পূর্বপক্ষঃ- অগ্নিহোত্র প্রভৃতি যাগ যজ্ঞ এবং ভগবানের ধ্যান, পূজা, উপাসনা প্রভৃতি সমস্তই ভেদজ্ঞানমূলক (দ্বৈত সাপেক্ষ), নির্বিশেষ অদ্বৈতবাদ বা অভেদবাদে কর্ম ও উপাসনার স্থান কোথায়? জীব ও ব্রহ্মের ঐক্যই যদি বেদান্তের সিদ্ধান্ত হয়, তবে বেদের কর্মকাণ্ড বা সংহিতাভাগ ও উপাসনাশাস্ত্রসমূহের সহিত উপনিষদের বিরোধ অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
উত্তরপক্ষঃ- অদ্বৈতবাদের বিরুদ্ধে এরূপ আপত্তিকর প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠে থাকে। এই প্রশ্নের উত্তরে আচার্য গৌড়পাদ্ বলেন যে, কর্ম ও উপাসনার ফলে যে দ্বৈতমূলক অধ্যাত্মতত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়, তা প্রকৃত আত্মতত্ত্বজ্ঞান নয়, ওটা গৌণ বা ব্যবহারিক আত্মজ্ঞান। অবশ্য এই আত্মজ্ঞানও নিরর্থক নয়, কারণ তা মন্দ ও মধ্যম অধিকারীর প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞান লাভের উপায় স্বরূপ—"উপায়ঃ সোঽবতারায়"-(মাণ্ডুক্য কারিকা-৩/১৫) এই সোপানাবলী অতিক্রম করেই ঐ সকল অনুন্নত অধিকারীরা অদ্বৈত বিজ্ঞান মন্দিরের চত্বরে প্রবেশ করতে পারে।
বেদান্তদর্শনে
ব্রহ্মবিদ্যা নিজের উৎপত্তিতে কাম্যবর্জ্জিত নিত্যনৈমিত্তিককর্ম্মরূপ বহিরঙ্গ সাধন
এবং শমদমাদিরূপ অন্তরঙ্গ সাধনসাপেক্ষ। আচার্য শঙ্কর ব্রহ্মসূত্রের (৩/৪/২৬) এর ভাষ্যে
স্পষ্ট বলছেন—"ব্রহ্মবিদ্যা আশ্রমবিহিত কাম্যবর্জ্জিত নিত্য ও নৈমিত্তিক সকল কর্ম্মকে
অপেক্ষা করে, অত্যন্ত অনপেক্ষ অবশ্যই নয়।" তাতে প্রমাণ কি? যেহেতু যজ্ঞাদিবোধক
শ্রতিবাক্য আছে, যথা-
'তমেতং
বেদানুবচনেন ব্রাহ্মণা বিবিদিষন্তি যজ্ঞেন দানেন তপসানাশকেন '-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪/৪/২২)
অর্থাৎ
সেই উপনিষৎপ্রতিপাদ্য ব্রহ্মকে ব্রাহ্মণগণ বেদপাঠ, যজ্ঞ, দান ও যথেচ্ছ ভোজন না করারূপ
তপস্যার দ্বারা জানতে ইচ্ছা করেন।"
কর্ম্মের
কি প্রয়োজন? উত্তর হল চিত্তশুদ্ধি, যথা—"এতেষাং নিত্যাদীনাং বুদ্ধিশুদ্ধিঃ পরং
প্রয়োজনম্"-(বেদান্তসার-১৩) অর্থাৎ এই সকল নিত্যাদি কর্মের প্রধান প্রয়োজন বুদ্ধিকে
শুদ্ধ করা।
আচার্য
শঙ্কর ভগবদ্গীতার (৩/৪) ভাষ্যে বিষয়টা আরও স্পষ্ট করেছেন—"কর্ম্মনিষ্ঠা চিত্তশুদ্ধি
দ্বারা জ্ঞাননিষ্ঠা বা পুরুষার্থের সাধক হয়। কর্মনিষ্ঠা জ্ঞাননিষ্ঠার হেতু বলে পরতন্ত্রভাবে
পুরুষার্থের কারণ হয়, স্বতন্ত্রভাবে নয়। এই অর্থ দেখাবার জন্য ভগবান বলছেন- সত্ত্বশুদ্ধি
ও জ্ঞানোৎপত্তিদ্বারা জ্ঞাননিষ্ঠার হেতু যজ্ঞাদি কর্ম্মসকলের অনারম্ভ অর্থাৎ প্রারম্ভ
না করে পুরুষ ইহজন্মে বা জন্মান্তরে নৈষ্কর্ম্যভাব অর্থাৎ কর্ম্মশুন্যতা ও নিষ্ক্রিয়
আত্ম-স্বরূপে অবস্থিতি প্রাপ্ত হয় না। আবার কেবলমাত্র সন্ন্যাস অর্থাৎ জ্ঞানশূন্য কর্ম্মত্যাগ
হতে সিদ্ধি অর্থাৎ নৈষ্কর্ম্যলক্ষণা জ্ঞানযোগনিষ্ঠা সম্যক্ রূপে অধিগত হয় না।"
মহাভারতেও
অন্যত্র বলা হচ্ছে-“পুরুষের পাপের ক্ষয় হলে জ্ঞান অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধি দ্বারা জ্ঞানাভ্যাস
যোগ্যতা উৎপত্তি হয়।”-(শান্তিপর্ব-২০৪।৮).
ব্রহ্মলোকে
ঈশ্বরীয় ঐশ্বর্যভোগ এবং মুক্তি, এই উভয়প্রকার আকাঙ্ক্ষাযুক্ত ব্যক্তির হয় উপাসনাতে
প্রবৃত্তি। মায়াশক্তিযোগে নির্গুণপরব্রহ্মই সগুণপরব্রহ্মরূপে অঙ্গীকৃত হন। প্রতীকাবলম্বনা
সাকার ব্রহ্মের উপাসনা অদ্বৈতবেদান্তে অঙ্গীকৃত হয়। ব্রহ্মসূত্রের (৩/২/১৫) ভাষ্যে
শঙ্করাচার্য বলেছেন— "ব্রহ্মাপি পৃথিব্যাদ্যুপাধিসংবন্ধাত্ তদাকারতামিব প্রতিপদ্যতে;
তদালম্বনো ব্রহ্মণ আকারবিশেষোপদেশ উপাসনার্থো ন বিরুধ্যতে" অর্থাৎ 'ব্রহ্মও পৃথিবী
প্রভৃতি উপাধির সহিত সম্বন্ধবশতঃ যেন সেই আকারকেই প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। উপাধি যাহার
অবলম্বন, এতাদৃশ যে ব্রহ্মের আকারবিশেষের উপদেশ, তাহা উপাসনার জন্য এইজন্য সবিশেষতা
ও নির্বিশেষতা জ্ঞাপিকা শ্রুতি বিরোধগ্রস্ত হয় না।'
শ্রুতিতেও
উপাসনার জন্য সাকার ব্রহ্মের বর্ণনা আছে, যথা— "হিরণ্ময়ঃ পুরুষঃ হিরণ্যশ্মশ্রুঃ
হিরণ্যকেশঃ" (ছান্দোগ্য উপনিষৎ-১/৬/৬), "বহুশোভমানাম্ উমাং হৈমবতীম্"
(কেন উপনিষৎ ৩/১২) ইত্যাদি। লক্ষ্য করতে হবে— 'সাকার উপাসনা' শব্দে শঙ্করাচার্য বিভিন্ন
শাস্ত্রে প্রতিপাদিত শিব, বিষ্ণু, শক্তি প্রভৃতি যাবতীয় সাকার বিগ্রহই গ্রহণ করলেন;
সুতরাং আচার্য শঙ্করের অদ্বৈত মতবাদকে অসাম্প্রদায়িক বলতে হবে।
প্রতিমাদি
প্রতীকাবলম্বনা সাকার ব্রহ্মোপাসনাও ক্রমশঃ অপ্রতীকাবলম্বনা উপাসনাতে পরিণত হয়ে সিদ্ধ
সাধককে ক্রমমুক্তি প্রদান করে। "সর্ব্বকালে সর্ব্বাবস্থাতে শ্রীভগবানের শ্রীমূর্ত্তি
যাঁর হৃদয়ে প্রতিভাত হতে থাকেন, তিনিই সিদ্ধপুরুষ"। শমদমাদি সহকৃত শুভকর্মানুষ্ঠান,
স্বাধ্যায়, বিষয়বৈরাগ্য, ভগবান্ নামগুণকীর্তন, তন্নামজপ, তন্মূর্তিধ্যান ইত্যাদি,
প্রসিদ্ধ সাধনসকলই এই মতে সাধনরূপে অঙ্গীকৃত হয়। ভগবৎপাদ্ শঙ্করাচার্য ব্রহ্মসূত্রের
(২/২/৪২) ভাষ্যে বলছেন—
"পরমেশ্বরংভগবন্তমভিগমনোপাদানেজ্যাস্বাধ্যাযযোগৈর্বর্ষশতমিষ্ট্বা
ক্ষীণক্লেশো ভগবন্তমেব প্রতিপদ্যত ইতি৷" অর্থাৎ পরমেশ্বরকে অভিগমন, উপাদান, ইজ্যা,
স্বাধ্যায় এবং যোগের দ্বারা শতবর্ষ অর্থাৎ যাবজ্জীবন উপাসনাকরতঃ ক্ষীণক্লেশ হয়ে জীব
ভগবানকেই প্রাপ্ত হয়। এই সূত্রের ভাষ্যে ভাষ্যকার আর বলছেন—
"ভগবতোভিগমনাদিলক্ষণমারাধনমজস্রমনন্যচিত্ততযাভিপ্রেয়তে"
অর্থাৎ 'সেই ভগবানের অভিগমনাদিরূপ আরাধনা অনন্যচিত্ত হয়ে অজস্রভাবে অভিপ্রায় করা
হয়।' সর্বোপরি পরমেশ্বরের অনুগ্রহই ব্রহ্মবিদ্যালাভ ও মোক্ষের হেতুরূপে এই মতে অঙ্গীকৃত
হয়, ব্রহ্মসূত্রের (২/৩/৪২) সূত্রের ভাষ্যে "তদনুগ্রহহেতুকেনৈব চ বিজ্ঞানেন মোক্ষসিদ্ধিঃ"
অর্থাৎ 'তাঁর অনুগ্রহই যার হেতু, সেই বিজ্ঞান দ্বারা জীবের মোক্ষ সিদ্ধ হয়' ইত্যাদি
ভাষ্যকারের বচন দ্রষ্টব্য।
…..........................................................
শ্রীশুভ
চৌধুরী।
ডিসেম্বর
১১, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ।
No comments:
Post a Comment