শঙ্কর ভগবৎপাদ্ প্রণীত এই প্রখ্যাত 'দেবী অপরাধক্ষমাপণ' স্তোত্রম্ এ আদ্যাশক্তি মহামায়া জগজ্জননী দুর্গার নিকট মনুষ্যের সর্ব্ব অপরাধ ক্ষমা করার প্রার্থনা করা হইয়াছে। আচার্য্যের লিখনীতে মা জগদম্বার প্রতি অহৈতুকি ভক্তি প্রদর্শিত হইয়াছে এইভাবে-
॥ অথ দেব্যপরাধক্ষমাপণস্তোত্রম্ ॥
ন মন্ত্রং নো য়ন্ত্রং তদপি চ ন জানে স্তুতিমহো
ন চাহ্বানং ধ্যানং তদপি চ ন জানে স্তুতিকথাঃ ।
ন জানে মুদ্রাস্তে তদপি চ ন জানে বিলপনং
পরং জানে মাতস্ত্বদনুসরণং ক্লেশহরণম্ ॥ ১॥
হে মা! আমি তোমার যন্ত্রমন্ত্র জানিনা, স্তোত্র জানিনা, আবাহন জানি না, ধ্যান জানি না, স্তুতি কথাও জানি না ; তোমার মুদ্রা জানি না, এমনকি কাতরতা প্রকাশ করিতেও জানি না; পরন্তু মা! আমি এইমাত্র জানি যে তোমার অনুসরণে সকল ক্লেশ হরণ হইয়া থাকে।
বিধেরজ্ঞানেন দ্রবিণবিরহেণালসতয়া
বিধেয়াশক্যত্বাত্তব চরণয়োর্যা চ্যুতিরভূত্ ।
তদেতত্ ক্ষন্তব্যং জননি সকলোদ্ধারিণি শিবে
কুপুত্রো জায়েত ক্বচিদপি কুমাতা ন ভবতি ॥ ২॥
মা! আমি শাস্ত্ৰবিধি জানি না। আমার জ্ঞান নাই, আমি নিরন্তর আলস্যের বশীভুত; তাহার পর যাহা কৰ্ত্তব্য তাহাও দুঃসাধ্য সুতরাং তোমার পূজায় উদাসীন। হে সকলজন উদ্ধারিণী! কল্যাণময়ী জননী! আমার সে সকল ক্ৰটি, সে সকল অপরাধ তুমি ক্ষমা কর। কেন না আমি তোমার কুপুত্র। জননী! কুসন্তান অনেক হইয়া থাকে সত্য কিন্তু মাতা তো কুমাতা কখন হয় না।
পৃথিব্যাং পুত্রাস্তে জননি বহবঃ সন্তি সরলাঃ
পরং তেষাং মধ্যে বিরলতরলোঽহং তব সুতঃ ।
মদীয়োঽয়ং ত্যাগঃ সমুচিতমিদং নো তব শিবে
কুপুত্রো জায়েত ক্বচিদপি কুমাতা ন ভবতি ॥ ৩॥
মা! এই পৃথিবীতে তোমার বহুপুত্ৰ আছে তাহারা সকলেই সরল। তাহাদের মধ্যে আমি তোমার এক মাত্র অস্থিরচিত্ত পুত্ৰ। মা সর্বমঙ্গলে! আমাকে তোমার এরূপ ত্যাগ করা উচিত হয় না ; কেন না, কুপুত্র অনেক হয় কুমাতা কখনও হয় না।
জগন্মাতর্মাতস্তব চরণসেবা ন রচিতা
ন বা দত্তং দেবি দ্রবিণমপি ভূয়স্তব ময়া ।
তথাপি ত্বং স্নেহং ময়ি নিরুপমং য়ত্প্রকুরুষে
কুপুত্রো জায়েত ক্বচিদপি কুমাতা ন ভবতি ॥ ৪॥
হে জগন্মাতা ! হে মাতা ! আমি কখনও তোমার চরণসেবা করি নাই, তোমার জন্য অর্থ ব্যয়ও আমি করি নাই। তথাপি যে তুমি আমাকে এরূপ অনুপম স্নেহ কর, তাহাতে মনে হয়। কুপুত্র অনেক হয়; কুমাতা কখনও হয় না।
পরিত্যক্তা দেবা বিবিধবিধসেবাকুলতয়া
ময়া পঞ্চা শীতেরধিকমপনীতে তু বয়সি ।
ইদানীং চেন্মাতস্তব য়দি কৃপা নাপি ভবিতা
নিরালম্বো লম্বোদরজননি কং য়ামি শরণম্ ॥ ৫॥
আমি বিবিধ সংসার সেবায় ব্যস্ত ছিলাম বলিয়া দেবসেবা পরিত্যাগ করিয়াছিলাম, এইরূপে আমার বয়স পঞ্চাশীতি বৎসরের অধিক হইয়াছে। এখনও যদি মা তোমার কৃপা না পাই; তবে হে লম্বোদর গণেশ জননী, আমি অবলম্বন শূন্য হইলাম, আমি আর কাহার শরণাপন্ন হইব?
শ্বপাকো জল্পাকো ভবতি মধুপাকোপমগিরা
নিরাতঙ্কো রঙ্কো বিহরতি চিরং কোটিকনকৈঃ ।
তবাপর্ণে কর্ণে বিশতি মনু বর্ণে ফলমিদং
জনঃ কো জানীতে জননি জননীয়ং জপবিধৌ ॥ ৬॥
মা! জপকালে কে তোমার ধ্যানের স্বরূপ মূৰ্ত্তি জানিতে পায় ? অপর্ণে ! তোমার মন্ত্রের বর্ণমাত্র মানবের কৰ্ণে প্ৰবেশ করা মাত্র তাহার এই ফল হয় যে, যে শ্বপাক (ব্যাধ ) নিতান্ত নিরক্ষর, সেও মধুর ভাষায় বক্তৃতার অধিকারী হয় ; আর রঙ্ক (দরিদ্র) নিশ্চিন্ত মনে চিরকাল কোটি কোটি স্বর্ণ মুদ্রা লইয়া সুখে বিহার করে।
চিতাভস্মালেপো গরলমশনং দিক্পটধরো
জটাধারী কণ্ঠে ভুজগপতিহারী পশুপতিঃ ।
কপালী ভূতেশো ভজতি জগদীশৈকপদবীং
ভবানি ত্বত্পাণিগ্রহণপরিপাটীফলমিদম্ ॥ ৭॥
যে পশুপতি অঙ্গে চিতাভস্ম মাখিতেন, গরল পান করিতেন, দিক ভিন্ন অন্য বসন যাঁহার ছিল না, যিনি জটাধারী, সৰ্পহার ভিন্ন যাঁহার মণিমুক্তার হার ছিল না, নরকপাল যাঁহার হস্তে, ভূতের ঈশ্বর যিনি, আজ তিনিও জগতের একমাত্র ঈশ্বর হইয়াছেন; হে ভবানী! সে কেবল মা তোমারই পাণিগ্রহণের ফল।
ন মোক্ষস্যাকাঙ্ক্ষা ভববিভববাঞ্ছাপি চ ন মে
ন বিজ্ঞানাপেক্ষা শশিমুখি সুখেচ্ছাপি ন পুনঃ ।
অতস্ত্বাং সংয়াচে জননি জননং য়াতু মম বৈ
মৃডানী রুদ্রাণী শিব শিব ভবানীতি জপতঃ ॥ ৮॥
মা! মোক্ষ বা ধনের আশা আমার নাই, শশিমুখী। জ্ঞান বা সুখও আমি আর চাহি না, অতএব জননী! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করিতেছি, “মৃড়ানী রুদ্রাণী শিব শিব ভবানী” এই নাম জপ৷ করিতে করিতে যেন আমার অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত হয়।
নারাধিতাসি বিধিনা বিবিধোপচারৈঃ
কিং রুক্ষচিন্তনপরৈর্ন কৃতং বচোভিঃ ।
শ্যামে ত্বমেব য়দি কিঞ্চন ময়্যনাথে
ধত্সে কৃপামুচিতমম্ব পরং তবৈব ॥ ৯॥
মা! আমি বিধিমত বিবিধ উপচারে তোমার আরাধনা করি নাই, প্ৰত্যুত রুক্ষ চিন্তা ও রুক্ষ বাক্য দ্বারা আমি কত অপরাধই না করিয়াছি। হে শ্যামা! তাই আমি আজ অনাথ, এখন তুমি যদি নিজ স্নেহগুণে আমার প্রতি কিঞ্চিন্মাত্রও কৃপা কর তবে মা,-তাহা তোমারই পক্ষে সমুচিত হইবে।
আপত্সু মগ্নঃ স্মরণং ত্বদীয়ং
করোমি দুর্গে করুণার্ণবেশি ।
নৈতচ্ছঠত্বং মম ভাবয়েথাঃ
ক্ষুধাতৃষার্তা জননীং স্মরন্তি ॥ ১০॥
হে করুণাৰ্ণবেশী! দুর্গে! মা আমি আজ বিপদ সাগরে পড়িয়া তোমাকে স্মরণ করিতেছি, ইহা আমার শঠতা বলিয়া মনে করিও না। কেন না সন্তান ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হইলেই জননীকে স্মরণ করে।
জগদম্ব বিচিত্র মত্র কিং
পরিপূর্ণা করুণাস্তি চেন্ময়ি ।
অপরাধপরম্পরাপরং
ন হি মাতা সমুপেক্ষতে সুতম্ ॥ ১১॥
হে জগদম্বা! আমার প্রতি যদি তোমার সম্পূর্ণ কৃপাই থাকে, তাহা থাকিতেও পারে ; ইহাতে আর বিচিত্র কি ? কারণ সন্তান পাপ করিয়া পাপ রাশিতে ডুবিয়া পড়িলেও মা তাহাকে একেবারে উপেক্ষা করেন না ।
মত্সমঃ পাতকী নাস্তি পাপঘ্নী ত্বত্সমা ন হি ।
এবং জ্ঞাত্বা মহাদেবি য়থায়োগ্যং তথা কুরু ॥ ১২॥
ইতি শ্ৰীমচ্ছঙ্করাচাৰ্য্যবিরচিতং শ্ৰীদেব্যপরাধ ক্ষমাপণ স্তোত্ৰং সমাপ্তম।
মা! আমার মত পাতকী আর নাই। তোমার মত পাপনাশিনীও আর নাই। ইহা বুঝিয়া মহাদেবী! তোমার যেরূপ যোগ্য হয় তুমি তাহাই কর।
ইতি শ্ৰীমৎ শঙ্করাচাৰ্য্য বিরচিত শ্ৰীদেবী অপরাধক্ষমাপণ স্তোত্ৰম্ সমাপ্ত।
No comments:
Post a Comment