Sunday, 16 May 2021

বিভিন্ন শাস্ত্রীয় যুক্তি দ্বারা উপাধিযুক্ত জীবকে কর্ত্তারূপে স্বীকৃতিঃ-



ইতোমধ্যে আলোচনা করিয়াছি উপাধিযুক্ত জীবই কর্ত্তা, এখন বিভিন্ন শ্রুতি যুক্তিবলে তাহাই পুষ্ট করা হইবে। শ্রুতিতে জীবের বিহার বা বিচরণাদির উপদেশ থাকায় জীবই কর্ত্তা। বেদান্তমীমাংসা শাস্ত্রে ভগবান বাদরায়ণ তাহাই সুত্র করিতেছেন-

বিহারোপদেশাৎ ৷৷ -(ব্রহ্মসূত্র ২.৩.৩৪)

ভগবৎপূজ্যপাদ্ শঙ্করাচার্য্যের 'শাঙ্করভাষ্য' অনুবাদঃ-আর এই হেতুবশতঃ জীবের কর্ত্তৃত্ব অঙ্গীকার করিতে হইবে, যেহেতু শ্রুতি জীবের প্রকরণে স্বপ্নাবস্থাতে বিহারের উপদেশ করিতেছেন, যথা-

'স ঈয়তেমৃতো যত্র কামম্'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৪।৩।১২)

অর্থাৎ "অমৃতস্বরূপ তাহা (-সেই আত্মা) যেখানে ইচ্ছা গমন করেন।"

'স্বে শরীরে যথাকামং পরিবর্ততে'-(ঐতরেয় উপনিষৎ-২।১।১৮)

অর্থাৎ "নিজের শরীরমধ্যে যথেচ্ছ বিচরণ করেন", ইত্যাদি শ্রুতি।

আবার শ্রুতিতে ইন্দ্রিয়াদি উপাদান গ্রহণরূপ কার্য্যের উল্লেখ থাকায় জীবই কর্ত্তা। ভগবান সূত্রকার তাহাই সিদ্ধান্ত করিতেছেন-

উপাদানাৎ ৷৷-(ব্রহ্মসূত্র ২.৩.৩৫)

'শাঙ্করভাষ্য' অনুবাদঃ-আর এই হেতুঃবশত জীবের কর্ত্তৃত্ব সিদ্ধ হয়, যেহেতু জীববোধক প্রকরণেই ইন্দ্রিয়সকলের গ্রহণ শ্রুতি বর্ণনা করিতেছেন, যথা-

'তদেষাং প্রাণানাং বিজ্ঞানেন বিজ্ঞানমাদায়'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২।১।১৭)

অর্থাৎ "তখন (-সুষুপ্তিতে) এই ইন্দ্রিয়সকলের বিষয়গ্রহণ সামর্থ্যকে বুদ্ধিস্থ চিদাভাসের দ্বারা গ্রহণ করিয়া" ইত্যাদি;

'প্রাণান্গৃহীত্বা'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২।১।১৮) অর্থাৎ "ইন্দ্রিয়সকল গ্রহণ করিয়া" ইত্যাদি শ্রুতি।

পরবর্তীতে ভগবান সূত্রকার আরও কয়েকটী সূত্রদ্বারা জীবের কর্ত্তৃত্ব সিদ্ধ করিতেছেন। পরবর্তী সূত্রের (ব্যপদেশাচ্চ ক্রিয়ায়াং ন চেন্নির্দেশবিপর্যয়ঃ৷ ব্রহ্মসূত্র ২.৩.৩৬) প্রতিপাদ্য বিষয়- যেহেতু শাস্ত্র লৌকিক ও বৈদিক ক্রিয়া সকলে ইহার কর্ত্তৃত্বের উল্লেখ করিতেছেন, যথা-

'বিজ্ঞানং যজ্ঞং তনুতে কর্মাণি তনুতেপি চ'-(তৈত্তিরীয় উপনিষৎ-২।৫।১)

অর্থাৎ "বিজ্ঞান যজ্ঞকে বিস্তার (-তদনুষ্ঠান) করে এবং (লৌকিকাদি) কর্ম্মসকলকেও বিস্তার করে" ইত্যাদি শ্রুতি। ভগবান ভাষ্যকার শঙ্করাচার্য বলিতেছেন-'বিজ্ঞান' এই শব্দ জীবেরই নির্দ্দেশ, বুদ্ধির নহে। যদি এই নির্দ্দেশ জীবের না হয়, তাহা হইলে নির্দ্দেশের বিপর্য্যয় (-ব্যাতিক্রম) হইয়া পড়িবে। কি সেই বিপর্যয়? তাহা বলিতেছেন-'বিজ্ঞান' শব্দ এইপ্রকারে কর্ত্তার দ্যোতক প্রথমা বিভক্তি দ্বারা নির্দ্দেশ না করিয়া করণতার দ্যোতক তৃতীয় বিভক্তি দ্বারা নির্দ্দেশ করা হইত। ঠিক যেমন অন্যস্থলে যথা পূর্ব্বোক্ত (বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২।১।১৭) এই শ্রুতিতে করণবিভক্তি দ্বারা বিজ্ঞান শব্দের নির্দ্দেশ পরিদৃষ্ট হইতেছে, তাই এই শ্রুতিতে বিজ্ঞান শব্দের অর্থ বুদ্ধি করা হইয়াছে।

বুদ্ধি আসলে করণ, যদি বুদ্ধিকে কর্ত্তা বলা হয় তাহা হইলে ইহা করণহিসেবে কার্য্য সহায়ক হইতে পারে না-আমাদের অন্যকিছুকে করণরূপে কল্পনা করিতে হয়। বুদ্ধির কর্ত্তৃত্বে করণশক্তির বিপর্যয়বশতঃ বুদ্ধিকরণক জীবের কর্ত্তৃত্ব ইহাই ভগবান সূত্রকার (শক্তিবিপর্যয়াৎ ৷ব্রহ্মসূত্র ২.৩.৩৮) এই সুত্রে সিদ্ধান্ত করিতেছেন।

এখন আরেকটী আপত্তি উঠে যে, জীব যদি কর্ত্তাই হয়, তাহা হইলে সে-যাহা তাহার পক্ষে কল্যাণকর তাহাই করিত, শুভ ও অশুভ উভয় কর্ম্ম করিত না। এই আপত্তিকে ভগবান সুত্রকার (উপলব্ধিবদনিয়মঃ ৷ ব্রহ্মসূত্র ২.৩.৩৭) এই সূত্রে খণ্ডন করিতেছেন-জীব যেমন স্বতন্ত্র হইলেও প্রিয় ও অপ্রিয় উভয়কেই উপলব্ধি করে, ঠিক সেইরূপই ইষ্ট ও অনিষ্ট উভয়প্রকার কার্য্যই করিয়া থাকে। এমন কোন নিয়ম নাই যে, জীব শুধু ভাল কাজই করিবে, মন্দকে পরিহার করিবে।

আবার আত্মার কর্ত্তৃত্ব স্বীকার না করিলে আত্মজ্ঞানলাভের জন্য শ্রুতি যে সমাধির উপদেশ দিয়াছেন, তাহা বৃথা হইয়া পড়িবে-

সমাধ্যভাবাচ্চ ৷৷ ব্রহ্মসূত্র ২.৩.৩৯৷৷

'শাঙ্করভাষ্য' অনুবাদঃ- আর উপনিষৎ প্রতিপাদ্য আত্মার প্রতিপত্তি (-তদ্বিষয়ক জ্ঞান) যাহার প্রয়োজন (-ফল), সেই যে এই সমাধি উপনিষৎসকলে উপদিষ্ট হইয়াছে, যথা-

'আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্রোতব্যো মন্তব্যো নিদিধ্যাসিতব্যঃ'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-২।৪।৫)

অর্থাৎ "প্রিয়ে! আত্মাই দর্শনীয়, শ্রবণীয়, মননীয় ও নিশ্চিতরূপে ধ্যেয়";

'সোন্বেষ্টব্যঃ স বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ'-(ছান্দোগ্য উপনিষৎ-৮।৭।১)

অর্থাৎ "তাঁহাকে অন্বেষণ করিতে হইবে, তাঁহাকে জানিবার ইচ্ছা (-বিচার) করিতে হইবে";

'ওমিত্যেবং ধ্যায়থ আত্মানম্'-(মুণ্ডক উপনিষৎ-২।২।৬)

অর্থাৎ "ওঙ্কার অবলম্বনে আত্মাকে ধ্যান করিবে" ইত্যাদি এই প্রকার শ্রুতি আত্মার কর্ত্তৃত্ব না থাকিলে সঙ্গত হইবে না। সুতরাং সেই হেতুবশতঃও ইহার ( জীবাত্মার, বুদ্ধিবিশিষ্ট চৈতন্যের) কর্ত্তৃত্ব সিদ্ধ হইল।...............................

 


No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...