রামগীতায় বেদান্তের 'তত্ত্বমসি' মহাবাক্যের মর্মার্থ-"শ্রদ্ধার সঙ্গে শুদ্ধচিত্ত হয়ে শ্রীগুরুর কৃপায় শ্রুতিবাক্য 'তত্ত্বমসি'র মর্মার্থ জেনে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যে অভেদ বুঝতে পারলে, দেখবে তুমি পরম আনন্দে সুমেরুর মত অচঞ্চল হয়ে গেছ। বাক্যের অর্থ সঠিকভাবে জানতে গেলে পদের অর্থ আগে জানা দরকার। "তত্ত্বমসি"-এই শ্রুতি বাক্যের মধ্যে রয়েছে তিনটি পদ- 'তৎ', 'ত্বং' আর 'অসি'। 'তৎ' পদের অর্থ-পরমাত্মা, 'ত্বং' পদের অর্থ জীব; 'অসি' পদ দিয়ে দুইয়ের মধ্যে যে অভেদ তা বলা হয়েছে।"-(অধ্যাত্ম-রামায়ণ, উত্তরকাণ্ড, পঞ্চম সর্গ, রামগীতা-২৪,২৫)
এখন আলোচ্য বিষয় সামবেদীয় মহাবাক্য 'তত্ত্বমসি' অর্থাৎ 'তুমিই সেই সৎপদার্থ'। ছান্দোগ্য উপনিষদে ইহার উল্লেখ পাওয়া যায়-
স
য এষোহণিমৈতদাত্ম্যমিদং সর্বং তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতোকেতো ইতি ভূয় এব মা
ভগবান্ বিজ্ঞাপয়ত্বিতি তথা সোম্যেতি হোবাচ।-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৬।৮।৭)
ভগবৎপাদ্
শ্রী শঙ্করাচার্যের 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- সেই যে এই সৎসংজ্ঞক অণিমা অর্থাৎ
অতি সূক্ষ্ম ভাবকে জগতের মূল বলে উক্ত হয়েছে, সমস্ত জগৎই এতদাত্মক – এই সৎপদার্থই
যাদের আত্মা, তারাই এতদাত্ম, সেই এতদাত্মের ভাব বা ধর্ম ঐতদাত্ম্য। এ দ্বারা বলা হলো
যে – পরিদৃশ্যমান এই সমস্ত জগৎ এই সৎসংজ্ঞক পরমাত্মা দ্বারাই আত্মবান্ অর্থাৎ সত্তাবান্
বা সৎ, এ ব্যতীত এর আর অন্য কোন সংসারী আত্মা নাই। এ বিষয়ে অপর কোন শ্রুতি বলেছেন,
“এ ভিন্ন অপর কোন দ্রষ্টা নাই, এ ভিন্ন অপর কোন শ্রোতা নাই" ইত্যাদি। পরিদৃশ্যমান
এই সমস্ত জগৎ যে আত্মা দ্বারা আত্মবান্ , সৎসংজ্ঞক সেই কারণটিই সত্য অর্থাৎ বাস্তবিক
সৎ ; অতএব তাই জগতের আত্মা, তিনিই প্রত্যক্ষস্বরূপ অর্থাৎ জীবরূপী যথার্থ তত্ত্ব, যেহেতু
উপপদশূন্য আত্ম শব্দটি অর্থাৎ যা দ্বারা অন্য অর্থ বুঝতে পারে, এমন কোন উপসর্গ যে আত্মশব্দের
পূর্বে নাই, ( যেমন- পরমাত্মা, বিশ্বাত্মা ইত্যাদি ) গো প্রভৃতি শব্দের ন্যায় তা প্রত্যগাত্মা
অর্থাৎ জীবাত্মা অর্থেই প্রসিদ্ধ; অতএব হে শ্বেতকেতু! তুমিও সেই সৎপদার্থই বটে।
পিতা
এইরূপে সৎপদার্থ বিষয়ে শ্বেতকেতুর উৎপাদন করলে তদনন্তর শ্বেতকেতু বলেছিলেন – ভগবান্
, আপনি আমাকে পুনরায় এ বিষয়ে বিশেষ করে উপদেশ দান করুন, কারণ আপনি যে বলেছিলেন– প্রাণীসমূহ
সুষুপ্তিকালে প্রত্যহই সৎস্বরূপ সম্পন্ন হয়, তারা সৎসম্পন্ন হয়েও বুঝতে পারে না যে,
আমরা সৎসম্পন্ন হয়েছি। এ বিষয়ে আমার এখনো সন্দেহ রয়েছে; অতএব দৃষ্টান্ত দ্বারা আমাকে
এ বিষয়ে ভালো করে বুঝিয়ে দিন। শ্বেতকেতুর এইরূপ বললে পিতা বলেছিলেন, হে সৌম্য! আচ্ছা
তাই হোক ||৭||...............................
এই
বিষয়ে ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য ছান্দোগ্যের ৬।১৬।৩ শ্রুতির ভাষ্যে বিস্তৃত ব্যাখ্যা
করছেন-
এখন
প্রশ্ন হচ্ছে যে, ত্বম্ পদবাচ্য এই শ্বেতকেতু কে? উত্তর হল যিনি আমি উদ্দালকপুত্র শ্বেতকেতু
বলে আপনাকে জেনেছিলেন, এবং উপদেশ শ্রবন করে, মনন করে এবং বিশেষরূপে অনুভব করে অশ্রুত,
অমত ও অবিজ্ঞাত বিষয়সমূহ জানবার নিমিত্ত পিতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,– ‘ভগবান, সেরূপ
আদেশ কিরূপে হতে পারে।’ ইতি। সেই এই অধিকারী শ্রোতা, মন্তা, বিজ্ঞাতা (শ্বেতকেতু অপুর
কিছুই নয়, পরব্ধ) দর্পণে প্রতিবিম্বিত পুরুষের ন্যায়, এবং জলাদিতে প্রতিবিম্বিত সূর্য্যাদির
ন্যায়, নাম রূপ প্রকটীকরণার্থ তেজঃ, জল ও অন্নময় কার্য-কারণাত্মক দেহে প্রবিষ্ট পরা
দেবতাই (পরমাত্মাই) (অন্য কিছু নয় )।
কিন্তু
তা হলেও পিতার উপদেশ শ্রবনের পূর্বে সে আত্মাকে কার্য-কারণসঙ্ঘাতাত্মক দেহ হতে সম্পূর্ণ
পৃথক সৎস্বরূপ সর্বাত্মক বলে জানত না। অনন্তর পিতা, এখন দৃষ্টান্ত ও যুক্তি দ্বারা
‘তুমি সেই ব্রহ্ম’ (তত্ত্বমসি) উত্তমরূপে বুঝিয়ে দিলে পর, পিতার উপদেশ প্রাপ্ত হয়
– বিশেষরূপে বুঝেছিলেন যে , ‘আমি সৎ ব্রহ্মস্বরূপই' বটে। ...............
“তত্ত্বমসি"
এই মহাবাক্য অসত্য বিকারাত্মক দেহাদিতে অধিকারী জীবেরই আত্মবুদ্ধি নির্বত্তক। শঙ্করশিষ্য
সুরেশ্বরাচার্য 'নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধিঃ'তে বলছেন-"এইরূপ পুরুষ যখন 'তত্ত্বমসি' প্রভৃতি
বাক্য হতে 'আমি ব্রহ্ম' এই জ্ঞান লাভ করেন, তখন 'আমি' ও আমার ভাব দূরীকৃত হওয়ায় তিনি
বাক্য ও মনের অতীত অর্থাৎ সর্বব্যবহারাতীত হন। 'তত্ত্বমসি' বাক্যে তৎ পদ প্রকরণোক্ত
অদ্বিতীয় ব্রহ্মপর এবং ত্বং-পদ (উদ্দেশ্য) প্রত্যাগাত্মাতে বর্ত্তমান। এই দুইটী পদ
নীলোৎপলের ন্যায় (পরস্পর নিয়ম্যনিয়ামকভাবে অবস্থিত থাকিয়া বিধেয় ব্রহ্মভাববশতঃ প্রত্যাগাত্মাতে)
দুঃখিত্বের ব্যাবৃত্তি (নিষেধ) করে এবং অনাত্মত্বের ব্যবৃত্তি করে।"-(নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধিঃ,
তৃতীয় অধ্যায়-২,৩)
ভগবান
শঙ্করাচার্য 'তত্ত্বোপদেশ' নামক প্রকরণ গ্রন্থে 'তত্ত্বমসি'(তৎ, ত্বম্, অসি) এই শ্রুতিবাক্যের
তৎ ও ত্বং পদের প্রতিপাদ্য পদার্থের শোধনের নিমিত্ত বলছেন-
"যে
যুক্তি দ্বারা তত্ত্বামস্যাদি বেদবাক্য ব্রহ্মে প্রমাণ বলে নিরূপিত হয়েছে, সে যুক্তি
হল-ত্বং পদার্থ শোধিত হলে 'তত্ত্বমস্যদি' বাক্যের চিন্তা (বিচার) সম্ভব অন্যথা নয়।
যিনি মিথ্যাভূত দেহ, ইন্দ্রিয় প্রভৃতির ধর্ম্ম আত্মাতে আরোপিত করে কর্ত্তৃত্ব, ভোক্তৃত্ব
প্রভৃতির অভিমানী হন, তিনিই 'ত্বং' পদের বাচ্যার্থ। যিনি দেহ ইন্দ্রিয় প্রভৃতির সাক্ষী,
দেহ ইন্দ্রিয় প্রভৃতি হইতে বিলক্ষণ-ভাবে (পৃথকভাবে) প্রকাশ পান, স্বয়ং জ্ঞানস্বরূপ
তিনিই 'ত্বং' পদের লক্ষ্যার্থ। যিনি একমাত্র বেদান্তবাক্যের দ্বারা জ্ঞেয়, যিনি বিশ্বের
অতীত, অবিনাশী, অদ্বিতীয় ও বিশুদ্ধ, যিনি স্বয়ং প্রকাশ, তিনিই 'তৎ' পদের লক্ষ্যার্থ।"-(তত্ত্বোপদেশ
২১-২৫)
'তৎ'
পদার্থের বাচ্যার্থ যে স্বগুণ ঈশ্বর তাহা ভগবান শঙ্করাচার্য পরবর্তীতে ৪১ শ্লোকে বলছেন-"
তত্ত্বমসি এই শ্রুতিতে কিরূপ লক্ষণা হবে তা শ্রবণ কর-ত্বং পদ প্রতিপাদ্য জীবধর্ম প্রত্যক্ত
প্রভৃতিকে ত্যাগ করিয়া এবং তৎ পদ প্রতিপাদ্য সর্বজ্ঞত্ব ও পরোক্ষত্ব-প্রভৃতি ধর্ম ত্যাগ
করে শ্রুতি আদর পূর্বক কেবল শুদ্ধ, কূটস্থ অদ্বৈত বস্তুকে বুঝাচ্ছে।-(তত্ত্বোপদেশ ৪০-৪১)
অর্থাৎ
'তৎ' পদার্থের লক্ষ্যার্থ কেবল চৈতন্য। সদানন্দযোগীন্দ্র সরস্বতী 'বেদান্ত সার'এ তাই
বলছেন-"এবং ঐ সকল উপাধি ও উপহিতের আধারস্বরূপ কেবল চৈতন্য 'তৎ' পদের লক্ষ্যার্থ।"-(বেদান্তসার-১৪৫)
সদানন্দযোগীন্দ্র
সরস্বতী আরো বলছেন-" এই 'তৎ ত্বম্ অসি' বাক্যটি তিনপ্রকার সম্বন্ধের দ্বারা অখণ্ড
অর্থের জ্ঞাপক হয়। সমন্ধত্রয় হল-পদদ্বয়ের সামানাধিকরণ্য, পদার্থ দুইটীর বিশেষণ-বিশেষ্যভাব,
পদার্থ দুইটী ও প্রত্যাগাত্মার লক্ষ্য-লক্ষণভাব সম্বন্ধ।"-(বেদান্তসার-১৪৮, ১৪৯)
স্বয়ং
আচার্য শঙ্কর 'তত্ত্বোপদেশ' এ তাহা স্পষ্ট করছেন-" 'তত্ত্বমসি' মহাবাক্যে 'তৎ'
ও 'তম্'-এই দুইটীপদের সামানাধিকরণ্য-রূপ সম্বন্ধ, অতএব বেদান্ত বাক্য সমূহের জীব ও
ব্রহ্মের ঐক্য প্রতিপাদিত হচ্ছে। যে স্থলে দুটী পদ বিভিন্নরূপে একটীবস্তুর প্রতিপাদক
হয়, তাদৃশ সমান বিভক্তিযুক্ত একার্থ প্রতিপাদক পদদ্বয়কে সমানাধিরণ বলে, তাহাদের সম্বন্ধই
সামানাধিকরণ্য। ইহা বেদান্ত সম্প্রদায়িগণ কর্ত্তৃক উক্ত হয়েছে। সেইরূপ পদার্থ দ্বয়ের
মধ্যে বিশেষ্যবিশেষণতারূপ সম্বন্ধ আছে। 'অয়ং সঃ' এবং 'সোহয়ং'-এই দুইবাক্যে যেমন একবার
'অয়ং' পদার্থটী বিশেষ্য ও 'সঃ' পদার্থটী বিশেষণ এবং অন্যবার 'সঃ' পদার্থটী বিশেষ্য
ও 'অয়ং' পদর্থটী বিশেষণ হয়, তদ্রূপ 'তৎ' ও 'ত্বং' পদার্থদ্বয় মধ্যে বিশেষ্যবিশেষণতারূপ
সম্বন্ধ হয়ে থাকে। আর 'তৎ' ও 'ত্বং' পদার্থের পরোক্ষত্ব ও প্রত্যকত্ব এবং পূর্ণতা ও
স্বদ্বিতীয়ত্ব পরস্পর বিরুদ্ধধর্ম, অতএব তৎ ও ত্বং পদার্থের ঐক্য প্রদর্শন করতে হলে
'তৎ' ও 'ত্বং' পদের অর্থ লক্ষণা করতে হয়। এইরূপ পদের বাচ্যার্থ অর্থাৎ 'তৎ' ও 'ত্বং'
পদপ্রতিপাদ্য বস্তু ও প্রত্যাগাত্মার মধ্যে লক্ষ্যলক্ষণভাবরূপ সম্বন্ধ। তৎত্বংপদের
যা প্রতিপাদ্য বা বাচ্যার্থ তা লক্ষণ ও প্রত্যাগাত্মা লক্ষ্য।"- (তত্ত্বোপদেশ
২৬-৩০)
বিদ্যারণ্য
স্বামী 'পঞ্চদশী'র মহাবাক্য-বিবেক প্রকরণে এক সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত করছেন এইভাবে-"সৃষ্টির
পূর্বে এক অদ্বিতীয় নামরূপবিবর্জিত যে সৎ ছিলেন, সৃষ্টির পরেও সেই সৎ যে সেই অবস্থায়ই
রয়েছেন-তা 'তৎ' এই পদ দ্বারা লক্ষিত হয়েছে। শ্রোতার দেহেন্দ্রিয়াতিরিক্ত যে সত্তা তিনি
এস্থলে 'ত্বম্' পদদ্বারা সূচিত হয়েছেন। 'অসি' এই পদ দ্বারা একতা বুঝাচ্ছে। সেই একতা
অনুভব করতে হবে।"-(পঞ্চদশী, মহাবাক্যবিবেক-প্রকরণ-৫,৬)
অর্থাৎ
'তত্ত্বমসি' এই শ্রুতিবাক্য তৎ ও ত্বং পদের ঐক্য সম্যগরূপে বুঝাচ্ছে। এরূপ ঐক্য জ্ঞান
উৎপন্ন হলে যুক্তির দ্বারা দৃঢ় সম্যক্ জ্ঞান হয়। যাঁর 'অহং ব্রহ্ম' অর্থাৎ 'আমি ব্রহ্ম'
এইরূপ জ্ঞান উদিত হয় তিনি শোকরূপ সংসার হতে উত্তীর্ণ হন, ইহাই আচার্য শঙ্করের বেদান্ত
তত্ত্বোপদেশ।
No comments:
Post a Comment