Thursday, 20 May 2021

জীবের কর্ত্তৃত্বাদি বুদ্ধ্যাদি উপাধিকৃত সুতরাং মিথ্যাঃ-

 


ইতোমধ্যে শ্রুতি ও বিদ্বানের অনুভববলে ইহা সিদ্ধ হইল যে জীবের কর্ত্তৃত্ব স্বাভাবিক নহে। বিবেকিগণের নিকট পরমাত্মা হইতে ভিন্ন জীব নামক কর্ত্তা, অথবা ভোক্তা কেহ বিদ্যমান নাই। এখন শঙ্কা হইল যে-পরমাত্মা হইতে ভিন্ন জীব নামক কিছু না থাকিলে পরমাত্মাই সংসারী কর্ত্তা এবং ভোক্তা হইয়া পড়িবেন, ফলে তাঁহার নিত্যমুক্ততার ব্যাঘাত হইবে। আচার্য শঙ্কর ব্রহ্মসূত্রের (২।৩।৪০) ভাষ্যে তাহা সমাধান করিতেছেন-

না তাহা বলা যায় না; যেহেতু কর্ত্তৃত্ব ও ভোক্তৃত্ব অবিদ্যাকর্ত্তৃক উপস্থাপিত হইয়াছে। শাস্ত্রও তাহাই বলেন, যথা-

'যত্র হি দ্বৈতমিব ভবতি তদিতর ইতরং পশ্যতি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২।৪।১৪)

"যেহেতু যখন দ্বৈতের ন্যায় হয়, তখন একে অপরকে দর্শন করে", এইপ্রকারে অবিদ্যাবস্থাতে কর্ত্তৃত্ব ও ভোক্তৃত্ব প্রদর্শন করিয়া বিদ্যাবস্থাতে সেই কর্ত্তৃত্বভোক্তৃত্বকে নিবারণ করিতেছেন, যথা-

'যত্র ত্বস্য সর্বমাত্মৈবাভূত্তত্কেন কং পশ্যেৎ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২।৪।১৪)

"কিন্তু যখন সমস্ত ইঁহার আত্মস্বরূপই হইয়া গেল, তখন কাহার দ্বারা কাহাকে দর্শন করিবে", ইত্যাদি শ্রুতি।

এইরূপে আকাশে উড্ডীয়মান শ্যেন পক্ষীর শ্রমের ন্যায় (বৃঃ ৪।৩।১৯), স্বপ্ন ও জাগ্রদবস্থাতে উপাধির সহিত সম্বন্ধের দ্বারা কৃত আত্মার শ্রমকে শ্রবণ করাইয়া শ্রুতি সুষুপ্তিতে প্রাজ্ঞ আত্মার (-পরমাত্মার) দ্বারা আলিঙ্গিত তাহার তদভাব(-শ্রমাভাব) শ্রবণ করাইতেছেন-

'তদ্বা অস্যৈতদাপ্তকামমাত্মকামমকামং রূপং শোকান্তরম্'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।২১)

"তাহাই ইহার(-জীবের) আপ্তকাম, আত্মকাম ও শোকবর্জ্জিত স্বরূপ", এই প্রকারে আরম্ভ করিয়া-

'এষাস্য পরমা গতিরেষাস্য পরমা সংপদেষোস্য পরমো লোক এষোস্য পরম আনন্দঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।৩২)

"ইহা ইহার(-জীবের) পরমাগতি, ইহা ইহার পরমা সম্পৎ (-বিভূতি), ইহা ইহার পরম লোক (-ভোগ্য সুখ), ইহা ইহার পরম আনন্দ" এই প্রকারে উপসংহৃত হইয়াছে।

আচার্য্য বাদরায়ণ সেই এই বিষয়টী বলিতেছেন-

যথা চ তক্ষোভয়থা ৷৷-ব্রহ্মসূত্র ২.৩.৪০৷৷

'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- এই চকারটী 'তু' (-কিন্তু) অর্থে পঠিত হইয়াছে। ইহা মনে করা উচিত নহে যে, অগ্নির উষ্ণতার ন্যায় আত্মার কর্ত্তৃত্ব অবশ্যই স্বাভাবিক। কিন্তু লোকমধ্যে তক্ষা (-সূত্রধর বা কাঠের মিস্ত্রী) যেমন কুঠারাদি করণকে হস্তে গ্রহণ করতঃ (-ছেদন ক্রিয়া সম্পাদনকরতঃ) কর্ত্তা ও দুঃখী হয়, আবার নিজ গৃহপ্রাপ্ত সেই তক্ষাই কুঠারাদি করণ হইতে বিমুক্ত হইয়া স্বস্থ (-প্রকৃতিস্থ), নির্বৃত্ত (-মানস প্রযত্নশূন্য), নির্ব্যাপার (-কায়চেষ্টারহিত) ও সুখী হয়। এই প্রকারে অবিদ্যা কর্ত্তৃক প্রত্যুপস্থাপিত দ্বৈতপ্রপঞ্চের সহিত সম্বন্ধযুক্ত আত্মা স্বপ্ন ও জাগ্রদবস্থাতে কর্ত্তা দুঃখী হইয়া থাকে। সে জীবাত্মা সেই শ্রমের অপনোদনের জন্য নিজের আত্মস্বরূপ পরব্রহ্মে প্রবেশকরতঃ দেহেন্দ্রিয়সংঘাত হইতে বিমুক্ত হইয়া সম্প্রসাদ (-সুষুপ্তি) অবস্থাতে অকর্ত্তা, সুতরাং সুখী হইয়া থাকে। এইপ্রকারে মুক্তাবস্থাতেও জ্ঞানরূপ প্রদীপের দ্বারা অবিদ্যরূপ অন্ধকারকে বিদূরিত করিয়া কেবল (-উপাধি কালুষ্যরহিত) আত্মাই শান্ত ও সুখী হইয়া থাকে।...............

অতএব ব্রহ্মাভিন্ন জীবের কর্ত্তৃত্ব উপাধিকৃত, সুতরাং মিথ্যা, ইহা সিদ্ধ হইল। উপাধিবশতঃই জীব ও পরমাত্মার ভেদ।

 

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...