স্বয়ং ভগবান্ শ্রীগীতায় বলেছেন—গুরুচরণে দণ্ডবৎ প্রণামদ্বারা, বেদান্ততত্ত্ব-বিবেক বিষয়ক প্রশ্নদ্বারা এবং গুরুসেবা দ্বারা সেই জ্ঞান লাভ কর। "তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া ৷ উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ৷ -(শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, জ্ঞানযোগ-৩৪) অর্থাৎ সেই বিশিষ্ট জ্ঞান যে বিধির দ্বারা পাওয়া যায় তা জান। আচার্য্যের নিকট গমন করে প্রকৃষ্টরূপে সর্বাঙ্গ নিম্নকরণের দ্বারা প্রণিপাত অর্থাৎ দীর্ঘ নমস্কারের দ্বারা ‘বন্ধন কি?’, ‘মোক্ষ কি?’, ‘বিদ্যা কি?’, ‘অবিদ্যাই বা কি?’ ইত্যাদি পরিপ্রশ্ন এবং সেবা অর্থাৎ গুরুশুশ্রূষার দ্বারা সেই ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হওয়া যায়। এইরূপ বিনয়াদির দ্বারা প্রসন্নভূত তত্ত্বদর্শী জ্ঞানী আচার্য্যেরা তোমাকে যথোক্ত-বিশেষণ অর্থাৎ তত্ত্বদর্শনরূপ জ্ঞান উপদেশ প্রদান করবেন।
যার দেবতার প্রতি পরাভক্তি, দেবতার ন্যায় গুরুর প্রতিও পরাভক্তি, তারই নিকট কথিত শাস্ত্রার্থ প্রকাশিত হয়ে থাকে। এটা শ্রুতি বলছে। "যস্য দেবে পরা ভক্তিঃ যথা দেবে তথা গুরৌ। তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ"-(শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ-৬/২৩)
ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য এই শ্রুতির ভাষ্যে বলছেন—"দেবতা ও গুরুর প্রতি যাদের ভক্তি আছে, তাদের পক্ষেই গুরূপদেশলব্ধ বিদ্যা অনুভবযোগ্য হয়ে থাকে। অখণ্ডৈকরস সৎ-চিৎ-আনন্দময় পরম জ্যোতিঃস্বরূপ দেবতায় অর্থাৎ পরমেশ্বরে যে অধিকারী পুরুষের পরাভক্তি অর্থাৎ উৎকৃষ্ট ভক্তি আছে, তা উপলক্ষণমাত্র, অচঞ্চলভাব ও শ্রদ্ধা, এ উভয় থাকাই আবশ্যক। যার দেবতার ন্যায় গুরুর প্রতিও এরূপ পরাভক্তি, তারই নিকট উপদিষ্ট শাস্ত্রার্থ প্রকাশিত অর্থাৎ অনুভবগোচর হয়ে থাকে। যেমন ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ভোজন ভিন্ন আর শান্তির উপায় নেই, তেমনি গুরুকৃপা ব্যতিরেকে ব্রহ্মবিদ্যাও দুর্লভ।"
মহাভারত প্রভৃতিতে এর বহু উদাহরণ আছে। নীতি শাস্ত্রবিৎ পণ্ডিতগণও বলে থাকেন—'গুরু শুশ্রূষয়া বিদ্যা'। আচার্য (গুরু) ও প্রাচার্যের (গুরুর গুরুর) উপস্থিতিতে শিষ্য পরম গুরুকে ভক্তি প্রদর্শন করে পরে গুরুকে ভক্তি প্রদর্শন করবে। এটা আপস্তম্ব বলেছেন। "আচার্য-প্রাচার্য-সন্নিপাতে প্রাচার্য্যারোপসংগৃহ্যোপসংজিঘৃক্ষেদাচার্য্যম্"- (আপস্তম্ব ধর্মসূত্র-৮/১৯) তাই প্রত্যেক পারম্পরিক আচার্যগণ স্বকৃত গ্রন্থের মঙ্গলাচরণে নিজ নিজ গুরু ও পরমগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে গুরু দ্বারা প্রাপ্ত বিদ্যার বিশুদ্ধি ও গ্রন্থের নির্দোষত্ব সূচনা করেছেন।
......................
শ্রীশুভ চৌধুরী
ডিসেম্বর ২২, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment