Friday, 21 May 2021

জীবে আরোপিত সেই কর্ত্তৃত্ব ঈশ্বরাধীনঃ-



পূর্ব্বে প্রতিপাদিত জীবের ঔপাধিক, সুতরাং মিথ্যা কর্ত্তৃত্বকে অবলম্বন করিয়া প্রস্তাবিত আলোচনায় তাহার ঈশ্বরাধীনতা প্রতিপাদিত হইতেছে। ইহাই বেদান্ত মীমাংসা শাস্ত্রের পরায়ত্তাধিকরণম্ এর প্রতিপাদ্য বিষয়। অবিদ্যাবস্থাতে এই যে উপাধিরূপ নিমিত্তবশতঃ জীবের কর্ত্তৃত্ব অভিহিত হইল, তাহা কি ঈশ্বরকে অপেক্ষা না করিয়া হইয়া থাকে অথবা ঈশ্বরকে অপেক্ষা করে, এইপ্রকার বিচার প্রভৃতি উদিত হয়। একদেশী কর্ম্মমীমাংসকেরা বলেন জীবের কর্ত্তৃত্ব ঈশ্বরাধীন নহে, পরন্তু স্বাভাবিক। ইহা নিরাকরণ করিয়া ভগবান সূত্রকার বাদরায়ণ সিদ্ধান্ত করিতেছেন-শ্রুতির প্রামাণ্যবলে ঈশ্বর প্রযোজক কর্ত্তা। ঈশ্বরানুগ্রহে জীবের ব্রহ্মজ্ঞানোৎপত্তি দ্বারা মোক্ষ হয়।

পরাত্তু তচ্ছ্রুতেঃ ৷৷- (ব্রহ্মসূত্র-২।৩।৪১)

'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- শারীরকমীমাংসা ভাষ্যে ভগবৎপাদ্ আচার্য শঙ্কর বলিতেছেন- পূর্বপক্ষীয় এইরূপ শঙ্কা প্রাপ্তিতে 'তু' শব্দের দ্বারা নিরাকরণ করিয়া আচার্য বাদরায়ণ প্রতিজ্ঞা করিতেছেন-'পরাৎ' ইতি অর্থাৎ 'পরমেশ্বর হইতে', ইত্যাদি। অবিদ্যাবস্থাতে দেহেন্দ্রিয়সংঘাতে অভিন্নতাদর্শী অর্থাৎ তাহাতে আত্মাভিমানী এবং অবিদ্যারূপ অন্ধকারের দ্বারা অন্ধ জীবের কর্ত্তৃত্বভোক্তৃত্বরূপ যে সংসার, তাহা সৎ স্বরূপ যে পরমাত্মা, যিনি কর্ম্মসকলের অধ্যক্ষ, সকল ভূতর অধিষ্ঠান, সাক্ষিস্বরূপ, চৈতন্যস্বভাব ও ঈশ্বর, তাঁহা হইতে তাঁহার অনুজ্ঞাবলে সিদ্ধ হয়। আবার তাঁহার অনুগ্রহই যাহার হেতু, সেই ব্রহ্মাত্ম-বিজ্ঞান দ্বারা জীবের মোক্ষ সিদ্ধ হয়, ইহা সঙ্গত। তাহাতে হেতু কি?-যেহেতু সেই প্রকার শ্রুতি আছে। যদিও জীব রাগ-দ্বেষাদি দোষকর্ত্তৃক কর্ম্মে প্রেরিত হয় এবং ইন্দ্রিয়াদি সাধনসম্পন্ন, আর যদিও লোকমধ্যে কৃষি প্রভৃতি কর্ম্মে ঈশ্বরের কারণতা প্রসিদ্ধ নাই; তথাপি সকলপ্রকার প্রবৃত্তিতেই ঈশ্বর প্রযোজক কর্ত্তা, ইহা শ্রুতি হইতে নিশ্চিত হয়। যেমন দেখ-

'এষ হ্যেব সাধু কর্ম কারয়তি তং যমেভ্যো লোকেভ্য উন্নিনীষতে ৷ এষ হ্যেবাসাধু কর্ম কারয়তি তং যমধো নিনীষতে'-(কৌষিতকি উপনিষৎ-৩।৮)

অর্থাৎ "ইনিই তাহাকে সাধু কর্ম্ম করান, যাহাকে এই লোকসকল হইতে উর্ধ্ব লোকে উন্নীত করিতে ইচ্ছা করেন। ইনিই তাঁহাকে অসাধু কর্ম্ম করান, যাহাকে অধলোকে লইয়া যাইতে ইচ্ছা করেন", ইত্যাদি।

'য আত্মনি তিষ্ঠন্নাত্মানমন্তরো যময়তি'-(বৃহদারণ্যক উপনিষৎ-৩।৭।১০)

"যিনি আত্মাতে (-বুদ্ধিতে) অবস্থানকরতঃ অভ্যন্তরবর্ত্তী হইয়া আত্মাকে নিয়মন করেন", ইত্যাদি এইজাতীয় শ্রুতি আছে।

কিন্তু এইপ্রকারে ঈশ্বর কারয়িতা হইলে বৈষম্য ও নিষ্ঠুরতা দোষ হইয়া পড়িবে, আর জীবের অকৃতকর্ম্মের ফলভোক্তৃত্ব হইয়া পড়িবে। তদুত্তরে আচার্য বাদরায়ণের সিদ্ধান্ত-

কৃতপ্রযত্নাপেক্ষস্তু বিহিতপ্রতিষিদ্ধাবৈযর্থ্যাদিভ্যঃ ৷৷ (ব্রহ্মসূত্র-২।৩।৪২)

'শাঙ্করভাষ্য' অনুসারে ভাবার্থঃ- 'তু' শব্দটী আশঙ্কিত দোষ নিরাকরণের জন্য। জীবের যে ধর্ম্মাধর্মরূপ প্রযত্ন অনুষ্ঠিত হইয়াছে, তাহাকে অপেক্ষা করিয়াই ঈশ্বর জীবকে শুভাশুভ কর্ম্ম করান। আর সেইহেতু এই আশঙ্কিত দোষসকল হইয়া পড়ে না। জীবানুষ্ঠিত ধর্ম্মাধর্ম্মরূপ বৈষ্যম্যকে অপেক্ষা করিয়াই পর্জ্জন্যের (-বর্ষণকারী মেঘের) ন্যায় নিমিত্ততামাত্রের দ্বারাই ঈশ্বর সেই সেই ধর্ম্মাধর্ম্মের ফলসকলকে বিষমভাবে বিভাগ করিবেন। ঠিক যেমন লোকসকল মধ্যে স্ব স্ব অসাধারণ বীজসকল হইতে যাহারা উৎপন্ন হয়, সেই নানাবিধ গুচ্ছ (অতি দীর্ঘ লতা) ও গুল্ম (-হ্রস্ব লতা) প্রভৃতির এবং ধান্য ও যব প্রভৃতির সাধারণ কারণ হয় পর্জ্জন্য (মেঘ)। দেখ, পর্জ্জন্য না থাকিলে তাহাদের রস, পুষ্প, ফল ইত্যাদিরূপ বৈষম্য উৎপন্ন হয় না। আর স্ব স্ব বীজসকল না থাকিলেও বিষমতা উৎপন্ন হয় না। এইপ্রকারে জীবকৃত ধর্ম্মাধর্ম্মরূপ প্রযত্নকে অপেক্ষা করিয়াই ঈশ্বর তাহাদের শুভাশুভ বিধান করিবেন, ইহা সঙ্গত হইতেছে।

কিন্তু জীবের কর্ত্তৃত্ব যদি পরায়ত্ত (-ঈশ্বরাধীন) হয়, তাহা হইলে ঈশ্বরের কৃতপ্রযত্নাপেক্ষতা অর্থাৎ জীবের ধর্ম্মাধর্ম্মসাপেক্ষ ফলদাতৃত্ব সঙ্গত হয় না। ইহা দোষ নহে কারণ কর্ত্তৃত্ত পরায়ত্ত হইলেও জীব অবশ্যই ধর্ম্মাধর্ম্ম অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। কর্ম্মানুষ্ঠানকারী তাহাকেই ঈশ্বর করান। আর দেখ জীবের পূর্ব্ব প্রযত্নকে অপেক্ষা করিয়া পরমেশ্বর এক্ষণে করাইতেছেন আবার তদপেক্ষা পূর্ব্ববর্ত্তী প্রযত্নকে অপেক্ষা করিয়া পূর্ব্বে করাইয়াছিলেন, এইপ্রকারে সংসার অনাদি হওয়ায় জীবের কর্ত্তৃত্ব এবং তৎকৃত ধর্ম্মাধর্ম্মসাপেক্ষ ঈশ্বরের কারয়িতৃত্ব হইল অনবদ্য (-দোষরহিত)।....

অর্থাৎ সংসার যেহেতু অনাদি, নিশ্চয়ই পুনঃপুনঃ পূর্ব জন্মগুলির কর্ম্মফল তাহাতে থাকিবেই এবং ঈশ্বরই এইসকল কর্ম্মফলানুসারে জীবের নিয়ন্তা। এইভাবে বুঝিলে শাস্ত্রের কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্যের বিধিনিষেধ যেমন "স্বর্গকামী যজ্ঞানুষ্ঠান করিবেন", "ব্রাহ্মণকে হত্যা করিবে না", ইত্যাদির স্বার্থকতা উপলব্ধি করা যায়। অন্যথা (-ঈশ্বর প্রাণিকর্ম্ম নিরপেক্ষ হইলে) তাহারা অনর্থক হইয়া পড়িবে, কারণ জড়কর্ম্ম ফল দানে অসমর্থ।

 

No comments:

আচার্য শ্রীহর্ষ ও খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্

  খৃষ্টীয় দশম ও একাদশ শতকে অদ্বৈতবেদান্তের ক্ষেত্র অনুর্বর হলেও অপরাপর দর্শনের ক্ষেত্র যে বিবিধ চিন্তা - শস্যসম্ভারে সমৃদ্ধ ...