ভগবান্ শঙ্করাচার্য অপরোক্ষানুভূতিতে বলেছেন— "বিষয়েষ্বাত্মতাং দৃষ্ট্বা মনসশ্চিতি মজ্জনম্। প্রত্যাহারঃ স বিজ্ঞেয়োঽভ্যসনীয়ো মুমুক্ষুভিঃ" অর্থাৎ সমগ্র বিষয়েতে আত্মস্বরূপকে দেখে চৈতন্যসত্তায় মনের যে নিমজ্জন তাই প্রত্যাহার জানবে; তাই মুমুক্ষুর অভ্যাস করা উচিত৷
যোগসূত্রের সাধনপাদে বর্ণিত আছে—"স্বস্ববিষয়াসম্প্রয়োগে চিত্ত-স্বরূপানুকার ইবেন্দ্রিয়াণাং প্রত্যাহারঃ" অর্থাৎ যখন ইন্দ্রিয়গণ তাদের নিজ নিজ বিষয় পরিত্যাগ করে যেন চিত্তের স্বরূপ গ্রহণ করে, তখন তাকে ‘প্রত্যাহার’ বলা যায়। ভগবান্ ভাষ্যকার ব্যাস বলেছেন—"নিজ নিজ শব্দাদি বিষয়ের প্রতি সংযোগের অভাবে চিত্তের স্বরূপের অনুকরণ মতো ইন্দ্রিয়গুলি চিত্ত মতোই নিরুদ্ধ হয়ে যায়। যেমন উড়ে যাচ্ছে এমন মধুকররাজের পিছনেই অন্য মৌমাছি উড়ে চলে, আবার মৌমাছি রাজ যেখানে নেমে এসে বসে অন্য মৌমাছিগুলোও তাকে অনুসরণ করে সেখানে এসে বসে, ঠিকসেইভাবে ইন্দ্রিয়গুলিও চিত্তের নিরুদ্ধতায় নিরুদ্ধ হয়। এই হল প্রত্যাহার।"
এখন
প্রত্যাহারের ফল কি? তা আলোচনা করব। শ্রীপাতঞ্জলে সাংখ্যপ্রবচনে বৈয়াসিকে সাধনপাদে
বলা হচ্ছে— "ততঃ পরমা বশ্যতেন্দ্রিয়াণাম্।" অর্থাৎ প্রত্যাহার হতে ইন্দ্রিয়গণ
সম্পূর্ণরূপে বশীভূত হয়ে থাকে। মহর্ষি জৈগীষ্যবের মতে—"চিত্তের একাগ্রতা হেতু,
বিষয়ের সঙ্গে সংযোগ-রাহিত্য হলো ইন্দ্রিয় জয়।" তাই এটি হলো যোগীর পক্ষে পরম
বশ্যতা, যাতে চিত্তের নিরোধেই ইন্দ্রিয়গুলির নিরোধতা।
শ্রীভগবান্
ভগবদ্গীতার সাংখ্যযোগে এই বিষয়ে স্পষ্ট বলছেন—
যদা
সংহরতে চায়ং কূর্ম্মোহঙ্গানীব সর্ব্বশঃ। ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা
প্রতিষ্ঠাতা" অর্থাৎ কূর্ম্ম (কচ্ছপ) যেমন সকল বস্তু হতে ভয়হেতু আপনার অঙ্গসকল
সংহরণ করে নেয় অর্থাৎ গুটিয়ে নেয়, তেমনি এই জ্ঞাননিষ্ঠায় প্রবৃত্ত যতিরা যখন ইন্দ্রিয়সকল
ইন্দ্রিয়দের অর্থ হতে তথা রূপরসাদি সর্ব্ববিষয় হতে উপসংহরণ বা প্রত্যাহার করেন, তখন
সেই জ্ঞাননিষ্ঠদের প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বুঝতে হবে।
আতুর
ব্যাধিগ্রস্ত লোকদের ইন্দ্রিয়সকলও তো কূর্মাঙ্গের মত বিষয় গ্রহণ না করে উপসংহৃত হয়,
কিন্তু তা বলে তাদের তদ্ বিষয়ক রাগ বা আসক্তি তো সংহৃত না? তাহলে সেই জ্ঞানী কি প্রকারে
ইন্দ্রিয় সকল বিষয় হতে উপসংহার করে থাকেন তা বলা হচ্ছে—
"বিষয়া বিনিবর্ত্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ। রসবর্জ্জং রসোহপ্যস্য পরং দৃষ্ট্বা নিবর্ত্ততে" অর্থাৎ নিরাহার দেহীর অর্থাৎ যাঁরা বিষয় আহরণ করে না এইরূপ কষ্টে তপস্যায় স্থিত দেহীর ইন্দ্রিয়াদির বিষয় নিবৃত্ত হয়, কিন্তু তৎপ্রতি রস তথা অনুরাগ যায় না। কেবল পরমার্থতত্ত্ব ব্রহ্মদর্শন করে ‘অহম্ এব তৎ’ এইরূপ উপলব্ধিতে সেই রস অর্থাৎ রঞ্জনরূপ সূক্ষ্ম আসক্তি নিবৃত্ত তথা নির্বীজ বিষয়বিজ্ঞান সম্পন্ন হয়ে থাকে।
যেইহেতু
সম্যগদর্শন না হলে বিষয়রস উচ্ছেদ হয় না, সেইহেতু সম্যগদর্শনাত্মিকা প্রজ্ঞায় পুনঃ পুনঃ
অভ্যাসের দ্বারা স্থৈর্য্য কর্তব্য। সেই সম্যগদর্শনরূপ প্রজ্ঞাতে স্থৈর্য্য ইচ্ছুক
জ্ঞানীদের পূর্ব্বে ইন্দ্রিয়সকল স্ববশে স্থাপন করা উচিত কিন্তু—
"যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষস্য বিপশ্চিতঃ। ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ" অর্থাৎ হে কৌন্তেয়! প্রমথনশীল অর্থাৎ চিত্তবিক্ষেপকারী ইন্দ্রিয়গণ প্রযত্নশীল মেধাবী কিন্তু বিষয়াভিমুখী পুরুষের মনকেও চিত্তাকুলপূর্ব্বক প্রসভ অর্থাৎ বলপূর্ব্বক বিষয়াভিমুখে হরণ করে থাকে।
"তানি সর্ব্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ। বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা" যেহেতু ইন্দ্রিয়সকল প্রবল, সেইজন্য সেই সকল ইন্দ্রিয় সংযম করে যুক্ত অর্থাৎ সমাহিত হয়ে; মৎপর অর্থাৎ আমি বাসুদেব সর্ব্বপ্রত্যাগাত্মা যাঁর নিকট পর তথা সর্ব্বোৎকৃষ্ট; 'ন অন্যোহং তস্মাত্' এইরূপ আত্মস্থ হয়ে যিনি অবস্থান করেন, যাঁর ইন্দ্রিয়সকল বশীভূত হয়েছে, অভ্যাসের বলে তাঁর প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতি শ্রীগীতায় ভগবৎ বচন।..............
শ্রীশুভ
চৌধুরী
ডিসেম্বর
৩০, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment