Thursday, 13 May 2021

সর্ববেদান্ত-সিদ্ধান্ত-সার-সঙ্গ্রহঃ (১-৪৭)




সর্ববেদান্ত-সিদ্ধান্ত-সার-সঙ্গ্রহঃ

“সৰ্ব্ববেদান্তসিদ্ধান্তসারসংগ্রহ” নামক গ্রন্থখনি শ্রীশঙ্করাচাৰ্য্যকৃত গ্রন্থ সমূহের মধ্যে অন্যতম উপাদেয় গ্রন্থ। এই গ্রন্থে ভগবৎপাদ বেদান্তের প্রায় যাবতীয় সিদ্ধান্ত সংক্ষিপ্ত অথচ সরলভাবে বিবৃত করিয়াছেন। জিজ্ঞাসু সরলবিশ্বাসী মানব কেবল এই একখানি গ্রন্থের সাহায্যে বেদান্তের অনেক বিষয় অবগত হইতে সমর্থ হইবেন। ইহাতে বিষয়গুলি অতি পরিপাটীরূপে যথাক্রমে উপন্যস্ত হইয়াছে।

॥ মঙ্গলাচরণম্ ॥

অখণ্ডানন্দসম্বোধো বন্দনাদ্যস্য জায়তে ।

গোবিন্দং তমহং বন্দে চিদানন্দতনুং গুরুম্ ॥ ১॥

অনুবাদঃ- যাঁহার উপাসনা করিলে অবিনশ্বর সুখের অনুভব হয়, চৈতন্য ও আনন্দের বিগ্ৰহম্বরূপ সেই গোবিন্দ-নামক গুরুকে আমি বন্দনা করিতেছি ॥

অখণ্ডং সচ্চিদানন্দমবাঙ্মনসগোচরম্ ।

আত্মানমখিলাধারমাশ্রয়েঽভীষ্টসিদ্ধয়ে ॥ ২॥

অনুবাদঃ- যাঁহার বিনাশ নাই, যিনি পরমার্থসৎ, যিনি জ্ঞানস্বরূপ ও আনন্দ এবং যিনি চরাচর প্রপঞ্চের আশ্রয়, সেই ব্রহ্মকে আমি আশ্রয় করিতেছি, সেই ব্রহ্ম বাক্য এবং মনের অগোচর ॥ ২

যদালম্বো দরং হন্তি সতাং প্রত্যূহসম্ভবম্ ।

তদালম্বে দয়ালম্বং লম্বোদরপদাম্বুজম্ ॥ ৩॥

অনুবাদঃ- যাঁহাকে অবলম্বন করিলে, সজ্জনগণের বিঘ্ন হইতে সমূৎপন্ন ভয়ের নিবৃত্তি হয়, করুণার আধার সেই গণেশ-পাদপদ্মকে আমি অবলম্বন করিতেছি ॥৩

অর্থতোহপ্যদ্বয়ানন্দমতীতদ্বৈতলক্ষণম্ ।

আত্মারামহং বন্দে শ্রীগুরুং শিববিগ্রহম্ ॥৪

অনুবাদঃ- নামেও যিনি অদ্বয়ানন্দ অথচ অর্থতঃও যিনি দ্বৈতভাববর্জিত, আনন্দময় অবিদ্যা হইতে বিনির্মুক্ত সাক্ষাৎ শিবমূৰ্ত্তিধারী আত্মমাত্রানুরক্ত সেই শ্ৰীগুরুদেবকে আমি বন্দনা করিতেছি। ৪

॥ ২ ॥ সাধন-চতুষ্টয় ॥

বেদান্তশাস্ত্রসিদ্ধান্তসারসঙ্গ্রহ উচ্যতে ।

প্রেক্ষাবতাং মুমুক্ষূণাং সুখবোধোপপত্তয়ে ॥ ৫॥

অনুবাদঃ- সদসদ্ বিবেকশালী মোক্ষার্থী যতিগণের—অনায়াসে বোধলাভের জন্য আমি বেদান্তশাস্ত্রের সারস্বরূপ সিদ্ধান্তসমূহ বলিতেছি ॥ ৫

অস্য শাস্ত্রানুসারিৎবাদনুবন্ধচতুষ্টয়ম্ ।

যদেব মূলং শাস্ত্রস্য নির্দিষ্টং তদিহোচ্যতে ॥ ৬॥

অনুবাদঃ- বেদান্তশাস্ত্রের আরস্তুহেতু বলিয়া যে চারিটি বস্তু নির্দিষ্ট হইয়াছে, এই গ্রন্থও বেদান্তশাস্ত্রের অনুসারে বিরচিত হইয়াছে বলিয়া এই গ্রন্থেও সেই চারিটি আরস্তুহেতুই বলা যাইতেছে ॥ ৬

অধিকারী চ বিষয়ঃ সম্বন্ধশ্চ প্রয়োজনম্ ।

শাস্ত্রারম্ভফলং প্রাহুরনুবন্ধচতুষ্টয়ম্ ॥ ৭॥

অনুবাদঃ- অধিকারী অর্থাৎ শাস্ত্রোক্ত ফলকামী, শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বস্তু, অধিকারী, প্রতিপাদ্য বস্তু এবং প্রয়োজন—এই কয়টির মধ্যে পরস্পর সম্বন্ধ এবং প্রয়োজন, এই চারিটি অনুবন্ধ—যাহার জ্ঞান শাস্ত্রারম্ভের হেতু, তাহাকেই অনুবন্ধ কহা যায় ॥ ৭

চতুর্ভিঃ সাধনৈঃ সম্যক্সম্পন্নো যুক্তিদক্ষিণঃ ।

মেধাবী পুরুষো বিদ্বানধিকার্যত্র সম্মতঃ ॥ ৮॥

অনুবাদঃ- কথিত চারি প্রকার সাধনসম্পত্তি যাঁহার হইয়াছে, যিনি যুক্তির অনুকূল, যিনি ধারণাসমর্থ এবং যাহার বেদাদিশাস্ত্রে বুৎপত্তি হইয়াছে, এই প্রকার মনুষ্যই এই বেদান্তশাস্ত্রে অধিকারী বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকেন ॥ ৮

বিষয়ঃ শুদ্ধচৈতন্যং জীবব্রহ্মৈক্যলক্ষণম্ ।

যত্রৈব দৃশ্যতে সর্ববেদান্তানাং সমন্বয়ঃ ॥ ৯ ॥

অনুবাদঃ- সকল উপনিষদেরই যাহা তাৎপর্যাৰ্থ বলিয়া পরিদৃষ্ট হইয়া থাকে, সেই জীব ও ব্রহ্মের ঐক্যরূপ শুদ্ধ চৈতন্যই এই শাস্ত্রের বিষয় অর্থাৎ প্রতিপাদ্য ॥৯

এতদৈক্যপ্রমেয়স্য প্রমাণস্যাপি চ শ্রুতেঃ ।

সম্বন্ধঃ কথ্যতে সদ্ভির্বোধ্যবোধকলক্ষণঃ ॥ ১০॥

অনুবাদঃ- এই জীব ও ব্রহ্মে ঐক্যরূপ যে প্রমেয়, তাহার এবং শ্রতিস্বরূপ প্রমাণের মধ্যে বোধ্য-বোধকরূপ সম্বন্ধই—পণ্ডিতগণকর্তৃক সম্বন্ধ বলিয়া কথিত হইয়া থাকে ॥১০

ব্রহ্মাত্মৈকৎববিজ্ঞানং সন্তঃ প্রাহুঃ প্রয়োজনম্ ।

যেন নিঃশেষসংসারবন্ধাৎসদ্যঃ প্রমুচ্যতে ॥ ১১॥

অনুবাদঃ- যাহার দ্বারা (জীব) সকল প্রকার সংসার-বন্ধন হইতে সদ্যঃ মুক্তিলাভ করিয়া থাকে, সেই জীব ও ব্রহ্মের অভেদ জ্ঞানকেই সজ্জনগণ বেদান্তশাস্ত্রের প্রয়োজন বলিয়া নির্দেশ করেন ॥১১

প্রয়োজনং সম্প্রবৃত্তেঃ কারণং ফললক্ষণম্ ।

প্রয়োজনমনুদ্দিশ্য ন মন্দোঽপি প্রবর্ততে ॥ ১২॥

অনুবাদঃ- ফলস্বরূপ প্রয়োজনই (লোকের) প্রবৃত্তির প্রতি কারণ হইয়া থাকে ; কারণ সচরাচর লোকে দেখিতে পাওয়া যায় যে অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিও প্রয়োজন না দেখিতে পাইলে কোন কার্য্যে প্রবৃত্ত হয় না ॥১২

সাধনচতুষ্টয়সম্পত্তির্যস্যাস্তি ধীমতঃ পুংসঃ ।

তস্যৈবৈতৎফলসংসিদ্ধির্নান্যস্য কিঞ্চিদূনস্য ॥ ১৩॥

অনুবাদঃ- যিনি বুদ্ধিমান এবং এই সাধন-চতুষ্টয় সম্পন্ন, সেই পুরুষেরই এই ফল (অর্থাৎ জীব-ব্রহ্মের অভেদ-জ্ঞান ) লাভ হয় ; যাহার কিন্তু সাধন-চতুষ্টয়ের মধ্যে কোন একটিও অসম্পূর্ণ থাকে, তাহার এই ফললাভ হয় না ॥১৩

চত্বারি সাধনান্যত্র বদন্তি পরমর্ষয়ঃ ।

মুক্তির্যেষাং তু সদ্ভাবে নাভাবে সিধ্যতি ধ্রুবম্ ॥ ১৪॥

অনুবাদঃ- মহর্ষিগণ এই (তত্ত্বজ্ঞানরূপ ফললাভের) চারিটি সাধন নির্দেশ করিয়া থাকেন—এই চারিটি সাধনের সস্তাব হইলে মুক্তি লাভ হয়, এই চারিটি সাধনের সদ্ভাব না হইলে মুক্তি সিদ্ধ হয় না ॥ ১৪

আদ্যং নিত্যানিত্যবস্তুবিবেকঃ সাধনং মতম্ ।

ইহামুত্রার্থফলভোগবিরাগো দ্বিতীয়কম্ ॥ ১৫॥

অনুবাদঃ- নিত্য এবং অনিত্য বস্তুর মধ্যে যে পরস্পর বৈলক্ষণ আছে, তাহার জ্ঞানই প্রথম সাধন বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে। এই জগতে এবং স্বর্গাদি লোকে যত প্রকার ভোগ্য বস্তু আছে, সেই সকলেরই উপর বিরক্তিই দ্বিতীয় সাধন বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে ॥১৫

শমাদিষট্কসম্পত্তিস্তৃতীয়ং সাধনং মতম্ ।

তুরীয়ং তু মুমুক্ষুৎবং সাধনং শাস্ত্রসম্মতম্ ॥ ১৬॥

অনুবাদঃ- শম প্রভৃতি (বক্ষ্যমাণ) ছয়টির সদ্ভাবই তৃতীয় সাধন বলিয়া বিবেচিত হয়। মুক্তিলাভের জন্য ইচ্ছাই চতুর্থ উপায় বলিয়া শাস্ত্রে অভিহিত হইয়া থাকে ॥ ১৬

॥ ৩ ॥ বস্তু-বিবেকঃ ॥

ব্রহ্মৈব নিত্যমন্যত্তু হ্যনিত্যমিতি বেদনম্ ।

সোঽয়ং নিত্যানিত্যবস্তুবিবেক ইতি কথ্যতে ॥ ১৭॥

অনুবাদঃ- ব্রহ্মই একমাত্র অবিনাশী,পরমাত্ম-ব্যতিরিক্ত বলিয়া প্রসিদ্ধ আর সকল বস্তুই বিনাশী—এই প্রকার যে জ্ঞান, তাহাই শাস্ত্রে নিত্যানিত্য-বস্তুবিবেক বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়া থাকে। ১৭

মৃদাদিকারণং নিত্যং ত্রিষু কালেষু দর্শনাৎ ।

ঘটাদ্যনিত্যং তৎকার্যং যতস্তন্নাশ ঈক্ষ্যতে ॥ ১৮॥

অনুবাদঃ- ত্ৰিলোকের মধ্যে সর্বত্রই দেখিতে পাওয়া যায় যে, মৃত্তিকা প্রভৃতি কার্যের উপাদানদ্রব্যগুলি—সেই সেই কাৰ্য্য অপেক্ষা নিত্য অর্থাৎ অধিককালস্থায়ি। কিন্তু, ঘটাদি কাৰ্য্যদ্রব্যগুলি মৃত্তিকাদি কারণ অপেক্ষা অনিত্য ; যেহেতু লোকে (মৃত্তিকাপ্রভৃতির বর্তমানতাদশাতেই ) ঘটাদি কাৰ্য্যদ্রব্যের ধ্বংস দেখিতে পায় ॥ ১৮

তথৈবৈতজ্জগৎসর্বমনিত্যং ব্রহ্মকার্যতঃ ।

তৎকারণং পরং ব্রহ্ম ভবেন্নিত্যং মৃদাদিবৎ ॥ ১৯

অনুবাদঃ- ব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন হইয়াছে বলিয়া এই সমগ্র বিশ্ব অনিত্য, আর এই জগতের কারণ সেই পরব্রহ্ম (ঘটাদি কার্য অপেক্ষা তদীয় কারণ মৃদাদি যেরূপ নিত্য সেইরূপ) পরমার্থতঃ নিত্য ॥১৯

সর্গং বক্ত্যস্য তস্মাদ্বা এতস্মাদিত্যপি শ্রুতিঃ ।

সকাশাদ্ব্রহ্মণস্তস্মাদনিত্যৎবে ন সংশয়ঃ ॥ ২০

অনুবাদঃ- এই সেই ব্ৰহ্ম হইতে (আকাশ প্রভৃতি উৎপন্ন হইয়াছে ) ইত্যাদি শ্রুতিবাক্য স্পষ্টই নির্দেশ করিতেছে যে, এই প্রপঞ্চ ব্ৰহ্ম হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। সেই কারণে জগতের অনিত্যত্ব বিষয়ে সন্দেহ হইতে পারে না ॥ ২০

সর্বস্যানিত্যৎবে সাবয়বৎবেন সর্বতঃ সিদ্ধে ।

বৈকুণ্ঠাদিষু নিত্যৎবমতির্ভ্রম এব মূঢ়বুদ্ধীনাম্ ॥ ২১॥

অনুবাদঃ- সাবয়বত্ব-নিবন্ধন (অর্থাৎ অবয়ব আছে বলিয়া) সকল প্রপঞ্চেরই (এইরূপে ) অনিত্যত্ব প্রতিপন্ন হইলে, বৈকুণ্ঠাদি লোকসমূহে যে নিত্যত্ব বোধ, তাহা মূঢ়বুদ্ধি জনগণের ভ্রান্তি মাত্র ॥২১

অনিত্যৎবং চ নিত্যৎবমেবং যচ্ছ্রুতিয়ুক্তিভিঃ ।

বিবেচনং নিত্যানিত্যবিবেক ইতি কথ্যতে ॥ ২২॥

অনুবাদঃ- এইরূপে নিত্যত্ব ও অনিত্যত্ব সম্বন্ধে বেদ ও তদনুযায়ী তর্কের সাহায্যে যে বিচার, তাহাই নিত্যানিত্য বিবেক বলিয়া কথিত হইয়া থাকে ॥ ২২

॥ ৪ ॥ নৈস্পৃহ্যম্ ॥

ঐহিকামুষ্মিকার্থেষু হ্যনিত্যত্বেন নিশ্চয়াৎ ।

নৈঃস্পৃহ্যং তুচ্ছবুদ্ধ্যা যত্তদ্বৈরাগ্যমিতীর্যতে ॥ ২২॥

অনুবাদ। ঐহিক এবং পারলৌকিক সকল ভোগ্য বস্তুতেই অনিত্য রূপে নিশ্চয় হওয়া প্রযুক্ত যে নিস্পৃহতা বা তুচ্ছবুদ্ধি (উদিত হয়) তাহাই বৈরাগ্য বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে ॥

নিত্যানিত্যপদার্থবিবেকাৎপুরুষস্য জায়তে সদ্যঃ ।

স্রক্চন্দনবনিতাদৌ সর্বত্রানিত্যবস্তুনি বিরক্তিঃ ॥ ২৩॥

অনুবাদ। নিত্য ও অনিত্য বস্তুর স্বরূপ কি তদবিষয়ে যথার্থ জ্ঞানের উদয় হওয়া নিবন্ধন পুরুষের পুষ্পমাল্য, চন্দন ও বনিতা প্রভৃতি যাবতীয় অনিত্য বস্তুতেই বৈরাগ্য উদিত হইয়া থাকে ॥

কাকস্যবিষ্ঠাবদসহ্যবুদ্ধির্ভোগ্যেষু সা তীব্রবিরক্তিরিষ্যতে ।

বিরক্তিতীব্রৎবনিদানমাহুর্ভোগ্যেষু দোষেক্ষণমেব সন্তঃ ॥ ২৪॥

অনুবাদ। ভোগ্যবস্তুনিবহে কাকের বিষ্ঠার ন্যায় যে অসহনীয়তা বোধ, তাহাকেই সাধুগণ তীব্র বৈরাগ্যের মূল কারণ বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকেন।

প্রদৃশ্যতে বস্তুনি যত্র দোষো ন তত্র পুংসোঽস্তি পুনঃ প্রবৃত্তিঃ ।

অন্তর্মহারোগবতীং বিজানন্কো নাম বেশ্যামপি রূপিণীং ব্রজেৎ ॥ ২৫॥

অনুবাদ। যে বস্তুতে দোষ আছে বলিয়া বুঝিতে পারা যায়, তাহাতে লোকের আর প্রবৃত্তি হয় না। ইহার অভ্যন্তরে মহারোগ আছে ইহা জানিতে পারিলে, কোন ব্যক্তি রূপবতী বেশ্যার সহিত সমাগত হয় ?

অত্রাপি চান্যত্র চ বিদ্যমানপদার্থসম্মর্শনমেব কার্যম্ ।

যথাপ্রকারার্থগুণাভিমর্শনং সন্দর্শয়ত্যেব তদীয়দোষম্ ॥ ২৬॥

অনুবাদ। এই লোকেই হউক আর পরলোকেই হউক, যত প্রকার ভোগ্য বস্তু আছে, তাহাদের কি স্বভাব (অর্থাৎ তাহার অনিত্য এবং পরিণামে দুঃখের হেতু হয় কি না) তাহারই বিবেচনা করা উচিত। এইভাবে ভোগ্যবস্তুনিবহের স্বরূপ বিচার শেষে তদীয় দোষ (অর্থাৎ অনিত্যত্ব এবং পরিণামে দুঃখহেতুত্ব ) প্রদর্শন করিয়া দিয়া থাকে ॥

কুক্ষৌ স্বমাতুর্মলমূত্রমধ্যে স্থিতিং তদা বিট্কৃমিদংশনং চ ।

তদীয়কৌক্ষেয়কবহ্নিদাহং বিচার্য কো বা বিরতিং ন যাতি ॥ ২৭॥

অনুবাদ । নিজ জননীর উদরে বিষ্ঠা ও মূত্রের মধ্যে অবস্থান ও সেই অবস্থানকালে বিষ্ঠাজাত ক্রিমি দ্বারা দংশন এবং জননীর জঠরমধ্যস্থিত বহির তাপ দ্বারা দাহ প্রভৃতির বিচার করিয়া কোন ব্যক্তি ( এই সংসারের উপর ) বিরক্তিকে না প্রাপ্ত হয়?

স্বকীয়বিণ্মূত্রবিমজ্জনং তচ্চোত্তানগত্যা শয়নং তদা যৎ ।

বালগ্রহাদ্যাহতিভাক্চ শৈশবং বিচার্য কো বা বিরতিং ন যাতি ॥ ২৮॥

অনুবাদ। সেইকালে (অর্থাৎ জননীর জঠরমধ্যে বাসকালে) নিজেরই বিষ্ঠা এবং মূত্রের মধ্যে নিমগ্ন হইয়া যে অবস্থান, জননীর জঠরমধ্যে উর্দ্ধভাগে পাদন্যাসপূর্বক নিম্নে মুখ করিয়া যে অবস্থিতি, এবং ( জন্মের পর ) বালকগণের পীড়াপ্রদ বিবিধ গ্ৰহগণের উপদ্রবসস্কুল যে শৈশব, তাহা চিন্তা করিয়া কোন ব্যক্তি বৈরাগ্যকে প্রাপ্ত হয় না ?

স্বীয়ৈঃ পরৈস্তাডনমজ্ঞভাবমত্যন্তচাপল্যমসৎক্রিয়াং চ ।

কুমারভাবে প্রতিষিদ্ধবৃত্তিং বিচার্য কো বা বিরতিং ন যাতি ॥ ২৯॥

অনুবাদ । (তাহার পর) কৌমারাবস্থাতে আত্মীয় এবং অনাত্মীয় জনকর্তৃক তাড়না, মূর্খতা, অতিশয় চাঞ্চল্য, অনুচিত কাৰ্য্য ও নানাপ্রকার প্রতিষিদ্ধ সেবা ( প্রভৃতির বিষয় ) চিন্তা করিয়া কোন ব্যক্তি বৈরাগ্যকে প্রাপ্ত হয় না ?

মদোদ্ধতিং মান্যতিরস্কৃতিং চ কামাতুরৎবং সময়াতিলঙ্ঘনম্ ।

তাং তাং যুবত্যোদিতদুষ্টচেষ্টাং বিচার্য কো বা বিরতিং ন যাতি ॥ ৩০॥

অনুবাদ। যৌবন-মদে ঔদ্ধতা, মান্যজনকে তিরস্কার করা, কামাতুরতা, মৰ্যাদা লঙ্ঘন,এবং যুবতীর সহিত সমাগমকালে সেই সেই নূতন নূতন আবির্ভূত কুৎসিত চেষ্টা চিন্তা করিয়া কোন ব্যক্তি বৈরাগ্যকে প্রাপ্ত না হয় ?

বিরূপতাং সর্বজনাদবজ্ঞাং সর্বত্র দৈন্যং নিজবুদ্ধিহৈন্যম্ ।

বৃদ্ধৎবসম্ভাবিতদুর্দশাং তাং বিচার্য কো বা বিরতিং ন যাতি ॥ ৩১॥

অনুবাদ। বিকৃত আকার, সকল লোকের নিকটে অবজ্ঞা, সকল স্থানেই দীনতা, নিজবুদ্ধির হ্রাস এবং সৰ্ব্বজনপ্রসিদ্ধ বাৰ্দ্ধক্যবশে সস্তাবিত দুরবস্থার বিষয় চিন্তা করিয়া কোন ব্যক্তি না বৈরাগ্য প্রাপ্ত হয় ?

পিত্তজ্বরার্শঃক্ষয়গুল্মশূলশ্লেষ্মাদিরোগোদিততীব্রদুঃখম্ ।

দুর্গন্ধমস্বাস্থ্যমনূনচিন্তাং বিচার্য কো বা বিরতিং ন যাতি ॥ ৩২॥

অনুবাদ। (বৃদ্ধাবস্থায় ) পিত্তজ্বর, ক্ষয়, গুল্ম, শূল ও শ্লেষ্মপ্রভৃতি রোগ হইতে সমুৎপন্ন উৎকট দুঃখ (শরীরে) দুৰ্গন্ধ, ( সর্বদা) স্বাস্থ্যের অভাব, এবং অপার চিন্তা (এই সকল বিষয়) বিচার করিয়া কোন ব্যক্তি বৈরাগ্যকে প্রাপ্ত হয় না ?

যমাবলোকোদিতভীতিকম্পমর্মব্যথোচ্ছ্বাসগতীশ্চ বেদনাম্ ।

প্রাণপ্রয়াণে পরিদৃশ্যমানাং বিচার্য কো বা বিরতিং ন যাতি ॥ ৩৩॥

মৃত্যুসময়ে যমকে দেখিতে পাইয়া যে ভয় হয়, সেই ভয় হইতে উৎপন্ন কম্প, মৰ্ম্মপীড়া, ক্লেশজনক উৰ্দ্ধশ্বাসের গতি, এবং পরিদৃশ্যমান যন্ত্রণার বিষয় বিচার করিয়া কোন ব্যক্তিই বা বৈরাগ্যকে প্রাপ্ত হয় না ?

অঙ্গারনদ্যাং তপনে চ কুম্ভীপাকেঽপি বীচ্যামসিপত্রকাননে ।

দূতৈর্যমস্য ক্রিয়মাণবাধাং বিচার্য কো বা বিরতিং ন যাতি ॥ ৩৪॥

অঙ্গারনদী, তপন, কুন্তীপাক, বীচী এবং অসিপত্রকানন নামে প্রসিদ্ধ নরকসমূহে যমদূতগণ (দেহপাতের পর পাপিগণকে) যে ক্লেশ প্রদান করিয়া থাকে, তাহা বিচার করিয়া কোন ব্যক্তি বৈরাগ্যকে প্রাপ্ত না হয় ?

পুণ্যক্ষয়ে পুণ্যকৃতো নভঃস্থৈর্নিপাত্যমানান্শিথিলীকৃতাঙ্গান্ ।

নক্ষত্ররূপেণ দিবশ্চ্যুতাংস্তান্বিচার্য কো বা বিরতিং ন যাতি ॥ ৩৫॥

স্বৰ্গভোগের অনুকূল পুণ্যের ভোগাবসানে ক্ষয় হইলে, আকাশস্থিত পুরুষগণকর্তৃক (অধোদেশে বলপূর্বক) প্রক্ষিপ্ত, বিকলাঙ্গ এবং নক্ষত্ররূপে আকাশ হইতে চ্যুত পুণ্যকাৰ্য্যকারী জীবগণেরও অবস্থা] বিচার করিয়া কোন ব্যক্তিই বা বৈরাগ্যকে প্রাপ্ত না হয় ?

বায়্বর্কবহ্নীন্দ্রমুখান্সুরেন্দ্রানীশোগ্রভীত্যা গ্রথিতান্তরঙ্গান্ ।

বিপক্ষলোকৈঃ পরিদূয়মানান্বিচার্য কো বা বিরতিং ন যাতি ॥ ৩৬॥

অনুবাদ। পরমেশ্বর হইতে উগ্রভয়ে (সর্বদা) পরিপূরিতচিত্ত (এবং অসুর প্রভৃতি) শক্রগণের দ্বারা (প্রায়ই) পরিভূত বায়ু, সূৰ্য্য, অগ্নি ও ইন্দ্র প্রভৃতি দেবশ্রেষ্ঠগণেরও (অবস্থা) বিচার করিয়া কোন ব্যক্তিই বা বৈরাগ্যকে প্রাপ্ত হয় না ?

শ্রুত্যা নিরুক্তং সুখতারতম্যং ব্রহ্মান্তমারভ্য মহীমহেশম্ ।

ঔপাধিকং তত্তু ন বাস্তবং চেদালোচ্য কো বা বিরতিং ন যাতি ॥ ৩৭॥

পরমেশ্বর হইতে আরম্ভ করিয়া কীট পর্যন্ত সুখের তারতম্য শ্রুতিতে উক্ত হইয়াছে ; সেই সুখও (অজ্ঞানকল্পিত দেহাদি ) উপাধিরই ধৰ্ম্ম, উহা (আত্মার ) পারমার্থিক ধৰ্ম্ম নহে, ইহা বিচার করিয়া কোন ব্যক্তিই বা বৈরাগ্যকে প্রাপ্ত না হয় ?

সালোক্যসামীপ্যসরূপতাদিভেদস্তু সৎকর্মবিশেষসিদ্ধঃ ।

ন কর্মসিদ্ধস্য তু নিত্যতেতি বিচার্য কো বা বিরতিং ন যাতি ॥ ৩৮॥

অনুবাদ । ইষ্টদেবতার সহিত একলোকে অবস্থান, ইষ্টদেবতার নিকটে থাকা এবং ইষ্টদেবতার সদৃশ মূৰ্ত্তিলাভ করা প্রভৃতি যে কয়প্রকার গৌণমুক্তি আছে,তাহা সকলই সৎকৰ্ম্ম-বিশেষেরই ফল। যাহা কৰ্ম্মের ফল, তাহা কখনই নিত্য হইতে পারে না; ইহা বিচার করিয়া কোন ব্যক্তিই বা বৈরাগ্যকে প্রাপ্ত হয় না ?

যত্রাস্তি লোকে গতিতারতম্যমুচ্চাবচৎবান্বিতমত্র তৎকৃতম্ ।

যথেহ তদ্বৎখলু দুঃখমস্তীত্যালোচ্য কো বা বিরতিং ন যাতি ॥ ৩৯॥

সংসারে যে স্থানে উৎকর্ষ ও অপকর্ষযুক্ত গতি তারতম্য অর্থাৎ ফলের ন্যুনাধিক ভাব বিদ্যমান আছে, সেই স্থানই কৃত অর্থাৎ কৰ্ম্ম দ্বারা নিষ্পাদিত এবং পরিণামে দুঃখের হেতু হয়—এইনিয়ম যেমন এই পৃথিবীতে পরিদৃষ্ট হয় সেইরূপ লোকান্তরেও পরিদৃষ্ট হইয়া থাকে, এই প্রকার চিন্তা করিয়া কোন ব্যক্তিই বা বৈরাগ্যকে প্রাপ্ত না হয় ?

কো নাম লোকে পুরুষো বিবেকী বিনশ্বরে তুচ্ছসুখে গৃহাদৌ ।

কুর্যাদ্রতিং নিত্যমবেক্ষমাণো বৃথৈব মোহান্ম্রিয়মাণজন্তূন্ ॥ ৪০॥

অনুবাদ । এই সংসারে প্রতিদিন প্রাণিগণ মরিতেছে, ইহা দেখিয়াও, কোন বিবেকশালী পুরুষ যৎসামান্য সুখের হেতু অথচ বিনশ্বর গৃহ প্রভৃতি ভোগ্য বস্তুতে মোহবশতঃ আসক্ত হইয়া থাকে ?

সুখং কিমস্ত্যত্র বিচার্যমাণে গৃহেঽপি বা যোষিতি বা পদার্থে ।

মায়াতমোঽন্ধীকৃতচক্ষুষো যে ত এব মুহ্যন্তি বিবেকশূন্যাঃ ॥ ৪১॥

বিচার করিয়া দেখিলে, এই সংসারে, গৃহ কিংবা স্ত্রী প্রভৃতি ভোগ্য বস্তুতে কি সুখ লাভ হয় ? মায়াময় অন্ধকারে যাহাদের চক্ষু অন্ধ হইয়াছে, সেই সকল বিবেকশূন্য ব্যক্তিই (এই সকল বিষয়ে) মোহ প্রাপ্ত হইয়া থাকে॥

অবিচারিতরমণীয়ং সর্বমুদুম্বরফলোপমং ভোগ্যম্ ।

অজ্ঞানামুপভোগ্যং ন তু তজ্জ্ঞানাং যোষিতি বা পদার্থে ॥ ৪২॥

অনুবাদ । (জগতের) সকল প্রকার ভোগ্য বস্তুই যে পর্যন্ত বিচারিত না হয়, সে পর্যন্তই রমণীয় (বলিয়া প্রতীত হইয়া থাকে); শেষে উদুম্বর ফলের ন্যায় (আস্বাদে বিরস হইয়া থাকে); যাহারা অজ্ঞ, তাহাদের নিকটেই ঐসকল বস্তু উপভোগ্য হইয়া থাকে ; কিন্তু যাহারা জ্ঞানী, তাহদের নিকট ঐ সকল বস্তু উপভোগ্য হইতে পারে না ॥

গতেঽপি তোয়ে সুষিরং কুলীরো হাতুং হ্যশক্তো ম্রিয়তে বিমোহাৎ ।

যথা তথা গেহসুখানুষক্তো বিনাশমায়াতি নরো ভ্রমেণ ॥ ৪৩॥

অনুবাদ । (বাহিরের) জল চলিয়া যাইলেও, কর্কট মোহবশতঃ গৰ্ত্ত ছাড়িতে অসমর্থ হয় বলিয়া,পরিণামে যেমন মৃত্যু প্রাপ্ত হয়; সেইরূপ গৃহ প্রভৃতির সুখে আসক্তচিত্ত মানব মোহবশতঃ মৃত্যুই প্রাপ্ত হইয়া থাকে ॥

কোশক্রিমিস্তন্তুভিরাত্মদেহমাবেষ্ট্য চাবেষ্ট্য চ গুপ্তিমিচ্ছন্ ।

স্বয়ং বিনির্গন্তুমশক্ত এব সংস্ততস্তদন্তে ম্রিয়তে চ লগ্নঃ ॥ ৪৪॥

যথা তথা পুত্রকলত্রমিত্রস্নেহানুবন্ধৈর্গ্রথিতো গৃহস্থঃ ।

কদাপি বা তান্পরিমুচ্য গেহাদ্গন্তুং ন শক্তো ম্রিয়তে মুধৈব ॥ ৪৫॥

আত্মরক্ষার্থ উদ্যত গুটিপোকা (নিজদেহপ্রসূত) সূত্রসমূহের দ্বারা বার বার (আপনাকে) বেষ্টন করিয়া, সেই সূত্ৰনিৰ্ম্মিত আত্মকারাগারের মধ্যে সংলগ্ন হইয়া পড়ে এবং পরিশেষে তাহার মধ্য হইতে বাহিরে যাইতে অসমর্থ হইয়া যেমন স্বয়ং মৃত্যুমুখে পতিত হয়, সেইরূপই গৃহস্থ ব্যক্তিও পুত্র, পত্নী এবং মিত্র প্রভৃতির প্রতি যে স্নেহরূপ বন্ধন, তাহা দ্বারা বদ্ধ হইয়া, কোনকালেই সেই পুত্র পত্নী প্রভৃতিকে পরিত্যাগপূর্বক গৃহ হইতে বাহিরে যাইতে (অর্থাৎ বিরক্তিসহকারে সন্ন্যাস অবলম্বন করিতে) সমর্থ হয় না এবং (শেষে) বৃথাই মৃত্যুবশ প্রাপ্ত হয়।

কারাগৃহস্যাস্য চ কো বিশেষঃ প্রদৃশ্যতে সাধু বিচার্যমাণে ।

মুক্তেঃ প্রতীপৎবমিহাপি পুংসঃ কান্তাসুখাভ্যুত্থিতমোহপাশৈঃ ॥ ৪৬॥

গৃহস্পৃহা পাদনিবদ্ধশৃঙ্খলা কান্তাসুতাশা পটুকণ্ঠপাশঃ ।

শীর্ষে পতদ্ভূর্যশনির্হি সাক্ষাৎপ্রাণান্তহেতুঃ প্রবলা ধনাশা ॥ ৪৭॥

অনুবাদ। ভাল করিয়া বিচার করিয়া দেখিলে, এই গৃহের সহিত কারাগৃহের কি পার্থক্য পরিদৃষ্ট হইয়া থাকে ? (কিছুই নহে) কারণ, এই গৃহেও কান্তার সমাগম হইতে সমুৎপন্ন সুখের মোহরূপ বন্ধনরজ্জুসমূহের দ্বারা পুরুষের মুক্তির প্রতিবন্ধ হইয়াই থাকে। গৃহভোগ করিবার আশাই (এখানে) চরণদেশে সংলগ্ন শিকলের সদৃশ, কান্তা ও পুত্র বিষয়ে যে আশা, তাহাই (এখানে) সুদৃঢ় কণ্ঠপাশের সদৃশ, এবং অতিশয় ধনার্জনের আশাই (এখানে) মস্তকের উপর পতনোন্মুখ বহু বজ্রের ন্যায় প্রাণবিনাশের কারণস্বরূপ বিদ্যমান রহিয়াছে। (সুতরাং কারাগৃহ হইতে এই গৃহের পার্থক্য কিছুই নাই, ইহাই তাৎপৰ্য্য) ॥

॥ ৫ ॥ অসক্তবুদ্ধিঃ ॥ 

আশাপাশশতেন পাশিতপদো নোত্থাতুমেব ক্ষমঃ

কামক্রোধমদাদিভিঃ প্রতিভটৈঃ সংরক্ষ্যমাণোঽনিশম্ ।

সম্মোহাবরণেন গোপনবতঃ সংসারকারাগৃহা-

ন্নির্গন্তুং ত্রিবিধেষণাপরবশঃ কঃ শক্নুয়াদ্রাগিষু ॥ ৪৮॥ 

অনুবাদঃ- সংসারে আসক্ত ব্যক্তিগণের মধ্যে কোন ব্যক্তি এই সংসাররূপ কারাগৃহ হইতে নির্গত হইতে সমর্থ? অৰ্থাৎ কেহই নির্গত হইতে পারে না। কারণ, এই সংসাররূপ কারাগৃহ সংমোহরূপ আবরণ দ্বারা সুরক্ষিত, আর সেই রাগী ব্যক্তিও আশারূপ শত রজ্জু দ্বারা বদ্ধচরণ ; সুতরাং তাহার উত্থান করিবারও শক্তি নাই। তাহার উপর কাম, ক্ৰোধ, মদ প্রভৃতি শক্রসেনাগণ তাহাকে সর্বদা আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে এবং পুত্রৈষণা, বিত্তৈষণ এবং লোকৈষণা-রূপ ত্ৰিবিধ এষণা তাহাকে সকল প্রকারে অধীন করিয়া রাখিয়াছে ॥ 

কামান্ধকারেণ নিরুদ্ধদৃষ্টির্মুহ্যত্যসত্যপ্যবলাস্বরূপে ।

ন হ্যন্ধদৃষ্টেরসতঃ সতো বা সুখত্বদুঃখত্ববিচারণাস্তি ॥ ৪৯॥

অনুবাদঃ- কামরূপ অন্ধকার যাহার দৃষ্টিকে নিরুদ্ধ করিয়াছে, সেই ব্যক্তিই অসৎকল্প অবলা-বিষয়ে মোহপ্রাপ্ত হইয়া থাকে। যাহার দেখিবার শক্তি নাই, সেই ব্যক্তির সুখ এবং দুঃখের হেতুতা সদ্বস্তুতে আছে বা অসদ্বস্তুতে আছে এই প্রকার বিচার করিবার শক্তি নাই।

শ্লেষ্মোদ্গারি মুখং স্রবন্মলবতী নাসাশ্রুমল্লোচনং

স্বেদস্রাবি মলাভিপূর্ণমভিতো দুর্গন্ধদুষ্টং বপুঃ ।

অন্যদ্বক্তুমশক্যমেব মনসা মন্তুং ক্বচিন্নার্হতি

স্ত্রীরূপং কথমীদৃশং সুমনসাং পাত্রীভবেন্নেত্রয়োঃ ॥ ৫০॥ 

অনুবাদঃ- মুখ শ্লেষ্মা উদগিরণ করিয়া থাকে, নাসিকা মলযুক্ত, নয়ন অশ্রুযুক্ত ; শরীর সর্বাংশেই স্বেদস্রাবি, অভ্যন্তরে মল পরিপূর্ণ এবং দুর্গন্ধযুক্ত ; ইহা ছাড়া অন্যান্য যাহা কিছু দোষ আছে, তাহা মুখে বলাও যায় না এবং মনে করাও উচিত নহে; এইত হইল স্ত্রীলোকের স্বরূপ। এই স্ত্রীরূপ কি প্রকারে সুবুদ্ধি ব্যক্তিগণের নয়নদ্বয়ে দেখিবার যোগ্য বলিয়া প্রতীত হয় ?

দূরাদবেক্ষ্যাগ্নিশিখাং পতঙ্গো রম্যত্ববুদ্ধ্যা বিনিপত্য নশ্যতি ।

যথা তথা নষ্টদৃগেষ সূক্ষ্মং কথং নিরীক্ষেত বিমুক্তিমার্গম্ ॥ ৫১॥

অনুবাদঃ- যেমন পতঙ্গ দূর হইতে অগ্নিশিখাকে পরম সুন্দর বুদ্ধিতে বিলোকন পূর্বক তাহার উপর নিপতিত হইয়৷ মৃত্যুমুখে পতিত হয় এবং সে নিজের সেই অগ্নিশিখা হইতে বিমুক্তির পথ দেখিতে পায় না সেইরূপ মূঢ়চেতা ব্যক্তি অতি দুর্জ্ঞেয় মুক্তির পথ কি প্রকারে বিলোকন করিতে পারিবে ?

কামেন কান্তাং পরিগৃহ্য তদ্বজ্জনোঽপ্যযং নশ্যতি নষ্টদৃষ্টিঃ ।

মাংসাস্থিমজ্জামলমূত্রপাত্রং স্ত্রিয়ং স্বয়ং রম্যতয়ৈব পশ্যতি ॥ ৫২॥ 

অনুবাদঃ- এই প্রাকৃত (অর্থাৎ বিষয়াসক্ত) ব্যক্তিও সেইরূপ কামের বশেই স্ত্রীকে কান্তা (অর্থাৎ পরম রমণীয়া) বলিয়া বোধ করে এবং সেই জন্যই বিনাশ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। আরও দ্রষ্টব্য এই যে, ঈদৃশ ব্যক্তিই মাংস, অস্থি, মজ্জা, মল ও মূত্রের আধার স্বরূপ স্ত্রীলোককে মনোহারিণী বলিয়া বিলোকন করিয়া থাকে॥ 

কাম এব যমঃ সাক্ষাৎকান্তা বৈতরণী নদী ।

বিবেকিনাং মুমুক্ষূণাং নিলয়স্তু যমালয়ঃ ॥ ৫৩॥ 

অনুবাদঃ- বিবেকসম্পন্ন মোক্ষার্থ-ব্যক্তিগণের সমক্ষে কামই সাক্ষাৎ যম, স্ত্রীই বৈতরণী নদী এবং নিজ গৃহই সাক্ষাৎ যমের গৃহ বলিয়া প্রতীত হইয়া থাকে ॥ 

যমালয়ে বাপি গৃহেঽপি নো নৃণাং তাপত্রয়ক্লেশনিবৃত্তিরস্তি ।

কিঞ্চিৎসমালোক্য তু তদ্বিরামং সুখাত্মনা পশ্যতি মূঢলোকঃ ॥ ৫৪॥ 

অনুবাদঃ- মনুষ্যগণের কি যমালয়ে অথবা নিজগৃহে কোন স্থলেই তাপত্ৰয়-জনিত ক্লেশের নিবৃত্তি হইতে পারে না। কিন্তু, মূঢ়বুদ্ধি ব্যক্তি কোন একটি বস্তুকেই সংস্কারবশে সুখের কারণ বলিয়া বিবেচনা করে, এবং তাহা দ্বারাই উক্ত তাপত্রয়জনিত ক্লেশের নিবৃত্তি হইবে, এই প্রকার বিবেচনা করিয়া থাকে ॥ 

যমস্য কামস্য চ তারতম্যং বিচার্যমাণে মহদস্তি লোকে ।

হিতং করোত্যস্য যমোঽপ্রিয়ঃ সন্কামস্ত্বনর্থং কুরুতে প্রিয়ঃ সন্ ॥ ৫৫॥ 

অনুবাদঃ- বিচার করিয়া দেখিলে বুঝিতে পারা যায় যে যম এবং কাম এই উভয়ের মধ্যে অতিশয় বৈষম্য বিদ্যমান রহিয়াছে। কারণ যম অপ্রিয় হইয়াও হিতই করিয়া থাকে, কিন্তু কাম প্রিয় হইয়াও অহিতই করিয়া থাকে ॥ 

যমোঽসতামেব করোত্যনর্থং সতাং তু সৌখ্যং কুরুতে হিতঃ সন্ ।

কামঃ সতামেব গতিং নিরুন্ধন্করোত্যনর্থং হ্যসতাং তু কা কথা ॥ ৫৬॥ 

অনুবাদঃ- যম অসাধুগণেরই অনিষ্ট বিধান করিয়া থাকে, কিন্তু (যম) সাধুগণের অনুকূল হইয়া সুখেরই বিধান করিয়া থাকে। কাম কিন্তু সাধুগণেরও সদ্‌গতি রুদ্ধ করিয়া অহিতই সাধন করে। অসাধুগণের যে অহিতাচরণ করে, সে বিষয়ে আর অধিক কি কথা বলা যাইতে পারে ?

বিশ্বস্য বৃদ্ধিং স্বয়মেব কাঙ্ক্ষন্প্রবর্তকং কামিজনং সসর্জ ।

তেনৈব লোকঃ পরিমুহ্যমানঃ প্রবর্ধতে চন্দ্রমসেব চাব্ধিঃ ॥ ৫৭॥ 

অনুবাদঃ-  বিধাতা নিজেই সংসারের বৃদ্ধি কামনা করিয়া প্রবৃত্তির হেতুস্বরূপ কামিজনকে সৃষ্টি করিয়াছেন। সেই কামের দ্বারাই মোহপ্রাপ্ত হইয়া চন্দ্রের দ্বারা সমুদ্রের ন্যায় এই জীবলোক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতেছে ॥ 

কামো নাম মহাঞ্জগদ্ভ্রময়িতা স্থিত্বান্তরঙ্গে স্বয়ং

স্ত্রীপুংসাবিতরেতরাঙ্গকগুণৈর্হাসৈশ্চ ভাবৈঃ স্ফুটম্ ।

অন্যোন্যং পরিমোহ্য নৈজতমসা প্রেমানুবন্ধেন তৌ

বদ্ধ্বা ভ্রাময়তি প্রপঞ্চরচনাং সংবর্ধয়ন্ব্রহ্মহা ॥ ৫৮॥ 

অনুবাদঃ- কামই মহান, এই কামই জগতের ভ্রান্তিহেতু, এই কাম হৃদয়ে অবস্থিত হইয়া স্ত্রী এবং পুরুষকে পরস্পর অনুরাগরূপ রজ্জু দ্বারা বদ্ধ করিয়া থাকে ; কামজনিত মোহই সেই অনুরাগরূপ রজ্জুর উপাদান হইয়া থাকে ; এই কামের প্রভাবে স্ত্রী ও পুরুষ পরস্পরের অঙ্গের সৌন্দৰ্য্য প্রভৃতি গুণ দেখিতে পায়, ইহারই প্রভাবে তাহাদের পরস্পরের হাস্য এবং ভাব তাহদের মোহের কারণ হইয়৷ থাকে ; এইরূপে কামই তাহাদিগকে পরিমোহিত করিয়া এবং মোহকল্পিত প্রেম রজ্জু দ্বারা বন্ধন করিয়া প্রপঞ্চ-রচনাকে বাড়াইবার জন্য ভ্রান্তিজালের মধ্যে নিক্ষেপ করিতেছে। এই কারণে কামই ব্ৰহ্মহা (অর্থাৎ পরব্রহ্মের স্বরূপকে আবৃত করিয়া রাখিয়াছে) 

অতোঽন্তরঙ্গস্থিতকামবেগাদ্ভোগ্যে প্রবৃত্তিঃ স্বত এব সিদ্ধা ।

সর্বস্য জন্তোর্ধ্রুবমন্যথা চেদবোধিতার্থেষু কথং প্রবৃত্তিঃ ॥ ৫৯॥ 

অনুবাদঃ- এই কারণেই সকল জীবেরই হৃদয়স্থিত কামের বেগবশতঃই ভোগ্যবস্তুতে প্রবৃত্তি স্বতঃই উৎপন্ন হইয়া থাকে। তাহা যদি না হইবে তবে অজ্ঞাত বস্তুর প্রতি ভোগ করিবার এই প্রকার প্রবৃত্তি (লোকের) কি প্রকারে হইতে পারে 

তেনৈব সর্বজন্তূনাং কামনা বলবত্তরা ।

জীর্যত্যপি চ দেহেঽস্মিন্কামনা নৈব জীর্যতে ॥ ৬০॥ 

অনুবাদঃ- সেই কামের প্রভাবেই সকল প্রাণীর কামনা অতিশয় প্রবল হইয়া থাকে। এমন কি এই দেহ জীর্ণ হইলেও, কামনা কিছুতেই জীর্ণ হয় না ॥ 

অবেক্ষ্য বিষয়ে দোষং বুদ্ধিয়ুক্তো বিচক্ষণঃ ।

কামপাশেন যো মুক্তঃ স মুক্তেঃ পথি গোচরঃ ॥ ৬১॥ 

অনুবাদঃ-যে বুদ্ধিমান এবং বিবেচক ব্যক্তি এইরূপে ভোগ্য বস্তুতে দোষ দর্শন করিয়া কাম-পাশ হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছে, সেই ব্যক্তিই মুক্তির পথে আরূঢ় হইতে পারিয়াছে ॥ 

কামস্য বিজয়োপায়ং সূক্ষ্মং বক্ষ্যাম্যহং সতাম্ ।

সঙ্কল্পস্য পরিত্যাগ উপায়ঃ সুলভো মতঃ ॥ ৬২॥ 

অনুবাদঃ- আমি সজ্জনগণের পক্ষে কামবিজয়ের দুর্জ্ঞেয় উপায় কি তাহা বলিতেছি। সংকল্পের পরিত্যাগই কামবিজয়ের অনায়াসসাধ্য উপায় বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে ॥

শ্রুতে দৃষ্টেঽপি বা ভোগ্যে যস্মিন্কস্মিংশ্চ বস্তুনি ।

সমীচীনত্বধীত্যাগাৎকামো নোদেতি কর্হিচিৎ ॥ ৬৩॥

অনুবাদঃ- শ্রুতিগোচরই হউক বা দৃষ্টিগোচরই হউক, যে কোন ভোগ্য বস্তু আছে, তাহাতে ইহা সমীচীন (অর্থাৎ আমার সুখসাধন) এইপ্রকার বুদ্ধিকে পরিত্যাগ করিতে পারলে, কোন সময়েই কাম উদিত হইতে পারে না ॥ 

কামস্য বীজং সঙ্কল্পঃ সঙ্কল্পাদেব জায়তে ।

বীজে নষ্টেঽঙ্কুর ইব তস্মিন্নষ্টে বিনশ্যতি ॥ ৬৪॥ 

অনুবাদঃ- অভিলাষ কামের বীজ-স্বরূপ; অতএব, সঙ্কল্প হইতেই কাম উৎপন্ন হইয়া থাকে ; বীজ নষ্ট হইলে অঙ্কুরের ন্যায়, অভিলাষ বিনষ্ট হইলে কামও বিনষ্ট হইয়া থাকে ॥ 

ন কোঽপি সম্যক্ত্বধিয়া বিনৈব ভোগ্যং নরঃ কাময়িতুং সমর্থঃ ।

যতস্ততঃ কামজয়েচ্ছুরেতাং সম্যক্ত্ববুদ্ধিং বিষয়ে নিহন্যাৎ ॥ ৬৫॥

অনুবাদঃ- যে কারণে কোন মনুষ্যই এই সম্যক্ত্ব-বোধ অর্থাৎ চারুতা জ্ঞান ব্যতিরেকে ভোগ্য বিষয়কে কামনা করিতে সমর্থ নহে ; সেই কারণে, যে ব্যক্তি কামকে জয় করিতে ইচ্ছা করে, সে ভোগ্য বিষয়ে এই চারুতা-বুদ্ধিকে বিনষ্ট করিবে ॥

ভোগ্যে নরঃ কামজয়েচ্ছুরেতাং সুখত্ববুদ্ধিং বিষয়ে নিহন্যাৎ ।

যাবৎসুখত্বভ্রমধীঃ পদার্থে তাবন্ন জেতুং প্রভবেদ্ধি কামম্ ॥ ৬৬॥ 

অনুবাদঃ- কামকে জয় করিতে যাহার অভিলাষ আছে, সেই ব্যক্তি ভোগ্য বস্তুতে এই সুখকরত্ব-জ্ঞানকে পরিহার করিবে। কারণ, যে পৰ্য্যন্ত ভোগ্য বস্তুতে এইরূপ সুখহেতুত্ব-জ্ঞানরূপ ভ্রান্তি বিদ্যমান থাকিবে, সেই পর্যন্ত কেহই কামকে জয় করিতে সমর্থ হয় না ॥ 

সঙ্কল্পানুদয়ে হেতুর্যথাভূতার্থদর্শনম্ ।

অনর্থচিন্তনং চাভ্যাং নাবকাশোঽস্য বিদ্যতে ॥ ৬৭॥ 

অনুবাদঃ- বস্তুর যাহা প্রকৃত স্বভাব, তাহার বোধ এবং ঐ বস্তু হইতে যে প্রকার অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা, তাহারও বোধ—এই দ্বিবিধ জ্ঞানই সংকল্পের অনুদয়ের প্রতি কারণ হইয়া থাকে; এই দুইপ্রকার বোধ দ্বারা কামের অবসর বিলুপ্ত হইয়া থাকে। (অর্থাৎ এই দুইপ্রকার বোধ হৃদয়ে জাগরূক থাকিলে, কামের উদয় হইবার কোন সম্ভাবনা থাকে না) 

রত্নে যদি শিলাবুদ্ধির্জায়তে বা ভয়ং ততঃ ।

সমীচীনত্বধীর্নৈতি নোপাদেয়ত্বধীরপি ॥ ৬৮॥ 

অনুবাদঃ- কোন রত্নে যদি ইহা প্রস্তর মাত্র এইপ্রকার জ্ঞান হয়, অথবা ঐ রত্ন হইতে যদি কোন অনিষ্ট সম্ভাবনা প্রযুক্ত ভয় হয়, তাহা হইলে, তাহাতে কাহারও ইহা সমীচীন এবং ইহা উপাদেয় এইপ্রকার বুদ্ধি উৎপন্ন হয় না । 

যতার্থদর্শনং বস্তুন্যনর্থস্যাপি চিন্তনম্ ।

সঙ্কল্পস্যাপি কামস্য তদ্বধোপায় ইষ্যতে ॥ ৬৯॥

অনুবাদঃ- সেই কারণে ভোগ্য বস্তুবিষয়ে যথার্থ দৃষ্টি (অর্থাৎ ঐ ভোগ্য বস্তুর যাহা প্রকৃত স্বভাব তাহার অবধারণ) এবং ঐ ভোগ্য বস্তু হইতে যে অনৰ্থপাত হইতে পারে, তাহার চিন্তা এই দুইটিই সংকল্প এবং কামকে বিধ্বস্ত করিবার হেতু বলিয়া অভিমত হইয়া থাকে।

 

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...