ইতোমধ্যে বেদের চতুর্মহাবাক্যের মধ্যে ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ ও ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’ আচার্য শঙ্করের ভাষ্যসমেত আলোচনা করিয়াছি। এক্ষণে যজুর্বেদীয়া মহাবাক্য 'অহং ব্রহ্মাস্মি' অর্থাৎ 'আমিই ব্রহ্ম' হইল আলোচ্য বিষয়। ইহা
কাণ্বশাখীয়
শুক্লযজুর্বেদের অন্তর্গত শতপথ ব্রাহ্মণের শেষাংশ বৃহদারণ্যক উপনিষদে বর্ণিত আছে-
ব্রহ্ম
কোন জ্ঞানের ফলে সর্বাত্মক হইলেন? এই প্রশ্নের সর্ব্বদোষবর্জিত উত্তর এই-
ব্রহ্ম
বা ইদমগ্র আসীত্তদাত্মানমেবাবেৎ। অহং ব্রহ্মাস্মীতি। তস্মাৎ তৎ সর্বমভবৎ তদ্ যো যো
দেবানাং প্রত্যবুধ্যত স এব তদভবৎ তথর্ষীণাং তথা মনুষ্যাণাং তদ্বৈতৎ পশ্যন্নৃষির্বামদেবঃ
প্রতিপেদেহহং মনুরভবং সূর্যশ্চেতি। তদিদমপ্যেতর্হি য এবং বেদাহং ব্রহ্মাস্মীতি স ইদং
সর্বং ভবতি...........(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-১।৪।১০)
ভগবৎপূজ্যপাদ্
আচার্য শঙ্করের 'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- 'ব্রহ্ম বা ইদমগ্র আসীৎ' এই ব্রহ্ম
শব্দে অপর ব্রহ্ম অর্থাৎ কার্য্য ব্রহ্ম বুঝিতে হইবে; কেননা সর্বাত্মভাবপ্রাপ্তি যখন
ক্রিয়াসাধ্য, তখন তাঁহার সম্বন্ধেই ঐরূপ ফল প্রাপ্তির কথা উপপন্ন হয়। কিন্তু পরব্রহ্মের
যে সর্ব্বাত্মভাব , তাহা কোন ক্রিয়া দ্বারা নিষ্পন্ন নহে, তাহা তাঁহার স্বাভাবিক।....
'ইদ'
অর্থ-শরীর মধ্যস্থরূপে যাহা গৃহীত হয়, অর্থাৎ দেহমধ্যে যে জগৎস্রষ্টা ব্রহ্ম প্রবেশ
করিয়া জীবরূপে অনুভূত হইতেছেন; এখানে তিনিই ব্রহ্ম শব্দের অর্থ। শ্রুতির 'বৈ' শব্দের
অর্থ- অবধারণ, অগ্রে অর্থাৎ জ্ঞানোদয়ের পূর্ব্বে, সেই সময়েও এই সমস্ত ব্রহ্মস্বরূপই
ছিল; কিন্তু প্রতিবোধ বা সম্যক্ জ্ঞানের অভাবে অব্রহ্মভাব ও অসর্ব্বত্ব অধ্যারোপিত
হওয়ায় -'আমি কর্ত্তা, ক্রিয়া সম্পন্ন এবং স্বকৃত ক্রিয়া ফলের ভোক্তা, সুখী, দুঃখী ও
সংসারী' ইত্যাদি ভাবনিচয় আত্মাতে অধ্যারোপিত করিয়া থাকে; প্রকৃতপক্ষে কিন্তু তৎকালেও
কর্ত্তৃত্বভোক্তৃত্বাদির বিপরীত ব্রহ্মস্বরূপই এবং সর্ব্বাত্মকই ছিল। দয়ালু আচার্য্য
কোনরকমে বুঝাইয়া দিলেন যে.'তুমি সংসারী নহে''; শিষ্য সেই প্রতিবোধের ফলে স্বাভাবিক
আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করিয়াছিলেন। শ্রুতির 'এব' শব্দের অভিপ্রায় এই যে, তিনি যাহা জানিয়াছিলেন
তাহাতে কোনপ্রকার অবিদ্যাসমারোপিত বিশেষ ধর্ম্মের সম্বন্ধ ছিল না।.....
তিনি
কি প্রকারে জানিয়াছিলেন, তাহা বলিতেছেন-"আমি দৃষ্টির দ্রষ্টা আত্মা-ব্রহ্মস্বরূপ"।
এখানে ব্রহ্ম অর্থ-যাহা সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষস্বরূপ সর্ব্বান্তর অশনায়াদির অতীত
"নেতি নেতি" শ্রুতিপ্রতিপাদ্য এবং অস্থূল ও অনণু ইত্যাদি প্রকারে সর্ব্বজগৎ
বিলক্ষণ; সেই ব্রহ্মই আমি, কিন্তু আপনি যেরূপ বলিতেছেন, আমি বস্তুঃত সেইরূপ ব্রহ্মাতিরিক্ত
স্বতন্ত্র সংসারী নহি। অতএব, এবংবিধ জ্ঞানের প্রভাবে সেই ব্রহ্ম সর্ব্বাত্মক হইয়াছিলেন,
অর্থাৎ আরোপিত অব্রহ্মভাব ও অসর্ব্বভাব নিবৃত্তি করিয়া সর্ব্বাত্মভাবাপন্ন হইয়াছিলেন।
এইজগতে
দেবগণের মধ্যে যিনি যিনি প্রতিবুদ্ধ হইয়াছিলেন অর্থাৎ যথোক্ত বিধানে আত্মস্বরূপ জানিয়াছিলেন,
প্রতিবুদ্ধ সেই সেই আত্মাই ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হইয়াছিলেন; এইরূপ ঋষিগণের মধ্যে এবং মনুষ্যগণের
মধ্যেও হইয়াছিল।
(এইখানে
যে দেবমনুষ্যাদি বিভাগের উক্তি করা হইয়াছে, তাহা কেবল লৌকিক ব্যবহার অনুযায়ী মাত্র,
কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানানুসারে নহে; কেননা, "পুরঃ পুরষ আবিশৎ" এই সকল শ্রুতি
অনুসারে ব্রহ্মই যে সর্বত্র অনুস্যূত আছেন একথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। শ্রুতিতে যে
'দেবানাম' ইত্যাদি ভেদোল্লেখ করা হইয়াছে, তাহা কেবল শরীরাদি-উপাধিকৃত লোকপ্রতীতির অনুযায়ী
মাত্র; প্রকৃতপক্ষে কিন্তু বিজ্ঞানলাভের পূর্ব্বেও সেই সমস্ত দেবাদি শরীরেও ব্রহ্ম
বিদ্যমানই ছিলেন, কেবল বুদ্ধিদোষে অন্য প্রকার প্রতীতি হইত মাত্র। পরে তিনি আত্মাকে
উপলব্ধি করিয়াছিলেন এবং সেই জ্ঞানপ্রভাবেই সর্ব্বাত্মভাব লাভ করিয়াছিলেন।)
এই
ব্রহ্মবিদ্যা হইতে যে সর্ব্বভাবপ্রাপ্তিরূপ ফল লাভ হয়, এইকথার দৃঢ়তা সম্পাদনার্থ শ্রুতি
নিজেই মন্ত্রসমূহের উল্লেখ করিতেছেন- বামদেব নামক ঋষি-'আমি হইতেছি এই ব্রহ্মস্বরূপ'
এই প্রকার আত্মদর্শন লাভ করত অর্থাৎ এইরূপ ব্রহ্মদর্শনের ফলে তৎক্ষণেই আপনার সর্ব্বাত্মভাব
বুঝিয়াছিলেন অর্থাৎ তিনি উক্ত ব্রহ্মদর্শনে অবস্থিত হইয়া এইসমস্ত মন্ত্রার্থ দর্শন
করিয়াছিলেন-'আমিই মনু ও সূর্য্য হইয়াছিলাম' ইত্যাদি।
ব্রহ্মবিদ্যার
ফল যে সর্ব্বভাবপ্রাপ্তি ইহা মহাবীর্য্যশালী দেবতা, ঋষ্যাদির ক্ষেত্রে সম্ভবপর হইয়াছিল,
কিন্তু ইহা বর্ত্তমানযুগের হীনবীর্য্য অল্পশক্তিসম্পন্ন মনুষ্যের জন্য সম্ভবপর নহে,
এইরূপ আশঙ্কা মনে জাগিতে পারে, ইহা অপনোদনের জন্য বলিতেছেন-দর্শনাদি ক্রিয়ানুমিত এই
যে সর্ব্বভূতানুপ্রবিষ্ট ব্রহ্মের কথা বলা হইল, তাহা বর্ত্তমান সময়েও যেকোন লোক বাহ্যবিষয়ে
আসক্তি পরিত্যাগপূর্ব্বক 'আমি উক্ত ব্রহ্মস্বরূপ' এই বলিয়া আত্মাকে জানেন। উপাধিসম্বন্ধজনিত
ভ্রান্তিজ্ঞানের ফলে যে সমূদয় বিশেষধর্ম্ম আরোপিত হইয়াছিল, সে সমস্ত অপনীত করিয়া, আমি
নিশ্চয়ই সংসারধর্ম্মে অসংস্পৃষ্ট এবং আমি সেই বাহ্যাভ্যন্তরভাবরহিত ব্রহ্মস্বরূপ, এইরূপ
আত্মোপলব্ধি করেন, ব্রহ্মবিজ্ঞানে অবিদ্যাকৃত অসর্ব্বত্বভ্রান্তি নিবৃত্ত হইয়া যাওয়াই
তিনিও উক্ত সর্ব্বভাবাপন্ন হইতে পারেন। কারণ, মহাশক্তিসম্পন্ন বামদেব প্রভৃতিতে কিংবা
বর্ত্তমানকালীন হীনবীর্য্য মনুষ্যেতে ব্রহ্ম বা ব্রহ্মবিজ্ঞানের কিঞ্চিন্মাত্রও তারতম্য
ঘটে নাই, অর্থাৎ ব্রহ্ম ও ব্রহ্মবিদ্যা সকলের পক্ষেই চিরদিন সমান আছে।.................................
পূজ্যপাদ্
বিদ্যারণ্য স্বামী 'পঞ্চদশীতে' 'অহম্ ব্রহ্মাস্মি' মহাবাক্যের অর্থ খুব সুন্দর করে
উপস্থাপন করিতেছেন-
"পরিপূর্ণ পরমাত্মা এই মায়াময় জগতে বিদ্যালাভযোগ্য মনুষ্যাদি দেহে বুদ্ধির সাক্ষিরূপে অবস্থিত থাকিয়া প্রকাশমান রহিয়াছেন। তিনিই 'অহম্' শব্দের দ্বারা উপলক্ষিত হইতেছেন। স্বভাবতঃ পূর্ণ পরমাত্মা এইস্থলে 'ব্রহ্ম' শব্দের দ্বারা বর্ণিত হইয়াছেন। 'অস্মি' শব্দ অহম্ শব্দবাচ্য চৈতন্যের সহিত ব্রহ্মচৈতন্যের একতা বুঝাইতেছে। সেইকারণে 'আমি ব্রহ্ম' এই অর্থ সিদ্ধ হইল।" -(পঞ্চদশী, মহাবাক্যবিবেক-প্রকরণ-৩,৪)
No comments:
Post a Comment