ইতোমধ্যে বিবিধ শাস্ত্রীয়যুক্তি দ্বারা আলোচনা করিয়াছি উপাধিযুক্ত জীবই কর্ত্তা। এখন প্রশ্ন হইতেছে তাহা স্বাভাবিক হইবে অথবা উপাধিরূপ নিমিত্ত বশতঃ, বেদান্ত মীমাংসাশাস্ত্রের তক্ষাধিকরণম্ এ ইহাই বিচার করা হইতেছে। অনির্ম্মোক্ষ প্রসঙ্গবশতঃ জীবের কর্ত্তৃত্ব স্বাভাবিক নহে, পরন্তু তাহা অধ্যস্ত। আচার্য শঙ্কর ব্রহ্মসূত্রের (২।৩।৪০) ভাষ্যে বলিতেছেন-
"(পূর্বপক্ষী
মীমাংসক ও নৈয়ায়িক) সেই বিষয়ে বলেন-শাস্ত্রের স্বার্থকতা প্রভৃতি এই হেতুসকলের দ্বারাই
সিদ্ধ হয় জীবের কর্ত্তৃত্ব স্বাভাবিক, যেহেতু নিরাকরণের প্রতিহেতু নাই। কিন্তু এইপ্রকার
পূর্বপক্ষ প্রাপ্ত হইলে বলিতেছি- আত্মার স্বাভাবিক কর্ত্তৃত্ব সম্ভব নহে, যেহেতু মুক্তির
অভাব হইয়া পড়িবে। যেহেতু কর্ত্তৃত্ব আত্মার স্বভাব হইলে কর্ত্তৃত্ব হইতে নির্ম্মোক্ষ
(-নিঃশেষে কর্ত্তৃত্বত্যাগ) সম্ভব হয় না; যেমন উষ্ণতা হইতে অগ্নির নির্ম্মোক্ষ সম্ভব
নহে। আর যিনি কর্ত্তৃত্ব হইতে মুক্ত নহেন, তাঁহার দুঃখাভাব ও পরমানন্দ প্রাপ্তিরূপ
পুরুষার্থ সিদ্ধ হয় না, কারণ কর্ত্তৃত্ব দুঃখস্বরূপ।"......
আবার
শুদ্ধব্রহ্মাত্মজ্ঞানে মোক্ষ। শ্রুতি ও বিদ্বানের অনুভববলে জীবের কর্ত্তৃত্ব স্বাভাবিক
নহে। ঐ একই সূত্রের ভাষ্যে শঙ্করাচার্য বলিতেছেন- "নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্ত
আত্মবিষয়ক প্রতিপাদন (-অবগতি) হইতে মোক্ষ সিদ্ধ হয়, ইহা শ্রুতি ও ব্রহ্মবিদ্গণ কর্ত্তৃক
স্বীকৃত। কিন্তু তাদৃশ আত্মার প্রতিপাদন জীবের কর্ত্তৃত্ব স্বাভাবিক হইলে সঙ্গত হইবে
না। সেই হেতু স্বীকার করিতে হইবে যে, অন্তঃকরণরূপ উপাধিগত ধর্ম্মের অধ্যাস দ্বারাই
জীবের কর্ত্তৃত্ব সিদ্ধ হয়, তাহা আত্মার স্বাভাবিক নহে। শ্রুতিও তাহাই বলিতেছেন-
'ধ্যায়তীব
লেলায়তীব'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।৭)
অর্থাৎ
"যেন ধ্যানই করেন, যেন ক্রিয়াশীলই হন", ইত্যাদি। আর
'আত্মেন্দ্রিয়মনোযুক্তং
ভোক্তেত্যাহুর্মনীষিণঃ'-(কঠ উপনিষৎ-১।৩।৪)
অর্থাৎ
"আত্মা (-শরীর) ইন্দ্রিয় ও মনোযুক্তকে মনীষিগণ ভোক্তা বলিয়া থাকেন", এই শ্রুতি
উপাধির সহিত সম্বন্ধযুক্ত আত্মারই ভোক্তৃত্ব প্রভৃতি বিশেষের লাভকে প্রদর্শন করিতেছেন।
দেখ, বিবেকিগণের নিকট পরমাত্মা হইতে ভিন্ন জীব নামক কর্ত্তা, অথবা ভোক্তা কেহ বিদ্যমান
নাই, যেহেতু-
'নান্যোতোস্তি
দ্রষ্টা'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৭।২৩)
অর্থাৎ
ইহা হইতে ভিন্ন দ্রষ্টা কেহ নাই", ইত্যাদিপ্রকার শ্রুতি আছে।
No comments:
Post a Comment