সূত্রকার বাদরায়ণ বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রে বলেছেন— "আভাস এব চ"-(ব্রহ্মসূত্র-২.৩.৫০) ভগবৎপাদ্
শঙ্করাচার্য এই সূত্রের ভাষ্যে বলছেন—"আভাস এব চ এষ জীবঃ পরস্যাত্মনো জলসূর্যকাদিবত্প্রতিপত্তব্যঃ,
ন স এব সাক্ষাত্, নাপি বস্ত্বন্তরম্৷" অর্থাৎ "জলসূর্য (জলে সূর্যপ্রতিবিম্ব)
যেমন বিম্বভূত সূর্যের আভাস (প্রতিবিম্ব), তেমনি জীবও পরমাত্মার আভাস (প্রতিবিম্ব)
এটা জানতে হবে। যেহেতু আভাস সেহেতু জীব সাক্ষাৎ পরমাত্মা নয়, পদার্থান্তরও নয়।"
যেমন একটি জলসূর্য কম্পিত হলে অন্য জলসূর্য কম্পিত হয় না, তেমনি এক জীবে কর্মফল-সম্বন্ধ
ঘটলেও অন্য জীবকে তা স্পর্শ করে না। সূর্যের এই উপমাটি বাদরায়ণ তার ব্রহ্মসূত্রেও
গ্রহণ করেছেন—"অত এব চোপমা সূর্যকাদিবৎ৷"-(ব্রহ্মসূত্র-৩.২.১৮)
শ্রুতিও
তাই বলছে— "এক এব হি ভূতাত্মা ভূতে ভূতে ব্যবস্থিতঃ।
একধা বহুধা চৈব দৃশ্যতে জলচন্দ্রবৎ॥"-(ব্রহ্মবিন্দু উপনিষৎ-১২) অর্থাৎ 'যেহেতু
প্রাণিগণের এই একই আত্মা বিভিন্ন প্রাণীতে বিশেষভাবে অবস্থিত আছেন, তিনি জলমধ্যস্থ
চন্দ্রের ন্যায় একরূপে ও বহুরূপে পরিদৃষ্ট হন।'
বুদ্ধি-প্রতিবিম্ব
জীব স্বীয় অজ্ঞানবশতঃ বুদ্ধির ধর্ম সুখ, দুঃখ প্রভৃতি নিজের ধর্ম বলে মনে করে; মোহগ্রস্ত
হয়ে শোক ও দৈন্যের অধীন হয়, স্বীয় নিত্যশুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্তস্বভাব বিস্মৃত হয়—"অনীশয়া
শোচতি মুহ্যমানঃ"- মুণ্ডকশ্রুত্যোক্ত জীবের এই বিভ্রান্তিই জীবের মোহনিদ্রা। মায়াই
এর মূল। ব্রহ্মের এই প্রতিবিম্ব অবিদ্যা কৃত সুতরাং জীবভাব ও জীবের সংসারলীলা প্রভৃতি
সমস্তই অজ্ঞানের খেলা। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য ভাষ্যে বলছেন—
"আভাসস্য চ অবিদ্যাকৃতত্বাত্তদাশ্রয়স্য সংসারস্যাবিদ্যাকৃতত্বোপপত্তিরিতি"
যেহেতু অবিদ্যা আভাসের জনক, সেহেতু আভাসাশ্রিত সংসারের অবিদ্যামূলকতা যুক্তিসিদ্ধ।
পরব্রহ্মের
ঈশ্বরভাব যেরূপ মায়িক, জীবভাবও সেরূপ মায়িক। পার্থক্য এই যে ঈশ্বর সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তি,
জীব অল্পজ্ঞ ও অল্পশক্তি। ঈশ্বর নিয়ন্তা, জীব তাঁর নিয়ম্য। মায়া ঈশ্বরের বশ, জীব
মায়ার বশ। ঈশ্বরের উপাধি সমষ্টি মায়া, জীবের উপাধি ব্যষ্টি অবিদ্যা। সমষ্টি ও ব্যষ্টি
উপাধির বিলয় হলে কি জীব, কি ঈশ্বর, সমস্তই অখণ্ড অনন্ত ভূমা ব্রহ্মে বিলীন হয়ে যাবে।
কোন
কোন অদ্বৈতবেদান্তীর মতে জীব অখণ্ড ব্রহ্মের সখণ্ড অভিব্যক্তি। তাঁদের মতে জীব ঘটাকাশ,
ব্রহ্ম মহাকাশ। অনন্ত, অখণ্ড মহাব্যোম যেমন ঘটাদি অবচ্ছেদ বা আবেষ্টনীর মধ্যে পড়ে
ঘটাকাশ বলে অভিহিত হয়, সেইরূপ অন্তঃকরণের আবেষ্টনীর মধ্যে পড়ে অখণ্ড সচ্চিদানন্দ
ব্রহ্ম, জীব সংজ্ঞা লাভ করে।ঘটাকাশ মহাকাশের সখণ্ড বা আংশিক অভিব্যক্তি, জীবও সেইরূপ
পরমাত্মার আংশিক বিকাশ। এটাকেই অদ্বৈতবেদান্তে "অবচ্ছেদবাদ" বলা হয়। এই
মতো বাদরায়ণ সম্মত এটা "অংশো নানাব্যপদেশাদন্যথা চাপি দাশকিতবাদিত্বমধীযত একে"-(ব্রহ্মসূত্র-
২.৩.৪৩) ইত্যাদি সূত্রে পরিলক্ষিত হয়। ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য ভাষ্যে বলিতেছেন-"এই
হেতু সূত্রকার বলছেন- 'অংশ' ইত্যাদি। জীব ঈশ্বরের অংশ, এটাই সঙ্গত; যেমন বিস্ফুলিঙ্গ
অগ্নির অংশ। এইখানে অংশ বলতে 'যেন অংশ' অর্থাৎ কল্পিত অংশ বুঝতে হবে, কারণ নিরবয়ব ব্রহ্মের
মুখ্য অংশ সম্ভব নয়।"
জীবকে
ব্রহ্মাগ্নির স্ফুলিঙ্গ, ব্রহ্মসিন্ধুর বিন্দুমাত্র। উপনিষৎ বলেছেন—"যথা
সুদীপ্তাৎপাবকাদ্বিস্ফুলিঙ্গাঃ সহস্রশঃ প্রভবন্তে সরূপাঃ"-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২.১.১)
যেমন প্রদীপ্ত অগ্নি হতে সহস্র সহস্র বিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হয় সেইরূপ অক্ষর পুরুষ হতে
বিবিধ জীব উৎপন্ন হয়ে থাকে এবং পরিণামে তাতেই বিলীন হয়।
শ্রীগীতায়
ভগবান্ বাসুদেব স্পষ্টবাক্যেই জীবকে ব্রহ্মাংশ বলে বর্ণনা করেছেন। 'মমৈবাংশো জীবলোকে
জীবভূতঃ সনাতনঃ'-(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-১৫।৭) ভগবান্ শঙ্কর গীতার এই শ্লোকের ভাষ্যে বলছেন-
"জীবলোকে অর্থাৎ সংসারে কর্তাভোক্তারূপে প্রসিদ্ধ জীব আমারই (পরমাত্মারই) সনাতন
অংশ অর্থাৎ ভাগ বা অবয়ব বা একদেশ অর্থাৎ এইগুলি পরমাত্মা হইত পৃথক কোন অর্থান্তর নয়।
সেই জীব আমার (পরমাত্মার) অংশ রূপে কল্পিত। জলরূপ নিমিত্ত অপসৃত হলে সূর্যাংশ জল-সূর্য
যেরূপ সূর্যে লীন হয়, অথবা মহাকাশের অভিন্ন অংশ ঘটস্থ আকাশ যেরূপ ঘট নষ্ট হলে মহাকাশে
মিলিত হয়, আর প্রত্যাগমন করে না, সেইরূপ ব্রহ্মাংশ জীব অবিদ্যাকৃত উপাধি-অপগমে ব্রহ্মপ্রাপ্ত
হয়ে আর পুনরাবৃত্ত হয় না। কারণ জীব স্বরূপত ব্রহ্মই।"
পরমার্থতঃ
ব্রহ্মভিন্ন জীব নামক কিছুই নেই। জীব স্বরূপতঃ ব্রহ্মই, বুদ্ধিরূপ উপাধিসম্বন্ধই জীবের
জীবত্ব। সেই সম্বন্ধ ব্রহ্মাত্মজ্ঞানোদয় পর্য্যন্ত বর্তমান থাকে। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য্য
ব্রহ্মসূত্রের (২.৩.৩০) শারীরকভাষ্যে তা স্পষ্ট করেছেন-
"
বুদ্ধিসংযোগ (বুদ্ধির সহিত চৈতন্যের সম্বন্ধ) যাবদাত্মভাবী অর্থাৎ (ব্রহ্মাত্মজ্ঞানোৎপত্তি
দ্বারা জীবাত্মভাবের উপশম না হওয়া পর্য্যন্ত স্থায়ী)। এই আত্মা যতকাল পর্য্যন্ত সংসারী
থাকে, অর্থাৎ সম্যগ্ দর্শনের দ্বারা এর সংসারিত্ব যতকাল পর্য্যন্ত নিবৃত্ত না হয়, ততকাল
পর্য্যন্ত বুদ্ধির সহিত এর সংযোগ নিবৃত্ত হয় না। আর যতকাল পর্যন্ত বুদ্ধিরূপ উপাধির
সহিত এই সম্বন্ধ থাকে, ততকাল পর্যন্তই জীবের জীবত্ব ও সংসারিত্ব। পরমার্থতঃ কিন্তু
বুদ্ধিরূপ উপাধির সহিত সম্বন্ধের দ্বারা পরিকল্পিত স্বরূপ ব্যতিরেকে জীব নামক কিছুই
নেই। যেহেতু উপনিষদৎসকলের অর্থ নিরূপণ করলে নিত্যমুক্তস্বরূপ সর্ব্বজ্ঞ ঈশ্বর হতে ভিন্ন
দ্বিতীয় চেতন ধাতু(-পদার্থ) উপলব্ধ হয় না;
'নান্যোতোস্তি
দ্রষ্টা শ্রোতা মন্তা বিজ্ঞাতা'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৭।২৩)
অর্থাৎ
'ইঁহা হতে ভিন্ন কোন দ্রষ্টা, শ্রোতা, মননকর্ত্তা ও বিজ্ঞাতা নেই।'
'নান্যদতোস্তি
দ্রষ্টৃ শ্রোতৃ মন্তৃ বিজ্ঞাতৃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৮।১১)
অর্থাৎ
''ইঁহা হতে ভিন্ন দ্রষ্টা, শ্রোতা, মনতা ও বিজ্ঞাতা কেউ নেই।'
'তত্ত্বমসি'-(ছান্দোগ্যোপনিষৎ
৬।৮।৭)
অর্থাৎ
'তুমিই তৎস্বরূপ।'
'অহং
ব্রহ্মাস্মি' -(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-১।৪।১০)
অর্থাৎ
'আমিই ব্রহ্ম।'
ইত্যাদি
শত শত শ্রুতি হতে তা অবগত হওয়া যায়।....."
তথ্যসূত্রঃ-
১.
ভগবান্ শঙ্করাচার্যের শ্রীগীতা ভাষ্য।
২.
ভগবান্ শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্র শারীরকমীমাংসা ভাষ্য।
৩.
"বেদান্তদর্শন-অদ্বৈতবাদ্", কাব্য-ব্যাকরণ-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ, বিদ্যাবাচস্পতি
শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী।
........…....….…..........................................................
শ্রীশুভ
চৌধুরী।
ডিসেম্বর
৮, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment