সগুণব্রহ্মবিদের মুক্তিকে 'ক্রমমুক্তি' বা অবান্তরমুক্তি বলা হয়। ব্রহ্মলোকে ব্রাহ্মী ঐশ্বর্য ভোগের পর কল্পান্তে সদ্যোমুক্তি লব্ধ হয় বলে এই মুক্তিকে ক্রমমুক্তি বলা হয়। ভোগবিতৃষ্ণ কেউ যদি ব্রহ্মলোকে নির্গুণ ব্রহ্মবিদ্যা অনুশীলন প্রভাবে নির্গুণব্রহ্মাত্মজ্ঞান লাভ করতে পারেন, তাহলে কল্পান্ত হবার পূর্বেই তাঁর সদ্যোমুক্তি লাভে বাধা নেই। যাহোক, প্রারব্ধাবসানে সিদ্ধসাধক স্থূল শরীর হতে উৎক্রমণকরতঃ সূক্ষশরীর পরিবৃত লিঙ্গশরীর সহ দেবযানমার্গাবলম্বনে আতিবাহিক দেবগণকর্তৃক বাহিত হয়ে ব্রহ্মলোকে গমন করেন।
স্বীয়
সঙ্কল্পপ্রভাবে তিনি ব্রহ্মলোকে ভোগযোগ্য শরীর নির্মাণকরতঃ সশরীর, অথবা অশরীর, বা বহুশরীর
যুক্ত হয়ে নানাবিধ ভোগ্যবস্তু ভোগ করেন। সত্যসঙ্কল্পত্বাদি গুণযুক্ত হওয়ায় তিনি
হন অনন্যাধিপতি। কিন্তু জগতের সৃষ্ট্যাদি সামর্থ্য তাঁর থাকে না। এর পুনরাবৃত্তি হয়
না, কল্পান্তে হিরণ্যগর্ভকর্তৃক উপদিষ্ট হয়ে নির্গুণব্রহ্মাত্মজ্ঞানলাভান্তে পরমপদে
প্রবেশ করেন। সগুণব্রহ্মোপসনাতে একটু বিশেষ আছে, তা এই— উপাসনা সম্যক্ পরিপক্ক ও সমগ্রাঙ্গযুক্ত
হলে সিদ্ধ সাধক সাযুজ্যমুক্তি লাভ করেন, কল্পান্তে হিরণ্যগর্ভকর্তৃক উপদিষ্ট হয়ে নির্গুণব্রহ্মবিদ্যালাভান্তে
এরই সদ্যোমুক্তি লব্ধ হয়, পুনরাবৃত্তি হয় না। উপাসনা সমগ্রাঙ্গযুক্ত না হলে সিদ্ধ
সাধক সামীপ্য ও সালোক্যাদি মুক্তিলাভ করেন, এদের পুনরাবৃত্তি হয়। শঙ্করাচার্য শারীরকমীমাংসা
ভাষ্যে বলছেন—"সগুণব্রহ্মোপাসনাৎ সহৈব মনসা ঈশ্বরসাযুজ্যং ব্রজন্তি"-(ব্রহ্মসূত্র,
শঙ্করভাষ্য-৪.৪.১৭) অর্থাৎ 'সগুণ ব্রহ্মের উপাসনাপ্রভাবে মনের সহিত ঈশ্বরসাযুজ্য প্রাপ্ত
হন।' এখানে ভাষ্যকার মনের সহিত কেন বলছেন? নির্গুণব্রহ্মাত্মবিদ্ না হওয়ায় এই সগুণব্রহ্মবিদ্গণের
অবিদ্যা বিনষ্ট হয় নি; সুতরাং "ন তস্য প্রাণা উৎক্রামন্তি"(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪.৪.৬)
অর্থাৎ "তার প্রাণ উৎক্রমণ করে না", এই অবস্থা তাঁরা প্রাপ্ত হন না। ফলে
উৎক্রমণকালে লিঙ্গশরীর ও সূক্ষ্মশরীর সহ তাঁদের উৎক্রমণ ও ব্রহ্মলোকে গতি হয়।
সগুণ
ব্রহ্মবিদ্গণের মুক্তি পাঁচ প্রকার, যথা—
১. সালোক্য— ইষ্টদেবতা সহ একই লোকে বাস।
২. সামীপ্য— নিকটবর্ত্তিত্ব অর্থাৎ পার্ষদ, বা পার্শ্বচররূপে ইষ্টদেবতার নিকট অবস্থিতি।
৩. সারূপ্য— সমানবিগ্রহবত্তা, অর্থাৎ ইষ্টদেবতার ন্যায় চতুর্ভুজাদি সমানরূপতা।
৪. সার্ষ্টি— ইষ্টদেবতার ন্যায় সমান ঐশ্বর্য এবং
৫. সাযুজ্য— ভগবৎসাযুজ্য। তার স্বরূপ কি? শঙ্করাচার্য বৃহদারণ্যক শ্রুতির (১.৩.২২ ও ১.৫.২৩)
ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সাযুজ্য শব্দের অর্থ করেছেন যথাক্রমে 'সমানদেহেন্দ্রিয়াভিমানিতা'
অর্থাৎ সদৃশদেহেন্দ্রিয়াভিমানিতা, অর্থ হল ঈশ্বরীয় শরীর হতে ভিন্ন, অথচ ঈশ্বরীয়
ভূয়োধর্মযুক্ত দেহেন্দ্রিয়াভিমানিতা ও 'একাত্মতা'। ক্রমমুক্ত পুরুষের শরীর ও ইন্দ্রিয়
মায়োপাধিক পরমেশ্বরের লীলাবিগ্রহ হতে ভিন্ন
হলেও তা ঈশ্বরীয় বহুধর্মযুক্ত। শ্রীগীতায় (১৪.২) ভগবান বলছেন—"ইদং জ্ঞানমুপাশ্রিত্য
মম সাধর্ম্যমাগতাঃ" অর্থাৎ এই জ্ঞান আশ্রয় করে আমার সাধর্ম্য লাভ করেন।
আচ্ছা,
কি সেই ঈশ্বরীয় ধর্ম? বলছি—পরমেশ্বরের অনন্তগুণসকলের মধ্যে যে যে গুণযোগে উপাসনা করে
উপাসক ক্রমমুক্তি লাভ করেন, সেই গুণসকলই সেই ধর্ম; যথা— ছান্দোগ্য শ্রুতির (৮.১.৫)
দহরবিদ্যাতে "পাপশূন্য, জরাহীন, মৃত্যুহীন, শোকহীন, ক্ষুধাহীন, পিপাসাহীন, সত্যকাম
ও সত্যসঙ্কল্প" ইত্যাদি গুণাষ্টক। এ প্রকারে ক্রমমুক্তিপ্রদ সেই সেই বিদ্যাসকলে যে যে
গুণসকল শ্রুতিতে পঠিত হচ্ছে, সেই সেই ঈশ্বরীয় গুণসকল সেই সেই ক্রমমুক্ত পুরুষে আবির্ভূত
হয়।
............................................................................
শ্রীশুভ
চৌধুরী।
ডিসেম্বর
২, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment